আজান

” কে ওই শোনাল মোরে আযানের ধ্বনি।

মর্মে মর্মে, সেই সুর, বাজিল কি সুমধুর

আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনী।

কি মধুর আযানের ধ্বনি।

আমি তো পাগল হয়ে সে মধুর তানে,

কি যে এক আকর্ষণে, ছুটে যাই মুগ্ধ মনে

কি নিশীথে, কি দিবসে মসজিদের পানে।

হৃদয়ের তারে তারে, প্রাণের শোনিত ধারে,

কি যে এক ঢেউ উঠে ভক্তির তুফানে–

কত সুধা আছে সেই মধুর আযানে।”

নজরুল

ঘুমাইয়া কাজা করেছি ফজর

তখনো জাগিনি যখন জোহর

হেলায় ফেলায় কেটেছে আসর

মাগরিবের ঐ শুনি আজান।”
কবি নাসির হেলাল আজান নিয়ে লিখেছেন এক মনকাড়া কবিতা। তিনি লিখেছেন-

“রাতের শেষে সুবহে সাদিক আজান ভেসে আসে

ঘুম ভাঙ্গানো সুরের আমেজ চুমকুড়ি দেয় ঘাসে।

দুপুর বেলা মিনার থেকে আজান ধ্বনি ছড়ায়

সে ধ্বনিতে মনটা আমার মসজিদ পানে গড়ায়।

বিকাল বেলা আসর নামাজ আজান শুনি কানে

মধুর ডাকে পা বাড়িয়ে ছুটি মসজিদ পানে।

আজান শুনি সন্ধ্যা বেলা মুয়াজ্জিনেরর গলা

দিনের মধুর বাঁশি কেমন শিল্পকলা

এশার আজান সবারর শেষে ঘুমের পাখি ডাকে

ঘুমের আগে স্মরণ করি স্মরণ করি তাঁকে।”

Paper doc

@dyd.gov.bd
Satkhira
“YDOassasuni” 636 “YDOdebhata” debhata@dyd.gov.bd 637 “YDOkalaroa” kalaroa@dyd.gov.bd 638 “YDOkaliganjsat” kaliganjsat@dyd.gov.bd 639 “YDOsatkhirasadar” satkhirasadar@dyd.gov.bd 640 “YDOshyamnagar” shyamnagar@dyd.gov.bd 641 “YDOtala” tala@dyd.gov.bd
পাশা খেলা থেকে ক্যাসিনো
জুয়া খেলার উৎস বা শুরুটা অজানা। নির্দিষ্ট করে বলার উপায় নেই কখন আর কিভাবে এর উদ্ভব। আনুমানিক কয়েক হাজার বছর আগে প্রচলন। ইতিহাসের প্রায় সব সমাজে কোনো-না-কোনো রূপে জুয়ার প্রচলন ছিল। প্রাচীন গ্রিক-রোমান থেকে নেপোলিয়নের ফ্রান্স এবং বর্তমান বাংলাদেশ সবখানেই জুয়ার প্রচলন দেখা যায়। উপমহাদেশে ‘পাশা’ খেলা হচ্ছে জুয়ার একটি আদিরূপ। আধুনিককালে অনিয়ন্ত্রিত জুয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য ক্যাসিনোর উৎপত্তি। এখন দেশে দেশে জুয়ার আসরে চলে ক্যাসিনোর রমরমা ব্যবসা। ওড়ানো হয় হাজার হাজার কোটি টাকা। তাই বিশ্বজুড়ে গড়ে উঠেছে হাজারো ক্যাসিনো; যেখানে জুয়ার নেশায় মেতে থাকে জুয়াড়িরা। পাশা খেলায় হেরে এমনকি, বউ খোয়ানোর ঘটনা মহাভারতে উল্লেখ আছে। হিন্দুধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী, পঞ্চপাণ্ডবের একজন, যুধিষ্ঠির কুটিল শকুনীর সাথে পাশা খেলায় হেরে স্ত্রী দ্রৌপদীসহ রাজ্যপাট হারিয়েছিলেন। জুয়ায় হেরে বউ খোয়ানোর ঘটনা কম ঘটেনি। খবরের কাগজে এমন সংবাদ বহু প্রকাশিত হয়েছে। তবে আজ পর্যন্ত কোনো নারী জুয়ায় বাজি ধরে স্বামী খুইয়েছে কি না তা জানা নেই। এমন ঘটনা ঘটলে জুয়ার বেলায় এক ধরনের সমতা বিধান হতো।
প্রাচীন আরবেও জুয়ার প্রচলন ছিল। আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি ফররুখ আহমদের কাব্যনাটক ‘নৌফেল ও হাতেম’-এ এ বিষয়ে উল্লেখ পাওয়ায় যায়। ওই কাব্য নাটকের প্রথম অঙ্কে রাজা নৌফেলের পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত, রাজ্যে প্রাচীন মেলায় আসা গুপ্তচর ও কয়েকজন দর্শকের জবানিতে সর্বনাশা জুয়ার উল্লেখ আছে। তাতে বলা হয়েছে- ‘জাহান্নামে যাক জুয়া খেলা। সর্বস্বান্ত গরীবেরা/ মারা পড়ে প্রতিদিন আজাজিল জুয়াড়ির চালে/ আসে তবু মৃত্যু আকর্ষণে?’
মনোবিজ্ঞানীদের অভিমত, জুয়া খেলতে খেলতে অনেকেই নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এতে তাদের জীবন সমস্যাপূর্ণ হয়ে ওঠে। গুরুত্বপূর্ণ সব কাজ ছেড়ে জুয়ায় ডুবে থাকে। টাকা-পয়সা খোয়ানো কিংবা বিপত্তি সত্ত্বেও জুয়া ছাড়তে পারে না অনেকে। ড্রাগের আসক্তির মতো এটি। মানসিক অব্যবস্থার বিভিন্ন ভাগ বা পর্যায়, যেমন ডিএসএম-৫ (ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিক্যাল ম্যানুয়াল অব মেন্টাল ডিসঅর্ডার) এবং আইসিডি-১০ (ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজ) অনুযায়ী, জুয়া খেলার তাড়নাকে একপ্রকার আসক্তি বলে বিবেচনা করা হয়। ২-৩ শতাংশ মানুষ শুরুতে আনন্দের জন্য জুয়া খেলে। ক্রমে তা অনারোগ্য মানসিক রোগে পরিণত হয়।
২০১৪ সালে এক গবেষণা থেকে জানা যায়, জুয়ার নেশা যখন জুয়াড়ির ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং দৈনন্দিন জীবনে নিরানন্দের কারণ হয়ে ওঠে তখন তা গুরুতর সমস্যায় পরিণত হয়। জুয়া ঘিরে ৮৭ দশমিক ৫ শতাংশ হারে সৃষ্ট সমস্যা একজন জুয়াড়ির জীবনে ২৫ বছর বয়সের আগেই শুরু হয়। বিশেষ ধরনের বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়ের জীবনে জুয়া খেলা ঘিরে নানা সমস্যার জন্ম হয়।
বিশ্বব্যাপী সর্বনিম্ন জুয়া খেলার বয়স ১৬-২১ বছরের মধ্যে। খরিদ্দারেরা ক্যাসিনো গেমস দিয়ে জুয়া খেলে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা বা দক্ষতারও প্রয়োজন হয়। বেশির ভাগ গেমস গাণিতিকভাবে এমনভাবে বিন্যাস করা থাকে, যাতে জুয়াড়িদের চেয়ে বাড়িগুলো বেশি সুবিধা পায়। এ সুবিধাকে ‘হাউজ এজ’ বলা হয়। পোকারের মতো খেলাগুলো যেখানে একজন খেলোয়াড় অপর খেলোয়াড়ের সাথে খেলে; সেখানে বাড়িগুলো ‘রেক’ নামে কমিশন নেয়। স্লট মেশিন বা ভিডিও লটারি মেশিন ক্যাসিনোর অন্যতম জনপ্রিয় জুয়া। আধুনিক স্লট মেশিন বাহ্যিকভাবে খুবই আকর্ষণীয়।
জুয়া খেলার আধুনিক রূপ হচ্ছে ক্যাসিনো। এটি বিভিন্ন ধরনের জুয়া খেলার একটি নির্দিষ্ট স্থান; যাকে বাংলায় জুয়ার আড্ডা বা আসর বলা যেতে পারে। সেটি হয় বৃহৎ পরিসরে। সাধারণত ক্যাসিনো এমনভাবে বানানো হয়, এর সাথে কিংবা পাশাপাশি হোটেল, রেস্টুরেন্ট, শপিংমল, আনন্দভ্রমণের জাহাজ এবং অন্যান্য পর্যটন আকর্ষণ থাকে। কিছু ক্যাসিনোতে বিনোদনের ব্যবস্থা আছে, যেমন- স্ট্যান্ডআপ কমেডি, কনসার্ট, খেলাধুলা ইত্যাদি। এর পরিবেশ এমনভাবে সাজানো থাকে, যে কেউ একবার গেলে শুধু টাকা ওড়াতে মন চাইবে। দুনিয়ার সুপরিচিত সব ক্যাসিনোতে মদের ফোয়ারা নামে, চলে নগ্ননৃত্যও। ধনী থেকে ফকির হওয়ার ‘সহজ উপায়’ নিয়মিত ক্যাসিনোতে যাওয়া। বর্তমান যুগে আমেরিকার লাসভেগাস বা মরক্কোর ক্যাসাব্লাঙ্কা নগরীর সাথে ক্যাসিনো কথাটি লেপটে আছে।
ক্যাসিনো ইতালি ভাষার শব্দ। মূল শব্দ ক্যাসা, মানে অর্থঘর। সর্বপ্রথম ক্যাসিনোর প্রচলন ইতালির ভেনিসে ১৬৩৮ সালে। ১৭৭৪ সালে এটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। জার্মান ও স্প্যানিশ ভাষায় ক্যাসিনো বা কাসিনো দিয়ে ‘অফিসার মেস’ বোঝানো হয়। শব্দটি দিয়ে ছোট ভিলা, গ্রীষ্মকালীন ঘর কিংবা সামাজিক ক্লাবও বোঝানো হয়ে থাকে।
উনিশ শতকের দিকে ‘ক্যাসিনো’ বলতে এমন সব ভবনকে বোঝানো হতো; যেখানে আনন্দদায়ক সব কাজকর্ম হতো; যেমন নগরের সামাজিক অনুষ্ঠান যেখানে নাচ, গান, জুয়া ইত্যাদির ব্যবস্থা থাকত। আধুনিক সময়ে ইতালিতে একাধিক অর্থে ক্যাসিনো ব্যবহার করা হয়। যেমন পতিতালয় (ক্যাসা চুইসাও বলে, যার অর্থ বন্ধবাড়ি) ও শব্দপূর্ণ পরিবেশ। তারা জুয়ার আসর বোঝাতে ভিন্ন উচ্চারণে ক্যাসিনো বলে। সব ক্যাসিনোই জুয়া খেলার কাজে ব্যবহার করা হতো না। ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা কাতালিনা দ্বীপের কাতালিনা ক্যাসিনোতে কখনো জুয়া খেলা হয়নি। কারণ, যখন এটি নির্মাণ করা হয়, সে সময় ক্যালিফোর্নিয়ায় জুয়া খেলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। ডেনমার্কের কোপেনহেগেন ক্যাসিনো থিয়েটার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৮৪৮ সালের আন্দোলনের সময় এখনকার গণজমায়েতের কারণে এটি পরিচিত। এই আন্দোলন ডেনমার্ককে একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে পরিণত করেছে। ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত এটি ডেনিশ থিয়েটার নামে সুপরিচিত ছিল। ফিনল্যান্ডের হাংকো ক্যাসিনোতেও কখনো জুয়া খেলা হয় না। ১৯ শতকের শেষের দিকে এটি স্পা রিসোর্ট হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে এটি রেস্তোরাঁ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
আমেরিকায় স্যালুন নামে প্রথম জুয়াবাড়ি নির্মিত হয়। চার প্রধান শহর নিউ অরলিয়েন্স, সেন্ট লুইস, শিকাগো এবং সানফ্রান্সিসকোয় এগুলো গড়ে তোলা হয়। এসব স্যালুনে আগত ব্যক্তিরা পান করত, আড্ডা দিত এবং প্রায়ই জুয়া খেলত। ১৯৩১ সালে সে দেশের নেভাদায় জুয়া খেলার বৈধতা দেয়া হয়। সেখানে প্রথম আইনসিদ্ধ আমেরিকান ক্যাসিনো নির্মিত হয়। ১৯৭৬ সালে নিউজার্সি আটলান্টিক শহরে জুয়া খেলা অনুমোদন করা হয়। এটি বর্তমানে আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহৎ ‘জুয়াবাড়ি শহর’। আর আধুনিক ক্যাসিনোর কথা উঠলে শুরুতেই আসবে লাসভেগাসের কথা। দুনিয়াজোড়া এর পরিচিতি।
ইদানীং এশিয়ার অনেক দেশে জুয়া খেলা ছড়িয়ে পড়েছে। নেপাল, ভারত, চীন, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া জুয়ার দিক দিয়ে এগিয়ে। সব বয়সী মানুষের দেখা মিলে এসব ক্যাসিনোতে। কোটি কোটি টাকা ওড়াতে আর মনোরঞ্জনে ক্যাসিনোতে আসে লোকজন। এশিয়ায় সবচেয়ে বড় জুয়ার আসর কাঠমান্ডুতে এবং নেপালি ক্যাসিনোর বিশ্বজোড়া পরিচিতি। এসব আসরে বেশি জুয়ায় মেতে ওঠে পর্যটকেরা। অনেকে এক রাতেই ‘রাজ্যের রাজা’ বনে যায়, অনেকে হয় ফকির। ২৪ ঘণ্টাই চলে জুয়ার আসর। জুয়াড়িরা মদের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। বিশ্বে যত ক্যাসিনো রয়েছে, দ্য ভ্যালেন্তিয়ান এর অন্যতম। চীনের এই ক্যাসিনো জুয়াড়িদের একটি প্রধান আকর্ষণ। প্রতি রাতে চলে সব রোমাঞ্চকর আয়োজন। এটি পাঁচতারকা মানের হোটেল। সমগ্র পৃথিবী থেকে ধনকুবেররা ভিড় জমায় এ ক্যাসিনোতে। এক ডলার থেকে এক হাজার ডলার পর্যন্ত বাজি ধরা যায় এখানে। কেউ পাঁচ লাখ ডলার পর্যন্ত প্লে-আউট করে থাকে।
একটি মুসলিমপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও জুয়া বাংলাদেশে অতিপরিচিত শব্দ। যেখানে সেখানে, অলিগলিতে তাকালে এর দেখা মেলে। কয়েক দশক আগেও এটি এত খোলামেলা ছিল না। তবে এ দেশে জুয়ার আসর বসলেও ক্যাসিনোর কথা শোনা যায়নি। বাংলাদেশের মানুষ গণমাধ্যমের সুবাদে ক্যাসিনো শব্দের সাথে বছর তিনেক আগে পরিচিত হয়েছে। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮১০ কোটি টাকা চুরির ঘটনা আমাদের মনে আছে। খোয়া যাওয়া ওই টাকা ফিলিপাইনের ক্যাসিনোতে ওঠার ব্যাপারে দেশী-বিদেশী গণমাধ্যমে খবর বেরোয়। ‘রাখাল বালক’ খ্যাত সে সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর দেশের টাকা রক্ষায় যথাযথ ‘রাখালী’ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

ঢাকা হচ্ছে ‘মসজিদের নগরী’। সেই নগরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এবার এ যাবৎ মিলেছে ৬০টির মতো ক্যাসিনোর সন্ধান। কিন্তু ঢাকার খানদানি ঐতিহ্যের সাথে ক্যাসিনো বড়ই বেমানান। তবু মানতেই হচ্ছে, মসজিদের এই নগরীতে ক্যাসিনোর অস্তিত্ব অবাঞ্চিত বাস্তবতা। এগুলোর পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন বর্তমান শাসকদলের অনেক মহান(!) নেতা। তাদের তত্ত্বাবধানে এগুলো চলত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চলমান অভিযানের কারণে এর মধ্যে কারো কারো নাম সাধারণের কানে এসে পৌঁছেছে। তবে অভিযানকারীদের টক-ঝাল-মিষ্টি কথা হজম করতে হয়েছে। জীবনানন্দের কবিতা ‘বনলতা সেন’-এর ভাষায় বলা হয়নি- ‘এত দিন কোথায় ছিলেন?’ বলা হলো, ‘এত দিন কি আঙুল চুষেছে?’ উল্লেখ্য, জুয়া দেশের প্রচলিত আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ।
জুয়ার আসর আর ক্যাসিনোর গ্যাম্বলিংয়ের মধ্যে তফাত আছে। জুয়ার আসর জমাতে সে রকম জাঁকালো কোনো জায়গা লাগে না। গ্রামে সড়কের পাশে, বড় গাছের নিচে গামছা পেতে তাসের মাধ্যমে জুয়া খেলার দৃশ্য অপরিচিত নয়। প্রচলিত জুয়ার আসর রাস্তার ধার থেকে অভিজাত মহলেও বসে। অপরদিকে, ক্যাসিনো হলো উচ্চ শ্রেণীর আখড়া। সেখানে যন্ত্রের মাধ্যমে লাখ টাকার বাজি ধরা হয়। ঢাকার কয়েকটি ক্লাবসহ নির্দিষ্ট স্থানে জুয়ার আসর বসে, এটি জানা ছিল দেশবাসীর। কিন্তু ক্যাসিনো নামটি কখনো শোনা যায়নি। সংবাদমাধ্যমের খবর, পুলিশ পাহারায় চলত এসব জুয়ার আসর। রাজধানীর অনেক ক্লাবের প্রচলিত জুয়ার আসরকে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও উপকরণে সজ্জিত করে ক্যাসিনোতে রূপান্তরিত করেছে প্রধানত একদল নেপালি।
মদ-জুয়া সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের নির্দেশ হচ্ছে- ‘লোকেরা তোমাকে জিজ্ঞেস করে মদ ও জুয়া সম্পর্কে। বলো, এ দুয়ের মধ্যে বড় ধরনের পাপ রয়েছে। কিছু উপকারও রয়েছে। তবে উপকারের চেয়ে গুনাহ বেশি’ ( সূরা বাকারা : ২১৯ আয়াত)। সূরা মায়েদার ৯০ নং আয়াতে বলা হয়েছে- ‘হে বিশ্বাসীরা, মদ, জুয়া, পূজার বেদি ও ভাগ্য নির্ধারণকারী শর হচ্ছে শয়তানের কাজ; সুতরাং তা তোমরা বর্জন করো। আশা করা যায়, এতে তোমরা সফল হতে পারবে।’ আল কুরআনে কঠোরভাবে বলা হয়েছে, ‘মদ ও জুয়ার মাধ্যমে শয়তান তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বৈরিতা সৃষ্টি করতে চায়। আর বাধা দিতে চায় আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে। তবে কি তোমরা এখনো ফিরে আসবে না?’ ( সূরা মায়েদা : আয়াত-৯১)। সমাজকে মদ-জুয়ার পঙ্কিলতামুক্ত করতে আল্লাহ তায়ালা ধীরে ধীরে একটি জাহেলি সমাজ থেকে কিভাবে তা দূর হবে সে জন্য পবিত্র কুরআনে নির্দেশনা দিয়েছেন। অথচ আমরা মুসলিমপ্রধান দেশ হয়েও তা বেমালুম ভুলে গেছি। ফলে বর্তমানে সমাজে যে নৈতিকতার ধস নেমেছে; তা আমাদের নিজেদের কাজের কুফল ছাড়া আর কিছুই নয়। জুয়ায় হার-জিত যা-ই ঘটুক না কেন, পরিণতি সর্বনেশে। জুয়া খেলে টাকা-পয়সা, ঘরবাড়ি, সহায়-সম্পদ হারিয়েছেন, এমন নজির ভূরিভূরি। মাদকের মতো জুয়াও যদি সারা দেশে বিষবৃক্ষের ডালপালা মেলে, তবে কি আর রক্ষা আছে? এর বিধ্বংসী ক্ষমতা সর্বপ্লাবী ও সর্বগ্রাসী।
camirhamza@yahoo.com

বিশ্ববিদ্যালয়, ভিসি ও ঐতিহ্য-সমাচার
বেলা বাড়ছে, তবু বাসায় বসে আছি। স্ত্রীকে বললাম: আমি কিন্তু ছুটিতে।

সে বিস্মিত কণ্ঠে বলে: কিসের ছুটি?
শ্রান্তি বিনোদন!
মানে?
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষকেরা কাজ করে করে ক্লান্ত হয়ে যান। সে জন্যই এ ছুটি! সে হেসে ফেলে। বলে: তোমরা তো সারা বছরই শ্রান্তি বিনোদন করো! এ জন্য আবার ছুটি?
আমি ছোট মুখ করে বসে থাকি। তার কথা পুরোপুরি ভুল নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন আমি পড়াই একটি মাত্র সাবজেক্ট বা বিষয়। রুটিনে আছে ক্লাস সপ্তাহে দুদিন, এক ঘণ্টা করে ক্লাস। এ ছাড়া বিভিন্ন মিটিং থাকে, পরীক্ষা কমিটির কাজ থাকে, পরীক্ষা হলে পরিদর্শনে যাই, সারা বছর পরীক্ষার খাতা দেখি। কিন্তু এক সাবজেক্টের শিক্ষক বলে বোঝা যায় না ফুল টাইম চাকরি এটা। তবে এ ছাড়া উপায়ও নেই। আমাদের বিভাগে এত বেশি শিক্ষক এখন যে পড়ানোর জন্য একটার বেশি সাবজেক্ট পাওয়ার সুযোগ নেই তেমন। এমনও হয়েছে কোনো কোনো নতুন শিক্ষক কয়েক মাস পড়ানোর সুযোগই পাননি সাবজেক্টের অভাবে।
আমার বিভাগের মতো একই অবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় প্রতিটি বিভাগে। এখানে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে যতটা প্রয়োজন থেকে, তার চেয়ে বেশি হচ্ছে দল ভারী করতে। দল ভারী করা হয় সরকারের প্রতি অনুগত শিক্ষক দল (বিএনপির সময় সাদা, আওয়ামী লীগের সময় নীল) যাতে বিভিন্ন নির্বাচনে জিতে মূলত সেটা নিশ্চিত করার জন্য। এই বিজয়টা খুব প্রয়োজন সরকারের জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারের অনুগত দল শিক্ষক সমিতি নির্বাচনে জিতলে সেটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, সরকার বা সরকারপন্থী কোনো সংগঠন অন্যায় করলে প্রতিবাদ করে না, এমনকি প্রতিবাদী কোনো শিক্ষক সরকারি ছাত্রসংগঠনের হাতে অপদস্থ হলেও কিছু বলে না। সিন্ডিকেট সদস্য বা ডিন হিসেবে জিতলে বরং এসব অন্যায়ে সহায়তা বা সমর্থন প্রদান করে কখনো কখনো।
অনুগত দল নির্বাচনে জিতলে নির্বিঘ্নে সমমনাদের বিভিন্ন ছাত্রাবাসে প্রভোস্ট বা আবাসিক শিক্ষক পদে নিয়োগ দিতে পারে। এরা ছাত্রাবাসে সরকারি ছাত্রসংগঠন অরাজকতা কায়েম করলে কিছু বলে না, বিভিন্ন নির্মাণ, মেরামত ও নিয়োগ কাজে চাঁদাবাজি করলে প্রতিবাদ করে না, ভিন্নমত পোষণকারীরা হেনস্তা হলে তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে।
ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। তবে সাধারণ চিত্র সব আমলে কমবেশি এটাই।
২.
নির্বাচনে জেতা নিশ্চিত করার প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নেওয়ার প্রবণতা শুরু হয় খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর। এরপর ক্রমে ক্রমে তা বেড়ে বর্তমানে ভয়াবহ আকার গ্রহণ করেছে। গত ১০ বছরে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় এক হাজার শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। এদের একটা সিংহভাগ যে সরকারি দলের প্রতি অনুগত তার প্রমাণ হচ্ছে শিক্ষকদের নির্বাচনে সরকারি দলের প্রায় রাতারাতি সাফল্য। আগের বিএনপি আমলে সাদা দল শিক্ষকদের বিভিন্ন নির্বাচনে বেশি জিতত। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতার আসার বছরখানেক পর থেকে জিততে থাকে নীল দল, ক্রমেই তা হতে থাকে আরও একচেটিয়া।
তবে এর মানে এটা নয় যে কোনো শিক্ষকেরই বিবেক বা নিজস্ব বিবেচনাবোধ নেই। কিন্তু নতুন নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের মধ্যে সরকারপন্থীদের (কেউ কেউ বাধ্য হয়ে এমন হন) সংখ্যা এত বেশি থাকে যে নির্বাচনে বিজয়ী হয় বিবেক বা অন্য কিছু না, বিজয়ী হয় সরকারি দলের প্রতি আনুগত্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পুরোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণত উপাচার্য নিয়োগ হন এই অনুগতদের মধ্য থেকে। বিভিন্ন নির্বাচনে কয়েক দফা জিতে এসে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে আনুগত্য প্রদর্শনে পারদর্শীরা নিয়োগ পান এ পদে। আগে একটা সময় ছিল, যখন এ নিয়োগের সময় উপাচার্যের একাডেমিক এক্সেলেন্স ও ব্যক্তিগত ইমেজ কিছুটা হলেও গুরুত্ব পেত। যে কারণে আওয়ামী লীগ আমলে অধ্যাপক আজাদ চৌধুরী ও বিএনপি আমলে এস এম এ ফায়েজের মতো উপাচার্য নিয়োগ পেয়েছিলেন। কিন্তু এরপর উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।
সাম্প্রতিক কালে উপাচার্য হিসেবে এ ধরনের ব্যক্তিদের নিয়োগের পেছনে দুটো বিষয় মুখ্য ভূমিকা রেখেছে সম্ভবত। এক. প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক বিরোধী রাজনীতির (ছাত্র আন্দোলনভিত্তিক) প্রতি সরকারের ভীতি বেড়েছে। এ কারণে সেখানে ছাত্রসংগঠন নামধারী একটি পেটোয়া বাহিনী রাখার গুরুত্ব বেড়েছে। এ ধরনের পেটোয়া বাহিনীকে সমর্থন বা প্রশ্রয় দিতে পারে কেবল সরকারের অন্ধ অনুগত একজন উপাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত বিশ্ববিদালয় প্রশাসন। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় দেশের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা তাই দেখেছি।
বিগত ১০ বছরে বহু নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে উপাচার্য হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন অপেক্ষাকৃত অনভিজ্ঞ ও কম যোগ্য বিভিন্ন শিক্ষকও। দলীয় এসব উপাচার্য কৃতার্থ হয়ে আরও বেশি সরকার অনুগত থেকেছেন, মূল দায়িত্ব পালনে বেপরোয়া শৈথিল্য দেখিয়েছেন। ঢাকায় অবস্থান করে অন্য জেলার ভিসির দায়িত্ব পালন বা কথায় কথায় শিক্ষার্থী বহিষ্কার করার মতো উপাচার্য তাই আমরা সাম্প্রতিক কালেই শুধু দেখতে পাই। এঁদের মধ্যে আবার অঞ্চলভিত্তিক দায়মুক্তি পাওয়ার বিশ্বাস বা অহংকারটা যাঁদের বেশি, তাঁরা কতটা বেপরোয়া ধরনের হতে পারেন, তা আমরা গোপালগঞ্জের বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখছি এখন।
উপাচার্যদের মূল সমস্যা জবাবদিহির। তিনি নিয়োগ পান প্রধানত সরকারের প্রতি অন্ধ আনুগত্যর ভিত্তিতে। এই আনুগত্যোর প্রতি তাঁর জবাবদিহি থাকলেই চলে। শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে ভিন্নমতাবলম্বী কোনো প্রবণতা রুখে দেওয়া ও সরকারের অন্ধ গুণগান করে এসব আনুগত্যের প্রমাণ দেওয়া হয়। প্রথম কাজটা কঠিন। এই কঠিন কাজটা করার জন্য তিনি সমমনাদের নিয়ে শিক্ষক প্রশাসন সাজান, মারমুখী অনুগতদের অবাধ প্রশ্রয় প্রদান করেন। বিনিময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সহাবস্থান, শিক্ষার মান, গবেষণা কার্যক্রম প্রসারে এমনকি দুর্নীতি-নিপীড়ন প্রতিরোধে তিনি নিন্দনীয় ভূমিকা গ্রহণ করলেও তাঁকে কারও কাছে জবাব দিতে হয় না। ফলে কিছু কিছু উপাচার্য হয়ে ওঠেন স্বেচ্ছাচারী।
৩.
কেন একজন উপাচার্য এসব করেন বা তাঁকে এসব করতে হয়? কারণ, আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল কাজ কী, তাই আমরা ভুলতে বসেছি। বিশ্ববিদ্যলয়ের আসল কাজ শুধু জ্ঞানদান করা নয়, জ্ঞান তৈরি করা (গবেষণা) এবং তা কাজে লাগানোও (গবেষণার প্রায়োগিক ব্যবহার)।
আমাদের এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ মূলত প্রথমটি। সেটিও কতটা গৌণভাবে তা প্রথমে উদাহরণ দিয়ে বলেছি। এখানে গবেষণার নামে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যা হয়, তা নিম্নমানের এবং প্রধানত পদোন্নতির অভিলাষে রচিত। ১৫-২০ বছর আগেও একটা মানসম্মত পিএইচডি আর বিদেশি জার্নালে কিছু লেখাসহ ১৫-২০টি গবেষণা ছাড়া অধ্যাপক হওয়ার কথা ভাবা যেত না। এখন অবস্থা বদলেছে। বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বহু বিভাগে অধ্যাপকের সংখ্যা এখন বাকিদের চেয়ে বেশি!
বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের এখন অন্যতম কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারের প্রতি অন্ধ আনুগত্য প্রদর্শন। সরকারের জনসভায় লোক হাজির করা, রাজপথ কাঁপিয়ে সরকারের গুণগান করা এবং সরকারের অপকর্মের কোনো প্রতিবাদ হলে তা কঠোরভাবে দমন করা। অথচ যেকোনো সরকারের অন্যায়ের প্রতিবাদ করার একটি অনন্য ঐতিহ্য ছিল বাংলাদেশের পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। এখনো বাম সংগঠনগুলো, সাধারণ ছাত্ররা বা কিছু শিক্ষক তা করে থাকেন। কিন্তু বেশির ভাগ ব্যস্ত থাকেন তাঁদের গুঁড়িয়ে দেওয়ার কাজে। অনেকে আবার নীরব থাকেন ভোগান্তির ভয়ে।
অ্যান্টি-এস্টাবলিশমেন্ট এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখন পরিণত করা হয়েছে সবচেয়ে প্রো-এস্টাবলিমেন্ট প্রতিষ্ঠানে। এটি করা হয়েছে শিক্ষকদের বিভিন্ন পদে বসিয়ে, বিভিন্ন অন্যায়ে দায়মুক্তি দিয়ে, ছাত্রদের অন্যায় ক্ষমতা আর অবৈধ বিত্ত অর্জনের সুযোগ দিয়ে।
এই প্রক্রিয়ার সিইও হচ্ছেন আজকের উপাচার্যরা! বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাঁচাতে হলে এই সিইওদের পাশাপাশি যাঁরা এদের নিয়োগ দেন, তাঁদেরও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক
সারা বিশ্বে ঝড় তুলেছেন গ্রেটা থুনবার্গ
২০১৮ সাল। সুইডেনের পার্লামেন্টে গিয়ে সোচ্চার প্রতিবাদ জানিয়ে এলো মেয়েটা। পরিবেশ বাঁচাতে রাষ্ট্রের কড়া পদক্ষেপ দাবি করল গ্রেটা আর তার সঙ্গীরা। স্কুল পালিয়েই দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তুলল প্রতিবাদ
খবরের কাগজে, শিরোনামে, টিভিতে বারবার দেখা যাচ্ছে একটাই নাম– গ্রেটা থুনবার্গ। কেন একটা ১৮ বছরের মেয়ে রাতারাতি এমন খবর হয়ে উঠল? কেন জাতিসঙ্ঘের আন্তর্জাতিক মঞ্চও অস্বীকার করতে পারল না গ্রেটা নামের সুইডিশ একটা মেয়েকে? গ্রেটা পরিবেশকে বাঁচাতে চেয়েছে। নিজের জন্যেও, আবার অন্য সবার জন্যও। এ পৃথিবীর সবার জন্য একটা সুস্থ পৃথিবীর, সুস্থ পরিবেশের স্বপ্ন দেখছে গ্রেটা।
জাতিসঙ্ঘ ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিটে গত সোমবার এক ঝাঁক কিশোর কিশোরী পরিবেশের প্রতি রাষ্ট্রের ঔদাসিন্য নিয়ে উগড়ে দিয়েছে তাদের যাবতীয় অভিযোগ। ১৬ জন অভিযোগকারীর মধ্যে মঞ্চে ছিলেন গ্রেটা থুনবার্গ।
যারা জাতিসঙ্ঘ সদস্যদের বিরুদ্ধে পরিবেশ ঔদাসিন্যের অভিযোগ এনেছে, তাদের বয়স ৮ থেকে ১৭-র মধ্যে। মূল অভিযোগ হলো, সদস্য দেশ পরিবেশের সংকট দূর করতে ব্যর্থ হয়েছে, এবং সেই সঙ্গে শিশুদের অধিকার লঙ্ঘন করেছে।
প্রথম আন্তর্জাতিক জনপ্রিয়তা পেয়ে খবরে আসা আগস্ট, ২০১৮ সালে। সুইডেনের পার্লামেন্ট গিয়ে সোচ্চার প্রতিবাদ জানিয়ে এল মেয়েটা। পরিবেশ বাঁচাতে রাষ্ট্রের কড়া পদক্ষেপ দাবি করল গ্রেটা আর তার সঙ্গীরা। স্কুল পালিয়েই দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তুলল প্রতিবাদ। ২০১৮ এর জাতিসঙ্ঘের জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে হওয়া কনফারেন্স-এ বক্তব্য রাখল থুনবার্গরা। তারপর থেকে প্রতি সপ্তাহে একের পর এক স্কুল শিক্ষার্থীর মধ্যে ছড়িয়ে গেল প্রতিবাদ। না, কোনো দেশ-কাল-সীমানার গণ্ডি মানল না সেই প্রতিবাদ।
রাষ্ট্র শক্তির পরিবেশ ঔদাসিন্য নিয়ে মুখ খুলতে এতটুকু দ্বিধা করেনি ১৮ বছর বয়সের মেয়েটা। সত্যি বলতে, কাউকেই ছেড়ে কথা বলতে হয়, এই বোধ তৈরির অনেক আগে গ্রেটার মধ্যে চলে এসেছে একটা সুন্দর, সুস্থ পৃথিবীর স্বপ্ন। যেখানে পরিবেশকে নিংড়ে নিয়ে শুধু একপক্ষের বেঁচে থাকা সমৃদ্ধ হয় না, বরং বেশ কিছুটা ফিরিয়ে দেয়া হয় পরিবেশকেও। ব্যক্তিগত পরিসরেও গ্রেটা বিশ্বাস করেছে পরিবেশবান্ধব এক যাপনে। আকাশপথে যাতায়াত ছেড়েছে, আমিষ খাওয়া ছেড়েছে।
২০১৯-এর মে মাসে টাইম ম্যাগাজিনে গ্রেটা নির্বাচিত হলো ‘আগামী প্রজন্মের নেতা’ হিসেবে। সারা পৃথিবীতে আরো মানুষ জানতে শুরু করল, এই গ্রহেরই কোনো এক সদ্য আঠেরোয় পড়া প্রাণ দিন নেই, রাত নেই, ভেবে চলেছে কী ভাবে একটা সুন্দর, সুস্থ পরিবেশ উপহার দেবে আগামী প্রজন্মকে। তৈরি হলো তথ্যচিত্র ‘মেক দ্য ওয়র্ল্ড গ্রেটা এগেইন’।
২০০৩ সালে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে জন্ম গ্রেটার। গ্রেটার মা অপেরা গাইকা ম্যালিনা ইমান, বাবা অভিনেতা ভ্যানতে থুনবার্গ। ২০০৮ সালে ১১ বছর বয়সে প্রথম জলবায়ু বদলে যাওয়ার কথা জানতে পারে মেয়েটা। অবসন্ন হতে হতে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিতে থাকে। চিকিৎসকেরা জানালেন অ্যাস্পারগার সিনড্রোমে ভুগছে গ্রেটা। এরপরই অবসাদ জ্বলে উঠল প্রতিবাদ হয়ে। বাকিটা ইতিহাস…
সূত্র : ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
আগামী দিনের নেতৃত্ব ও যুবসমাজ
দেশের সামনে এখন অনেক সম্ভাবনা। সামনের দশক আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশবাসী একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, সুপ্রতিষ্ঠিত শক্তিশালী বিচারব্যবস্থা, সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন, ব্যক্তিস্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, গ্রহণযোগ্য আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা চায়। দুর্নীতি ও অরাজকতার বিরুদ্ধে গোটা জাতি যাতে এক হতে পারে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। বিরোধী দলগুলোরও দায়িত্ব রয়েছে। দায়িত্ব রয়েছে দেশের নাগরিকসমাজের ও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের। এ দেশের যুবসমাজের হাতে থাকবে আগামী দিনের নেতৃত্ব।
কিন্তু প্রকৃত গণতন্ত্র, সুশাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রশ্নে আমাদের মধ্যে ভয় কাজ করছে। প্রকাশ্যে দিনে-দুপুরে জনাকীর্ণ স্থানে যখন কোনো যুবককে দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে হত্যা করে, অথচ এ দেশের শত শত লোক দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখে। কেউ প্রতিবাদ করে না। সমাজ কতটা অধঃপতিত হলে মানুষ প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না। কারণ, রাষ্ট্রশক্তির পক্ষ থেকেই খুনিরা বাধা পাচ্ছে না। বিশ্বজিৎ হত্যার কথাও কেউ ভোলেননি নিশ্চয়ই। সরকারবিরোধী সন্দেহে কুপিয়ে হত্যা করা হলো তাকে। পাশে দাঁড়িয়ে বহু মানুষ সেটি তাকিয়ে দেখেছে বিনা প্রতিবাদে। এমনকি পুলিশও অদূরে নীরবে দাঁড়িয়ে এই নারকীয়তা প্রত্যক্ষ করেছে। এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও লজ্জাজনক। নিঃসন্দেহে বলা যায়, এ দেশের সর্বস্তরের মানুষ চায় সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশ, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, কার্যকর সংসদ সর্বক্ষেত্রে সুশাসন, দুর্নীতিমুক্ত, বৈষম্যহীন সুন্দর সমাজ। এটাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
স্বাধীনতার তিন বছর পরই জরুরি আইন ও একদলীয় শাসন কায়েম হওয়ায় পুরো পরিস্থিতি পাল্টে যায়। সংগঠিত হয় এক ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা এবং ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করার মধ্যে দিয়ে এ দেশের ইতিহাস অন্য দিকে মোড় নেয়। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ চলে যায় সামরিক শাসকের হাতে। অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানও হতে থাকে।
’৮২ তে আবার সামরিক শাসন জারি হয়। শাসনভার চলে যায় নতুন এক জান্তার হাতে। প্রতিক্রিয়ায় শুরু হয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। এ দেশের যুবক, ছাত্র-জনতা, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা এক হয়ে তৎকালীন স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে আসে। দেশবাসীর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিদায় নেয় স্বৈরশাসক। সেদিন এ দেশের যুবসমাজ, সর্বদলীয় ছাত্র-জনতার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে গণতন্ত্রের পথ খুলে যায়। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের পুরোটা সময় নানামুখী চাপ সত্ত্বেও ছাত্র-জনতা আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছিল, উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন পেশাজীবীরাও। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের ভূমিকা ছিল সাহসী ও অনুপ্রেরণামূলক।
১৯৯১ সালের একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ফিরে আসে গণতন্ত্র। বিএনপি ক্ষমতায় আসে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ আসে ক্ষমতায়। ২০০৬ সালের শেষ দিকে সাধারণ নির্বাচন নিয়ে দেশে গভীর সঙ্কট তৈরি হলে ২০০৭ সালে জানুয়ারি থেকে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় থাকে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসে।
তবে ২৮ বছর পর আবারো নির্বাচন গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে জাতি গভীর সঙ্কটে পতিত হয়েছে। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন ও জাতিকে দেখতে হয়েছে। ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ সালে হয়েছে আরেকটি একতরফা, প্রহসনমূলক নির্বাচন। টিআইবি প্রণীত রিপোর্টে দেখা গেছে, ৫০টির মধ্যে ৩৩টিতেই আগের রাতে এবং ৩০টি কেন্দ্র দখল করে ব্যালট পেপারে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর পক্ষে সিল মেরে বাক্স ভরা হয়েছিল। নির্বাচনের দিন সহিংসতার নিহত হয়েছিল ১৯ জন। এদিকে, অপহরণ, গুম ও রাজনৈতিক হত্যা থামছে না। ব্যক্তি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে বিরাট সমস্যা রয়েছে।
ফলে গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করতে হলে স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বর্তমান ছাত্র-জনতা ও যুবসমাজকে নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের দাবির কথা মনে করতে হবে। বিগত দ্ইু দশকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেকটা স্বাবলম্বী হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরীণ অবকাঠামোগত অনেক উন্নয়ন হয়েছে। মাথাপিছু আয় ও গড় আয়ু বেড়েছে। কিন্তু শিক্ষার গুণগতমান মুখ থুবড়ে পড়েছে। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বর্তমানে প্রায় ২৭ লাখ কর্মক্ষম তরুণ-তরুণী বেকার। ফলে নানা ধরনের অপরাধ, খুন, ধর্ষণ, মাদকাসক্তির দরুণ যুবসমাজ অধঃপতিত হচ্ছে।
বিচারহীনতা ও ক্ষমতাশীন দলের প্রভাব খাটিয়ে সন্ত্রাসীচক্র প্রকাশ্যে হত্যা, ধর্ষণ ও জবর দখলে মেতে উঠেছে। এভাবে চলতে থাকলে সৎ, যোগ্য, মেধাবী ও দেশপ্রেমিক নেতৃত্বের সঙ্কট দেখা দেয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু আমরা তবুও হতাশ হবো না, ভেঙে পড়ব না। কারণ আমাদের রয়েছে সম্ভাবনাময় তরুণসমাজ। নানা ক্ষেত্রে দেশের তরুণেরা প্রতিভা আর সম্ভাবনার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। তাদের যেন পথবিভ্রাট না ঘটে। তারা যেন দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে এগিয়ে যায়, সেদিকে সবার খেয়াল রাখা উচিত। এই তরুণদের থেকেই আগামী দিনের নেতৃত্ব গড়ে উঠবে। তাই সৎ দক্ষ, দেশপ্রেমিক, ধর্মপ্রাণ ও খোদাভীরু ও জবাবদিহিতা করায় প্রস্তুত নেতৃত্ব গড়ে ওঠা চাই।
আমাদের দেশে সংসদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনে যে নেতৃত্ব উঠে আসে, তা সাধারণত বিভিন্ন দলের ছাত্র সংগঠনগুলো থেকেই আসে। ছাত্র সংগঠনগুলোকে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা যদি সৎ, ধর্মপ্রাণ, পরমতসহিষ্ণু, মেধাবী ও দেশপ্রেমিক না হন তাহলে সন্ত্রাস, দুর্নীতি, জঙ্গিবাদ ও সামাজিক অনাচার বহু গুণে বেড়ে যাবে। আমাদের তরুণদের বিশাল অংশ অস্থিরতার মধ্যে আছে। তাদের সঠিকভাবে পরিচালনার অভাব রয়েছে। এর সাথে যুক্ত হচ্ছে মাদকের প্রভাব।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাদকবিরোধী, সন্ত্রাসবিরোধী যতই অভিযান পরিচালনা করুক না কেন, এতে কিছু দিন দমে থাকলেও পুনরায় অপরাধীচক্র নানাভাবে ফিরে আসছে। এ জন্য আমাদের দরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। আমাদের পরিবার, সমাজ, শিক্ষাঙ্গন ও শিক্ষাব্যবস্থায় মানবিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় জ্ঞান ও খোদাভীরুতা এবং দেশপ্রেম ও পারস্পরিক ভালোবাসার সেতুবন্ধন তৈরি করতে হবে। পরিবার থেকে যুবকদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, নীতিনৈতিকতা ও দেশপ্রেমের শিক্ষা দিতে হবে। ছাত্র সংগঠনগুলোকে নেতা নির্বাচনে সৎ, আদর্শ, নিষ্ঠাবান ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন তরুণদেরকেই নেতৃত্বের আসনে নিয়ে আসা উচিত।
E-mail: main706@gmail.com
নীতিনৈতিকতার পরাজয়
নীতি ও নৈতিকতা দু’টি শব্দ ব্যাপক অর্থ বহন করে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজে নীতি ও নৈতিকতা থাকা অত্যাবশ্যক। ব্যক্তি, পরিবার, প্রতিষ্ঠান ও সমাজে আদর্শিকভাবে নীতি আর নৈতিকতা বিলুপ্ত হলে সেসব প্রতিষ্ঠান রোগাক্রান্ত হয়ে যায়। নৈতিক আদর্শ না থাকলে প্রতিষ্ঠান সমাজ বা রাষ্ট্র টিকে থাকা কঠিন হয়ে যায়। আমরা যে দেশে বসবাস করছি সে দেশের ব্যক্তি-পরিবার-সমাজে কী পরিমাণ নীতিনৈতিকতা লালন পালন করছি- সে বিষয়ে আলোকপাত করতে যাচ্ছি।
আমরা বই-পুস্তকে মনীষীদের লেখায় নৈতিক মূল্যবোধ, চরিত্র, আলোকিত আদর্শের কথা পড়েছি। সে নীতিনৈতিকতা এখন পুস্তকেই শোভা পাচ্ছে। যারা এসব বিষয় শিক্ষার্থীদের রপ্ত করাবেন তাদের কাছেও ওই সব বিষয় অনুপস্থিত। একজন শিক্ষার্থী নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠানে পদচারণা করলেও বাস্তবে শিক্ষার্থী শিক্ষকের কাছ থেকে সে শিক্ষা পাচ্ছে না। ক্ষেত্রবিশেষে অনৈতিক কর্মকাণ্ড ও চরিত্র ধারণ করে পশুর আচরণ নিয়ে শিক্ষাজীবন শেষ করছে। ফলে তার জীবন ধ্বংস, সে সাথে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে করছে কলুষিত। এভাবে সমাজের প্রতিটি শাখা-প্রশাখা এখন নৈতিকতার পরাজয়ের শেষ প্রান্তে পৌঁছেছে। সমাজের কোনো সেক্টরেই নীতি-আদর্শ-মূল্যবোধের অবস্থান নেই বলা যায়।
দোকান থেকে বাজার, মার্কেটের ক্রেতা-বিক্রেতাদের নেই কোনো ভালোবাসা আর আদর্শিক নৈতিকতা। কে কাকে কী পরিমাণ ঠকিয়ে ধোঁকা দিয়ে মিথ্যা ছলচাতুরীর মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা যায়, সেটিই এখন আমাদের অন্যতম চরিত্র হিসেবে দেখা যাচ্ছে। একটা পণ্যের কী পরিমাণ ন্যায্যমূল্য সেটি কম-বেশি সব ক্রেতার ধারণা থাকে। দেখা যায়, বিক্রেতা এক শ’ টাকার একটা পণ্যের মূল্য হাঁকাল এক হাজার টাকা। তাহলে এটাকে পণ্যের ন্যায্যমূল্য হিসেবে আখ্যায়িত করবেন, নাকি ডাকাতি বলবেন। এভাবে সব মানুষ কোনো-না-কোনো জায়গায় অনৈতিকভাবে প্রতারণার শিকার। সমাজের কোথাও অথবা কোনো সেক্টরে নীতিনৈতিকতার আদর্শ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কে
কার চেয়ে বেশি টাকা আয় করবে- সেটিই এখন আমাদের অন্যতম টার্গেট। বৈধ, অবৈধ, হালাল, হারাম কোনো পার্থক্য খুঁজে পাচ্ছি না।
মাদক উৎপাদন, মাদক পাচার, বেচা-বিক্রি তো সবারই জানা অবৈধ ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড। একটি সমাজ ও জাতিকে ধ্বংস করতে মাদকই যথেষ্ট। সেটি জানার পরও যারা এসব কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত তাদের কী পরিণতি, আর কী ধরনের বিচার ও শাস্তি- সেটি রাষ্ট্রীয় আইনেই বলা আছে। আমাদের কথা হচ্ছে, এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ডে যারা জড়িত তাদের পরিচয় দেখলে পাওয়া যায়, তারা একটি নির্দিষ্ট ধর্মের লেবাস ব্যবহার করে এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। এসব লোক ধর্ম-কর্মে এগিয়ে থাকতে দেখা যায়। ধর্মের আবরণে অবৈধ, অনৈতিক অপকর্ম করাটা, সেটি যেন অভ্যাসে পরিণত। ধর্ম যেখানে নীতিনৈতিকতার প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা ছিল, সেখানে উল্টোটা সমাজ দেখছে। যাদের থেকে ধর্মীয় মূল্যবোধ নীতিনৈতিকতা গ্রহণ করার কথা ছিল তাদের কারো কারো অনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্বয়ং ধর্ম পর্যন্ত এখন প্রশ্নবিদ্ধ।
আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ জন্মের অর্ধশত বছর অতিক্রান্ত হলেও সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধের কোনো অগ্রগতি দেখছি না। শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম সব কিছু আজ কলুষিত। আপন ও দলীয় স্বার্থে অনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অপরের ক্ষতি ও ধ্বংস কোনো ব্যাপার নয়। আধিপত্য বিস্তার ও ক্ষমতার লালসায় সব ধরনের অনৈতিক উচ্ছখল আচার-আচরণ এ জাতির পক্ষে সম্ভব। দেখে দেখে একে অন্যের কাছ থেকে এসব অভ্যাসে গড়ে উঠছে পরিবার ও সমাজ। শিষ্টাচার-ভদ্রতা-নম্রতা, অন্যের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্যশীল আচরণ বিলুপ্তির পথে। পরিবার থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত এখন অনৈতিকতায় দিশাহারা সমাজ।
সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তি থেকে পরিবার ও রাষ্ট্র পর্যন্ত সবখানে নীতিনৈতিকতার লালন-পালন ও প্রতিষ্ঠা থাকতে হবে। তা না হলে কোনো অবস্থায় সুশৃঙ্খল ও আদর্শিক সমাজ আশা করা যায় না।
লেখক : সংগঠক
মানবজাতির প্রতি কোরআনের ১০০ উপদেশ

মানবজাতির প্রতি কোরআনের ১০০ উপদেশ
কালের কণ্ঠ অনলাইন
২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ১০:১২ | পড়া যাবে ১৮ মিনিটে
প্রিন্ট

অ- অ অ+
মানবজাতির প্রতি পবিত্র কোরআনের ১০০টি উপদেশ ধারাবাহিকভাবে ১০ পর্বে প্রকাশিত হয়। আজ সবগুলো পর্ব একসাথে দেওয়া হলো।
১। সত্য ও মিথ্যার মিশ্রণ করা যাবে না
ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশ্রিত কোরো না। এবং জেনেশুনে সত্য গোপন কোরো না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ৪২)
২। সৎ কাজ নিজে করে অন্যকে করতে বলো
ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা কি মানুষকে সৎকর্মের নির্দেশ দাও, আর নিজেদের বিস্মৃত হও…?’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ৪৪)
৩। বিবাদে লিপ্ত হয়ো না
ইরশাদ হয়েছে, দুষ্কৃতকারীরূপে পৃথিবীতে নৈরাজ্য সৃষ্টি কোরো না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ৬০)
৪। কারো মসজিদে যাওয়ার পথে বাধা দিয়ো না
ইরশাদ হয়েছে, ‘তার চেয়ে বড় জালিম আর কে, যে আল্লাহর (ঘর) মসজিদে তাঁর নাম স্মরণ করতে বাধা দেয় এবং এর বিনাশসাধনে প্রয়াসী হয়…?’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১১৪)
৫। কারো অন্ধ অনুসরণ করা যাবে না
ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন তাদের বলা হয়, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তা তোমরা অনুসরণ করো; তারা বলে, না, বরং আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদের যাতে পেয়েছি, তার অনুসরণ করব…।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৭০)
৬। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ কোরো না
ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ করো…।’ (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ১)
৭। অন্যায়ভাবে কারো সম্পদ ভোগ করবে না
ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস কোরো না…।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৮)
৮। সীমা লঙ্ঘন করা যাবে না
ইরশাদ হয়েছে, ‘…সীমা লঙ্ঘন কোরো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীদের ভালোবাসেন না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৯০)
৯। আল্লাহর পথে ব্যয় করো
ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা আল্লাহর পথে ব্যয় করো…।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৯৫)
১০। এতিমদের সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ করো
ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষ তোমাকে এতিমদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, বলে দাও, তাদের জন্য সুব্যবস্থা করা উত্তম…।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২২০)
১১। ঋতুস্রাবের সময় সহবাস পরিহার করো
ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা ঋতুস্রাবের সময় যৌন সঙ্গম কোরো না। (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২২২)
১২। শিশুকে দুই বছর বুকের দুধ খাওয়াও
ইরশাদ হয়েছে, ‘শিশুকে পূর্ণ দুই বছর দুধ পান করাও।’
(সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৩০)
১৩। সৎ শাসক নির্বাচন করো
ইরশাদ হয়েছে, ‘সৎ গুণ দেখে শাসক নির্বাচন করো।’
(সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৪৭)
১৪। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি নয়
ইরশাদ হয়েছে, ‘দ্বিনের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই।
(সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৫৬)
১৫। মানুষের নিঃস্বার্থ উপকার করো
ইরশাদ হয়েছে, ‘প্রতিদান কামনা করে দান বিনষ্ট কোরো না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৬৪)
১৬। অন্যের বিপদে সাহায্য করো
ইরশাদ হয়েছে, ‘প্রয়োজনে সহযোগিতা করো।’
(সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৭৩)
১৭। সুদ পরিহার করো
ইরশাদ হয়েছে, ‘সুদ গ্রহণ কোরো না।’
(সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৭৫)
১৮। অপারগ ব্যক্তির ওপর সদয় হও
ইরশাদ হয়েছে, ‘যদি ঋণগ্রহীতা অভাবগ্রস্ত হয়, তবে সচ্ছলতা আসা পর্যন্ত সময় দাও।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৮০)
১৯। হিসাব সংরক্ষণ করো
ইরশাদ হয়েছে, ‘ঋণের বিষয় লিখে রাখো।’
(সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৮২)
২০। আমানত রক্ষা করো
ইরশাদ হয়েছে, ‘আমানত রক্ষা করো।’
(সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৮৩)
২১। পরনিন্দা পরিহার করো
ইরশাদ হয়েছে, ‘কারো গোপন তথ্য অনুসন্ধান কোরো না এবং পরনিন্দা কোরো না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৮৩)
২২। সব নবীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করো
ইরশাদ হয়েছে, ‘সব নবীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করো।’
(সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৮৫)
২৩। আল্লাহ চেষ্টা অনুযায়ী প্রতিদান দেন
ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ সাধ্যের বাইরে কারো ওপর বোঝা চাপিয়ে দেন না। সে তা-ই পায় যা তার অর্জন।’
(সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৮৬)
২৪। আল্লাহ বিচ্ছিন্নতা পছন্দ করেন না
ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’
(সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১০৩)
২৫। সত্যের প্রতি আহ্বানকারী থাকা চাই
ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের ভেতর এমন একটি দল থাকা উচিত, যারা ভালো কাজের প্রতি আহ্বান জানাবে, সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে।’
(সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১০৪)
২৬। কোমলভাষী হও
ইরশাদ হয়েছে, ‘রূঢ় ভাষা ব্যবহার কোরো না।’
(সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৫৯)
২৭। সৃষ্টিজগতে আল্লাহর অনুসন্ধান করো
ইরশাদ হয়েছে, ‘এই বিশ্বের বিস্ময় ও সৃষ্টি নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করো।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৯১)
২৮। নারী-পুরুষ সবাই তার কর্মফল পাবে
ইরশাদ হয়েছে, ‘নারী ও পুরুষ উভয়ই তাদের কৃতকর্মের সমান প্রতিদান পাবে।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৯৫)
২৯। প্রাপ্তদের উত্তরাধিকারের সম্পদ বুঝিয়ে দাও
ইরশাদ হয়েছে, ‘মৃতের সম্পদ তার পরিবারের সদস্যদের ভেতর বণ্টন করতে হবে।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৭)
৩০। নারীদের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত কোরো না
ইরশাদ হয়েছে, ‘সম্পদের উত্তরাধিকারে নারীদেরও সুনির্দিষ্ট অংশ রয়েছে।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৭)
৩১। অনাথের সম্পদ আত্মসাত্ কোরো না
ইরশাদ হয়েছে, ‘অনাথদের সম্পদ আত্মসাত্ কোরো না।’
(সুরা : নিসা, আয়াত : ১০)
৩২। নিষিদ্ধ নারীকে বিয়ে কোরো না
ইরশাদ হয়েছে, ‘যাদের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক রয়েছে তাদের
বিয়ে কোরো না।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ২৩)
৩৩। অন্যায়ভাবে সম্পদ হরণ কোরো না
ইরশাদ হয়েছে, ‘অন্যায়ভাবে কারো সম্পদ ভক্ষণ কোরো না।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ২৯)
৩৪। পুরুষ পরিবারের অভিভাবক হবে
ইরশাদ হয়েছে, ‘পরিবারের অভিভাবকত্ব ও অর্থ ব্যয়
পুরুষের দায়িত্ব।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৩৪)
৩৫। সদাচারী হও
ইরশাদ হয়েছে, ‘অন্যের প্রতি সদাচারী হও।’
(সুরা : নিসা, আয়াত : ৩৬)
৩৬। কৃপণ হয়ো না
ইরশাদ হয়েছে, ‘কার্পণ্য কোরো না এবং অন্যকে কার্পণ্য শিক্ষা দিয়ো না।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৩৭)
৩৭। বিদ্বেষ পরিহার করো
ইরশাদ হয়েছে, ‘বিদ্বেষী হয়ো না।’
(সুরা : নিসা, আয়াত : ৫৪)
৩৮। ন্যায়বিচার করো
ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষের প্রতি ন্যায়বিচার করো।’
(সুরা : নিসা, আয়াত : ৫৮)
৩৯। মানুষ হত্যা কোরো না
ইরশাদ হয়েছে, ‘পরস্পরকে হত্যা কোরো না।’
(সুরা : নিসা, আয়াত : ৯২)
৪০। বিশ্বাস ভঙ্গকারীদের পক্ষপাত কোরো না
ইরশাদ হয়েছে, ‘বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষ নিয়ে বিতর্ক কোরো না।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১০২)
৪১। সত্যের ওপর অবিচল থাকো
ইরশাদ হয়েছে, ‘ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকো।’
(সুরা নিসা, আয়াত : ১৩৫)
৪২। অঙ্গীকার পূর্ণ করো
ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ করো।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ১)
৪৩। সৎকাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করো
ইরশাদ হয়েছে, ‘সৎকাজ ও খোদাভীতির ব্যাপারে পরস্পরকে সহযোগিতা করো।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ২)
৪৪। সীমা লঙ্ঘনের ব্যাপারে সহযোগিতা কোরো না
ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমরা পাপ ও সীমা লঙ্ঘনের ব্যাপারে পরস্পরকে সহযোগিতা কোরো না।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ২)
৪৫। সত্যের অনুগামী হও
ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! তোমরা আল্লাহর উদ্দেশে সাক্ষ্যদানের ক্ষেত্রে সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে।’
(সুরা মায়িদা, আয়াত : ৮)
৪৬।অপরাধীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাও
ইরশাদ হয়েছে, ‘পুরুষ চোর ও নারী চোর, তাদের হাত কেটে দাও। এটা তাদের কৃতকর্মের ফল এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে দৃষ্টান্তমূলক দণ্ড।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ৩৮)
৪৭। পাপ ও অবৈধ জিনিসের পেছনে শ্রম ব্যয় কোরো না
ইরশাদ হয়েছে, ‘তাদের অনেককেই তুমি দেখবে পাপে, সীমালঙ্ঘনে ও অবৈধ ভক্ষণে তৎপর। তারা যা করে নিশ্চয় তা নিকৃষ্ট।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ৬২)
৪৮। মাদকদ্রব্য বর্জন করো
ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! নিশ্চয় মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদি ও ভাগ্য নির্ণায়ক তীর ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন করো।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ৯০)
৪৯। জুয়া খেলো না
ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! নিশ্চয় মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদি ও ভাগ্য নির্ণায়ক তীর ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন করো।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ৯০)
৫০। পৃথিবীতে ভ্রমণ করো
ইরশাদ হয়েছে, ‘বলুন! তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করো, অতঃপর দেখো, যারা সত্যকে অস্বীকার করে তাদের পরিণাম কী হয়েছিল!’ (সুরা আনআম, আয়াত : ১১)
৫১। আধিক্য সত্যের মানদণ্ড নয়
ইরশাদ হয়েছে, ‘যদি তুমি পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের কথামতো চলো, তবে তারা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। তারা তো শুধু অনুমানের অনুসরণ করে এবং তারা শুধু অনুমানভিত্তিক কথা বলে।’
(সুরা : আনআম, আয়াত : ১১৬)
৫২। সঠিক ওজনে লেনদেন করো
ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা ন্যায্য পরিমাপ ও ওজন পূর্ণ করবে।’
(সুরা : আনআম, আয়াত : ১৫২)৫৩. অহংকার পতনের মূল
ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি এই স্থান থেকে নেমে যাও। এখানে থেকে তুমি অহংকার করবে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং তুমি বের হয়ে যাও। নিশ্চয় তুমি অধমদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ১৩)
৫৪। নামাজের সময় সুন্দর পোশাক পরিধান করো
ইরশাদ হয়েছে, ‘হে আদম সন্তান, তোমরা প্রত্যেক নামাজের সময় সুন্দর পোশাক পরিধান করো।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ৩১)
৫৫। অপচয়কারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন না
ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা খাও এবং পান করো। তবে অপচয় কোরো না। নিশ্চয় আল্লাহ অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ৩১)
৫৬। অন্যের ত্রুটিবিচ্যুতি ক্ষমা করো
ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি ক্ষমাপরায়ণ হোন।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ১৯৯)
৫৭। যুদ্ধের ময়দান থেকে পালাবে না
ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, যখন তোমরা কাফির বাহিনীর মুখোমুখি হবে তখন তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন কোরো না।’ (সুরা : আনফাল, আয়াত : ১৫)
৫৮। নিরাপত্তাপ্রত্যাশীদের নিরাপত্তা দাও
ইরশাদ হয়েছে, ‘মুশরিকদের কেউ আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করলে আপনি তাকে আশ্রয় দেবেন, যেন সে আল্লাহর বাণী শুনতে পারে।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৬)
৫৯। আল্লাহ পবিত্র ব্যক্তিকে ভালোবাসেন
ইরশাদ হয়েছে, ‘সেখানে রয়েছে এমন মানুষ, যারা পবিত্রতা অর্জন করতে পছন্দ করে। আর আল্লাহ পবিত্রতা অর্জনকারীকে ভালোবাসেন।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ১০৮)
৬০। আল্লাহঅনুগ্রহ থেকে নিরাশ হয়ো না
ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হয়ো না।’
(সুরা : আরাফ, আয়াত : ১৩)
৬১। অজ্ঞতাবশত ভুল হলে আল্লাহ ক্ষমা করেন
ইরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর যারা অজ্ঞতাবশত মন্দ কাজ করে তারা পরে তওবা করলে এবং নিজেদের সংশোধন করলে তাদের প্রতি তাদের প্রতিপালক অবশ্যই অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ১১৯)
৬২। ইসলাম প্রচারে কৌশলী হও
ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি আল্লাহর পথে প্রজ্ঞা ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে আহ্বান করো। তাদের সঙ্গে উত্তম পন্থায় বিতর্কে লিপ্ত হও। নিশ্চয় তোমার প্রভু পথভ্রষ্টদের সম্পর্কে সবিশেষ অবগত এবং সত্য পথের অনুসারীদের ব্যাপারেও সর্বোত্তম জানেন।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ১২৫)
৬৩। কেউ কারো পাপের বোঝা বহন করবে না
ইরশাদ হয়েছে, ‘যে সৎপথ অনুসরণ করে সে নিজের কল্যাণের জন্য সৎপথ অনুসরণ করে এবং যে পথভ্রষ্ট হবে সে নিজের ধ্বংসের জন্যই তা করবে। কেউ কারো বোঝা বহন করবে না। আমি রাসুল প্রেরণ করার পূর্ব পর্যন্ত কাউকে শাস্তি প্রদান করি না।’ (সুরা : বনি ইসরাইল, আয়াত : ১৫)
৬৪। পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার কোরো
ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন, তিনি ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত না করতে এবং মা-বাবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে।’ (সুরা : বনি ইসরাইল, আয়াত : ২৩)
৬৫। মা-বাবার সঙ্গে মন্দ ব্যবহার কোরো না
ইরশাদ হয়েছে, ‘তাদের একজন বা উভয়ই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তাদের ‘উফ’ বলো না, তাদের ধমক দিয়ো না; তাদের সঙ্গে বিনম্র ভাষায় কথা বলো।’
(সুরা : বনি ইসরাইল, আয়াত : ২৩)
৬৬। জীবনে মধ্যপন্থা অবলম্বন করো
ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি তোমার হাত তোমার গ্রীবায় আবদ্ধ করে রেখো না এবং তা সম্পূর্ণ প্রসারিতও কোরো না। তাহলে তুমি তিরস্কৃত ও নিঃস্ব হয়ে যাবে।’ (সুরা : বনি ইসরাইল, আয়াত : ২৯)
৬৭। সন্তান হত্যা কোরো না
ইরশাদ হয়েছে, ‘দারিদ্র্যের ভয়ে তোমরা সন্তান হত্যা কোরো না। তাদের এবং তোমাদের আমিই জীবিকা প্রদান করি। নিশ্চয় তাদের হত্যা করা মহাপাপ।’ (সুরা : বনি ইসরাইল, আয়াত : ৩১)
৬৮। অবাধ যৌনাচারে লিপ্ত হয়ো না
ইরশাদ হয়েছে, ‘ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ।’ (সুরা : বনি ইসরাইল, আয়াত : ৩২)
৬৯। না জেনে কোনো কিছুর অনুসরণ করবে না
ইরশাদ হয়েছে, ‘যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই তার অনুসরণ কোরো না। নিশ্চয় কান, চোখ, হৃদয়—এর প্রত্যেকটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।’ (সুরা : বনি ইসরাইল, আয়াত : ৩২)
৭০। নম্র ভাষায় কথা বলো
ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা তার সঙ্গে নম্র ভাষায় কথা বলবে। হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় পাবে।’
(সুরা : ত্বহা, আয়াত : ৪৪)
৭১। অনর্থক কাজ থেকে বিরত থাকো
ইরশাদ হয়েছে, ‘(মুমিন তারা) যারা অনর্থক ক্রিয়াকলাপ থেকে বিরত থাকে।’ (সুরা : মুমিনুন, আয়াত : ৩)
৭২। অনুমতি ছাড়া কারো ঘরে প্রবেশ কোরো না
ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! অন্যের ঘরে অনুমতি গ্রহণ বা সালাম প্রদান না করে প্রবেশ কোরো না। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করো।’
(সুরা : নুর, আয়াত : ২৭)
৭৩। লজ্জা ও শালীনতার সঙ্গে চলো
ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি মুমিন পুরুষদের বলে দিন যেন তারা তাদের দৃষ্টি সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থান হেফাজত করে। এটাই তাদের জন্য পবিত্রতম। তারা যা করে আল্লাহ নিশ্চয়ই তা জানেন। এবং আপনি মুমিন নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং লজ্জাস্থান হেফাজত করে; তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তবে ওইটুকু ব্যতীত যা স্বাভাবিকভাবে প্রকাশ পায়।’ (সুরা : নুর, আয়াত : ২৭)
৭৪। মা-বাবার ঘরে প্রবেশের আগেও অনুমতি নাও
ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! তোমাদের মালিকাধীন দাস-দাসীরা এবং তোমাদের মধ্যে যারা এখনো বয়ঃপ্রাপ্ত হয়নি তারা যেন তিন সময় তোমাদের ঘরে প্রবেশের পূর্বে অনুমতি নেয়—ফজরের নামাজের পূর্বে, দুপুরে যখন তোমরা তোমাদের পোশাক খুলে রাখ এবং এশার নামাজের পর। এই তিন সময় তোমাদের গোপনীয়তার সময়।’ (সুরা : নুর, আয়াত : ৫৮)
৭৫। বিনম্র হয়ে চলাফেরা করো
ইরশাদ হয়েছে, ‘রহমানের বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে।’ (সুরা : ফোরকান, আয়াত : ৬৩)
৭৬। মানুষের প্রতি দয়া করো
ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তোমার প্রতি যেমন অনুগ্রহ করেছেন, তুমিও তেমন অনুগ্রহ করো। পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি কোরো না।’ (সুরা : কাসাস, আয়াত : ৭৭)
৭৭। সংকটকালেও আল্লাহর পথে অটল থাকো
ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমার প্রতি আল্লাহর আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর তারা যেন তোমাকে কিছুতেই সেগুলো থেকে বিমুখ না করে। তুমি তোমার প্রতিপালকের প্রতি আহ্বান করো এবং কিছুতেই মুশরিকদের দলভুক্ত হইয়ো না।’ (সুরা : ফোরকান, আয়াত : ৮৭)
৭৮। সমকামিতা জঘন্যতম অপরাধ
ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরাই তো পুরুষে উপগত হচ্ছো, তোমরাই ডাকাতি করে থাকো, তোমরাই তোমাদের মজলিসে প্রকাশ্যে অপকর্ম করে থাকো। উত্তরে তার সম্প্রদায় শুধু বলল, আমাদের ওপর আল্লাহর শাস্তি নিয়ে এসো—যদি তুমি সত্যবাদী হও।’
(সুরা : আনকাবুত, আয়াত : ২৯)
৭৯। সৎ কাজের আদেশ করো
ইরশাদ হয়েছে, ‘হে পুত্র! নামাজ আদায় করো, সৎ কাজের আদেশ দাও এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করো। বিপদে ধৈর্য ধারণ করো। এটাই তো দৃঢ় সংকল্পের কাজ।’
(সুরা : লোকমান, আয়াত : ১৭)
৮০। মানুষকে অবজ্ঞা কোরো না
ইরশাদ হয়েছে, ‘অহংকারবশত তুমি মানুষকে অবজ্ঞা কোরো না এবং পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে বিচরণ কোরো না। নিশ্চয় আল্লাহ কোনো উদ্ধত অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’
(সুরা : লোকমান, আয়াত : ১৮)
৮১। কণ্ঠস্বর নিচু রাখো
ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি সংযতভাবে পথ চলো এবং তোমার কণ্ঠস্বর নিচু রাখো। নিশ্চয়ই গাধার স্বর সর্বাধিক শ্রুতিকটু।’
(সুরা লোকমান, আয়াত : ১৯)
৮২। নারী অশালীনভাবে নিজেকে প্রদর্শন করবে না

ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা ঘরে অবস্থান করো এবং পূর্ববর্তী জাহেলি (বর্বর) যুগের মতো নিজেদের প্রদর্শন করে বেড়াবে না।’ (সুরা আহজাব, আয়াত : ৩৩)
৮৩। অপরাধ যত বড় হোক আল্লাহ ক্ষমা করবেন

ইরশাদ হয়েছে, ‘বলুন! হে আমার বান্দাগণ তোমাদের মধ্যে যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব গুনাহই ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’ (সুরা ঝুমার, আয়াত : ৫৩)
৮৪। আল্লাহর নিকট আশ্রয় গ্রহণ করো

ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের অভিমুখী হও এবং তাঁর নিকট আত্মসমর্পণ করো; তোমাদের ওপর শাস্তি আসার আগে, যখন তোমাদের সাহায্য করা হবে না।’
(সুরা ঝুমার, আয়াত : ৫৪)
৮৫। মন্দের বিপরীতে ভালো করো

ইরশাদ হয়েছে, ‘ভালো-মন্দ কখনো সমান হতে পারে না। মন্দ প্রতিহত করো ভালোর দ্বারা। ফলে তোমার সঙ্গে যার শত্রুতা আছে, সে অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে যাবে।’
(সুরা হা মিম সাজদা, আয়াত : ৩৪)
৮৬। পরামর্শ করে কাজ করো

ইরশাদ হয়েছে, ‘(মুমিনরা) পরস্পরের সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করে।’ (সুরা শুরা, আয়াত : ৩৮)
৮৭। আল্লাহ আপস পছন্দ করেন

ইরশাদ হয়েছে, ‘মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং তোমরা ভাইদের ভেতর শান্তি স্থাপন করো আর আল্লাহকে ভয় করো যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও।’ (সুরা হুজরাত, আয়াত : ১০)
৮৮। কাউকে উপহাস করো না

ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! কোনো পুরুষ যেন অপর কোনো পুরুষকে উপহাস না করে; কেননা যাকে উপহাস করা হচ্ছে সে তার চেয়ে উত্তম হতে পারে। কোনো নারী যেন অপর কোনো নারীকে উপহাস না করে। কেননা যাকে উপহাস করা হচ্ছে সে উপহাসকারী নারীর চেয়ে উত্তম হতে পারে।’
(সুরা হুজরাত, আয়াত : ১১)
৮৯। সন্দেহপ্রবণতা ভালো নয়
ইরশাদ হয়েছে, ‘মুমিনরা অধিক পরিমাণে সন্দেহ করা থেকে বিরত থাকো। নিশ্চয়ই কিছু কিছু সন্দেহ পাপতুল্য।’ (সুরা হুজরাত, আয়াত : ১২)
৯০। পরনিন্দা করো না
ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা পরস্পরের অনুপস্থিতিতে নিন্দা করো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা তা ঘৃণা করো। আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’ (সুরা হুজরাত, আয়াত : ১২)
৯১। সম্মানের ভিত্তি খোদাভীতি
ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে। অতঃপর তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো। তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি আল্লাহর কাছে অধিক সম্মানিত যে আল্লাহকে অধিক ভয় করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কিছু জানেন এবং সব কিছুর খবর রাখেন।’ (সুরা : হুজরাত, আয়াত : ১৩)
৯২। অতিথির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করো
ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনার নিকট ইবরাহিমের সম্মানিত মেহমানদের ঘটনা বিবৃত হয়েছে? যখন তারা তাঁর কাছে উপস্থিত হয়ে বলল, সালাম। উত্তরে তিনি বললেন, সালাম। এরা তো অপরিচিত লোক। অতঃপর ইবরাহিম তার নিকট গেল এবং একটি মাংসল গরুর বাছুর ভাজা নিয়ে এলো এবং তাদের সামনে রাখল।’ (সুরা : জারিয়াত, আয়াত : ২৪-২৭)
৯৩। দাতব্যকাজে অর্থ ব্যয় করো
ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করো এবং আল্লাহ তোমাদেরকে যা কিছুর উত্তরাধিকারী করেছেন তা থেকে ব্যয় করো। তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও ব্যয় করে, তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার।’ (সুরা : হাদিদ, আয়াত : ৭)
৯৪। বৈরাগ্যবাদ মানুষের সৃষ্টি
ইরশাদ হয়েছে, ‘বৈরাগ্যবাদ এটা তারা নিজেরাই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য প্রবর্তন করেছিল। আমি তাদের এই বিধান দিইনি। অথচ তারা এটাও ঠিকমতো পালন করেনি।’ (সুরা : হাদিদ, আয়াত : ২৭)
৯৫। আলেমদের আল্লাহ মর্যাদা দান করেছেন
ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন। তোমরা যা করো আল্লাহ তা সম্মুখ অবগত।’
(সুরা : মুজাদালা, আয়াত : ৫৮)
৯৬। অমুসলিমদের সঙ্গেও উত্তম আচরণ করতে হবে
ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা দ্বিনের ব্যাপারে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে নিজ মাতৃভূমি থেকে বের করে দেয়নি, তাদের প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেননি।’ (সুরা : মুমতাহিনা, আয়াত : ৮)
৯৭। ঋণদাতার জন্য রয়েছে পুরস্কার
ইরশাদ হয়েছে, ‘যদি তোমরা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দান করো, তিনি তোমাদের জন্য তা বহুগুণ বৃদ্ধি করে দেবেন এবং তিনি তোমাদের ক্ষমা করবেন। আল্লাহ গুণগ্রাহী, ধৈর্যশীল।’ (সুরা : তালাক, আয়াত : ১৭)
৯৮। তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ো
ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় আপনার প্রতিপালক জানেন যে আপনি জাগরণ করেন কখনো রাতের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ, কখনো অর্ধাংশ এবং কখনো এক-তৃতীয়াংশ; জাগে তোমার সঙ্গে যারা আছে তাদের একটি দলও। আল্লাহই নির্ধারণ করেন দিন-রাতের পরিমাণ।’ (সুরা : মুজাম্মিল, আয়াত : ২০)
৯৯। ভিক্ষুকদের ধমক দিয়ো না
ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং তুমি ভিক্ষুককে ধমক দিয়ো না।’ (সুরা : দুহা, আয়াত : ১০)
১০০। আল্লাহর একত্ববাদের সাক্ষ্য
ইরশাদ হয়েছে, ‘বলুন! আল্লাহ এক-অদ্বিতীয়, তিনি অমুখাপেক্ষী, তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাঁকেও কেউ জন্ম দেয়নি। এবং তাঁর সমতুল্য কেউ নেই।’ (সুরা : ইখলাস)
জেলায় ন্যাশনাল সার্ভস স কর্মরত সা সার্ভ
সাভিস ম্যানদের জেলা প্রশাসন কতৃক

জেলায় ন্যাশনাল সাভিসে কর্মরত সাভিসম্যান এবং সকল যুব সংগঠনকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিস মশা নিধনের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহনের জন্য বলা হলো ।
সমাজ গঠনে মানবিক মূল্যবোধ
সুস্থ সমাজ গঠনে মানবিক মূল্যবোধের কোনো বিকল্প নেই। পত্রিকার পাতা খুললে প্রায়ই যেসব অমানবিক বর্বর নিষ্ঠুরতার চিত্র পাওয়া যায়, তা নিন্দা জানানোর ভাষাও থাকে না। সম্প্রতি বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরারের নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ড এমনই একটি ঘটনা, যা সমগ্র জাতির বিবেককে নাড়া দিয়েছে। মানবরূপী এসব দানবের প্রতি জনমনে তীব্র ঘৃণা ও ক্ষোভ সঞ্চারিত হয়েছে। এর রেশ কাটতে না কাটতেই আরও একটি নারকীয় হত্যাকাণ্ড। এবারের শিকার পাঁচ বছরের শিশু তুহিন। নজিরবিহীন জঘন্য কায়দায় নৃশংস হত্যাকাণ্ড। এ কোন জিঘাংসার ফসল? প্রাথমিক তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য ঘটনাটি বাবা-চাচাদের দ্বারা সংঘটিত। অতীতেও প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য স্বজন হত্যার বহু নজির রয়েছে। কিন্তু নৃশংসতার সব সীমা ছাড়িয়ে নিজের শিশুসন্তানকে হত্যা করে বীভৎস কায়দায় শিশুটির বিভিন্ন স্পর্শকাতর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখে কী প্রমাণ করতে চেয়েছে খুনিরা? কোনো মানুষের পক্ষে একটা শিশুকে খুন করে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এ বীভৎস কায়দায় কর্তন করা সম্ভব? বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। পিতার কাছে যদি সন্তানের নিরাপত্তা না থাকে, তাহলে শিশুর জন্য নিরাপদ আশ্রয় কোথায়? আবরার কিংবা তুহিন, যারা নৃশংসতার শিকার হলো আমি মনে করি, এ এক বিকৃত মানসিকতা-সম্পন্ন খুনিদের নিষ্ঠুর উলল্গাস। এসবের পরিবর্তন দরকার। দরকার মনুষ্যত্ব জাগ্রত করা। মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ গঠনটাও আজ বড় জরুরি।

নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ হারানোর হাহাকার আজ চারদিকে। বুয়েটের ছাত্র আবরারকে যারা পিটিয়ে মেরে ফেলল, তারা তো একই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র। তিন দফায় আবরারকে পেটানো হয়। একজনও এগিয়ে এলো না থামাতে। একজনেরও বিবেক জাগ্রত হলো না। আবরারের হত্যাকারীরা প্রত্যেকেই নটর ডেম কলেজের ছাত্র, মেধাবী। এই খবরটা জেনে আমার ছেলেরও খুব মন খারাপ। কারণ সে নটর ডেমের ছাত্র ছিল। এখান থেকে মানুষ পরিশীলিত জীবনের শিক্ষা পায়। অথচ ছাত্র নামধারী শিক্ষিত এই খুনিদের কারণে আজ প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুণ্ণ হলো। আমি মনে করি, এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে শুধু আবরারের বাবা-মা তাদের সন্তানকে হারিয়েছেন এমনটি নয়, ক্ষতি হয়েছে দেশ-জাতি সবার। এই খুনিরা এতটাই ঘৃণিত হয়েছে যে, জেলখানার কয়েদিরা পর্যন্ত তাদের ধিক্কার দিয়েছে। তাদের পিতা-মাতার অবস্থা আরও করুণ। কীভাবে তারা সমাজে মুখ দেখাবে? প্রত্যেক বাবা-মা তাদের আদরের সন্তানদের শিক্ষিত করার স্বপ্ন বোনেন। কারও কারও কাছে বুয়েট স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান। এখানে ভর্তি করতে পারলে সন্তানটি সুশিক্ষা পাবে, দেশ ও দশের জন্য কাজ করবে, নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করবে- এটাই অভিভাবকের প্রত্যাশা। কিন্তু বিপরীতে আজ এ কী চিত্র আমরা দেখলাম! আবরার পরপারে চলে গেছে। বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে তার জন্য আফসোস। শোক প্রকাশ করছে। তার বাবা-মার প্রতি সবাই সমবেদনা জ্ঞাপন করছে। সরকারপ্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবরারের মাকে বুকে টেনে নিয়েছেন। বিচার নিশ্চিত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেবেন শুরু থেকেই বলে আসছেন। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবরারের খুনিদের পরিবারগুলোর কথা চিন্তা করলে তাদের মর্মবেদনাও অনুভব করা যায়। তাদের চোখের জল ফেলতে হয় লুকিয়ে। তারা আবরারের মায়ের মতো হাহাকার করতে পারছে না। কী এক অসহায় অবস্থায় তাদের দিন কাটে। তাদের স্বপ্নগুলোও ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। কেন এই মেধাবী সন্তানগুলো এভাবে বখে গেল, তার কারণ অনুসন্ধান করা এখন সময়ের দাবি।

আমার শিক্ষাজীবনেও র্যাগিং দেখেছি। অশ্লীলতায় পূর্ণ কী বর্বর আচরণ ছিল কিছু সংখ্যক র্যাগিংবাজের, যা সহ্য করার মতো ছিল না। আমরা বরাবরই এই অশ্লীল সংস্কৃতির বিরোধিতা করেছি। নোংরামির বিরোধিতা করেছি। নির্মল আনন্দের বিপক্ষে কেউ না; কিন্তু আনন্দের নামে অশ্লীলতা সহ্য করা যায় না। আমার স্বামী মুহসীন হলের ছাত্র ছিলেন। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তোমাদের হলে কি টর্চার সেল ছিল?’ উত্তরে ‘না’ পেয়েছি। আমার ছোট ভাই ছিল এসএম হলের ছাত্র। সে সময় অস্ত্রের ঝনঝনানি ছিল। মারামারি ছিল। আমি রোকেয়া হলের ছাত্রী ছিলাম। ১৯৭৮ সালে হলের সেই মারামারি, চুলোচুলির ঘটনা দেশজুড়ে জানাজানি হয়ে গেল। বাড়িতে গেলে বা কোথাও বেড়াতে গেলে অনেকেই ঠাট্টা করে জিজ্ঞেস করত, দেখি মাথায় কয় গোছা চুল আছে? সে রকম পরিস্থিতিতেও কিন্তু এ রকম পিটিয়ে মেরে ফেলার সংস্কৃতি ছিল না। মানুষের মানবিকতা এভাবে উবে গেল কেন? মানুষ কেন অমানুষ হবে? একজন ছাত্রেরও মনে হলো না যে, ছেলেটি মরে যেতে পারে। শুনতে পাই, গেস্টরুমে তারা আদব-কায়দা শিক্ষা দিত। আদব-কায়দার যদি এই নমুনা হয়, তাহলে এমন আদব-কায়দা শেখানোর কোনো প্রয়োজন নেই। নিজেরা সংযত হলেই ভালো।

হল কর্তৃপক্ষ এখন কী করে? এটি একটি বিরাট প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। তাদের কি কোনো দায়দায়িত্ব নেই? আমাদের সময় আমরা দেখেছি, মাঝেমধ্যে হাউস টিউটর আপা সন্ধ্যার পরে হোস্টেল কক্ষ ভিজিট করতেন। হলে-রুমে রান্না করা নিষিদ্ধ ছিল; কিন্তু অনেক মেয়েই হলের ডাইনিংয়ের খাবার খেতে পারত না। তারা লুকিয়ে রান্না করত। কেউ হিটারে, কেউ কেরোসিনের চুলায়। হাউস টিউটর আপা রুম ভিজিটে বেরিয়েছেন- এই খবর পেলে সে কী তড়িঘড়ি করে চুলা লুকানো হতো। অনেক সময় গরম চুলা খাটের নিচে লুকাতে গিয়ে কারও কারও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পুড়ে গেছে। শিক্ষক যেমন ছাত্রকে সন্তানতুল্য দেখবেন, ছাত্রও শিক্ষককে তেমনি পিতৃতুল্য মর্যাদায় রাখবেন। ছাত্রদের মাঝে শিক্ষকদের প্রতি এক ধরনের শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভয় থাকতে হবে। শিক্ষকদের চোখের সামনে দিনের পর দিন এই ঘটনাগুলো ঘটছে। তারা কিছুই করতে পারছেন না, এটি মেনে নেওয়া যায় না। তারা যদি উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারতেন, তাহলে মেধাবী ছাত্র আবরারের যেমন অকালে ঝরে যেতে হতো না, তেমনি আবরারের খুনি যারা এই প্রতিষ্ঠানেরই মেধাবী ছাত্র, তাদের জীবনেও হয়তোবা এই কলঙ্কময় অধ্যায়ের সূচনা হতো না। আমাদের সমাজব্যবস্থায় মূল্যবোধের ধস নেমেছে। সবার মাঝে যদি মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত থাকত, তাহলে হয়তোবা এই শিক্ষার্থীরা দানবে পরিণত হতো না। হয়তোবা এই ঘটনাটিই ঘটত না। সবার কাছে আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ- আসুন, আমরা সবাই মিলে পারিবারিক বন্ধন মজবুত করি। সবার মাঝে সহিষুষ্ণতা, সহনশীলতা ফিরিয়ে আনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের ব্যবহার এতটাই বেশি যে, পাশের ঘরে দাদা-দাদি, বাবা-মা কারও কথা মনে থাকে না। তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় নেই। স্মার্টফোন হাতে পেয়ে সবার মাঝে থেকেও সবাই যেন একা। তাহলে পারিবারিক বন্ধন কার সঙ্গে হবে? সামাজিকতাটা কার জন্য? কেন সারাক্ষণ নেশাগ্রস্তের মতো মোবাইল সেটে চোখ রাখতে হবে? এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসাটা এখন জরুরি। আমাদের পারিবারিক বন্ধন মজবুত করা দরকার। মানবিকতার মূল্যবোধ পরিবার থেকে জাগ্রত না হলে আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার, অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। বাঙালি পরিবারের ঐতিহ্য হচ্ছে মায়া-মমতাঘেরা আত্মীয়তার বন্ধন। সেই মায়া-মমতা আজ যেন হারিয়ে যাচ্ছে। পারিবারিক মূল্যবোধের পুনরুদ্ধারে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মানবিক শিক্ষা দিতে হবে। শৈশবে যেমন আদর্শলিপি দিয়ে আমাদের হাতেখড়ি হয়েছে; এখনকার শিশুদের মাঝেও শৈশব থেকেই সেই নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। আমরা বাবা-মায়ের কাছে শিখেছি, মিথ্যা বলা মহাপাপ। সবসময় সত্য কথা বলবে, অন্যের ক্ষতি করবে না। এগুলো এখনও আমাদের মনে গেঁথে আছে।

আমার স্বামী প্রায়ই বলে থাকেন, মান ও হুঁশ এই দুই শব্দের সম্মিলনে হয় মানুষ। মানুষ শব্দের অর্থের মধ্যেই মনুষ্যত্বের বিষয়টি রয়েছে। মানুষের ভেতর মনুষ্যত্ব তৈরি করতে হয়। পশুপাখি সে শুধুই পশুপাখি। গরুকে গরু হতে কেউ বলে না। যার মধ্যে সম্মানবোধ এবং জ্ঞান আছে, সেই মানুষের পক্ষে কোনো অমানবিক আচরণ করা সম্ভব নয়। তাই মানুষকে মানুষ করার জন্য আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষাঙ্গন, সভা-সেমিনার সর্বত্র সবাই মিলে মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে হবে। বর্বর আচরণ ও নির্মমতা-নিষ্ঠুরতা থেকে আমাদের মুক্তি পেতেই হবে। সুস্থ সমাজ গঠনে মানবিক মূল্যবোধের কোনো বিকল্প নেই। সম্মানজনকভাবে বেঁচে থাকার সবটুকু অধিকার আছে প্রত্যেক মানুষের। এটা কেউ নিতে পারে না। এটা কোনো রাষ্ট্রীয় গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, বিশ্বব্যাপী সর্বত্র এই অধিকার। এটাই মানবাধিকার। এই মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে সামাজিক আন্দোলন জোরদার করা এখন সময়ের দাবি; আর বিলম্ব নয়।

চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সাবেক সিনিয়র সচিব

অর্থনৈতিক ক্যান্সার ও পশ্চিমা সভ্যতা

বর্তমান বিশ্বের সামনে যেসব সঙ্কট তৈরি হয়েছে, তার একটি হলো অর্থব্যবস্থা তথা অর্থের সংস্থান নিয়ন্ত্রণ। এর শুরুটা হয়েছিল মূলত ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে। শুনে অনেকেই অবাক হতে পারেন যে, বর্তমান বিশ্বের অর্থের উৎস নিয়ন্ত্রণ করছেন মাত্র পাঁচ-সাত জন লোক। কোনো দেশ বা কোনো সরকার নয়। আর এটাই মানবসভ্যতার জন্য সবচেয়ে গুরুতর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এর ইতিহাস কিছুটা আমাদের জানা থাকা উচিত। আমরা এখন আমেরিকান সভ্য সমাজ বলতে যাদেরকে বুঝি, তারা মূলত ইউরোপ থেকে যাওয়া লোকজন। তারা ছিলেন উদ্যমী মানুষ। বিশাল এই উপমহাদেশে সৌভাগ্যের হাতছানি দেখে তারা ঝাঁকে ঝাঁকে সেখানে গিয়ে হাজির হয়েছেন। সপ্তদশ শতকের ঘটনা এটা। ইউরোপীয়রা সেখানে গিয়ে উপনিবেশ স্থাপন করেছিলেন। তারা সেখানে গিয়ে দেখেন, ইচ্ছেমতো যা খুশি তাই করা যাচ্ছে। ছোটবেলায় আমরা গল্প পড়েছিলাম ‘হাউ মাচ ল্যান্ড ডাজ এ ম্যান রিকয়্যার’। আমেরিকা মহাদেশে পাড়ি জমানো ইউরোপীয় অধিবাসীদের জন্য এই গল্প ছিল সত্যি।
ইউরোপ থেকে যারা আমেরিকায় পাড়ি জমান, তারা হাজার হাজার একর ভূ-সম্পত্তির মালিক হয়ে বসেন। কারণ তখন সেখানে জমির কোনো মালিক ছিলেন না। যে আগে গিয়ে যতখানি জায়গা মার্কিং দিয়ে নিজের বলে দাবি করতেন, সেটাই তার হয়ে যেত। সবাই এটা মেনেও নিতেন। কারণ জমির অভাব নেই। কিন্তু হাজার হাজার বিঘা জমি নিয়ে বসে থাকলে তো হবে না, জমি আবাদ করতে হবে। ইউরোপীয়রা এসে দেখেন; জমি পড়ে আছে কাজ করার লোক নেই। জঙ্গলে বিশাল বিশাল আকারের টার্কি ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা সেগুলো মেরে খাওয়া শুরু করলেন। আর সে কারণেই ৪ জুলাই আমেরিকানরা যখন তাদের স্বাধীনতা দিবস পালন করেন, সে দিন খাবারের মেন্যুতে টার্কি হচ্ছে প্রধান আইটেম।
কিন্তু টার্কি খেয়ে আর কত দিন চলা যায়? এরপর শুরু করা হলো দাসব্যবস্থা। ইউরোপীয়রা বিশেষ করে, আফ্রিকা থেকে আদিবাসীদের ধরে নিয়ে গিয়ে আমেরিকায় দাস হিসেবে কাজে লাগানো শুরু করেছিলেন। আমেরিকান সভ্যতার যাত্রা শুরু মূলত এখান থেকেই। এই ইউরোপীয় ভূস্বামীরা আমেরিকায় চরম স্বাধীনতা ভোগ করতে থাকেন। যে যার মতো চলতে থাকেন। এদের অনেকে এমন প্রতিপত্তি লাভ করেন যে, প্রাইভেট ব্যাংক নাম দিয়ে নিজেই টাকা ছাপানো শুরু করেছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রশাসনও তৈরি হলো। কিন্তু পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেল যে, প্রশাসনকে পর্যন্ত শাসনব্যবস্থা পরিচালনার জন্য ওই সব পুঁজিপতির কাছে হাত পাততে হয়েছে। পরবর্তীকালে আরো অনেক দেশেও এটা ঘটেছে। এমন সম্পদশালী অনেক পরিবার তৈরি হয়, যারা সরকার চালানোর টাকা দিয়ে থাকে। সৌদি আরবের মতো দেশে আল রাজি পরিবার, আল নাসির পরিবার রয়েছে। বাদশাহ সউদ, বর্তমান সৌদি আরবের ক্ষমতাসীন পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা, তাদের বাড়িতে এসে থাকতেন। কারণ তখন রাজপ্রাসাদ তৈরি করার মতো অর্থ বাদশাহর ছিল না।
যা হোক, ভূস্বামীরা যখন টাকা ছাপানো শুরু করলেন, তখন আমেরিকার রাজনীতিবিদদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিলো। এর সুদূরপ্রসারী এবং ক্ষতিকর দিকগুলো চিন্তা করে আতঙ্কিতবোধ করলেন তারা। বেশির ভাগ আমেরিকান প্রেসিডেন্ট এটা প্রতিরোধ করতে চাইলেন। কিন্তু তারা তা পারেননি। এই চেষ্টা করতে গিয়ে আমেরিকার তৃতীয় প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন বলেছিলেন : “If the American people ever allow private banks to control the issue of their currency, first by inflation, then by deflation, the banks and corporations that will grow up around them will deprive the people of all property until their children wake up homeless on the continent their Fathers conquered… The issuing power should be taken from the banks and restored to the people, to whom it properly belongs.” (আমেরিকার জনগণ যদি তাদের মুদ্রা ইস্যু করার ক্ষমতা বেসরকারি ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দেয়, তাহলে প্রথমে মুদ্রাস্ফীতি ও পরে মুদ্রাসঙ্কোচনের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো জনগণকে তাদের সম্পত্তি থেকে এমনভাবে বঞ্চিত করতে থাকবে যত দিন না তাদের সন্তানরা এই মহাদেশে গৃহহীন হয়ে পড়ে, যে মহাদেশটিকে তাদের পিতারা জয় করেছিলেন… মুদ্রা ইস্যু করার ক্ষমতা ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে নিয়ে জনগণের কাছে দিতে হবে, যারা সত্যিকারের অধিকারী)। জেফারসন এই কথা বললেও তিনি প্রাইভেট ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে মুদ্রা ইস্যু করার ক্ষমতা নিতে পারেননি।
জেফারসনের পর চতুর্থ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেমস ম্যাডিসনও একই কথা বলেছেন: “History records that the money changers have used every form of abuse, intrigue, deceit, and violent means possible to maintain their control over governments by controlling money and it’s issuance.” (ইতিহাসে দেখা যায়, মুদ্রা ও এর ইস্যু করা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মুদ্রা ব্যবসায়ীরা সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সম্ভাব্য সব ধরনের অপব্যবহার, চক্রান্ত, শঠতা, প্রতারণা ও হিংসাত্মক উপায় অবলম্বন করেছে)।
কারণ মানুষ যত কথাই বলুক না কেন, শেষ কথা হলো অর্থ। আমাদের দেশে কী হচ্ছে? কিছু মানুষ অবৈধ পথে বিপুল বিত্ত-বৈভবের অধিকারী হয়ে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে যাচ্ছে। এরা ম্যাডিসনের আশঙ্কা মতো কোনো অপকর্মই বাদ রাখছে না। পরিস্থিতি এক ধরনের ক্যান্সারে রূপ নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীকে সাধুবাদ দিই, তিনি দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করেছেন। তবে এটা শুধু একটি ক্ষেত্রে সীমিত রাখলে হবে না। এই ক্যাসিনোর মতো কিছু আমাদের দেশে হচ্ছে, অনেকের মতো আমিও তা ভাবতে পারিনি। নিজে যখন দীর্ঘ দিন ওয়ার্ল্ড ক্লাস টপ সিভিল সার্ভেন্ট থেকেও অস্তিত্বের সংগ্রাম করছি এখন, তখন কিছু তরুণ ও যুবকের অল্প সময়ে বিপুল অর্থের মালিক হওয়াটা আমাদের জন্য কল্পনাতীতই বটে।
অ্যান্ড্রু জ্যাকসন, আমেরিকার সপ্তম প্রেসিডেন্ট, ক্ষমতায় এসে বললেন : “If Congress has the right under the Constitution to issue paper money, it was given to be used by themselves, not to be delegated to individuals or corporations” (সংবিধানের আওতায় কংগ্রেসের কাছে কাগজের টাকা ইস্যু করার যে ক্ষমতা রয়েছে তা শুধু তারই ব্যবহারের জন্য, সেটি কোনো ব্যক্তি বা করপোরেশনের হাতে অর্পণের জন্য নয়)।
আব্রাহাম লিঙ্কনেরও একই কথা ছিল : The Government should create, issue, and circulate all the currency and credits needed to satisfy the spending power of the Government and the buying power of the consumers. By the adoption of these principles, the taxpayers will be save from immense sums of interest. Money will cease to be master and become the servant of humanity” (সরকারের ব্যয়ের ক্ষমতা ও ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা পরিতুষ্ট করার জন্য সরকার সব ধরনের মুদ্রা ও ক্রেডিট সৃষ্টি, ইস্যু ও বিতরণ করবে। এই নীতিমালা গ্রহণ করা হলে করদাতারা বিপুল অঙ্কের সুদ থেকে রক্ষা পাবেন। অর্থ তখন প্রভু না হয়ে মানবতার সেবকে পরিণত হবে)।
এই উদ্ধৃতিগুলো দিয়েছি মূলত ব্যক্তির হাতে অর্থ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা যে ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে, তা বুঝানোর জন্য। আমেরিকার সেরা প্রেসিডেন্টরা পর্যন্ত এটা জানতেন। আর আব্রাহাম লিঙ্কন যে কথা বলেছেন, তাতে ইসলামের মূল্যবোধের কথাই চলে আসে। লিঙ্কন তো মুসলমান ছিলেন না। কিন্তু মানবিক বিষয়গুলো সব সভ্যতাতেই এক। ইসলাম মানবসভ্যতা ও মানবজ্ঞানেরই অংশ।
কিন্তু এতসব সতর্কবাণীর পরও ১৯১৩ সালে প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন ফেডারেল রিজার্ভ আইনে স্বাক্ষর করে আমেরিকার মুদ্রাব্যবস্থা কয়েকজন ব্যক্তির নিয়ন্ত্রিত একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেন, যা আজকে ‘ফেডারেল রিজার্ভ’ নামে পরিচিত। এটি কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক নয় যে, সরকার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এটা বলতে গেলে, একটি আর্থিক মাফিয়া চক্র পরিচালিত প্রতিষ্ঠান। আর সে কারণে পরে উইলসনই আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘আমি সবচেয়ে দুঃখী মানুষ। কারণ আমি অনিচ্ছায় আমার দেশকে ধ্বংস করেছি।’
উইলসনের ওই আইনে স্বাক্ষর করার হয়তো কারণ ছিল। হয়তো তাকেও অর্থের জন্য বেসরকারি খাতের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। আজ এই ফেডারেল রিজার্ভ আমেরিকার সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা শুধু ডলার ছাপিয়ে বাজারে ছাড়ছেন আর আমাদের মতো দেশগুলো তার পেছনে ছুটছে। যখন মিশিগানে ডক্টরেট করছিলাম, তখন আমার প্রফেসর বলতেন, ‘কোনো সমস্যা নেই। আমরা শুধু নোট প্রিন্ট করব।’ ডলারের বিপরীতে স্বর্ণ মজুদ করার কথা ছিল। কিন্তু এই নিয়মও বাতিল করা হলো। আমরা ডলার দেখলে পাগল হয়ে যাই। কিন্তু সূক্ষ্ম বিচারে এই ডলারের কোনো মূল্যই নেই। এটা ‘কাগুজে বাঘ’ মাত্র। এটাই বাস্তবতা। যে কেউ এই তথ্যগুলো যাচাই করে দেখতে পারেন। সারা দুনিয়ায় তারা এই কাগুজে বাঘ ছড়িয়ে দিয়েছেন। সে কারণেই সৌদি আরবকে তারা কব্জায় রাখতে চান।
আজ সৌদি আরব যদি বলে, তারা তেলের মূল্য হিসেবে কাগুজে ডলারের পরিবর্তে সমমূল্যের সোনা চান, তাহলে আমেরিকার পতন ঘটবে। যুক্তরাষ্ট্র এটা কোনোভাবেই সহ্য করবে না। কিন্তু আমেরিকানদের যুদ্ধশক্তির কাছে বিশ্ব হয়ে আছে অসহায়। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যবিরোধের সূচনা এখানেই। চীন এখন উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি। কারণ বাণিজ্যক্ষেত্রে আমেরিকা তার প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ‘ডকট্রিন অব কমপিটেটিভ অ্যাডভানটেজ’ বহুল পঠিত একটি বিষয়। এর মোদ্দা কথা হলো, যে যত কম দামে পণ্য তৈরি করবে, ক্রেতা তার দিকে ঝুঁকবে। একই পণ্য যুক্তরাষ্ট্র ও চীন যখন তৈরি করে, সেগুলোর মানের কিছুটা পার্থক্য থাকলেও দামের ব্যবধান থাকে কয়েক গুণ। চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে আমেরিকার জিডিপি’র ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ আসত পণ্যসামগ্রী বিক্রি থেকে। তাদের মেনুফ্যাকচারিং খাত সেরা মানের পণ্য তৈরি করত। কিন্তু পরে তারা জাপানের কাছে এই প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা হারায়। তাদের জিডিপিতে মেনুফ্যাকচারিং খাতের অবদান ১০ শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে। অনেক স্বল্পোন্নত দেশেও এর অবদান আরো বেশি। জাপান ও চীন দুটোরই উদ্ভাবনী মেধা ও কঠোর পরিশ্রমী জনবল রয়েছে। দু’টি দেশের কাছেই পরিশ্রম করা হচ্ছে ধর্মীয় অনুশীলনের মতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হেরে জাপান যুদ্ধসরঞ্জাম তৈরি থেকে মনোযোগ সরিয়ে গৃহসামগ্রী তৈরির দিকে মনোযোগী হয়। ১৯৭০-এর দশক নাগাদ আমেরিকাকে তারা এ ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধায় অনেক পেছনে ফেলে দেয়। একইভাবে ১৯৯০-এর দশকের পর থেকে চীনের উত্থান শুরু হয়। একে বলব ‘প্যারাডাইম চেঞ্জ।’
একটি জাতি কিভাবে ছোট থেকে বড় হয়। সেই শিক্ষা জাপান ও চীনের কাছ থেকে আমাদের নেয়া উচিত। অস্ত্র কেনা এবং সামরিক বাহিনীর পেছনে বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় না করে দেশের সত্যিকারের উন্নয়নের জন্য আমাদের উচিত প্রশিক্ষিত জনবল তৈরির পেছনে অর্থ ব্যয় করা। আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠী আসলে একটি বিশাল সম্পদ। এটাকে লালন করা উচিত। জাপান ও চীনের মতো দেশগুলো মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ করেছে। ফলে আজ তাদের এই পরিবর্তন। এখন আমেরিকার বেশির ভাগ ব্র্যান্ডের পণ্যসামগ্রী তৈরি করা হয় চীনে। কারণ তারা দেখেছেন, চীনে শ্রমিকদের মান খারাপ নয়। অনেক সস্তায় সেখানে ভালো মানের পণ্য তৈরি করা যাচ্ছে। বিশ্বের এই পরিবর্তনগুলো মাত্র ৭০ বছরের মধ্যে ঘটেছে। গত ৩০ বছরের মধ্যে আমেরিকা তার প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা হারিয়ে ফেলেছে।
কিন্তু একটি ক্ষেত্রে আমেরিকা সুবিধা ধরে রেখেছে- সেটি হলো উদ্ভাবন। সারা বিশ্ব থেকে নানাভাবে প্রলুব্ধ করে মেধাবী মানুষদের তারা নিয়ে গেছে। আমেরিকা খুবই কসমোপলিটন একটি সোসাইটি। সেখানে যদি ছয় মিলিয়ন মুসলমান থাকে, তাহলে দেখা যাবে দুই মিলিয়নই পিএইচডি ডিগ্রিধারী। ১০ হাজার ইহুদি থাকলে তাদের ১০ হাজারই ডক্টরেট। বিশ্বের আর কোনো দেশে এটা নেই। আমেরিকানরা এখনো উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে। এটা এ কারণে নয় যে, সাদা চামড়ার মানুষ মেধাবী, আর অন্যরা মেধাহীন। তারা মেধাপাচার করে নিয়ে যাওয়ার কারণেই এটা হয়েছে। এই উদ্ভাবনের কারণে তারা যুদ্ধশিল্পে সবাইকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছে। তাদের টিকে থাকলে হলে যুদ্ধ বাধিয়েই টিকে থাকতে হবে।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা
জরিপ বলছে অধিকাংশ নারী যৌনতায় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন অথচ ইসলাম কি বলে
প্রকাশের সময় : নভেম্বর ৮, ২০১৯, ১২:১৭ অপরাহ্ণ
রাশিদ রিয়াজ : ইদানিং যৌনতা সম্পর্কে শিক্ষা দিয়ে থাকেন এবং এক্ষেত্রে ভিকটিমদের ক্ষেত্রে যারা কাউন্সিলিং করেন তারা বলছেন অসম্মতিতে যৌনতার সময় নারীরা মারাত্মক ভীতিকর অবস্থায় পড়েন। কারণ এধরনের যৌনতার ক্ষেত্রে শুধু নির্যাতন নয়, অস্বাভাবিক শারীরিক ধকল সইতে হয় নারীকে। পশ্চিমা বিশ্বে ইদানিং ‘রাফ সেক্স’ মারত্মক এক সামাজিক সংকট তৈরি করেছে। যৌনতার সময় পাষণ্ডের মত আচরণ রীতিমত নির্যাতনের মাত্রা ছাড়িয়ে যায় বলে অনেক নারীর জন্যে তা মারাত্মক শারীরিক ক্ষতি এমনকি মৃত্যুকে বরণ করে নিতে হচ্ছে। সেক্সডল, বিভিন্ন ধরনের সেক্সটয়ের ব্যবহার মানুষকে রোবটের মত যান্ত্রিকভাবে এতটাই অমানবিক আচরণ করতে বাধ্য করছে যে নারীর পক্ষে এর ধকল সহ্য করা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ ইসলামে পুরুষকে স্ত্রীর ওপর যথেচ্ছ যৌনাচারের ফ্রি লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। ইসলামে যৌন অধিকার একতরফাভাবে পুরুষকে দেয়া হয়নি।
সুস্থবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ তা অবশ্যই বুঝবেন। এবং নিজেদের যৌনাচরণকে এমন পশুত্বের পর্যায়ে নামাবেন না যাতে তা প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দি আটলান্টিক নামে মার্কিন একটি ম্যাগাজিনের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পর্ন ছবিতে অভিনয়ের সময় একই ধরনের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় নারীকে। এধরনের পাশবিকতা যৌনতায় অতিরিক্ত পরিমানে বৃদ্ধি পাওয়ায় নারীদের মধ্যে যৌনতা নিয়ে ভীতি প্রবল হয়ে উঠছে। পর্ন ইসলাম তো বটেই আমার জানা নেই অন্য কোনো ধর্ম একে স্বীকৃতি দেয় কি না। বরং পর্ন কখনোই স্বাভাবিক যৌনতা যে নয় তা এখন প্রমাণিত। একই সঙ্গে এধরনের যৌনতা পুরুষের মধ্যেও অস্বস্তি ও বিভ্রান্তিকর বার্তা দেয়। ধর্ষণের মত ঘটনা বেড়ে যাওয়া এবং এধরনের সংকটও সামাজিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে অসম্মতিতে এধরনের রুক্ষ যৌনতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সম্মতির কোনো প্রয়োজন মনে করা হচ্ছে না। আর যতুটুক সম্মতিও আদায় করা হয় তা অনেকটাই জোরপূর্বক বা অর্থের বিনিময়ে হওয়ায় ভুক্তভোগী নারীর আর কিছুই করার থাকছে না। সমীক্ষায় এক চতুর্থাংশ মার্কিন নারী অকপটে স্বীকার করেছেন তারা যৌনতার সময় ভীতিকর অবস্থায় পড়েন।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অনেকে বুঝাতে চান যে নারীদের যৌন চাহিদার কোন মূল্য নাই, বরং এই ব্যাপারে পুরুর্ষ অর্থনীতি, সমাজ ও তার আচরণের চালিকাশক্তি হিসেবে নারীর ওপর যৌনতার নামে বর্বর আচরণ করেই ক্ষান্ত নয় এর নানাবিধ উপকরণ শিল্পরুপে পণ্য রুপে বাজারে ছাড়ছে। ব্যাপারটা এমন যে পুরুষকে যৌনতায় একতরফা অধিকার দেওয়া হয়েছে, পুরুষ যখন ইচ্ছা তখন যৌন চাহিদা পূরণ করবে আর নারী তার চাহিদা মাফিক চাহিবা মাত্র তা পূরণের জন্য সদা প্রস্তুত ও বাধ্য থাকবে। এই ধারণার পিছনে কুরআনের আয়াত এবং হাদিসের অসম্পূর্ণ পাঠের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। বস্তুত কুরআনের কিছু আয়াত বা কিছু হাদিস দেখে কোন বিষয় সম্পর্কে ইসলামের শিক্ষাকে পুরোপুরি উপলব্ধি করা সম্ভব নয়, বরং তা অনেক ক্ষেত্রেই পাঠককে বিভ্রান্ত করতে পারে। কোন বিষয় সম্পর্কে ইসলামের শিক্ষাকে সঠিকভাবে উপলদ্ধি করতে হলে সেই সংক্রান্ত কুরআনের সবগুলো আয়াত এবং সবগুলো হাদিসকে সামনে রাখতে হবে। মনে রাখবেন ইসলামে নারীদের যৌন চাহিদার অবশ্যই স্বীকৃতি আছে।
সূরা বাকারার ২২৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
نِسَاؤُكُمْ حَرْثٌ لَكُمْ فَأْتُوا حَرْثَكُمْ أَنَّى شِئْتُمْ
তোমাদের স্ত্রীরা হলো তোমাদের জন্য শস্যক্ষেত্র। অতএব তোমরা তোমাদের শস্য-ক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা গমন কর।
তার মানে কোনো বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান কৃষক তার শস্যক্ষেত্রে ভুলভাবে ব্যবহার করতে পারে না। শস্যক্ষেত্রের প্রয়োজনমাফিক যত্ন ও নিবিড় পরিচর্যা করতে বাধ্য সে। তা না হলে আশানুরুপ ফসল ফলবে না তার শস্যক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে নারীর শারীরিক দিকটি কতই না গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এ আয়াতে। অথচ হঠাৎ করে এই আয়াত কারো সামনে পেশ করা হলে মনে হতে পারে যে এখানে পুরুষকে যখন ইচ্ছা তখন তার স্ত্রীর সাথে যৌনাচার অবাধ অনুমতি দেওয়া হচ্ছে- এমনকি স্ত্রীর সুবিধা-অসুবিধার দিকেও তাকানোর কোন প্রয়োজন যেন নেই। যারা এই ধরনের ধারণার প্রচারণা চালান তারা সাধারণত এই আয়াতটি উল্লেখ করার পর তাদের ধারণার সমর্থনে কিছু হাদিসও উল্লেখ করেন, যেমন-কোন স্ত্রী যদি তার স্বামীর বিছানা পরিহার করে রাত কাটায় তবে ফেরেশতারা সকাল পর্যন্ত তাকে অভিশাপ দিতে থাকে। (মুসলিম, হাদিসের ইংরেজি অনুবাদ-৩৩৬৬)
উপরে উল্লেখিত কুরআনের আয়াতা এবং এই ধরনের কিছু হাদিস পেশ করে অনেকই এটা দেখাতে চান ইসলাম কেবল পুরুষের যৌন অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করেছে এবং নারীকে যৌন যন্ত্র হিসেবে যখন তখন যাচ্ছেতাই হিসেবে ব্যবহারের ফ্রি লাইসেন্স দিয়ে রেখেছে। সোজা কথায় ইসলামে যৌন অধিকার যেন একতরফাভাবে পুরুষের! আসলেই বিষয়টি মোটেই তা নয়।
কুসংস্কারের মূলোচ্ছেদকারি কুরআনের ২:২২৩ আয়াত এক্ষেত্রে বিভ্রান্তির নিরসন ঘটিয়ে দেয়।
মদিনার ইহুদিদের মধ্যে একটা কুসংস্কার ছিল, কেউ যদি তার স্ত্রীর সাথে পেছন দিক থেকে যোনিপথে সঙ্গম করত তবে বিশ্বাস করা হতো যে এর ফলে ট্যারা চোখবিশিষ্ট সন্তানের জন্ম হবে। মদিনার আনসাররা ইসলামপূর্ব যুগে ইহুদিদের দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত ছিল। ফলে আনসারগণও এই কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিলেন। মক্কাবাসিদের ভেতর এই কুসংস্কার ছিল না। মক্কার মুহাজিররা হিজরত করে মদিনায় আসার পর, জনৈক মুহাজির যখন তার আনসার স্ত্রীর সাথে পেছন দিক থেকে সঙ্গম করতে গেলেন, তখন এক বিপত্তি দেখা দিল। আনসার স্ত্রী এই পদ্ধতিকে ভুল মনে করে জানিয়ে দিলেন রাসূলুল্লাহ (সা:) এর অনুমতি ব্যতিত এই কাজ তিনি কিছুতেই করবেন না। ফলে ঘটনাটি রাসূলুল্লাহ (সা:) পর্যন্ত পৌঁছে গেল। এ প্রসঙ্গেই কুরআনের আয়াত (২:২২৩) নাযিল হয়, যেখানে বুঝানো হচ্ছে- সামনে বা পেছনে যেদিক দিয়েই যোনিপথে গমন করা হোক না কেন, তাতে কোন সমস্যা নেই। শস্যক্ষেত্রে যেদিক দিয়ে বা যেভাবেই গমন করা হোক না কেন তাতে শস্য উৎপাদনে যেমন কোন সমস্যা হয় না, তেমনি স্বামী তার স্ত্রীর যোনিপথে যেদিক দিয়েই গমন করুক না কেন তাতে সন্তান উৎপাদনে কোন সমস্যা হয় না এবং এর সাথে ট্যারা চোখবিশিষ্ট সন্তান হবার কোন সম্পর্ক নেই। আরো বিস্তারিত জানার জন্যে আমাদের জন্যে অনেক তাফসির রয়েছে।
এই আয়াতের উদ্দেশ্য ইহুদিদের প্রচারিত একটি কুসংস্কার দূর করা। স্ত্রীর সুবিধা অসুবিধার প্রতি লক্ষ্য না রেখে যখন তখন অবাধ যৌনাচারের অনুমোদন নয়। যারা মনে করেন কুরআনে ইহুদি খ্রিস্টানদের কিতাব থেকে ধার করা হয়েছে বা মুহাম্মাদ (সা:) ) ইহুদি খৃষ্টানদের থেকে শুনে শুনে কুরআন রচনা করেছেন, এই আয়াত তাদের জন্য বেশ অস্বস্তিকর বটে! প্রকৃত মুক্তচিন্তার মানুষ বরং এই আয়াতের প্রশংসা করে থাকেন।
ফেরেশতাদের অভিশাপ নিয়ে হাদিসটির বিশ্লেষণ
ফেরেশতাদের অভিশাপ করা নিয়ে হাদিসটা বুখারিতেও এসেছে আরেকটু পূর্ণরুপে
যদি কোন স্বামী তার স্ত্রীকে বিছানায় ডাকে (যেমন- সঙ্গম করার জন্য), আর সে প্রত্যাখান করে ও তাকে রাগান্বিত অবস্থায় ঘুমাতে বাধ্য করে, ফেরেশতারা সকাল পর্যন্ত তাকে অভিশাপ করতে থাকে। [বুখারি, ইংরেজি অনুবাদ ভলি- ৪/বুক-৫৪/৪৬০]
লক্ষ্য করলে দেখবেন যে, স্ত্রী স্বামীর ডাকে সাড়া না দেওয়ায় স্বামী রাগান্বিত হয়ে কী করছে? স্ত্রীর ওপর জোর-জবরদস্তি করে নিজের যৌন অধিকার আদায় করে নিচ্ছে? নাকি ঘুমিয়ে পড়েছে?
এই হাদিসে নারীর স্বামীর ডাকে সাড়া না দেওয়ার কারণে স্ত্রীর সমালোচনা করা হলেও পুরুষকে কিন্তু জোর-জবরদস্তি করে নিজ অধিকার আদায়ে উৎসাহিত করা হচ্ছে না। আবার স্ত্রী যদি অসুস্থতা বা অন্য কোন সঙ্গত কারণে যৌনাচার হতে বিরত থাকতে চান, তবে তিনি কিছুতেই এই সমালোচনার যোগ্য হবেন না, কেননা ইসলামের একটি সর্বস্বীকৃত নীতি হচ্ছে: আল্লাহ কারো ওপর তার সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপান না।
আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোন কাজের ভার দেন না [২:২৮৬]
আমি কাউকে তার সাধ্যাতীত দায়িত্ব অর্পন করি না। [২৩:৬২]
আসলে ইসলাম নারী ও পুরুষ উভয়কেই সতর্ক করেছে।
ইসলাম স্ত্রীদেরকে স্বামীর যৌন চাহিদার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলেছে, কিন্তু স্বামীকে নিজ চাহিদা আদায়ের ব্যাপারে উগ্র হবার কোন অনুমতি যেমন দেয়নি তেমনি স্বামীকেও স্ত্রীর যৌন চাহিদার প্রতি যত্মবান হবার নির্দেশ দিয়েছে। ইসলাম স্ত্রীকে বলেছে যদি রান্নারত অবস্থায়ও স্বামী যৌন প্রয়োজনে ডাকে তবে সে যেন সাড়া দেয়, অন্য দিকে পুরুষকে বলেছে সে যেন তার স্ত্রীর সাথে ভালো আচরণ করে, স্ত্রীর কাছে সে তার আচরণে ভালো হতে না পারলে কিছুতেই পূর্ণ ঈমানদার বা ভালো লোক হতে পারবে না। এই কথা জানার পরও কোন পুরুষ কি স্ত্রীর সুবিধার প্রতি কোনরূপ লক্ষ্য না রেখেই যখন তখন তাকে যৌন প্রয়োজনে ডাকবে? ইসলাম পুরুষকে এব্যাপারেও সাবধান করে দিয়েছে যে নিজের যৌন চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে স্ত্রীর যৌন চাহিদার কথাকে সে যেন ভুলে না যায়।
আসলে এক শ্রেণীর পুরুষ নিজে ধর্ষকামী, যান্ত্রিক মনোভাব থেকে যৌনতাকে শুধুমাত্র ভোগের বস্তু হিসেবে দেখতে যেয়ে নারীর ওপর এমন অসংযত, অন্যায়ভাবে পাশবিক আচরণ করছে। বিশেষ করে যৌনতার সময় সংবেদনকে তীব্র করতে নারীকে চড় মারা, শরীরে আঘাত করা, থুথু ছিটানো, জান্তব আচরণ আনন্দকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। অনেকের ধারণা যৌনতায় এধরনের রুক্ষ আচরণ তাকে আরো অধিকমাত্রায় উত্তেজক ও কামুক করে তোলে। কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার কারণে তা এক ধরনের মানসিক বৈকল্যের দিকে নারীকে নিয়ে যাচ্ছে। যৌনতা সম্পর্কে সঠিক রুচি ও আগ্রহ নারী হারিয়ে ফেলছে। এটি তার জন্যে রীতিমত ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আর পুরুষ যৌনতায় এধরনের আচরণ তার পক্ষ থেকে সম্ভব হচ্ছে বিভ্রান্ত হওয়ার কারণে, পর্নগ্রাফি দেখে বা তার যৌনচিন্তায় বৈকল্য ঘটে বা তথাকথিত রোবটিক সেক্স অপসংস্কৃতি নিজের ভালবাসার মানুষ বা অন্যকারো ওপরে প্রয়োগ করে সে তার ধর্ষকামী মনোভাবের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। ফলে যৌনতার এধরনের অপব্যবহার সম্পর্কে উৎসাহসূচক কোনো সম্মতি থাকছে না বা এর কোনো প্রয়োজনও মনে করা হয় না। অনুমতি নেয়া ছাড়া নারীর ওপর এধরনের আচরণ করার ক্ষেত্রে ধরেই নেয়া হচ্ছে এমন জান্তব আচরণে সে সন্তষ্ট থাকছে। আদতে তা নারীর কাছে অপ্রত্যাশিত এবং তার কাছে যৌনতা সম্পর্কে নেতিবাচক অনুভূতি তৈরি করছে। এবং এক ধরনের ভীতি তাকে তাড়া করে ফিরছে।
যৌন বিশারদরা বলছেন, সবচেয়ে ভাল জিনিস হচ্ছে সঙ্গীর সঙ্গে তার সঙ্গে কি করা হবে সে বিষয়ে কথা বলা, আনন্দের সঙ্গে ভীতিহীনভাবে সে তা গ্রহণ করছে কি না তা যাচাই করে নেয়া তা না হলে এমন অপ্রত্যাশিত আচরণ পারস্পরিক সম্পর্ক থেকে যোজন যোজন দূরে ঠেলে দিতে পারে। কারণ এধরনের আচরণের সময় নারীরা জানেও না কিভাবে সাড়া দিতে হবে, ফলে বিষয়টি একতরফা জান্তব ও বিরক্তিকর মুহুর্তের সমষ্টিতে পরিণত হয়। তার মনমানস পুরোপুরি এধরনের আচরণে বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। বরং এটাই ভাল তাকে জিজ্ঞেস করা, কি সে পছন্দ করে, রাজি কি না এবং তা হলে সম্মতির সঙ্গে পাল্টা সহযোগিতার দরজা খুলে যেতে পারে। কারণ যৌনতার পূর্ব শর্তই হচ্ছে উভয়ই এতে প্রশান্তি লাভ করবেন, পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করবেন। এজন্যে সঙ্গীর মনের ভাব জানা তার অধিকার এবং তাতে সদয় সম্মতি ও সন্মানজনক আচরণ একান্তই প্রয়োজন।
Gf

মনিষা gfdm gcJb nfkjgNDvfW gfdY
বিপদ বেশি, সহায় কম
কথায় বলে, ‘বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু।’ আমাদের জীবনে বিপদ আছে পদে পদে; কিন্তু বিপদের বন্ধু কি আছে? দেশের কোনো নাগরিক বিপদে পড়লে সাহায্য চাইবে রাষ্ট্রের কাছে; রাষ্ট্রই ব্যবস্থা রাখবে উদ্ধারের—এটাই তো স্বাভাবিক। সে ব্যবস্থা আছেও। কিন্তু কতটা কার্যকর? দেশের মানুষ কি বিপদে পড়লে রাষ্ট্রযন্ত্রের শরণাপন্ন হয়? সাহায্য পায়? পেলেও কতটা? কোনো পরিসংখ্যান আছে কি না জানা নেই। কালের কণ্ঠ চেষ্টা করেছে নিজস্ব আয়োজনে দেশব্যাপী জরিপ অনুসন্ধান চালিয়ে এবিষয়ক তথ্য-উপাত্ত বের করার। এর ভিত্তিতে যে ধারণাচিত্র পাওয়া গেছে, তার বিস্তারিত প্রতিবেদন তুলে ধরা হলো
ঘটনাটা বগুড়ায়। ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে এক সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা মারা যান, আহত মা হন চিরতরে পঙ্গু। অসহায় দুই বোন তখন হাই স্কুলে পড়ে। মায়ের চিকিৎসার জন্য ব্যয় হয় অনেক টাকা। যৌথ পরিবারে চাচারা দুই বোনের পড়ালেখা আর চালাতে চান না। জানান, যৌথ সম্পত্তিতে তাদের বাবার যে অংশ ছিল, তা এরই মধ্যে তাদের মায়ের চিকিৎসায় ব্যয় হয়ে গেছে। তাদের আর কিছু নেই। কিন্তু যেকোনো মূল্যে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প নিয়ে অসুস্থ মাকে নানার আশ্রয়ে রেখে একপর্যায়ে বগুড়ার জলেশ্বরীতলার বাড়ি ছাড়ে দুই বোন। ঢাকায় এসে দূরসম্পর্কের এক চাচার বাসায় ওঠে, যিনি ঢাকায় এলে চাকরি দেওয়ার নিশ্চয়তা দেন। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই এক রাতে সেই বাসায় ধর্ষণের শিকার হয় বড় বোন। পরদিনই সেই বাসা ছেড়ে গার্মেন্টকর্মীদের একটা মেসে ওঠে দুই বোন। বড় বোন খিলগাঁওয়ের একটি গার্মেন্টে চাকরি নেন, ছোট বোন কলেজে ভর্তি হন। ধর্ষিত হওয়ার মতো বিপদে পড়েও আইনের আশ্রয় নেননি মেয়েটি।
২. রাজধানীর বাড্ডা এলাকার মাদানী সড়কে ফুটপাতে পিঠা বিক্রি করতেন ৬০ বছর বয়সী এক নারী। গত বছর একদিন জায়গাটির ওপর কুনজর পড়ে এলাকার এক উঠতি মাস্তানের, যে পুলিশের সোর্স হিসেবে পরিচিত। প্রথমে চাঁদা দাবি, তারপর উচ্ছেদের জন্য নানা অত্যাচার। তার পরও বৃদ্ধা জায়গাটি না ছাড়লে মাদকবিরোধী অভিযানের সময় ইয়াবা বিক্রির ধুয়া তুলে দলবল নিয়ে হামলা চালায়, বৃদ্ধাকে নির্মমভাবে পিটিয়ে সব কিছু ভেঙে দিয়ে চলে যায়।
বিপদগ্রস্ত এই নারীও কারো কাছে উদ্ধার পেতে যাননি।
৩. একটি ওষুধ কম্পানির একজন বিক্রয় প্রতিনিধি সারা দিন কাজ শেষে বাসায় ফিরতে রাত ১২টা বেজে যায়। গত জানুয়ারিতে এক রাতে খিলগাঁওয়ে তাঁর মহল্লার নিরাপত্তা গেট বন্ধ হয়ে গেছে। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে নিরাপত্তাকর্মীদের ডাকার জন্য মোটরসাইকেলের হর্ন বাজাতে থাকলে এক অপরিচিত যুবক এসে ধমক লাগায়, ‘দেখছেন না, আমরা লিডারের সঙ্গে কথা বলছি। আপনি বাইক স্টার্ট রেখে আবার হর্ন বাজাচ্ছেন!’ কথা বলতে বলতেই যুবকটি বাইক বন্ধ করে চাবি নিয়ে চলে যায়। তারপর অনেক ঘটনা। সেই লিডার, যিনি একটি রাজনৈতিক দলের ওয়ার্ড শাখার সাধারণ সম্পাদক, তাঁর কাছে মাফ চেয়ে, ২০ হাজার টাকা ব্যয় করে দুই দিন পর বাইকটি ফেরত পাওয়া যায়। এই অপমান, হয়রানি ও অর্থদণ্ডের পরও ওই বিক্রয় প্রতিনিধি কারো কাছে বিচার চাওয়ার চিন্তাও করেননি।
এই ঘটনাগুলো কালের কণ্ঠ থেকে একটি জরিপ অনুসন্ধান পরিচালনাকালে পাওয়া অনেক ঘটনার কয়েকটি মাত্র। ‘আকস্মিক সমস্যায়/বিপদে পড়ে মানুষ প্রথম কার কাছে সাহায্য চায় : বিচারের জন্য কার কাছে যায়’—এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই জরিপ অনুসন্ধানটি চালানো হয়। এতে যে তথ্যগুলো প্রকট হয়ে উঠে এসেছে, তা হলো—আকস্মিক সমস্যা/বিপদে পড়ার আশঙ্কায় থাকেন দেশের ৮০.২ শতাংশ মানুষ; আর নিজেরা বিপদে পড়েছেন বলে তথ্য দিয়েছেন ৬০.৭ শতাংশ মানুষ। বিপদে পড়ে সাহায্য পেতে প্রথম কার কাছে যান, সে প্রশ্নে পাওয়া গেছে—২২.৭ শতাংশ মানুষ সাহায্যের জন্য প্রথম যান জনপ্রতিনিধির কাছে; ১৭.৮ শতাংশ যান সমাজের মুরব্বিদের কাছে; ১৩.৬ শতাংশ যান পুলিশের কাছে। বাকি ৪৫.৯ শতাংশ মানুষ অন্যান্য সহায়কের কাছে যাওয়ার কথা বলেছেন (ছক দেখুন)। জরিপে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ যে তথ্য পাওয়া গেছে, তা হলো—বিপদে পড়েও সহজে উদ্ধার বা সাহায্য পাননি ৬১.৮ শতাংশ মানুষ।
জরিপে যে চিত্রটি আরো আশঙ্কাজনক বলে উঠে এসেছে, সেটি হলো—দেশের নাগরিকদের বিপদ-আপদে ভরসাস্থল হিসেবে রাষ্ট্র যে প্রতিষ্ঠানটিকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে, সেই পুলিশ প্রশাসনের কাছে প্রথম সাহায্যের জন্য যান না ৮৬.৪ শতাংশ মানুষ, কারণ পুলিশের প্রতি আস্থা নেই তাঁদের অথচ এখনো ৪০.১ শতাংশ মানুষ মনে করেন, কাঙ্ক্ষিত সাহায্যটি পুলিশের কাছ থেকেই পাওয়া উচিত। অবশ্য তথ্য প্রদানকারীদের একটি অংশ তাঁদের ঘটনা পুলিশ-সংশ্লিষ্ট না হওয়ায় পুলিশের কাছে যাননি বলে জানিয়েছেন।
জনপ্রতিনিধি, মুরব্বি বা অন্যদের কাছে সাহায্য চাওয়ার পরও যাঁরা সমাধান পাননি, তাঁরা দ্বিতীয় চেষ্টা হিসেবেও পুলিশের সহযোগিতা চান না। দ্বিতীয় পদক্ষেপে পুলিশের সহায়তা চান মাত্র ১১.৯ শতাংশ। আবার যাঁরা পুলিশের সাহায্য চেয়েছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সাহায্য না পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। সম্প্রতি টিআইবি পরিচালিত এক জরিপে পুলিশের কাছে মানুষের সাহায্য চাওয়ার হার আরো কম পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন— বিশিষ্ট গবেষক আফসান চৌধুরী।
অন্যদিকে কোনো অন্যায়-অবিচারের শিকার হলে ন্যায়বিচার পেতে মানুষ সবচেয়ে বেশি যান গ্রাম/গোষ্ঠীর মুরব্বিদের কাছে—৪৬.১ শতাংশ। এর পরই থানা পুলিশের কাছে যান ২১.১ শতাংশ; সৃষ্টিকর্তার কাছে বিচার চান ১৪.৭ শতাংশ আর গ্রাম আদালতে যান ৮.৭ শতাংশ। আদালত তথা জজকোর্ট-হাইকোর্টে ন্যায়বিচারের জন্য যান মাত্র ৬.৮ শতাংশ মানুষ।
জরিপ অনুসন্ধানে ন্যায়বিচার পেতে কী করা উচিত—এই প্রশ্নে সবচেয়ে বেশি—৪৮.৬ শতাংশ মানুষ চেয়েছেন দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। এরপরই ২২ শতাংশ মানুষ ভরসা চেয়েছেন স্বাধীন ও উপযুক্ত বিচারব্যবস্থায়।
দেশের ৯৬৮ জন মানুষের সরাসরি সাক্ষাৎকারে দেওয়া তথ্য ও মতামতের ভিত্তিতে এই ধারণা পাওয়া গেছে। গত প্রায় দুই মাস ধরে কালের কণ্ঠ’র সারা দেশের ৫৯ জন প্রতিবেদক ও প্রতিনিধি এই জরিপকাজে অংশ নেন। ব্যক্তিপর্যায়ের তথ্য কখনো প্রকাশ করা হবে না—প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এ কারণে ঘটনা-সংশ্লিষ্টদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করা হলো না।
বিপদে পড়ে এবং ন্যায়বিচার পেতে কেন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পুলিশ প্রশাসন কিংবা আইন-আদালতের আশ্রয় নেন না মানুষ, তার কারণ অনুসন্ধানও ছিল আমাদের জরিপের বিষয়। বগুড়ার যে ঘটনাটি শুরুতেই বলা হয়েছে, সেই নারী গার্মেন্টকর্মী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বেঁচে থাকাটাই আমাদের সংগ্রাম। পুলিশের কাছে গেলে যে টাকা লাগবে, তা তো ছিল না। আর পুলিশ যে ব্যবস্থা নেবে তারই বা নিশ্চয়তা কী? তার চেয়ে নিজের দুঃখ নিজের মধ্যেই থাক।’
পিঠা বিক্রেতা নারীর বক্তব্য—‘যারা মাস্তানি করল, তারাই তো থানা পুলিশের লোক। আমরা গেলে কি পুলিশ আমাদের কথা শুনত?’
আর ওষুধ কম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধির বক্তব্য—‘পুলিশই তো ওদের পোষে। না হলে তারা এত সাহস পায় কোথায়? পুলিশের কাছে গেলে আরো বেশি ঝামেলা হতে পারে, তাই যাইনি।’
এ বিষয়ে জরিপের তথ্য কী বলছে? বিপদে পড়েও পুলিশের সহায়তা না চাওয়ার কারণ হিসেবে ২৬ শতাংশ বলেছেন আস্থা নেই। হয়রানির ভয়ের কথা বলেছেন ২৫.২ শতাংশ। প্রয়োজন পড়েনি বলেছেন ২৪.১ শতাংশ। ঘুষের ভয়ের কথা বলেছেন ১৪.৬ শতাংশ। মাধ্যম বা দালাল না থাকার কথা বলেছেন ১০ শতাংশ। আর ন্যায়বিচার পেতে আইনের আশ্রয় কেন নিতে চান না মানুষ, সে বিষয়ে অনেকে খোলাসা করে কিছু বলতে না চাওয়ায় জরিপে সংখ্যাগত উল্লেখযোগ্য কোনো তথ্য উঠে আসেনি। তবে এ বিষয়ে বিশিষ্ট গবেষক, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেছেন, ‘সার্বিকভাবে আমাদের বিচারব্যবস্থার সামাজিক বিশ্লেষণ করলে তিনটি বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। একটা হলো দীর্ঘসূত্রতা; আরেকটি ব্যয়বহুলতা; অন্যটা ফলাফলের অনিশ্চয়তা। এসব কারণে মানুষ আইন-আদালতে না গিয়ে সামাজিক ব্যবস্থা তথা সালিসি ব্যবস্থাকেই প্রাধান্য দেয়। সালিসি ব্যবস্থায় ব্যয় কম, ফলাফলটাও নিশ্চিত।
ওদিকে বিপদে পড়েও পুলিশের কাছে না যাওয়ার বিষয়টিকে পুলিশের প্রতি আস্থাহীনতার প্রকাশ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের প্রশ্ন, নাগরিকের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব যাদের, তাদের ওপরই যদি আস্থা না থাকে তাহলে মানুষ যাবে কোথায়?
নাগরিক আন্দোলনের নেতা, বিশিষ্ট গবেষক-বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আবুল মকসুদের মতে, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হওয়ার কারণেই পুলিশ প্রশাসনের প্রতি আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশ রাষ্ট্রের হয়ে, জনগণের হয়ে কাজ করার বদলে সরকারি দলের সহযোগী হয়ে কাজ করছে। এ কারণে মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। বিষয়টি খুবই গুরুতর। আরো দুটি কারণ আছে। প্রথমত—আইনি জটিলতা। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ পুলিশের জেরার মুখে নিজের ক্ষতির প্রমাণ কিভাবে দেবে, তা নিয়ে ভীতির মধ্যে থাকে। আরো যদি বিপদগ্রস্ত হতে হয়, তাঁকেই যদি ফাঁসিয়ে দেয় পুলিশ—এই ভয়ে থাকে। দ্বিতীয়ত—পুলিশেরই একটা শ্রেণি বিপদগ্রস্তকে সাহায্য না করে তার কাছ থেকে উল্টো সুবিধা আদায় করতে চায়; নিজেরাও অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। ফলে উপকার পাওয়ার চেয়ে আরো বেশি ঝামেলায় জড়িয়ে যাওয়ার ভয়ের মধ্যে থাকে বিপদগ্রস্তরা।’
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান মনে করেন, ‘সার্বিকভাবে বিষয়টি খুবই অস্বস্তিকর। বিপদে সহায়তা পাওয়া, নিরাপত্তা পাওয়া মানুষের নাগরিক অধিকার। কিছু বিপদ হয়তো আকস্মিক ঘটে যাচ্ছে, আবার কিছু বিপদ আছে পরিবেশগত—মাস্তানতন্ত্র, ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলে ভয়ভীতির পরিবেশ তৈরি হয়, যা বিপদ তৈরি করে। যে পরিবেশ বিপদ তৈরি করে সেখানে মানুষ পুলিশকে বিপদ তৈরির সহায়ক মনে করছে অথবা পুলিশকে অসহায় মনে করছে। ভাবছে, এরা হয়তো জিম্মি, কিছুই করতে পারবে না। সে কারণে পুলিশের কাছে যেতে আস্থা পাচ্ছেন না। এমন না যে, পুলিশের কারিগরি দক্ষতার ঘাটতি আছে। আবার পুলিশের কাছে যাওয়ার প্রক্রিয়াগুলোও জনবান্ধব নয়। একজন নারী বিপদে পড়লে যে পুলিশের আশ্রয় নেবেন, থানাগুলো তো অতটা নারীবান্ধব নয়। প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণেও মানুষ উৎসাহবোধ করে না। আরেকটা হচ্ছে—সেবার মানসিকতার ঘাটতি। ওখানে গিয়ে ফলাফল পাওয়া সম্পর্কেও আস্থাহীনতা আছে। কিন্তু পুলিশের সেবার চাহিদাটা মানুষের কাছে প্রকট আকারে আছে।’
পুলিশের ওপর মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা জরুরি বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা। এই আস্থা ফিরিয়ে আনার করণীয় সম্পর্কে সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘আস্থা ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব প্রথমত পুলিশ বিভাগকেই নিতে হবে। পুলিশের মনোভাবগত পরিবর্তন আনতে হবে। বিপদগ্রস্তকে আরো বিপদে ফেললে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয়ত—রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দরকার। হয়রানি যাতে না করতে পারে তার জন্য রাজনৈতিক অঙ্গীকার দরকার। পুলিশ হয়রানি করলে, কোনো অপরাধে জড়ালে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আর রাজনৈতিক স্বার্থে পুলিশকে ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।’
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘পুলিশের ওপর মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনাটা অত্যন্ত জরুরি। বিপদ সৃষ্টির পরিবেশগত কারণটা সার্বিক সুশাসনের বিষয়। আইনের শাসন কতটা জোরদার, তার প্রতিফলন থাকতে হয়। পুলিশ যে ক্ষমতার অপব্যবহারের সঙ্গে জড়িত নয়, সহায়ক নয়—এ বিষয়টি পুলিশেরই পরিষ্কার করা দরকার। পুলিশ যদি ক্ষমতার অপব্যবহারকারীদের হাতে জিম্মি হয়ে থাকে; সহায়ক হয়ে যায়; ক্ষমতাবলয়ের সঙ্গে জড়িয়ে যায়; অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে যায়, তাহলে আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়। সবাই হয়তো নয়, কিন্তু এই জায়গায় একটা সংস্কার দরকার। দুই নম্বর হচ্ছে—পুলিশি প্রক্রিয়াগত জটিলতা, ব্যয়বহুলতা দূর করে নিরাপত্তা সেবাটাকে জনবান্ধব, নারীবান্ধব করার ক্ষেত্রে অনেক সংস্কারের প্রয়োজন আছে। নাগরিকদের নিজেদের সচেতনতাও জরুরি। কখন কী করতে হবে, অনেকেই জানে না। নাগরিক সেবার ৯৯৯-কে আরো কার্যকর করাও জরুরি।
এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, পুলিশ চেষ্টা করছে মানুষের আস্থা অর্জনের। এ জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের কথাও তিনি জানিয়েছেন। তাঁর মতে, দেশের মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় নেই। শান্তিতে আছেন; নিরাপদে আছেন।

মন্তব্য
‘ছয় বছরে ৮০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে’
দারিদ্র্য বিমোচন ও মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির কারণে বাংলাদেশে ২০১০ থেকে ২০১৬ সময়ে ৮০ লাখ মানুষ দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে এসেছে। এর বেশিরভাগই সম্ভব হয়েছে শ্রম আয় বৃদ্ধির কারণে।
সোমবার (৭ অক্টোবর) সকালে রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে বাংলাদেশ পোভার্টি অ্যাসেসমেন্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরে বিশ্বব্যাংক।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দারিদ্র্য বিমোচনের ৯০ শতাংশই গ্রামে হয়েছে। শহরে দারিদ্র্য কমেছে সীমিত হারে। এছাড়া অতিদারিদ্র্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে শহরের লোকের সংখ্যা একই রয়ে গেছে। ফলে জাতীয় দারিদ্র্য বিমোচনে ধীরগতি। জোরালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের দারিদ্র্য কমাচ্ছে। তবে তুলনামূলক কম গতিতে।
কৃষি নয়, গ্রাম অঞ্চলে দারিদ্র্য কমাতে শিল্প ও সেবা খাত অবদান রেখেছে। আলোচ্য সময়কালে কৃষি প্রবৃদ্ধি ধীর ছিল এবং সবচেয়ে কম দারিদ্র্য বিমোচনে অবদান রেখেছে।
শহরাঞ্চলে ম্যানুফ্যাকচারিং বা উৎপাদন খাত বিশেষত তৈরি পোশাক খাত দারিদ্র্য কমাতে শীর্ষ স্থানীয় ভূমিকা রেখেছে। এদিকে, উৎপাদন খাতে কর্মসংস্থানের ধীর গতির কারণে সুবিধা পেতে পারতো এমন পরিবার অংশ চিহ্নিত হয়েছে। অন্যদিকে, সেবাখাতে আত্মকর্মসংস্থানে নিহতদের মধ্যে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। যা নগর দারিদ্র্য কমানোর ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করেছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি বলেন, সরকারের অন্যতম শত্রু দারিদ্র্যতা। দারিদ্র্য বিমোচনে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশ সঠিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে আমরা ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলবো। এ সময় দরিদ্র মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
মানবকণ্ঠ/এএম

নিউজ ডেস্ক : সন্ত্রাসবাদ দমনে জিরো টলারেন্স ও হলি আর্টিজানের পর জোরালো পদক্ষেপ নেয়ায় বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ সূচকে ৬ ধাপ উন্নতি হয়েছে বাংলাদেশের। ভোরের কাগজ
অস্ট্রেলিয়ার সিডনিভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিকস এন্ড পিস প্রকাশিত গ্লোবাল টেরোরিজম ইনডেক্স বা বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ সূচকে (আইইপি) ৮২ দেশের মধ্যে এখন ৩১তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে তুলনামূলক সন্ত্রাসী তৎপরতা কমে আসে। গত বছর বাংলাদেশে মোট ৩১টি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে, যাতে প্রাণ হারান ৭ জন। ২০১৭ সালের তুলনায় গত বছর সন্ত্রাসী হামলায় নিহতের সংখ্যা কমে প্রায় ৭০ শতাংশ।
এতে বলা হয়, হলি আর্টিজান হামলার পর ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কৌশল নিয়ে বাংলাদেশকে নতুন করে ভাবতে হয়েছিলো। হলি আর্টিজানের হামলায় সাত জাপানি ও ইতালির নাগরিক নিহত হওয়ার পর প্রথম ছয় মাস বাণিজ্য খাতে সেই হামলার বেশ প্রভাব পড়েছিলো, যা দেশটিকে এক প্রান্তে ঠেলে দেয়।
হলি আর্টিজান হামলার ৩ বছরে বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ দমনে নানা পদক্ষেপ নেয়। সরকার সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করে। দ্রুত পরিবর্তনশীল দেশের সামগ্রিক অবস্থাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষায় বাংলাদেশ দারুণভাবে লড়াই চালিয়েছে, যার ফলে সন্ত্রাসবাদের বৈশি^ক সূচকে দেশটির এমন উন্নতি।
প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সন্ত্রাসবাদ দমনে বাংলাদেশের উন্নতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ২০১৭ সালে যে আটটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন বিশ^জুড়ে হামলা চালায় তার মধ্যে ৫টি ২০১৮ সালে বাংলাদেশে কোনো হামলা চালায়নি। তাদের মধ্যে বিশে^র সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী সংগঠন ইসলামিক স্টেটও (আইএস) রয়েছে।
বাংলাদেশের বিপরীতে সন্ত্রাসবাদের তালিকায় প্রথম স্থানে থাকা আফগানিস্তানে ২০১৮ সালে সবচেয়ে বেশি সন্ত্রাসী কর্মকাÐ ঘটে। প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে প্রথম স্থানে নাম রয়েছে আফগানিস্তানের। ২০০৮ সালে দেশটিতে সন্ত্রাসী হামলায় যে নিহতের সংখ্যা ছিল তা বিগত সময়ে বেড়েছে প্রায় ৬৩১ শতাংশ। বিশে^র প্রতি বিশটি ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার মধ্যে ১৬টিই হয় আফগানিস্তানে। এরপর ৭ হাজার ৩৭৯ মৃত্যু নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ইরাক। পরে নাইজেরিয়া, সিরিয়া, পাকিস্তান ও সোমালিয়ার অবস্থান। বৈশি^ক সন্ত্রাসবাদ সূচকে ভারতের অবস্থান এখন সপ্তম।
‘ক্ষুধা সূচকে ভারত-পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ’
কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক এমপি বলেছেন, জনসংখ্যা দিনদিন বড়লেও কমছে কৃষিজমি। একই সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। ধান, গম ও ভুট্টা বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলেছে। সবজি উৎপাদনে তৃতীয় আর চাল ও মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে। বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও দুর্যোগসহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষে। ক্ষুধা সূচকে ১১৭টি দেশের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ এখন ৮৮তম অবস্থানে।
সোমবার সিরডাপ মিলনায়তনে বিশ্ব ক্ষুধা সুচক ২০১৯’এর প্রকাশ অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ পুষ্টি কাউন্সিলের মহাপরিচালক ডা. শাহ নেওয়াজ, কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড’এর কান্ট্রি ডিরেক্টর একেএম মুসা, হেলভেটাস বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর উম্মে হাবিবা। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাতীয় পুষ্টি সেবার লাইন ডাইরেক্টর ডা. এসএম মোস্তফিজুর রহমান।
কৃষিবান্ধব প্রধানমন্ত্রীর সময়পযোগি পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে কৃষিতে বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয় উল্লেখ করে কৃষিমন্ত্রী ড. রাজ্জাক বলেন, বাংলাদেশ শুধু খাদ্যে নয় এমডিজি’র লক্ষ্য প্রায় সবগুলো অর্জন করেছে। তাইতো বাংলাদেশ ১১৭টি দেশের মধ্যে ক্ষুধা সুচকে ৮৮তম হয়েছে, স্কোর ২৫.৮। যেখানে ২০০০ সালে ছিল ৩৬। এসকল দেশের মধ্যে ৪৭টি দেশের অবস্থা মারাত্মক। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে ধারাবাহিকভাবে। মোট স্কোর গতবারের ২৬.১ থেকে কমে হয়েছে ২৫.৮। তারপরও বাংলাদেশ বৈশ্বিক অবস্থানে দুই ধাপ পিছিয়েছে, কারণ অন্যদের উন্নতি ঘটছে আরও দ্রুতগতিতে। বাংলাদেশ ছাড়া দক্ষিণ এশীয় অন্যান্য দেশের মধ্যে ভারত ১০২, পাকিস্তান ৯৪, নেপাল ৭৩, মিয়ানমার ৬৯ এবং শ্রীলঙ্কা ৬৬তম অবস্থানে রয়েছে।
মন্ত্রী বলেন, সরকার সামাজিক নিরাপত্তার নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ফলে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশে সার্বিকভাবে উন্নতির দিকেই রয়েছে। বাংলাদেশ শিশু মৃত্যু হ্রাসে ভালো করেছে এবং অন্যান্য সুচকে বাংলাদেশ ভালে করবেই। পুষ্টিহীনতা, শিশু খর্বাকার এবং শিশু মৃত্যু হার হ্রাস পেয়েছে বাংলাদেশে। অর্থনৈতিক বিকাশ, পিতামাতার শিক্ষায় এবং স্বাস্থ্য উন্নয়নে সাফল্যে, স্যানিটেশন এবং জনতাত্বিক উন্নয়নের ফলে দেশে খর্বাকার শিশু, শিশু মৃত্যু হার হ্রাস পেয়েছে। নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য একটি চেইন, এখানে কৃষক ভোক্তা সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যাপারগুলো জড়িত।
কৃষিমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম ঝুকিপুর্ণ দেশ হওয়া সত্তেও খাদ্য উৎপাদনে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন লক্ষ্য আধুনিক কৃষি, বানিজ্যিক কৃষি এবং নিরাপদ কৃষি। সবার জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিমান সম্পন্ন খাদ্য নিশ্চিত করতে সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ। সরকার যে কোন মুল্যে তা করবে। শহরের সকল সুযোগ সুবিধা গ্রামে নিয়ে যাওয়া হবে। কৃষি যান্ত্রকিকরণের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করা হবে। বঙ্গবন্ধু কন্যা মানবতার মা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসনিার হাতে দেশ যত দিন আছে- এদেশ থেকে ক্ষুধা দারিদ্র দুর হবেই। বাংলাদেশ হবে বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা।
প্রসঙ্গত. বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে কোনটির জনগণ কতটা খাদ্যাভাব অর্থাৎ ক্ষুধায় পীড়িত, তা তুলে ধরা হয় বিশ্ব ক্ষুধা সূচক বা গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে। এই সূচকে ০ থেকে ১০০ পয়েন্টের মাপকাঠিতে দেশগুলোকে ফেলে যাচাই করা হয় কোন দেশটি কতটা ক্ষুধাপীড়িত। এই মাপকাঠিতে ০ হচ্ছে সবচেয়ে ভালো স্কোর, যার অর্থ সেই দেশটিতে ক্ষুধা নেই, আর ১০০ হচ্ছে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা। ১০’এর কম স্কোর হলো ক্ষুধা সমস্যা কম। ২০ থেকে ৩৪.৯ স্কোরের অর্থ তীব্র ক্ষুধা, ৩৫ থেকে ৪৯.৯ অর্থ ভীতিকর ক্ষুধা আর ৫০ বা তার বেশি স্কোর বলতে বোঝায় চরমভাবে ভীতিকর ক্ষুধায় পীড়িত দেশকে।
প্রতিটি দেশের পরিস্থিতি বিচার করে চারটি মাপকাঠিতে গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স (জিএইচআই) তৈরি হয়েছে। অপুষ্টি, ৫ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে কম ওজনের শিশু, ৫ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে কম উচ্চতার শিশু, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যু-এই চারটি মাপকাঠিতে প্রতিটি দেশের স্কোর হিসাব করা হয়েছে ১০০ পয়েন্টের ভিত্তিতে।
চলতি বছরসহ ৫ বছরে অবস্থানে খুব সামান্য তারতম্য হলেও দীর্ঘমেয়াদি চিত্রে ফুটে উঠেছে বাংলাদেশের ক্রমোন্নতির চিত্র। ২০০০ সালে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ১০০’র মধ্যে ৩৬.১, অর্থাৎ ‘ভীতিকর’। এর ৫ বছর পর, ২০০৫ সালের সূচকে সেই স্কোর কমে ৩০.৭-এ দাঁড়ায়। অর্থাৎ বাংলাদেশ ‘ভীতিকর’ থেকে ‘তীব্র’ ক্ষুধাপীড়িত দেশের পর্যায়ে চলে আসে। আরও ৫ বছর পর অর্থাৎ ২০১০ সালে স্কোর সামান্য একটু কমে ৩০.৩ হয়। আর তারপর টানা ৯ বছরের ব্যবধানে এবারের সূচকে বাংলাদেশ পেল ২৫.৮, যা ধারাবাহিক উন্নতিকেই সামনে এনেছে।
________________________________________
রাস্তায় পড়ে থাকা জুতার বাক্সে সাড়ে ১১ লাখ টাকা!
ইত্তেফাক রিপোর্ট ০৪:১৪, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৯
রাস্তায় পড়েছিল সুন্দর একটা শপিং ব্যাগ। কৌতূহলবশত ব্যাগটি হাতে তুলে নেন লাইব্রেরি ব্যবসায়ী সেন্টু। ব্যাগের ভেতর জুতার একটি বাক্স দেখতে পান তিনি। আর বাক্সটি খুলতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠে তার। বাক্সভর্তি সব ৫০০ টাকার বান্ডিল। ঘটনাটি গত ১২ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৭টার। রায়েরবাজার হাইস্কুলের সামনে রাস্তায় পড়েছিল ব্যাগটি।
এতগুলো টাকা দেখে প্রথমে কিছুক্ষণ হতবিহ্বল হয়ে পড়েন তিনি। তবে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেননি সেন্টু। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যান নিউমার্কেট থানায়। টাকাভর্তি ব্যাগটি জমা দেন থানার ওসির কাছে। গুনে দেখা যায় সেখানে ৫০০ টাকার ২৩টি বান্ডিলে মোট সাড়ে এগারো লাখ টাকা আছে। ওসিও দেরি করেননি করণীয় নির্ধারণে। টাকার প্রকৃত মালিককে খুঁজে বের করার জন্য ঢাকার সব থানায় বেতার বার্তা দেন তিনি। বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করেন বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে। একপর্যায়ে জানা যায় মো. হারুন অর রশিদ গত ১২ ডিসেম্বর, সাড়ে ১১ লাখ টাকা হারিয়ে গেছে মর্মে হাজারীবাগ থানায় একটি জিডি করেন। তিনি একজন কেমিক্যাল ব্যবসায়ী।
এভাবে টাকার প্রকৃত মালিককে খুঁজে বের করে নিশ্চিত হয়ে গত মঙ্গলবার রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. সাজ্জাদুর রহমানের উপস্থিতিতে টাকার প্রকৃত মালিক হারুন অর রশিদকে টাকা বুঝিয়ে দেয় নিউমার্কেট থানা পুলিশ।
ইত্তেফাক/বিএএফ
• টাকার ব্যাগ
PreviousPauseNext

চীনা নাগরিক হত্যাকাণ্ড
টাকা লুটের জন্যই খুন করে দুই নিরাপত্তাকর্মী
নিজস্ব প্রতিবেদক
১৯ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ | পড়া যাবে ৪ মিনিটে
প্রিন্ট

Kalarkhonto-19-12-19
রাজধানীর বনানীতে চীনা নাগরিক গাওজিয়ান হুইকে (৪৭) শ্বাসরোধে হত্যার পর লাশ বাড়ির পেছনে পুঁতে রাখার ঘটনায় তোলপাড় শুরু হলেও বাড়িটির নিরাপত্তাকর্মীদের কেউ পালিয়ে যায়নি। এর মধ্যে তদন্ত এগোচ্ছিল ব্যাবসায়িক বিরোধ এবং ব্যবসার টাকা আত্মসাতের সন্দেহের দিকে। শেষ পর্যন্ত জানা গেল, এসব নয়, বাড়িটির দুই নিরাপত্তাকর্মীই নগদ টাকা আত্মসাতের লোভে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। অথচ হত্যাকাণ্ডের পর নিরাপত্তাকর্মীরা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে নির্বিকার জবাব দিয়েছিল।
পুলিশ জানায়, হত্যায় অভিযুক্ত নিরাপত্তাকর্মীদের মধ্যে আব্দুর রউফ (২৬) এ কয়দিন পুলিশ ও সাংবাদিকদের নানা তথ্য দিয়ে সহায়তা করে। বাড়ির নিরাপত্তার ঘাটতিসহ কিছু বিষয়ে সন্দেহ থাকায় তাকেসহ ছয়জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে যাচ্ছিল পুলিশ। তবে জিজ্ঞাসাবাদে কিছুই জানে না—এমন ভাব দেখায় রউফ। নিহতের টাকা আত্মসাতের তথ্য মেলায় তখন তদন্তে ব্যাবসায়িক বিরোধকেই গুরুত্ব দেয় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ঘটনার রাতে বাড়িতে থেকেও অনেক বিষয়ে তথ্য না দেওয়ায় সন্দেহের আওতায় আসে রউফ। তদন্তে ধরা পড়ে রফের সন্দেহজনক যোগাযোগ। তবু জিজ্ঞাসাবাদে সে ছিল স্বাভাবিক। আটকের পর দেখা যায়, তার হাতে রয়েছে কামরের দাগ। পরে ডিবি পুলিশ গত মঙ্গলবার আব্দুর রউফ ও তার সহযোগী নিরাপত্তারক্ষী এনামুল হককে (২৭) গ্রেপ্তার করে। এরপর তারা অকপটে স্বীকার করতে থাকে হত্যার দায়। এভাবেই চীনা নাগরিক গাওজিয়ান হুই হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করেছে ডিবি।
গ্রেপ্তারকৃত এই দুজনই সুবাস্তু হাউজিং কম্পানির নিরাপত্তাকর্মী। তাদের কাছ থেকে নিহতের ব্যবহৃত একটি ভাঙা মোবাইল, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত গামছা, বালতি ও লাশ মাটিচাপা দেওয়ার জন্য গর্ত খোঁড়ার কাজে ব্যবহৃত কাঠের টুকরা এবং এক লাখ ২১ হাজার ৫০০ টাকা উদ্ধার করা হয়। গতকাল বুধবার বিকেলে দুজনকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে ১০ দিন করে রিমান্ড আবেদন করা হয়। শুনানি শেষে মহানগর হাকিম তোফাজ্জল হোসেনের আদালত চার দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।
হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে গতকাল দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে পুলিশ।
যেভাবে হত্যাকাণ্ড : তদন্তকারীরা বলেন, বিত্তবানদের জীবনযাপন দেখে হতাশা থেকে দুজন রাতারাতি ধনী হওয়ার মতো কিছু করার সিদ্ধান্ত নেয়। দুজনই ওই ভবনের ছাদে থাকত। একসঙ্গে চাকরির সুবাদে তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একজনের বাড়ি নড়াইলে এবং অন্যজনের বাড়ি ঝিনাইদহে। তারা সম্প্রতি একাকী থাকা গাওজিয়ান হুইকে হত্যা করে তাঁর বাসা থেকে টাকা লুট করে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে রউফ ও এনামুল।
অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল বাতেন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, গত ৬ ডিসেম্বর একবার তারা গাওজিয়ানকে হত্যার জন্য গেলেও বাসার দরজা না খোলায় ফিরে আসে। পরে ৯ ডিসেম্বর এনামুল তার নিজের ব্যবহৃত গামছা সঙ্গে নিয়ে যায়। মাগরিবের আজানের পর তারা গাওজিয়ানের ফ্ল্যাটের কলিংবেল চাপে। গাওজিয়ান ইশারায় জানতে চাইছিলেন যে কী বিষয়। তখন এনামুল ‘ওয়াটার ওয়াটার’ বলে বোঝাতে চায় যে তারা পানি খাবে। মুহূর্তের মধ্যেই তারা ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং এনামুল গলায় গামছা পেঁচিয়ে ধরে। রউফ কোমরের দিকে জাপটে ধরে। অল্প সময়ের মধ্যেই গাওজিয়ানের নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়ে যায়। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে গাওজিয়ান রউফের বাঁ হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি কামড়ে দেয়। তারা দু-তিন মিনিটের মধ্যেই গাওজিয়ানের মৃত্যু নিশ্চিত করে। বসার ঘরে টেবিলের ওপরে তাঁর ল্যাপটপ খোলাই ছিল এবং পাশে ছিল একটি ছোট ব্যাগ। রউফ ওই ব্যাগটি খুলে সেখানে থাকা তিনটি ১০০০ টাকার বান্ডিল, কিছু খুচরা টাকা ও মোবাইল নিয়ে নেয়। এরপর মৃতদেহ রেখে ছাদে চলে যায়।
রাত ১১টার দিকে ভবন একটু সুনসান হলে রউফ পেছনে গিয়ে বালুমাটিতে কাঠের টুকরা দিয়ে গর্ত করে। এরপর নিজে একাই গাওজিয়ানের লাশ লিফটে করে নিচে এনে মাটিচাপা দেয়।
দ্বীন মানতে হবে পূর্ণভাবে
আমাদের জীবন কিছু সময়ের সমষ্টি। প্রতিনিয়ত তা ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। বরফ বিক্রেতার যেমন সময় যত অতিক্রান্ত হয় তার পুঁজি তত নিঃশেষ হয়ে যায়, আমাদের জীবনও ঠিক তেমনি। যত দিন যাচ্ছে, আমাদের হায়াত তত হ্রাস পাচ্ছে। অর্থাৎ আমরা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। মৃত্যুর ব্যাপারে আস্তিক-নাস্তিকের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সবাই স্বীকার করে, জন্মেছি যেহেতু মৃত্যু একবার আসবেই।
নাস্তিকের কথা বাদ দিলে আমরা যারা মুসলিম তারা সবাই বিশ্বাস করি যে, এ মৃত্যুই শেষ নয়, এরপর আরেকটি জগৎ আছে, যেখানে দুনিয়ার কৃতকর্মের বদলা দেয়া হবে। এখন আমরা দেখি বিশ্বাসীদের জীবনে দ্বীন পালনের অবস্থা কেমন। আমাদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ দ্বীনের কোনো বিধিবিধানই মান্য করি না। নামাজ-রোজা-জাকাত-হজ বা উপার্জনে হালাল-হারাম কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করি না। মাঝে মধ্যে জুমার নামাজ বা বছরে দু’বার ঈদের নামাজ আদায় করে থাকি। বিধিবিধান পালনের কথা বললে তাদের জবাব হয়, নামাজ না পড়লেও আমাদের ঈমান ঠিক আছে। অথচ কুরআন ও হাদিসের বর্ণনা মতে, নামাজ আদায় মুসলমান হওয়ার জন্য ন্যূনতম শর্ত। হাদিসের ভাষা হলো- ‘যে ইচ্ছাকৃতভাবে নামাজ ছেড়ে দিলো সে কুফরি করল।’ রাসূল সা: ও সাহাবায়ে কেরামের যুগে কেউ জামাতে হাজির না হলে মনে করা হতো, সে ঈমানহারা হয়ে গেছে। কুরআনে নামাজ না পড়াকে জাহান্নামে যাওয়ার কারণ বা পরকাল অবিশ্বাসের ফলশ্রুতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমনÑ সূরা মুদ্দাসসিরে বলা হয়েছে, ‘জাহান্নামিদের জিজ্ঞেস করা হবে- কোন জিনিস তাদেরকে জাহান্নামে নিয়ে এলো?’ তারা বলবে, ‘আমরা নামাজি লোকদের মধ্যে গণ্য ছিলাম না।’ সূরা বাকারায় বলা হয়েছেÑ ‘নামাজ নিঃসন্দেহে কঠিন কাজ। কঠিন নয় আল্লাহর সেসব অনুগত বান্দাহদের, যারা আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের ভয় রাখে।’
আমাদের সমাজে এমন চরিত্রের লোকের সংখ্যাই বেশি। আরেক দল রয়েছে, যারা ইসলামকে দ্বীন ও দুনিয়া- দু’টি ভাগে ভাগ করে নিয়েছেন। তারা নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, তাসবি-তাহলিল, জিকির-আজকার, মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ, মিলাদ-ওয়াজ মাহফিল ইত্যাদি যেসব কাজে দ্বীনদারির রঙ রয়েছে তাতে মোটামুটি নিষ্ঠাবান। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, লেনদেন, আচার-আচরণ, আত্মীয়স্বজনসহ মানুষের হক আদায়ে তত নিষ্ঠাবান নন। অনেক সময় অর্থনীতি ও রাজনীতির অঙ্গনে ইসলামের দুশমনদের সাথেই তাদের নিবিড় সম্পর্ক। এরা বিশ্বাসগতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ। তাদের সেøাগান- ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার। ধর্মকে ব্যক্তিগত বিষয় বিবেচনা করে সমাজ ও রাষ্ট্রে ধর্মের প্রভাব তারা অস্বীকার করেন। অথচ আল্লাহ পাক ইসলামকে একমাত্র দ্বীন ও পূর্ণরূপে ইসলামে দাখিল হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। ইসলামে ধর্মনিরপেক্ষতার কোনো সুযোগ নেই।
মানবজীবনের ব্যাপ্তি যতখানি, ইসলাম ঠিক ততখানি। ইসলামের দাবি হলো- অংশবিশেষ নয়, সম্পূর্ণটাই মানতে হবে। আমাদের লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, আচার-আচরণ সবক্ষেত্রে ইসলামের সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে এবং তা মেনে চলা নামাজ-রোজার মতোই ফরজ। যেমন- একজন ব্যবসায়ী অবশ্যই সঠিক পরিমাপের সাথে কোনো ধোঁকা-প্রতারণার আশ্রয় নেবে না বা ভেজাল দেবে না বা ফরমালিন মেশাবে না। অর্থাৎ ক্রেতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা তার হক নষ্ট হয় এমন কিছু করবে না। একজন চাকরিজীবী কেবল সময়মতো অফিসই করবে না, সাথে সাথে সে অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করবে এবং যে কাজ আধা ঘণ্টায় সম্ভব সে কাজে কখনোই এক ঘণ্টা লাগাবে না। আর তা করা হলে সেটা হবে সুস্পষ্ট জুলুম। ঘুষ নেয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না এবং তা হবে জ্বলন্ত আগুন ভক্ষণ করার শামিল। ঘুষদাতা ও গ্রহীতা যে জাহান্নামি, সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। অফিস-আদালতে খেয়ানত একটি সাধারণ ব্যাপার হয়ে পড়েছে। খেয়ানত প্রসঙ্গে রাসূল সা: বলেছেন, ‘আমরা যখন কাউকে দায়িত্ব প্রদান করি, সে যদি এক টুকরো সুতা বা তার চেয়েও কোনো ক্ষুদ্র জিনিস খেয়ানত করে তবে কিয়ামতের দিন খেয়ানতের বোঝা মাথায় করে সে উত্থিত হবে। আর কর্তব্যকর্মে ফাঁকি দেয়া পূর্ণ মুসলমান কল্পনাও করতে পারে না। কারণ, কর্মস্থলে বিলম্বে উপস্থিতি আর মসজিদে নামাজের জামাতে বিলম্ব দুটোতেই গুনাহ রয়েছে। তবে গুনাহের পরিমাণ কোনটাতে বেশি সেটা বলা মুশকিল। কারণ মানুষকে পূর্ণাঙ্গভাবে আল্লাহর গোলামির মধ্যে নিয়ে আসার জন্যই ফরজ করা হয়েছে নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাতের মতো আনুষ্ঠানিক ইবাদত-বন্দেগি। নামাজের জন্যও নামাজ নয়, আবার রোজার জন্যও রোজা নয়। আল্লাহর বাণী, ‘নিশ্চয়ই আমি মানুষকে কেবল আমার গোলামির (ইবাদত) জন্যই সৃষ্টি করেছি।’ একজন গোলাম তখনই তার মনিবের গোলামি করতে পারে যখন সে তার মনিবকে স্মরণ ও ভয় করে। নামাজ মানুষের মধ্যে আল্লাহর স্মরণ জাগরূক রাখে। মুয়াজ্জিনের আজানধ্বনিতে একজন মুমিনের ঘুম ভাঙে। নামাজের দিকে এসো, কল্যাণের দিকে এসো- এ আহ্বানে সে ছুটে আসে মসজিদপানে এবং মসজিদে উপস্থিত হয়ে প্রমাণ করে, সে একজন মুসলিম। হাত বেঁধে অত্যন্ত নম্র ও বিনয়ের সাথে ওয়াদা করে যে- ‘আমরা কেবল তোমারই গোলামি করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য চাই।’ একবার-দু’বার নয়, নানা কর্মব্যস্ততার মাঝে বারবার মসজিদে এসে তাকে একই প্রতিশ্রুতি প্রদান করতে হয়।
এ মুমিন কিভাবে আল্লাহর নাফরমানি করবে? লজ্জা বলতে তো কিছু আছে। বারবার আল্লাহর গোলামির কথা স্মরণ করিয়ে দেয় বলেই নামাজকে জিকর বলা হয়েছে। এ নামাজের মধ্য দিয়েই বান্দাহ সারাক্ষণ আল্লাহকে স্মরণ করে। আল্লাহর ভাষায়- ‘তোমরা নামাজ সমাপনান্তে রুজির জন্য বেরিয়ে পড়ো আর আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করো।’ অর্থাৎ আমি যে কাজই করি না কেন; সে কাজে আল্লাহর দেয়া নিয়ম ও বিধিবিধান অনুসরণ করার নামই আল্লাহর স্মরণ। এ স্মরণ সর্বক্ষণ- সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত এবং সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয়। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা শোয়া, বসা ও দণ্ডায়মান অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করো।’ মানুষ এ তিন অবস্থার বাইরে থাকতে পারে না। কোনো একটি মুহূর্ত বা কোনো একটি কাজের ব্যাপারে মুমিন ধর্মনিরপেক্ষ থাকতে পারে না। যখনই সে কোনো বিষয়ে ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে যায়, তখনই সে আল্লাহর গোলামির বাইরে শয়তানের গোলামিতে চলে যায়। আর আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা শয়তানকে অস্বীকার করে কেবল আমারই আনুগত্য করো।’ নামাজ যেমন মানুষকে বারবার আল্লাহর গোলামির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, তেমনি রোজা মানুষের মধ্যে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি করে। রোজা মাসব্যাপী এক প্রশিক্ষণ। সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সে কেবল আল্লাহরই ভয়ে পানাহারসহ তার রবের নিষিদ্ধ কাজ থেকে নিজেকে দূরে রাখে। দুনিয়ার কেউ দেখে না, দেখেন কেবল আল্লাহ। গোপন ও প্রকাশ্য সব বিষয়ে আল্লাহ অবহিত এ বোধ-উপলব্ধি রোজা মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করে। তাকওয়া বা আল্লাহর ভয় সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে রোজা অনন্য, রোজার কোনো বিকল্প নেই। আর যার মধ্যে আল্লাহর স্মরণ ও তাকওয়া আছে, তার দ্বারা আল্লাহর নাফরমানি বা গুনাহের কাজ অসম্ভব। রমজান মাসে বৈধ কাজ আল্লাহ সাময়িকভাবে নিষেধ করেছেন বলে তা থেকে সে বিরত থাকে। আল্লাহ যা হারাম করেছেন অন্য সময় বা রমজান মাসে কেমন করে তা সে করবে?
আমি আমার কাজটা করার চেষ্টা করেছি: ফজলে হাসান আবেদ
মতিউর রহমান
২৭ এপ্রিল ২০১৬, ০০:২০
আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০১৯, ২২:১৯
প্রিন্ট সংস্করণ

বাঁ থেকে ডানে (উপবিষ্ট) ফজলে হাসান আবেদের বাবা সিদ্দিক হাসান, মামা নওয়াব জাস্টিস স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা কেসিআইই ও চাচা আতিকুল হাসান। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠার চার বছর আগে ১৯৬৮ সালে তরুণ ফজলে হাসান আবেদ। ছবি: ব্র্যাক১৯৭২ সালে ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাকালে সিলেটের মার্কুলিতে ফজলে হাসান আবেদ। ছবি: ব্র্যাকপিতৃস্নেহ। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকেসহকর্মীদের সঙ্গে কর্মপরিকল্পনায় ব্যস্ত। ছবি: ব্র্যাকব্র্যাক স্কুলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। ছবি: ব্র্যাকব্র্যাক পরিচালিত একটি স্কুল পরিদর্শনকালে স্যার আবেদ। ছবি: ব্র্যাকব্র্যাকের কৃষি কর্মসূচি পরিদর্শনে গিয়ে কর্মীদের সুবিধা-অসুবিধার কথা শুনছেন স্যার ফজলে। ছবি: নাসির আলী মামুন২০০৫ সালে ব্র্যাক কর্মসূচি পরিদর্শনকালে মাইক্রোসফট করপোরেশনের কর্ণধার বিল গেটস, তাঁর স্ত্রী মেলিন্ডা গেটস এবং গ্রাম সংগঠনের নারীদের সঙ্গে। ছবি: ব্র্যাক২০০২ সালে ব্র্যাকের মাঠ কার্যক্রম পরিদর্শনকালে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ও চেরি ব্লেয়ারের সঙ্গে। ছবি: ব্র্যাক২০০৯ সালে তিব্বতি ধর্মীয় নেতা দালাইলামার সঙ্গে। ছবি: সংগৃহীত২০০১ সালে ব্র্যাক ব্যাংকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। ছবি: ব্র্যাক২০১১ সালে কাতারের আমির শেখ হামাদ বিন খলিফা আল-তানির কাছ থেকে ওয়ার্ল্ড ইনোভেশন সামিট ফর এডুকেশন (ওয়াইজ) পুরস্কার গ্রহণকালে। ফটো: সংগৃহীত২০১০ সালে নাইটহুড উপাধি গ্রহণ। ছবি: সংগৃহীতব্র্যাকের গভর্নিং বডির মিটিংয়ে (বাঁ থেকে) শাবানা আজমি, ফারুক চৌধুরী, স্যার ফজলে ও হুমায়ুন কবীর। ছবি: ব্র্যাকব্র্যাক সেন্টারে স্যার ফজলে হাসান আবেদ। ছবি: জিয়া ইসলামব্র্যাক সেন্টারে নিজ দপ্তরে স্যার ফজলে হাসান আবেদ। ছবি: জিয়া ইসলামআরও ছবি বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসন ফজলে হাসান আবেদের ৮০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মতিউর রহমান
প্রশ্ন: আপনি স্কটল্যান্ডে নৌ-স্থাপত্য বিষয়ে পড়তে গেলেন। ওটা বাদ দিয়ে সিএ পাস করলেন। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেন। সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ালেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সক্রিয় থাকলেন নানাভাবে। সেখান থেকে বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক গড়ে তুললেন। পুরো বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
উত্তর: যেসব পরিবর্তন আমার মনের মধ্যে এসেছে, তা ধারাবাহিকভাবেই এসেছে। আর মুক্তিযুদ্ধ তো আমার প্রাণ ছুঁয়ে গেছে বিভিন্নভাবে। মুক্তিযুদ্ধের পরে যে বাংলাদেশকে আমি দেখেছি, সেটা ছিল বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি—দরিদ্রতম দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ছিল দ্বিতীয় স্থানে। ভাবলাম, আমাদের এত দরিদ্র দেশ, তার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সময় উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া প্রায় এক কোটি মানুষ ফিরে আসছে। এদের ঘরবাড়ি নেই, টাকাপয়সা নেই, খেতে কোনো শস্য নেই। সাহায্য শুরু করলাম ত্রাণ দেওয়ার মধ্য দিয়ে। আমার ধারণা ছিল, ত্রাণ দেওয়া শেষে বছর দুই-তিনেক পর আমি আমার পেশায় ফিরে যাব—ইংল্যান্ড-আমেরিকা বা অন্য কোথাও। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে যে দারিদ্র্য দেখলাম, এত দরিদ্র মানুষকে এভাবে ফেলে রেখে আমি বিদেশে চাকরি করে আরাম-আয়েশে থাকব, এটা কোনো কাজের কথা নয়। সিদ্ধান্ত নিলাম, আমার সারা জীবনে বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনের কাজে নিয়োজিত থাকব।
২০০৫ সালে ব্র্যাক কর্মসূচি পরিদর্শনকালে মাইক্রোসফট করপোরেশনের কর্ণধার বিল গেটস, তাঁর স্ত্রী মেলিন্ডা গেটস এবং গ্রাম সংগঠনের নারীদের সঙ্গে ফজলে হাসান আবেদ l ছবি: ব্র্যাকের সৌজন্যে১৯৭৩ সালের প্রথম দিকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর আমি আর পেছন ফিরে তাকাইনি। আমি ভাবলাম, বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে এখন গড়তে হবে। আর গড়তে হলে দারিদ্র্য বিমোচনই প্রথম কাজ হওয়া উচিত। তখন প্রত্যেক নারী ৬ দশমিক ৪ জন শিশুর জন্ম দিত। জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই হার অব্যাহত থাকলে দারিদ্র্য বিমোচন কখনো সম্ভব হবে না। দারিদ্র্য বিমোচন করতে গেলে জন্ম নিয়ন্ত্রণও করতে হবে। এ কারণে প্রথম থেকেই আমরা স্বাস্থ্য কর্মসূচির পাশাপাশি জন্মনিয়ন্ত্রণ ও নারীর ক্ষমতায়নে কাজ শুরু করলাম।
প্রশ্ন: এর আগে মুক্তিযুদ্ধ শেষে আপনারা সুনামগঞ্জে বাড়িঘর তৈরি করে দেওয়া থেকে নানা ত্রাণকাজ শুরু করলেন।
উত্তর: সেখানে আমরা দরিদ্র মানুষকে ত্রাণ-কার্যক্রম আর ঘরবাড়ি বানিয়ে দেওয়ার কার্যক্রম পরিচালনা করলাম। মৎস্যজীবীদের নৌকা দেওয়া হলো, বিদেশ থেকে মাছধরা জাল এনে দেওয়া হলো। ত্রাণ-কার্যক্রম তো ক্ষণস্থায়ী ব্যাপার। আসলে উন্নয়ন যখন করতে হয়, তখন অনেক ক্ষেত্রেই কাজ করতে হয়। উন্নয়ন করতে হলে শুধু তো বসতবাড়ি গড়ে দিলে হয় না, কর্মসংস্থান তৈরি করতে হয়। সে কারণে কৃষির উন্নতির কাজ আরম্ভ করলাম, স্বাস্থ্যের উন্নতিতে কাজ শুরু করলাম, জন্মনিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করলাম। এসব কাজেই ছিল আমাদের অগ্রাধিকার।
বাংলাদেশে তখন অর্ধেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। আমরা তাদের নিয়েই কাজ শুরু কলাম। তবে কিছু ক্ষেত্র আছে, যেখানে শুধু দরিদ্রদের জন্য কাজ করা যায় না। যেমন আপনি শিশুদের টিকা দেবেন, যাতে তাদের স্বাস্থ্যের সুরক্ষা দেওয়া যায়। সেখানে তো শুধু দরিদ্র নয়, সব শিশুকেই টিকা দিতে হবে।
প্রথমে সুনামগঞ্জের শাল্লায় আমাদের কাজ শুরু হলো। এরপর মানিকগঞ্জ ও জামালপুরে কাজ শুরু করলাম। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের শেষ দিকে রংপুরের রৌমারীতে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। সেখানে শিশুসহ অনেক লোক মারা যেতে থাকল। শাল্লা থেকে গেলাম রৌমারীতে। সেখানে ১৫ হাজার শিশুকে প্রতিদিন দুই বেলা খাইয়ে কোনো রকমে বাঁচিয়ে রাখলাম।
সেখানে দেখলাম খর্বকায় শিশু আর পুষ্টিহীন চেহারার অতি রুগ্ণ মা। বাড়িতে শুধু নারী আর শিশুরা আছে, পুরুষেরা বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে কাজের খোঁজে। একটা উপলব্ধি হলো, পরিবার বা সমাজে আসলে দারিদ্র্য মোকাবিলা করেন প্রধানত নারীরা। যদি তাঁরা দারিদ্র্যকেই ম্যানেজ করতে পারেন, তাহলে এঁদের দিয়েই আমরা উন্নয়নের কাজ আরম্ভ করি না কেন? আমি আগে যখন গ্রামেগঞ্জে বেশি যেতাম, দেখতাম পাঁচ বছরের মেয়েশিশু এক বছরের ছোট ভাইকে কোলে নিয়ে দেখাশোনা করছে। আর তার বড় ভাইটা বাড়ির বাইরে গিয়ে খেলছে। এসব দেখে মনে হলো আমাদের মেয়েদেরই আগে তৈরি করতে হবে। আমরা মেয়েদের সংগঠিত করা শুরু করলাম। কারণ, মেয়েরা ছোটবেলা থেকেই ব্যবস্থাপনা শেখে।
প্রশ্ন: ১৯৭১ সালে আপনাকে একটা বড় দায়িত্ব দিয়েছিল পাকিস্তানি সামরিক সরকার—লিয়াজোঁ কর্মকর্তা হিসেবে সারা দেশে তেল সরবরাহ-ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার।
উত্তর: দায়িত্ব দিয়েছিল। কিন্তু সেটা আমি বেশি দিন করিনি। সপ্তাহ খানেক করেছিলাম। এরপর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ওদেরই পরিচয়পত্র নিয়ে প্রথমে ঢাকা থেকে করাচি, পরে সেখান থেকে আফগানিস্তান হয়ে লন্ডনে চলে যাই।
প্রশ্ন: তারপর লন্ডন থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন ও সহযোগিতার জন্য কাজ শুরু করলেন…
উত্তর: লন্ডনে গিয়ে আমরা দুটি সংগঠন করেছিলাম। একটা হলো অ্যাকশন বাংলাদেশ। এর প্রধান কাজ ছিল বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে রাজনৈতিক সমর্থন আদায় করা। আরেকটা হলো হেল্প বাংলাদেশ। এর কাজ ছিল অর্থ সংগ্রহ করা, যাতে আমাদের মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করা যায়। কাজ করতে করতে একবার সেখানে কিছু মার্সেনারির (ভাড়াটে বিদেশি সৈনিক) সঙ্গে দেখা হলো। তারা ভিয়েতনামে যুদ্ধ করেছে। ওই সৈনিকেরা একটা প্রস্তাব দিল, ‘যদি তোমরা ১৬ হাজার পাউন্ড জোগাড় করতে পারো, তাহলে আমরা তোমাদের জন্য একটা কাজ করতে পারি। গুজরাট উপকূল থেকে মাছ ধরার নৌকা নিয়ে করাচি বন্দরে গিয়ে দু-একটা জাহাজকে বিধ্বস্ত করে দিতে পারি।’ ১৬ হাজার পাউন্ড আমরা জোগাড় করলাম ঠিকই। কিন্তু ভাবলাম, কাজটি করার আগে সরকারের সঙ্গে একটা পরামর্শ করলে বোধ হয় ভালো হয়। এ জন্য সেপ্টেম্বরের দিকে কলকাতায় গেলাম। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। তাঁকে বললাম, কাজটা করতে পারলে কেমন হয়? তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনে বললেন, ‘আমার মনে হয়, এটা না করাই ভালো হবে। বরং আপনি টাকাটা আমাদের দিয়ে দিন, আমরা কাজে লাগাব। সত্যি সত্যিই যদি এটা আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা করতেন, তাহলে একটা কথা ছিল। আপনি তৃতীয় কোনো বাইরের শক্তি দিয়ে করাবেন, ভবিষ্যতে যদি জানাজানি হয়, তখন ওরা বলবে, লোক ভাড়া করে আক্রমণ করেছে। এর দরকার নেই।’ তাঁর কাছ থেকে হোটেলে ফিরলাম। জিয়াউর রহমান এক দিন আমার হোটেলে এলেন। বললেন, ‘আমার তো অনেক কিছু দরকার। কিন্তু ভারত থেকে সেগুলো পাই না। আমাদের যথেষ্ট গোলাবারুদ নেই। আর ব্যক্তিগতভাবে একটা জিনিসও খুব দরকার। সেটা হলো বাইনোকুলার; শত্রু কোন দিক থেকে আসছে দেখতে পাই না। যদি আমার জন্য এটা পাঠাতে পারেন তাহলে ভালো হয়।’ লন্ডনে ফিরে তাঁর জন্য বাইনোকুলার পাঠিয়েছিলাম।
প্রশ্ন: আগে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বললেন। পাশাপাশি শুরু থেকেই শিক্ষা নিয়েও একটা ভাবনা ছিল, শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ছাড়া কোনো উন্নয়ন হবে না।
উত্তর: প্রথম দিকে আরম্ভ করেছিলাম বয়স্ক শিক্ষা নিয়ে। আমরা ২০০ গ্রামে কাজ শুরু করেছি। আমাদের পরিকল্পনা ছিল ২০০ গ্রামে ২০০টি স্কুল করব, আর নারী-পুরুষ উভয়কে শিক্ষিত করে ফেলব। অন্তত যাতে তারা বই পড়তে পারে, স্বাক্ষর করতে পারে, চিঠি লিখতে পারে। ২০০ স্কুল চালু করলাম। বুঝলাম, গরিব মানুষের পক্ষে সারা দিন পরিশ্রম করে পড়ায় মনোযোগ দেওয়া সম্ভব নয়। বেশির ভাগ স্কুল আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল। তখন আমার হাতে ব্রাজিলের শিক্ষাবিদ পাওলো ফ্রেইরির একটা বই এসেছিল। নাম পিডাগজি অব দ্য অপ্রেসড। বইটি থেকে জানলাম, মানুষের উন্নয়ন করতে হলে আগে মানুষকে সচেতন ও উদ্যমী করে তুলতে হবে। আর মানুষকে সংগঠিত করতে না পারলে উন্নয়ন হবে না। তখন সচেতনতা বাড়ানোর কাজ শুরু করলাম। আগের ওই কর্মসূচি থেকে আমরা শিখলাম, আমরা সংগঠন হিসেবে খুব বেশি কিছু করতে পারব না, যদি না তাদের সচেতন করতে পারি। আমরা তোমাদের সবকিছু করে দেব, তা হবে না। বরং মানুষের ভেতরকার আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে দিয়ে জীবনকে বদলে দেওয়ার কাজে তাদের উদ্যমী করে তুলতে হবে। এই বিষয়টা যতক্ষণ না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো কর্মসূচি সফল হবে না। এটা হলো ব্র্যাকের সফলতার মূল ভিত্তি।
প্রশ্ন: নারীর ক্ষমতায়ন ও শিক্ষাক্ষেত্রে জোর দেওয়া, স্বাস্থ্য, কৃষি, ক্ষুদ্রঋণ—এর প্রতিটাতেই আপনি সম্পৃক্ত আছেন। সব মিলিয়েই আপনার ব্র্যাক। এর মধ্যে কি বলতে পারেন, এই সেক্টরে আমি সবচেয়ে ভালো করলাম, এরপর ওটা?
উত্তর: দেখুন, কতগুলো বিষয়ে বাংলাদেশে আমরা গর্ব বোধ করি। যেমন বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার শ্রীলঙ্কা ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। কী করে হলো? সরকার বলবে, আমরা করেছি। কিন্তু আমি মনে করি, এ ক্ষেত্রে ব্র্যাকের বড় অবদান আছে। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এই ১০ বছর প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে খাবার স্যালাইন কীভাবে বানাতে হয়—লবণ, গুড় আর আধা সের পানি মিশিয়ে—সেটা আমরা শিখিয়েছি। এরপর এল খাবার স্যালাইনের প্যাকেট। কতটুকু পানি হলে সেটা ঠিক আধা সের পরিমাণ হয়, সেটা তত দিনে নারীরা শিখে ফেলেছে। এখন প্যাকেট স্যালাইন কিনে আধা সের পানি মিশিয়ে সঠিকভাবে স্যালাইন বানাতে পারে। ওই দশ বছর আমরা যদি ওই কাজটা না করতাম, তাহলে সেই চিত্রটার পরিবর্তন হতো না।
১৯৮৬ সালে বাংলাদেশে টিকাদানের হার ছিল ৪ শতাংশ। তখন এরশাদ সাহেব ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। ইউনিসেফ দেশে টিকাদানের হার ১৯৯০ সালের মধ্যে ৮০ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার জন্য কর্মসূচি শুরু করল। প্রেসিডেন্ট স্বাস্থ্যসচিবকে টিকাদান কর্মসূচি সফল করতে নির্দেশ দিলেন। আমার বন্ধু মনযূর-উল-করিম ছিলেন তখন স্বাস্থ্যসচিব। তিনি বললেন, এটা আমরা একা পারব না। আমাদের সঙ্গে তোমরা যোগ দাও। আমরা অর্ধেক বাংলাদেশের দায়িত্ব নিলাম। ওরা নিল বাকি অর্ধেক বাংলাদেশের। আমরা যে অর্ধেক নিলাম, সেখানে আমরা ৮২ শতাংশ কভারেজ দিলাম চার বছরের মধ্যে। আর যে অর্ধেক সরকার নিল, সেটা হলো ৬১ শতাংশ। বাংলাদেশে এখন টিকাদানের হার ৯৬ শতাংশ। আর ভারতে ৫৭ শতাংশ। সে জন্য সেখানে মৃত্যুহার বেশি।
প্রশ্ন: খাবার স্যালাইন, টিকাদান—এরপরের গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য কী?
উত্তর: পানি ও পয়োনিষ্কাশন। সারা বাংলাদেশে এখন মাত্র ৩ শতাংশ লোক খোলা জায়গায় পায়খানা করে। বাংলাদেশের প্রতিটা বাড়িতে গিয়ে স্যানিটারি ল্যাট্রিন দেওয়া, দিনে অন্তত তিনবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া শেখানো, প্রতিটি স্কুলে গিয়ে বাচ্চাদের হাত ধোয়া শেখানো—এগুলো তো আমরা করেছি দশ বছর ধরে। ফলে শিশুমৃত্যুর হার কমেছে, মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে। মাতৃমৃত্যুর হার আগে প্রতি লাখে ৮০০ ছিল, এখন সেটা ১৭৫-এ নেমে এসেছে। ১৭৫ থেকে ৩০-এ নিয়ে যেতে হলে কী করতে হবে, এখন আমরা সেটা করছি। এটা করতে হলে প্রতিটা ইউনিয়নে দুজন করে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মিডওয়াইফ লাগবে। এসএসসির পর তিন বছর মেয়াদি মিডওয়াইফারি ডিপ্লোমা দিচ্ছি আমরা। ৩০০ জন এরই মধ্যে পাস করেছে। এভাবে আমরা তৈরি করব ১০ হাজার। তাদের মধ্য থেকে যখন প্রত্যেক ইউনিয়নে দুজন করে পাওয়া যাবে, তখন গ্রামের নারীদের ডেলিভারি করাতে আর হাসপাতালে যেতে হবে না।
প্রশ্ন: শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ অবদান কোনটি?
উত্তর: এখানে বড় অবদান হলো আমরা প্রায় ৭০ লাখ শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষা দিয়েছি। এর মধ্যে ৪০ লাখ মেয়েশিশু। তার মানে ৬৬ শতাংশ মেয়ে। এখন সরকারি হিসাবে ৯৮ ভাগ মেয়ে স্কুলে ভর্তি হয় আর ৯৬ ভাগ ছেলেশিশু স্কুলে ভর্তি হয়। এই যে ২ শতাংশ বেশি, এটা ব্র্যাকের কারণে। কিন্তু এখন আমাদের বড় কাজ হলো শিক্ষার মান উন্নয়ন। শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য আমাদের ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে একটা ইনস্টিটিউট তৈরি হয়েছে। সরকারের সঙ্গে বসে এখন আমরা পাঠক্রম তৈরি করছি।
প্রশ্ন: কৃষিক্ষেত্রে বড় কাজ কোনটি?
উত্তর: কৃষি সম্প্রসারণে কাজ হয়েছে অনেক। সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে ও এককভাবে এ ক্ষেত্রে আমরা অনেক কাজ করেছি। কৃষকদের উচ্চমানের বীজ সরবরাহ করেছি। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কাজ করতে গিয়েই বীজের বিষয়টা ভাবনায় এসেছিল। প্রায় ৩ লাখ নারী আমাদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে সবজি চাষ করছিলেন। আমি কয়েকটি খামারে সবজিচাষি নারীদের সঙ্গে কথা বললাম। জিজ্ঞেস করলাম, আপনাদের আসল সমস্যা কী? অনেকেই বললেন, সমস্যা হলো বীজের। ভালো বীজ নেই। আমরা তখন শাকসবজির বীজ তৈরি করা শুরু করলাম। এরপর আনলাম ভুট্টার বীজ। ভুট্টা কিন্তু আমরাই পরিচয় করিয়েছি বাংলাদেশে।
পোলট্রির খামার করতে গিয়ে দেখলাম, মুরগির মৃত্যুহার কমানোর জন্য ভ্যাকসিন দরকার। তখন এরশাদ সরকারের আমল। সরকারকে বললাম, হয় আপনারা ভ্যাকসিন উৎপাদন করুন, না হলে আমাদের দায়িত্ব দিন, আমরা উৎপাদন করব। সরকার বলল, আমরাই করব। সরকার ভ্যাকসিন উৎপাদন করল, আর আমরা জেলায় জেলায় সরবরাহ শুরু করলাম। প্রত্যেক উপজেলায় একজন করে পশুপালন কর্মকর্তা আছেন। তাঁর অফিসে ফ্রিজ আছে। এই ফ্রিজে সংরক্ষণের জন্য ঢাকা থেকে আমরা ভ্যাকসিন পাঠানো শুরু করলাম। থানার পশুসম্পদ অফিসারের ফ্রিজ নষ্ট হয়ে গেলে ভ্যাকসিনগুলো অকার্যকর হয়ে যায়। তখন আমরা ১২ জন ফ্রিজ মেরামতকারী নিয়োগ করে বিভিন্ন জেলায় পাঠিয়ে দিলাম। ফ্রিজ অকার্যকর হলে ফোন করলেই ওরা সেটি ঠিক করে দিয়ে আসে। চল্লিশ হাজার গ্রামে চল্লিশ হাজার নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ভ্যাকসিনেটর তৈরি করলাম।
প্রশ্ন: ব্র্যাক যে ছোট থেকে এত বড় হলো, পরিচালনা-ব্যবস্থাপনা-মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় কী উদ্যোগ ছিল?
উত্তর: এগুলোর ক্ষেত্রে বিশেষ একটা পদক্ষেপ ছিল আমাদের। আমরা আমাদের কর্মীদের খুব বিশ্বাস করেছি। তাঁদের দায়িত্ব দিয়েছি, ক্ষমতাও দিয়েছি। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাটা কিন্তু একেবারে গ্রামেই ছিল। কাকে ঋণ দেবে, কাকে দেবে না—তা জানার জন্য কাউকে ঢাকায় আসতে হতো না। কর্মীরা নিজেরাই ঠিক করতেন কাকে ঋণ দেবেন, কাকে দেবেন না। তাতে তাঁরা কাজে যেমন স্বাধীনতা পেয়েছেন, তেমনি আনন্দও পেয়েছেন। মূল ব্যাপার ছিল, যা তিনি করতে চেয়েছেন, তা করার ক্ষমতাও তাঁর হাতে ছিল। সে জন্য ব্র্যাকে কোনো আমলাতন্ত্র গড়ে ওঠেনি। সব সিদ্ধান্ত আবেদ ভাই বা তাঁর চারপাশের চার-পাঁচজন লোক নেবেন, এটা নয়। সবাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সে জন্য এটা এত বড় হয়েছে এবং ভিত্তিটা শক্তিশালী হয়েছে। ব্র্যাক থেকে অনেক লোক তৈরি হয়েছেন, যাঁরা ভালো ম্যানেজার হয়েছেন।
প্রশ্ন: সারা বিশ্বের ১২টা দেশে যে আপনারা ব্র্যাক পরিচালনা করছেন, সেখানে কোন ধরনের কাজ করছেন?
উত্তর: সেসব দেশে নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্ষুদ্রঋণ প্রভৃতি—আমাদের সব কাজই পরিচালনা করছি।
প্রশ্ন: অনেকে বলেন, আপনি ব্র্যাকের সামগ্রিক কাজের পাশাপাশি আবার ব্যাংক করলেন, ইউনিভার্সিটি করলেন—এসবের কী দরকার ছিল?
উত্তর: ব্যাংক গড়ার প্রেক্ষাপটটা বলি। ১৯৯৭ সালে যে সমীক্ষা করেছিলাম, সেখানে তো অতিদরিদ্রদের পেলাম, যারা ঋণ পায় না। সেখানে আরেকটা চিত্র ছিল, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও ঋণ পান না—তাঁরা দরিদ্রও নন, অতিদরিদ্রও নন, আবার সচ্ছলও নন। দরিদ্র মানুষ ঋণ পেতে পারেন, আবার যাঁরা সচ্ছল, তাঁরাও ঋণ পেতে পারেন। কিন্তু এঁদের কী হবে? সেই চিন্তা থেকেই ব্র্যাক ব্যাংক করতে যাওয়া, যাতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়া যায়। এরপর নিয়ে এলাম বিকাশ। বিকাশ ব্যবহার করে তো এখন সবাই দ্রুত টাকা পাঠাচ্ছে। আমার আসল উদ্দেশ্য হলো, বিকাশ শুধু টাকা পাঠানোতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, এর মাধ্যমে গ্রাহকেরা ঋণ পেতে পারবেন, বিভিন্ন রকমের সঞ্চয়ও রাখতে পারবেন। তাঁদের মোবাইল ফোনের মধ্যেই স্বনিয়ন্ত্রিতভাবে সেই ঋণ ব্যবহার করতে পারবেন।
ইউনিভার্সিটি করলাম, আমরা যদি কিছু শিক্ষিত মানুষ তৈরি করতে পারি, যারা দরিদ্রদের নিয়ে কাজ করতে চায়। তাহলে তো আমাদের মতো মানুষ আরও পাওয়া সম্ভব, যারা সমাজের জন্য দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে চায়। আর সেটা যদি আমি ইউনিভার্সিটির মাধ্যমে করতে পারি, আমাদের শিক্ষা ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে যদি শিক্ষার মান উন্নয়ন করতে পারি, সিভিল সার্ভেন্টদের ডিগ্রি দিয়ে যদি সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় তবে দেশের কিছু লাভ হবে। ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের বাবা সিদ্দিক হাসান (বাঁয়ে বসা), চাচা আতিকুল হাসান (ডানে বসা) এবং তাঁদের (সিদ্দিক হাসান ও আতিকুল হাসান) মামা নওয়াব জাস্টিস স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা কেসিআইই (মাঝে বসা)। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠার চার বছর আগে ১৯৬৮ সালে তরুণ ফজলে হাসান আবেদ। ছবি: ব্র্যাকের সৌজন্যে১৯৭২ সালে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠাকালে সিলেটের মার্কুলিতে ফজলে হাসান আবেদ। ছবি: ব্র্যাকের সৌজন্যেপিতৃস্নেহ। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকেসহকর্মীদের সঙ্গে কর্মপরিকল্পনায় ব্যস্ত। ছবি: ব্র্যাকের সৌজন্যেব্র্যাক স্কুলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। ছবি: ব্র্যাকের সৌজন্যেব্র্যাক পরিচালিত একটি স্কুল পরিদর্শনকালে স্যার ফজলে হাসান আবেদ। ছবি: ব্র্যাকের সৌজন্যেব্র্যাকের কৃষি কর্মসূচি পরিদর্শনে গিয়ে কর্মীদের সুবিধা-অসুবিধার কথা শুনছেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। ছবি: নাসির আলী মামুন২০০৫ সালে ব্র্যাকের কর্মসূচি পরিদর্শনকালে মাইক্রোসফট করপোরেশনের কর্ণধার বিল গেটস, তাঁর স্ত্রী মেলিন্ডা গেটস এবং গ্রাম সংগঠনের নারীদের সঙ্গে ফজলে হাসান আবেদ। ছবি: ব্র্যাকের সৌজন্যে২০০২ সালে ব্র্যাকের মাঠ কার্যক্রম পরিদর্শনকালে যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ও তাঁর স্ত্রী চেরি ব্লেয়ারের সঙ্গে ফজলে হাসান আবেদ। ছবি: ব্র্যাকের সৌজন্যে২০০৯ সালে তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দালাইলামার সঙ্গে। ছবি: সংগৃহীত২০০১ সালে ব্র্যাক ব্যাংকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। ছবি: ব্র্যাকের সৌজন্যে২০১১ সালে কাতারের আমির শেখ হামাদ বিন খলিফা আল-থানির কাছ থেকে ‘ওয়ার্ল্ড ইনোভেশন সামিট ফর এডুকেশন (ওয়াইজ)’ পুরস্কার গ্রহণকালে। ছবি: সংগৃহীত২০১০ সালে নাইটহুড উপাধি গ্রহণ। ছবি: সংগৃহীতব্র্যাকের গভর্নিং বডির মিটিংয়ে (বাম থেকে) শাবানা আজমী, ফারুক চৌধুরী, স্যার ফজলে হাসান আবেদ ও হুমায়ুন কবীর। ছবি: ব্র্যাকের সৌজন্যেব্র্যাক সেন্টারে স্যার ফজলে হাসান আবেদ। ছবি: জিয়া ইসলামব্র্যাক সেন্টারের নিজ দপ্তরে স্যার ফজলে হাসান আবেদ। ছবি: জিয়া ইসলামআরও ছবি
প্রশ্ন: এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। আপনার প্রিয় মানুষ কে?
উত্তর: আমার প্রিয় মানুষ আমার মা। তারপর আমার ছোট চাচা সায়ীদুল হাসানের দ্বারা খুব প্রভাবিত ছিলাম।
প্রশ্ন: ব্যক্তিত্ব হিসেবে কাকে আদর্শ মনে করেন?
উত্তর: আমার সবচেয়ে পছন্দের মানুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমাদের মননকে তিনি যেভাবে প্রভাবিত করেছেন, সেটা আর কেউ করতে পারেননি।
প্রশ্ন: আপনার প্রিয় লেখক কে, রবীন্দ্রনাথ না শেক্সপিয়ার? আপনি শেক্সপিয়ারের অনেক কবিতা আবৃত্তি করেন।
উত্তর: মানুষ হিসেবে পছন্দ রবীন্দ্রনাথ, আর লেখক হিসেবে শেক্সপিয়ার।
প্রশ্ন: শিল্পকর্মের অনেক সংগ্রহ আপনার। প্রিয় শিল্পী কে?
উত্তর: শিল্পীদের মধ্যে কামরুল হাসান, মোহাম্মদ কিবরিয়া, মুর্তজা বশীর, আমিনুল ইসলাম, রশিদ চৌধুরী সবাই আমার বন্ধু। রশিদ চৌধুরীর অনেক প্রদর্শনীর আয়োজন করে দিয়েছি। চিত্রকর্ম বিক্রিতে সহযোগিতা করেছি।
প্রশ্ন: আপনি গান শোনেন সব সময়। শিল্পীদের মধ্যে কে কে বেশি প্রিয়?
উত্তর: রবীন্দ্রসংগীতই বেশি শুনি। ভারতের অনেকের কণ্ঠেই গান শুনতে ভালো লাগে। আমাদের দেশে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, শামা রহমান, অদিতি মহসীনের কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত খুব ভালো লাগে। লুভা নাহিদ চৌধুরীর গানও খুব প্রিয়। পুরোনোদের মধ্যে কুন্দনলাল সায়গল, পঙ্কজকুমার মল্লিক, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ আমার প্রিয় শিল্পী। ছোটবেলায় তো কলের গানে তাঁদের গান শুনতাম।
প্রশ্ন: কার সিনেমা ভালো লাগে?
উত্তর: আমার তো আর্ট ফিল্ম খুব ভালো লাগে। ইতালির ভিক্টরিয় ডি সিকা, মাইকেলেঞ্জেলো অ্যান্টোনিওনি—এঁদের মতো পুরোনো অভিনয়শিল্পীদের ছবি ভালো লাগত। এঁদের ছবি দেখিয়েই আমি আলমগীর কবিরকে প্রভাবিত করেছিলাম। আমাদের সত্যজিৎ রায়ের সিনেমাও ভালো লাগে, খুব চমৎকার।
প্রশ্ন: মা-বাবা-চাচা বাদ দিয়ে মানুষ হিসেবে আর কাউকে কি দেখেন, যিনি আপনাকে প্রভাবিত করেছেন।
উত্তর: ওভাবে বলতে পারব না। অনেক লেখকের বই পড়ি আমি। এর মধ্যে টলস্টয়ের চিন্তাজগৎ এত ব্যাপক, তাঁর চিন্তা দ্বারা খুব প্রভাবিত হই। তাঁর চিন্তা এত বিস্তৃত, এত গভীর—এগুলো খুব ভালো লাগে।
প্রশ্ন: আপনি নিজেকে পুরোপুরি সফল মনে করেন, নাকি আরও সাফল্যের বাকি আছে? আরও কিছু করতে চান?
উত্তর: নিজেকে আমি খুব বেশি সফল মনে করি, তা নয়। আমি আমার কর্তব্যটা করার চেষ্টা করেছি, এর বেশি কিছু না।
প্রশ্ন: বাংলাদেশ নিয়ে আর কী স্বপ্ন দেখেন?
উত্তর: শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার আরও কমানো। বাংলাদেশের সহজাত সুবিধা হলো, মানুষগুলো বুদ্ধিমান। এদের যদি একটু ভালো শিক্ষার সুযোগ দেওয়া যায়, তাহলে আমরা অনেক এগিয়ে যেতে পারতাম। পৃথিবীতে অনেক দেশ আছে, যেসব দেশের মানুষ এতটা বুদ্ধিমান নয়। আমাদের লোকগুলো বেশি সুযোগ পায়নি কিন্তু তাদের মেধা আছে, বুদ্ধি আছে। এদের একটু সুযোগ দিলে পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে পরিচিতি পেত।
প্রশ্ন: আমাদের দেশে যা কিছু হয়, তা হয়ে যায় ব্যক্তিপ্রধান। কিন্তু এখানে ব্র্যাক সামনে, ফজলে হাসান আবেদ পেছনে। এই যে আড়ালে থাকা, এটা কি পরিকল্পনা করে হয়েছে, নাকি স্বভাবজাত?
উত্তর: এটা আমার সহজাত অভ্যাসও, আবার কিছুটা পরিকল্পিতও। আমি সব সময় চেয়েছি, লোকে আমার সংস্থাটি চিনবে, আমাকে চেনার তো দরকার নেই। এই সংস্থায় এত লোক কাজ করে, সেখানে একজনকে চিনে লাভ কী? ব্র্যাকে যে এত কাজ হয়েছে, সেটা কি আমার একার কাজ? হাজার হাজার কর্মীর কাজ। কাজেই সেই পরিচিতি তো তাদের প্রাপ্য। আমি নেতা হিসেবে হয়তো একটু বেশি কাজ করেছি। কিন্তু আসলে তো হাজার হাজার কর্মী নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছে বলেই ব্র্যাক এতটা সুনাম অর্জন করেছে।
মতিউর রহমান: আবেদ ভাই, ২৭ এপ্রিল আপনার জন্মদিন। আপনাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই। আপনি দীর্ঘজীবী হোন। মানুষের জন্য, দেশের জন্য আপনার কাজ আরও গতিশীল হোক—এই কামনা করি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ফজলে হাসান আবেদ: আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।
ব্র্যাক: বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি সাহায্য সংস্থা। তারা বহুমুখী কাজের মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করেছে। তাদের কাজের পরিধি ব্যাপক। দেশের বাইরে তারা ১২টি দেশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তাদের কাজের উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্রগুলো হলো: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন, স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা; পানি, পয়োনিষ্কাশন, শিক্ষা, কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তা, সমন্বিত উন্নয়ন, ক্ষুদ্রঋণ, উদ্যোগ ও বিনিয়োগ, নারীর ক্ষমতায়ন, লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণ, আইনি সহায়তা প্রদান প্রভৃতি। উল্লিখিত এসব ক্ষেত্রে দেশ-বিদেশে তাদের কর্মী রয়েছে এক লাখেরও বেশি। এর ৭০ শতাংশের ওপর নারী কর্মী রয়েছেন। এর বাইরে রয়েছে তাদের স্বনামধন্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান আড়ং।
আরও পড়ুন:
একজন মহান অগ্রপথিক

স্যার ফজলে হাসান আবেদের সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত
নিজস্ব প্রতিবেদক
২৭ এপ্রিল ২০১৬, ০২:০৭
আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০১৯, ২৩:৪২

ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের বাবা সিদ্দিক হাসান (বাঁয়ে বসা), চাচা আতিকুল হাসান (ডানে বসা) এবং তাঁদের (সিদ্দিক হাসান ও আতিকুল হাসান) মামা নওয়াব জাস্টিস স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা কেসিআইই (মাঝে বসা)। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠার চার বছর আগে ১৯৬৮ সালে তরুণ ফজলে হাসান আবেদ। ছবি: ব্র্যাকের সৌজন্যে১৯৭২ সালে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠাকালে সিলেটের মার্কুলিতে ফজলে হাসান আবেদ। ছবি: ব্র্যাকের সৌজন্যেপিতৃস্নেহ। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকেসহকর্মীদের সঙ্গে কর্মপরিকল্পনায় ব্যস্ত। ছবি: ব্র্যাকের সৌজন্যেব্র্যাক স্কুলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। ছবি: ব্র্যাকের সৌজন্যেব্র্যাক পরিচালিত একটি স্কুল পরিদর্শনকালে স্যার ফজলে হাসান আবেদ। ছবি: ব্র্যাকের সৌজন্যেব্র্যাকের কৃষি কর্মসূচি পরিদর্শনে গিয়ে কর্মীদের সুবিধা-অসুবিধার কথা শুনছেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। ছবি: নাসির আলী মামুন২০০৫ সালে ব্র্যাকের কর্মসূচি পরিদর্শনকালে মাইক্রোসফট করপোরেশনের কর্ণধার বিল গেটস, তাঁর স্ত্রী মেলিন্ডা গেটস এবং গ্রাম সংগঠনের নারীদের সঙ্গে ফজলে হাসান আবেদ। ছবি: ব্র্যাকের সৌজন্যে২০০২ সালে ব্র্যাকের মাঠ কার্যক্রম পরিদর্শনকালে যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ও তাঁর স্ত্রী চেরি ব্লেয়ারের সঙ্গে ফজলে হাসান আবেদ। ছবি: ব্র্যাকের সৌজন্যে২০০৯ সালে তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দালাইলামার সঙ্গে। ছবি: সংগৃহীত২০০১ সালে ব্র্যাক ব্যাংকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। ছবি: ব্র্যাকের সৌজন্যে২০১১ সালে কাতারের আমির শেখ হামাদ বিন খলিফা আল-থানির কাছ থেকে ‘ওয়ার্ল্ড ইনোভেশন সামিট ফর এডুকেশন (ওয়াইজ)’ পুরস্কার গ্রহণকালে। ছবি: সংগৃহীত২০১০ সালে নাইটহুড উপাধি গ্রহণ। ছবি: সংগৃহীতব্র্যাকের গভর্নিং বডির মিটিংয়ে (বাম থেকে) শাবানা আজমী, ফারুক চৌধুরী, স্যার ফজলে হাসান আবেদ ও হুমায়ুন কবীর। ছবি: ব্র্যাকের সৌজন্যেব্র্যাক সেন্টারে স্যার ফজলে হাসান আবেদ। ছবি: জিয়া ইসলামব্র্যাক সেন্টারের নিজ দপ্তরে স্যার ফজলে হাসান আবেদ। ছবি: জিয়া ইসলামআরও ছবি ফজলে হাসান আবেদ ১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল বাংলাদেশের হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পাবনা জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি ব্রিটেনের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে নেভাল আর্কিটেকচারে ভর্তি হয়েছিলেন। সেটা বাদ দিয়ে তিনি লন্ডনের চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউনট্যান্টসে ভর্তি হন। ১৯৬২ সালে তিনি তাঁর প্রফেশনাল কোর্স সম্পন্ন করেন।
শিক্ষাজীবন শেষে দেশে ফিরে এসে ফজলে হাসান আবেদ শেল অয়েল কোম্পানিতে যোগ দেন এবং দ্রুত পদোন্নতি লাভ করে ফাইন্যান্স বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। শেল অয়েল কোম্পানিতে কর্মরত থাকাকালে ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। এ সময় তিনি তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে ‘হেলপ’ নামের একটি সংগঠন গড়ে তুলে ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত মনপুরা দ্বীপের অধিবাসীদের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। সেখানে তাঁরা ব্যাপক ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে ফজলে হাসান আবেদ ইংল্যান্ডে চলে যান। সেখানে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায়, তহবিল সংগ্রহ ও জনমত গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
একাত্তর সালের ডিসেম্বর মাসে ফজলে হাসান আবেদ সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এ সময় তিনি তাঁর লন্ডনের ফ্ল্যাট বিক্রি করে সেই অর্থ দিয়ে ত্রাণকাজ শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চল শাল্লা এলাকায় কাজ শুরু করেন। এই কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায়ই তিনি ব্র্যাক গড়ে তোলেন। গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে তাঁর দীর্ঘ অভিযাত্রার সূচনা ঘটে। দরিদ্র মানুষ যাতে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করে নিজেরাই নিজেদের ভাগ্যনিয়ন্তা হয়ে উঠতে পারে, সেই লক্ষ্যে তিনি তাঁর কর্মসূচি পরিচালনা করেন।
চার দশকের মধ্যে তিনি তাঁর অভূতপূর্ব নেতৃত্বের মাধ্যমে কর্মকাণ্ডের বিস্তার ঘটান। ব্র্যাক পরিণত হয় বিশ্বের সর্ববৃহত্ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায়।
বর্তমানে বিশ্বের ১২টি দেশে ব্র্যাকের লক্ষাধিক কর্মী প্রায় তেরো কোটি মানুষের জীবনে উন্নয়নে নিরলস কাজ কাজ করে যাচ্ছে। ফজলে হাসান আবেদের সুযোগ্য নেতৃত্বই অজস্র প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ব্র্যাকের অনন্য সাধারণ এই অর্জনকে সম্ভব করে তুলেছে।
বস্তুত প্রতিষ্ঠাতার স্বাপ্নিক দূরদৃষ্টি, অদম্য সাহস এবং গতিশীলতা ব্র্যাকের ক্রম অগ্রযাত্রা, নব নব নিরীক্ষা ও সম্প্রসারণের নিরন্তর অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে গেছে। ফলে দেশ-বিদেশে পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও স্বীকৃতি।
যেসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন:
Ø ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির হার্ভার্ড ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট-এর ভিজিটিং স্কলার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
Ø ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত অ্যাসোসিয়েশন অব ডেভেলপমেন্ট এজেন্সিজ ইন বাংলাদেশ (এডাব)-এর চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
Ø ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)-এর বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। একই সময় তিনি এই প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র ফেলো হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
Ø ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত দি ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, জেনেভার এনজিও কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
Ø ১৯৮৭ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সাউথ এশিয়া পার্টনারশিপ-এর চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
Ø ১৯৮৭ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অন হেলথ রিসার্চ ফর ডেভেলপমেন্ট-এর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
Ø ১৯৯০ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত গণসাক্ষরতা অভিযান-এর চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
Ø ১৯৯০ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত এনজিও ফোরাম ফর ড্রিংকিং ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড স্যানিটেশন-এর চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
Ø ১৯৯২ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ইন্ডিপেনডেন্ট সাউথ এশিয়ান কমিশন অন পভার্টি এলিভিয়েশন-এর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
Ø ১৯৯২ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত সার্ক-এর সাউথ এশিয়ান কমিশন অন পভার্টি এলিভিয়েশন-এর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
Ø ১৯৯৩ সাল থেকে ১৯৯৪ এবং ২০০৭ সাল থেকে ২০০৯ সাল মেয়াদে আইন ও সালিশ কেন্দ্র-এর চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
Ø ১৯৯৪ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
Ø ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের সাসেক্স ইউনিভার্সিটির পরিচালনা বোর্ডের সদস্য এবং ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (আইডিএস)-এর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
Ø ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি), ফিলিপাইন-এর বোর্ড অব গভর্নরস-এর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
Ø ২০০০ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি), ফিলিপাইন-এর ফাইন্যান্স অ্যান্ড অডিট কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন।
Ø ২০০২ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্ক অব অলটারনেটিভ ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন (ইনাফি)-এর গ্লোবাল চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
Ø ২০০৫ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ইউএন কমিশন অন লিগ্যাল এমপাওয়ারমেন্ট অব দি পুওর (সিএলইপি)-এর কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
Ø ২০১০ সালে জাতিসংঘের তদানীন্তন মহাসচিব বান কি মুন স্যার ফজলে হাসান আবেদকে বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশসমূহের ‘স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গে’র একজন হিসেবে নিযুক্তি প্রদান করেন।
Ø অশোকা স্যার ফজলে হাসান আবেদকে ‘গ্লোবাল গ্রেট’ স্বীকৃতিতে ভূষিত করেছে। তিনি এই প্রতিষ্ঠানের ‘গ্লোবাল অ্যাকাডেমি ফর সোশ্যাল আন্ট্রপ্রেনিওরশিপ’-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
Ø ২০১০ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ইউএন সেক্রেটারি জেনারেলস গ্রুপ অব এমিনেন্ট পারসনস ফর লিস্ট ডেভেলপড কান্ট্রিজ (এলডিসি)-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
Ø ২০১২ সাল থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ইউএন সেক্রেটারি জেনারেলস লিড গ্রুপ অব দি স্কেলিং এবং অশোকা গ্লোবাল অ্যাকাডেমি ফর সোশ্যাল আন্ট্রোপ্রেনিওরশিপ-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
যেসব পুরস্কার পেয়েছেন:
Ø ২০১৯ সালে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নে কয়েক দশকব্যাপী অনবদ্য ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ নেদারল্যান্ডসের নাইটহুড ‘অফিসার ইন দ্য অর্ডার অব অরেঞ্জ-নাসাউ’ খেতাবে ভূষিত হয়েছেন।
Ø ২০১৯ সালে শিক্ষা উন্নয়ন বিষয়ে অত্যন্ত মর্যাদাসূচক এবং অর্থমূল্যের দিক থেকে সবচেয়ে বড় পুরস্কার ইদান প্রাইজ লাভ করেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। হংকংভিত্তিক ইদান প্রাইজ ফাউন্ডেশন এই পুরস্কার ঘোষণা করে।
Ø ২০১৮ সালে প্রাকশৈশব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অসাধারণ অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ লেগো ফাউন্ডেশন, ডেনমার্ক প্রদত্ত লেগো পুরস্কার।
Ø ২০১৭ সালে দারিদ্র্যপীড়িত লক্ষ-কোটি মানুষের সম্ভাবনা বিকাশে সুযোগ সৃষ্টির জন্য লুডাটো সি অ্যাওয়ার্ড।
Ø ২০১৬ সালে গ্লোবাল লিডারশিপ ফোরাম অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপ, ওয়াশিংটন ডিসি প্রদত্ত হোসে এডগারডো ক্যাম্পোস কোলাবোরেটিভ লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড লাভ।
Ø ২০১৬ সালে জনস্বাস্থ্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত টমাস ফ্রান্সিস জুনিয়র মেডেল অব গ্লোবাল পাবলিক হেলথ পুরস্কার।
Ø খাদ্য ও কৃষিক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৫ সালে ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ লাভ করেন।
Ø ২০১৪ সালে রাশিয়ান চিলড্রেন ফান্ড কর্তৃক লেভ তলস্তয় স্বর্ণপদক এবং স্পেনের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা অর্ডার অব সিভিল মেরিট (অর্ডেন ডেল মেরিটো সিভিল) লাভ করেন।
Ø ২০১৪ সালে নারীর অধিকার রক্ষা ও সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ট্রাস্ট উইমেন হিরো অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।
Ø ২০১৩ সালে ওপেন সোসাইটি প্রাইজ লাভ করেন।
Ø ২০১১ সালে কাতার ফাউন্ডেশন প্রবর্তিত শিক্ষাক্ষেত্রে বিশ্বের সর্বোচ্চ পুরস্কার ওয়াইজ প্রাইজ লাভ করেন।
Ø ২০১০ সালে দারিদ্র্য বিমোচনে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ যুক্তরাজ্যের অন্যতম সর্বোচ্চ সম্মানজনক নাইটহুড উপাধিতে ভূষিত হন।
Ø ২০০৯ সালে দ্য ওয়ার্ল্ড আন্ট্রপ্রেনিওরশিপ ফোরামের পক্ষ থেকে আন্ট্রপ্রেনিওর ফর দ্য ওয়ার্ল্ড লাভ করেন।
Ø ২০০৮ সালে ডেভিড রকফেলার ব্রিজিং লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড এবং ফেলোশিপ অব এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ লাভ করেন।
Ø ২০০৭ সালে হেনরি আর. ক্রাভিস প্রাইজ ইন লিডারশিপ এবং ক্লিনটন গ্লোবাল সিটিজেনশিপ অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।
Ø ২০০৭ সালে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও সামাজিক উন্নয়নে অবদানের জন্য পল্লীকর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) কর্তৃক আজীবন সম্মাননা লাভ করেন।
Ø ২০০৪ সালে গেটস অ্যাওয়ার্ড ফর গ্লোবাল হেলথ ও ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন বিষয়ক পুরস্কার মাহবুবুল হক অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।
Ø ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের সেন্টার ফর পাবলিক লিডারশিপ প্রদত্ত গ্লেইটসম্যান ফাউন্ডেশন পুরস্কার লাভ করেন।
Ø ২০০২ সালে দ্য শোয়াব ফাউন্ডেশন সোশ্যাল আন্ট্রপ্রেনিওরশিপ প্রতিষ্ঠান থেকে ‘আউটস্ট্যান্ডিং সোশ্যাল আন্ট্রপ্রেনিওর’ স্বীকৃতি লাভ করেন।
Ø ২০০১ সালে সুইডেন থেকে ওলফ পামে অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।
Ø ১৯৮০ র্যামন ম্যাগসেসে অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন।
ব্র্যাককে যেসব পুরস্কার এনে দিয়েছেন:
Ø ২০০৮ সালে মানবিক ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য কনরাড এন হিলটন হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাওয়ার্ড।
Ø ২০০৭ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কার।
Ø ১৯৯২ সালে ইউনিসেফ মরিস পেট অ্যাওয়ার্ড।
Ø ১৯৯০ সালে অ্যালানশন ফেইনস্টেইন ওয়ার্ল্ড হাঙ্গার পুরস্কার।
Ø ১৯৮৫ সালে ইউনেসকো নোমা পুরস্কার অর্জন।
সম্মানসূচক ডিগ্রি:
Ø ১৯৯৪ কানাডার কুইন্স ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব লজ ডিগ্রি।
Ø ২০০৩ যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টার থেকে ডক্টর ইন এডুকেশন ডিগ্রি।
Ø ২০০৭ যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট অব হিউমেন লেটার্স ডিগ্রি।
Ø ২০০৮ যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব লজ ডিগ্রি।
Ø ২০০৯ যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব লেটার্স ডিগ্রি।
Ø ২০০৯ জাপানের রিক্কিও ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট অব হিউমেন লেটার্স লাভ।
Ø ২০১০ যুক্তরাজ্যের বাথ ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব লজ ডিগ্রি।
Ø ২০১২ যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রি।
Ø ২০১৪ যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব লজ ডিগ্রি।
Ø ২০১৪ যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব দি সাউথ থেকে ডক্টর অব সিভিল লজ ডিগ্রি।
Ø ২০১৬ যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ব্র্যাডফোর্ড থেকে ডক্টর অব এডুকেশন ডিগ্রি।

তরুণদের কতটা বুঝতে পারছি আমরা
আমরা ছিলাম এ রকম আর ওরা অন্য রকম। প্রসঙ্গ এলে বলাবলি এমনটাই হয়ে থাকে। নতুন কালের মানুষেরা আমাদের মতো হয়নি দেখে প্রায়ই দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয়। দুঃখ বাড়ে। হতাশা বাড়ে।

সময় বদলের সঙ্গে মানুষেরও বদল ঘটবে—খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। সেই বদলে আমরা কতটুকু সন্তুষ্ট হতে পারি বা মোটেও যদি না পারি, সে দায় অন্যের কাঁধে চাপিয়ে দিতে পারলেই ল্যাঠা চুকে যায় না।

সেই আর এই সময়ের তুলনা করে কী লাভ? কী চমৎকার কেটেছে আমাদের—এই আত্মসুখ প্রকাশ করে তৃপ্ত হই বটে। কিন্তু এখন যাদের তরুণকাল, তারা আমাদের মতো জীবন পায়নি বলে তো হা-হুতাশ করে বলে মনে হয় না। অস্বীকার করা যাবে না, বহু তরুণের জ্ঞানবুদ্ধি, বিবেচনা, দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের অবাক করে—বিস্মিত, আনন্দিত ও অনুপ্রাণিত করে।
আনন্দ মিললে ভাগে খানিকটা মন্দও জুটবে—নিয়ম। ভালো-মন্দ, আলো-অন্ধকার সবই একটির সঙ্গে অন্যটি ফ্রিতে মেলে। সেই নিয়মে এ সময়ে অজস্র ভালোর দেখা মিললে আনন্দ-উৎসাহ অনুপ্রেরণা জাগে। অসংখ্য মন্দ উদাহরণও নিত্য তেড়ে আসে। আসে অস্বস্তি, হতাশা আর বেদনা ছড়াতে।
বেদনা, হতাশা, অস্বস্তির বিষয়গুলো নিয়ে নাড়াচাড়াও বেশি হয়। কেন এই বেশি? কেন যা সুখকর নয়, তা নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত চর্চা অনুশীলনে উৎসাহ?
এবার একটু পেছনে তাকানো যাক। আমাদের কৈশোর-যৌবনকাল ছিল ব্যাপক অভিভাবকত্বে সুরক্ষিত। বাড়ির বাইরে বের হতে পারলে মুক্তি-স্বাধীনতার অনুভব ছিল। ছিল জোয়ার-ভাটার নদী, অসীম আকাশ, প্রাণখোলা মাঠ, হাসিমাখা ফসলের খেত, লাফানো ঝাঁপানোর টলটলে পুকুর। অজস্র রকম আনন্দের উপকরণে জীবন ঝলমলে ছিল। তবে উপভোগের সময় সতর্ক থাকতে হতো। মাথায় রাখতে হতো কখন কী অন্যায় হয়ে যায়, কে কখন দেখে ফেলে।
দুর্দান্ত যারা, তাদেরও অনেক বিষয়ে সামলে চলতে হতো। শিক্ষক, পরিবারের ঘনিষ্ঠজন, অন্যের অভিভাবকদের বিষয়েও সতর্কতা বজায় রাখতে হতো। সে সতর্কতায় ভয় নয়, ছিল সমীহ। পাড়ার বয়সে বড়রাও ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ অভিভাবক। ক্লাব, লাইব্রেরি, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা—সেই বয়সে এসবের নিয়ন্ত্রণও ছিল।
পরিবারের বাইরে যাঁদের অভিভাবকত্বের কথা বলা হচ্ছে, তাঁদের বয়সের কারণে মানতে হতো, তা নয়। যোগ্যতাতে তাঁরা ছিলেন সমীহের উপযুক্ত। তখন মানে না বুঝলেও পারস্পরিক সম্মানবোধ কী, তা অজ্ঞাত ছিল না।
গ্রাম ছেড়ে শহরে আসার পর যৌবন থেকে সেই অভিভাবকত্ব সরে যায়নি। গৌরবময় রাজনীতি ও সংস্কৃতি একসঙ্গে নব অধ্যায়ের সূচনা করে দিয়েছিল। নাটক, সিনেমা, সংগীত, সাহিত্য, ক্রীড়া—আত্মার খোরাকের অভাব ছিল না। শিক্ষক, সাংবাদিক, শিল্পী, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী অসংখ্য পরিচয়ের মর্যাদা জীবন ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ন্ত্রণ করেছে।
টেলিভিশন, দৈনিক, পাক্ষিক, সাপ্তাহিক পত্রপত্রিকার প্রতি আগ্রহ ও আকর্ষণ ছিল। এখন রয়েছে অনুযোগ, অভিযোগ আর হতাশা প্রকাশ। বলা হয়ে থাকে, দেখা, শোনা ও পড়ার আগ্রহ কমেছে। পাশাপাশি নতুন নানান মাধ্যমের আবির্ভাব ঘটেছে। সেসবে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিপুল পরিমাণ মানুষ দিনরাত হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকছে। আগ্রহ ও আকর্ষণের বিষয় বদলেছে। গায়ের জোরে বলা যাবে না, এই যে হুলুস্থুল ঘাড় গুঁজে থাকা, তা কেবলই মন্দের টানে।
সময় গড়াচ্ছে। জগৎ–সংসারের খুঁটিনাটি আঙুলডগার ইচ্ছায় নিমেষেই চোখের সামনে হাজির হয়ে যায়। এমন সুযোগ কোনো মানুষ হেলায় হারাতে চায়! মানুষ নতুন বা পুরোনো যা-ই হোক, আকাঙ্ক্ষা-আগ্রহ বা কৌতূহল সর্বদা নতুনের প্রতিই। আমরা দেখতে পাই উৎপাদক ও বিজ্ঞাপন মাধ্যমের অবিরাম চেষ্টা থাকে নিত্যনতুনকে যুক্ত করা। হোক দীর্ঘদিনের জনপ্রিয় পণ্য, নতুনভাবে উপস্থাপনার চেষ্টা থেমে থাকে না। চেষ্টা মানে সৃজনশীলতা। সৃজনশীলতার মধ্যে থাকে সেই শক্তি, যা উপলব্ধি করতে পারা মানুষকে আনন্দ দান করে, মনে বিস্ময় জাগায়, টিকিয়ে রাখে ভালোবাসা। সমীহ প্রকাশের ইচ্ছাও জাগিয়ে দেয়।
নতুনদের নিয়ে বহুজনের অনেক রকমের আক্ষেপ রয়েছে। জগতে তাদের আগে যাদের আগমন, সেই অভিজ্ঞদের অভিজ্ঞতা আকর্ষণহীন হলে নিশ্চয়ই আগ্রহ নিয়ে তারা তা প্রত্যক্ষ করে থাকে। সে আগ্রহ তাদের জন্য যথেষ্ট অনুপ্রেরণাদায়ক কি না!
আমাদের চর্চা, অনুশীলনের অধিকাংশ বিষয় সব সময় মন ভালো করা নয়। বিষয় অস্বস্তিকর কিন্তু পাঠক, দর্শক টানার উপাদান রয়েছে ভেবে হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশনা। অন্যদিকে যা সমাজ-সংস্কৃতি, দেশ ও মানুষের জন্য উল্লেখযোগ্য এবং বিশেষ বৃহৎ গোষ্ঠীর কাছে তা আবেদনহীন মনে হলে সামনের হয়ে উঠতে পারে না। গুরুত্ব হারায়।
ক্রমাগত স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে তা একসময় স্বার্থপরতা হয়ে দাঁড়ায়। সাপ মরবে, লাঠি ভাঙবে না—এমন সুচতুর বুদ্ধির খেলায় লাভ হচ্ছে না। মানুষে মানুষে দূরত্ব, অবিশ্বাস বেড়েই চলেছে। নতুন প্রজন্মকে তো ভরসাস্থল পেতে হবে। না পেলে তাদের আশা-ভরসাকে তো কাগজের নৌকা বানিয়ে তারা অনির্দিষ্ট পথে ভাসিয়ে দেবে না।
একসময় সংস্কৃতির জোরই দেশ ও মানুষের জোর ছিল। নগদ প্রাপ্তির কালে বাকির খাতায় চলে যায় সংস্কৃতি পালন। এখন জোর বলতে বোঝায় অন্য কিছু। সেই জোরের চর্চা পরিচর্যায় উচ্ছন্নে যাওয়াকে উন্নতি বলে। তেমন উন্নতি লাভের জন্য হুলুস্থুল কাণ্ডে সমগ্র ক্ষেত্রে অভিভাবকত্ব দিশেহারা। নতুন ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ যে চারপাশ ভুলে আপন আপন ভুবনে নেশাগ্রস্তের মতো ডুবে আছে, তাকে অস্বাভাবিকতা ভাবা যায়। ভাবা হচ্ছে। সেই স্বভাব দোষের হলে নিজেরা যে একেবারেই যে দোষহীন, তার পক্ষে জোরদার যুক্তি কি অভিভাবক শ্রেণির মুঠোতে রয়েছে?
সবাই আমি বা আমরাতে আটকা পড়ে রয়েছি। কুড়ি-ত্রিশ বছরে যারা নতুন প্রজন্ম পরিচয়ে বেড়ে উঠেছে, উঠছে, তারা কেউই আমি বা আমাদের মতো নয়। তারা আমাদের মতো হবে, এমন আশা কেন করা? তাদের ভাব, ভাষা, আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং ধ্যানধারণা বুঝতে চাওয়ার, নিকটের হওয়ার কতখানি উদ্যোগ চোখে পড়ে?
অস্বস্তি বা হতাশায় ভোগার চেয়ে নতুনকে বুঝতে চাওয়ার আন্তরিক প্রচেষ্টা শুরু হোক। হয়তো অস্বস্তি হতাশার উৎপাদনে ভাটা পড়তে পারে।
প্রক্রিয়া খানিকটা ব্যাহত হতে পারে।
আফজাল হোসেন অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, লেখক ও নির্দেশক

সবার ওপরে ফেসবুক
মতামত প্রকাশ, ব্যক্তিগত সম্পর্ক, দেশ-বিদেশের খবর, বিনোদন, কেনাকাটা—যাপিত জীবনের প্রায় সবকিছুর জন্য তরুণ–তরুণীরা নির্ভর করছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর। আর তাঁদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক। প্রতি ১০ জনে ৯ জন তরুণ-তরুণীর কাছেই ফেসবুকের জুড়ি নেই।

প্রথম আলোর তারুণ্য জরিপে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। পেশাদার জরিপ সংস্থা ওআরজি-কোয়েস্ট রিসার্চ লিমিটেড পরিচালিত এই জরিপে সারা দেশের ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী ১ হাজার ২০০ তরুণ-তরুণীর মতামত নেওয়া হয়েছে।
এবারের জরিপে অংশ নেওয়া তরুণ-তরুণীদের ৯৩ দশমিক ৯ শতাংশ বলছেন, ফেসবুক একমেবাদ্বিতীয়ম্। তাঁরা প্রতিদিন গড়ে ৪৬ মিনিট সময় কাটাচ্ছেন ফেসবুকে। শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে এবং তরুণীদের তুলনায় তরুণদের মধ্যে ফেসবুকের জনপ্রিয়তা বেশি। ২০১৭ সালের জরিপে ৯৪ দশমিক ৭ শতাংশ তরুণের কাছে ফেসবুক জনপ্রিয় ছিল।
ফেসবুক তরুণ-তরুণীদের আসক্তিতে পরিণত হচ্ছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক সভাপতি এ কে এম ফাহিম মাসরুর। বিডি জবসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম প্রথম আলোকে বলেন, ফেসবুকের এই আসক্তি আশঙ্কাজনক। তরুণ-তরুণীদের বড় একটা সময় ফেসবুক ব্যবহারের মতো অনুৎপাদনশীল কাজে চলে যাচ্ছে। ইন্টারনেটের অনেক ইতিবাচক বিষয় আছে, সেগুলো তাঁদের সামনে তুলে ধরতে হবে।
তারুণ্য জরিপে দেখা যায়, মার্ক জাকারবার্গের অনবদ্য সৃষ্টি ফেসবুকে আস্থা রাখেন ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী ইন্টারনেটে নির্ভরশীল তরুণ-তরুণীদের সবাই। তবে ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে ফেসবুকের জনপ্রিয়তা তুলনামূলক কম। এই বয়সী ৮৬ দশমিক ৫ শতাংশ তরুণ-তরুণীর কাছে ফেসবুক সবচেয়ে জনপ্রিয়।
শুধু বাংলাদেশে নয়, পুরো বিশ্বেই একাধিপত্য ফেসবুকের। গত মাসে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তিন মাসে তাদের মাসিক ব্যবহারকারী বেড়ে ২৪৫ কোটিতে পৌঁছেছে। বর্তমানে দৈনিক ১৬২ কোটি মানুষ সক্রিয়ভাবে ফেসবুক ব্যবহার করছেন।
অবশ্য ফেসবুকের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সম্প্রতি প্রশ্ন উঠেছে। ফেসবুকের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, তারা ব্যবহারকারীদের তথ্য গোপনে হাতিয়ে নিয়ে ব্যবসায়িক উদ্দেশে বিক্রি করে দিচ্ছে। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকাসহ নানান কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছে হয়েছে সামাজিক যোগাযোগের এই মাধ্যম। তবে এ–ও সত্যি, ফেসবুকের বিকল্প এখনো তৈরি হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজনের ফেসবুক বন্ধুতালিকায় নানা ধরনের মানুষ থাকেন। সেখানে অন্যদের দেওয়া নানা ধরনের পোস্ট থেকে তরুণ-তরুণীরা মনঃকষ্টে ভোগেন। তাতে ব্যবহারকারীদের মধ্যে একধরনের মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় আসক্তির ফলে তাঁরা বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছেন বলেও তাঁরা মনে করেন।
প্রথম আলোর জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশি তরুণদের পছন্দের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে আছে ইউটিউব। ভিডিও শেয়ারিং এই ওয়েবসাইট ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ৫২ দশমিক ৮ শতাংশ তরুণ-তরুণীর কাছে জনপ্রিয়। দুই বছরের ব্যবধানে ইউটিউবের জনপ্রিয়তা অনেকটাই বেড়েছে। ২০১৭ সালেও প্রথম আলোর উদ্যোগে এই জরিপ হয়েছিল। ২০১৭ সালে ৩৩ দশমিক ৩ শতাংশ তরুণ-তরুণীর সামাজিক মাধ্যমের পছন্দের তালিকায় ইউটিউব ছিল।
জরিপে দেখা যায়, ইউটিউব ব্যবহারে তরুণেরা এগিয়ে। তরুণীদের তুলনায় ইউটিউবে অনেক বেশি মজে থাকেন তরুণেরা। প্রায় ৬২ শতাংশ তরুণ জনপ্রিয়তার দৌড়ে ইউটিউবকে এগিয়ে রেখেছেন। তরুণীদের ক্ষেত্রে তা ৩২ শতাংশ। ফেসবুকের মতো ইউটিউব পছন্দের ক্ষেত্রেও ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীর আধিক্য বেশি।
জনপ্রিয়তার মিটারে মেসেজিং অ্যাপ ইমো আছে তৃতীয় স্থানে। ৪৬ দশমিক ৮ শতাংশ তরুণ-তরুণীর কাছে জনপ্রিয় এই অ্যাপ। তবে ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে ইমো বেশি জনপ্রিয়। গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরে এর জনপ্রিয়তা কম। গত দুই বছরে তাঁদের কাছে জনপ্রিয়তা হারিয়েছে ইমো। ২০১৭ সালে ইমো জনপ্রিয় ছিল ৫৬ দশমিক ৮ শতাংশের মধ্যে। এবার তা নেমে গেছে ৪৬ দশমিক ৭ শতাংশে।
জনপ্রিয়তার বিচারে চতুর্থ অবস্থানে থাকলেও হোয়াটসঅ্যাপে মন দেওয়া তরুণ-তরুণীর সংখ্যা বেশ কম, ১৩ শতাংশের কিছু বেশি। তবে শহর এলাকায় এই মেসেজিং অ্যাপ ব্যবহারের হার বেশি। প্রযুক্তি বিশ্লেষকদের মতে, সুরক্ষিত উপায়ে বার্তা আদান–প্রদানের সুবিধাই হোয়াটসঅ্যাপের জনপ্রিয়তা বাড়ার মূল কারণ। বলা হয় হোয়াটসঅ্যাপে এন্ড টু এন্ড এনক্রিপশন ব্যবহার করা হয়। এই ফিচার থাকায় একজন ব্যবহারকারীর পাঠানো বার্তায় অনাকাঙ্ক্ষিত নজরদারি চালানো সম্ভব হয় না। তবে ইদানীং এই দাবির যথার্থতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
জরিপে দেখা গেছে, এ দেশের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে খুব কমসংখ্যকই ইনস্টাগ্রাম, টুইটার ও গুগল প্লাসে ঢুঁ মারেন। ছবি শেয়ারের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইনস্টাগ্রামে আগ্রহ তুলনামূলকভাবে বেশি ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের মধ্যে। মাইক্রোব্লগিং সাইট টুইটারেরও একই অবস্থা।
২০১৭ ও ২০১৯ সালের জরিপের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ইউটিউব ছাড়া বাকি সব সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম এ দেশের তরুণ-তরুণীদের কাছে জনপ্রিয়তা সামান্য হলেও হারিয়েছে। যেমন ২০১৭ সালের জরিপের তুলনায় এবার ইউটিউবের জনপ্রিয়তা বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। অন্যদিকে ফেসবুক যৎসামান্য জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। ইমো ও হোয়াটসঅ্যাপের জনপ্রিয়তাও নিম্নগামী।
কোন মাধ্যমে কত সময়
এবারের জরিপে দেখা গেছে, তরুণ-তরুণীরা প্রতিদিন গড়ে ৪৬ মিনিট সময় কাটান ফেসবুকে। এর তুলনায় ইউটিউবে ৫ মিনিট সময় কম দেন তাঁরা। গতবারের তুলনায় সময় কাটানোর এই হার কাছাকাছি, খুব বেশি হেরফের হয়নি এ ক্ষেত্রে। তবে ইমোতে সময় কাটানো বেশ কমিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। সেই প্রভাবই পড়েছে ইমোর জনপ্রিয়তায়।
জরিপে দেখা গেছে, বর্তমানে ফেসবুকে আকৃষ্ট মোট তরুণ-তরুণীর মধ্যে ৪২ শতাংশের বেশি প্রতিদিন গড়ে আধা ঘণ্টা সময় ফেসবুকে দিচ্ছেন। ৩১ থেকে ৬০ মিনিট পর্যন্ত সময় দিচ্ছেন ৪৫ শতাংশ। তবে ১ ঘণ্টার বেশি সময় দেওয়া তরুণ-তরুণীর সংখ্যা আগের চেয়ে কমেছে।
অন্যদিকে ইউটিউবে ৩০ মিনিট পর্যন্ত সময় কাটানো তরুণ-তরুণীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৬১ শতাংশ। সময় কাটানোর দিক থেকে ফেসবুক-ইউটিউবের তুলনায় ইমো-হোয়াটসঅ্যাপ তাঁদের খুব আকর্ষণ করতে পারছে না। জরিপ অনুযায়ী, তাঁদের ৮০ শতাংশের বেশি এই দুই মেসেজিং অ্যাপে সর্বোচ্চ আধা ঘণ্টা সময় কাটান। তরুণ-তরুণীদের সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার প্রসঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ভালো কিংবা মন্দ, তা নির্ভর করে ব্যবহারকারীর ওপর। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে বাদ দিয়ে চলা যাবে না, কিন্তু এগুলোর ক্ষতিকর দিক বাদ দিয়ে ইতিবাচক দিকগুলো নিতে হবে। এ বিষয়ে তাঁদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। শিক্ষক ও অভিভাবকদের এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে হবে।
আরও সংবাদ
বিষয়:

দিনরাত কাটে ইন্টারনেটে
ইন্টারনেটে কী কী কাজ হয়, সেই হিসাব রাখার চেয়ে কোন কোন কাজ হয় না—সেই হিসাব রাখা বেশি সহজ। অন্তত আঙুল গুণেই তা মনে রাখা সম্ভব। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে ব্রিটিশ কম্পিউটার বিজ্ঞানী টিম বার্নার্স লির এই উদ্ভাবন। দিনকে দিন ইন্টারনেটের সঙ্গে মানুষের বাঁধন আরও দৃঢ় হচ্ছে।
বিশ্বজুড়েই ইন্টারনেটের আধিপত্য বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। জন্মদিনের ছবি আপলোড থেকে শুরু করে বাজারসদাই, চাকরির আবেদন, টাকা লেনদেন—সবই এখন সম্ভব ইন্টারনেটে।
বাংলাদেশের তরুণেরা এখন অবসরে একটা বড় সময় কাটাচ্ছেন ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে। টেলিভিশন দেখা ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার পরই এর অবস্থান।
প্রথম আলোর উদ্যোগে পেশাদার জরিপ সংস্থা ওআরজি-কোয়েস্ট রিসার্চ লিমিটেডের এক জরিপে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। জরিপে দেখা গেছে, অবসরে সময় কাটানোর উপায় হিসেবে ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চ্যাটিং বা গল্পগুজবে তরুণেরা বেজায় আগ্রহী। ৫৩ শতাংশের বেশি তরুণের কাছে এটি জনপ্রিয়। এ প্রবণতা শহর ও গ্রামাঞ্চল—সবখানে প্রায় একই।
দেশের তরুণেরা গড়ে প্রতিদিন ৮৭ মিনিট বা প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় ইন্টারনেটে কাটান। ২০১৭ সালে এটি ছিল ৮০ মিনিট। টেলিভিশন ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে গল্পগুজবেও এত সময় দিচ্ছেন না তরুণেরা। এ প্রবণতা শহুরে ও উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মধ্যে তুলনামূলক বেশি। এই দুই শ্রেণির তরুণেরা প্রতিদিন গড়ে ১০০ মিনিটের বেশি সময় কাটান ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে।
২০১৭ সালের সঙ্গে এবারের জরিপের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ইন্টারনেট ব্রাউজ ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তরুণদের সময় কাটানোর হার আগের চেয়ে বেড়েছে। ৩০ মিনিট পর্যন্ত সময় কাটানোর ক্ষেত্রে তরুণের সংখ্যা গতবারের তুলনায় ৭ শতাংশ বেশি। আর দুই ঘণ্টার বেশি সময় কাটানোর ক্ষেত্রে তরুণদের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৯ শতাংশ।
গুণগত জরিপে তরুণেরা বলেছেন, তাঁদের কাছে অবসর কাটানোর সেরা উপায় ইন্টারনেট। বই-পত্রিকা পড়া, টেলিভিশন দেখা বা রেডিও শোনা—কিছুই এর ধারেকাছে নেই। শহুরে তরুণদের কাছে ইন্টারনেটের জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি। কারণ, এর মাধ্যমে তাৎক্ষণিক খবর পাওয়া থেকে শুরু করে পরিবার-পরিজন ও দূরদূরান্তের বন্ধুবান্ধবের সঙ্গেও সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা যায়।

ইন্টারনেট নয়, ভালো মন্দ নিজের ভেতরে
থম আলোর তারুণ্য জরিপ থেকে দুই দিন আগে জানলাম, দেশে প্রতি চার তরুণের মধ্যে তিনজনই জীবনের লক্ষ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন। কর্মসংস্থান নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন প্রায় ৭৮ শতাংশ তরুণ। অথচ কী আশ্চর্য, এই তরুণদের ইন্টারনেট ব্যবহারের হিসাব–নিকাশের মধ্যে ‘লিংকডইন’–এর নাম কোথাও নেই!

উদ্বিগ্ন তরুণেরা যদি কাজের খোঁজে নানা সুযোগ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করতেন, দেশ–বিদেশে চাকরির জন্য আবেদন করতে শুরু করতেন, তাহলে তো লিংকডইনেই তাঁদের ভিড় করার কথা। কারণ, পেশাজীবীদের জন্য এটিই সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, আর কাজের সুযোগসন্ধানীদের জন্য ‘নেটওয়ার্ক’ তৈরি করার সবচেয়ে ভালো প্ল্যাটফর্ম। জরিপ বলছে, তরুণেরা প্রতিদিন গড়ে ৮৭ মিনিট সময় ব্যয় করেন ইন্টারনেটে। প্রতিদিন এই ৮৭ মিনিটের মধ্যে ১০ মিনিটও যদি আত্মোন্নয়নে কাজে লাগানো যেত, তরুণেরা যদি ইন্টারনেটের শক্তি কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন দক্ষতা রপ্ত করতেন, তাহলে নিশ্চয়ই উদ্বিগ্ন তরুণদের নিয়ে আমাদের উদ্বেগ অনেকটা কমত।
বাংলাদেশের আনাচকানাচে তথ্যপ্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের সুফল পৌঁছে যাচ্ছে বেশ দ্রুত। কিন্তু ডিজিটাল সাক্ষরতার (ডিজিটাল লিটারেসি) প্রয়োজনীয়তা বুঝতে আমরা বোধ হয় একটু দেরি করে ফেলেছি (শুধু আমরা বললে ভুল হবে, পুরো পৃথিবীই সময়মতো এর ব্যাপকতাটুকু ধরতে পারেনি)। আশার কথা হলো, এখন সরকারিভাবে মানুষকে ইন্টারনেটের ব্যবহার–আদবকেতা শেখাতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান কিংবা বেসরকারি সংস্থাগুলোও বিভিন্ন ক্যাম্পেইন আয়োজন করছে।
এ রকম বেশ কয়েকটি আয়োজনে গিয়ে আমি নিজেও ডিজিটাল সাক্ষরতার কথা বলেছি, আমাদের টেন মিনিট স্কুলে এ–সংক্রান্ত বিভিন্ন ভিডিও বানিয়েছি। কিন্তু দিন শেষে কেন যেন আমার কাছে পুরো ব্যাপারটাই ফুটো কলসের মতো মনে হয়। এক দিকে আমরা হয়তো দুজন মানুষকে ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহার শেখাচ্ছি, অন্যদিকে আরও দুজন নতুন ব্যবহারকারী যুক্ত হচ্ছেন, যিনি এ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তিনি হয়তো ফেসবুকের একটা ছবি কিংবা অনলাইনের যেকোনো খবর কোনো যাচাই–বাছাই ছাড়াই অকাট্য সত্য বলে ধরে নিচ্ছেন।
ফেসবুক অনেকটা চিনির মতো—আমাদের শরীর–মনে একধরনের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। চিনি খাওয়া কিন্তু খারাপ নয়। এর মধ্যে শরীরের জন্য কিছু উপকারী উপাদানও আছে। কিন্তু আপনি যদি খাওয়ার পরিমাণটুকু নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন, তাহলে বিপদ। আমাদের সমস্যা হলো, আমরা বলি বাচ্চাদের হাত থেকে মুঠোফোন কেড়ে নাও, ফেসবুক বন্ধ করে দাও। এটা তো সমাধান নয়। যে শিশুটিকে আপনি ইন্টারনেট থেকে দূরে রাখছেন, কদিন পর ওর ক্লাস হবে ইন্টারনেটে, ওর অফিস হবে ভার্চ্যুয়াল। অতএব, তাকে ইন্টারনেট থেকে দূরে রাখার কোনো উপায় নেই। বরং ওকে এর সঠিক ব্যবহার শেখান।
একটা মানুষের ইউটিউবের হোমপেজ হলো তাঁর প্রতিফলন। আপনার হোমপেজে কী ধরনের ভিডিও আসে? নাচ, গান, খবর, খেলাধুলা? গান হলে কার গান? কোন ভাষার গান? ইউটিউবের হোমপেজ একনজর দেখেই মানুষটির পছন্দ–রুচি সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। আমরা যদি নিজেরাই একবার নিজেদের হোমপেজের দিকে তাকিয়ে ভাবি, তৃতীয় একজন ব্যক্তি আমার হোমপেজ দেখে আমার সম্পর্কে কী ধারণা পাবে, আমি কি নিজেকে এভাবে অন্যের সামনে তুলে ধরতে চাই? তাহলেই কিন্তু নিজেকে বদলানোর তাগিদটা অনুভব করা যায়। পৃথিবীতে যত কিছু আবিষ্কৃত হয়েছে, প্রতিটিরই ভালো–মন্দ দিক আছে। দিন শেষে ভালো–মন্দ নিজের ভেতরে; ইন্টারনেট বা ফেসবুকে নয়।
লেখক: টেন মিনিট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা
আরও সংবাদ
বিষয়:
২৬ ডিসেম্বর ২০১৯, ১১:০৮

ভালো দিকগুলো দেখার পক্ষে
খুব স্বাভাবিকভাবেই ইন্টারনেট আমার কাছে অপরিহার্য বিষয়। একইভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো দারুণ প্রয়োজনীয়। কথা হচ্ছে, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো আমরা কখন ও কী কাজে ব্যবহার করছি। কাজের সময়ে ব্যবহার করলে এগুলোর বিভিন্ন নেতিবাচক দিকই সামনে আসবে। কেবল সময় কাটানোর জন্য ব্যবহার করলে একসময় এগুলো অভিশাপ হিসেবেই জীবনে প্রভাব ফেলবে। তারপরও সব বিচারে আমি ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ইতিবাচক দিকগুলো দেখার পক্ষে। তরুণ–তরুণীরা যেন এগুলো ব্যবহারে পরিমিতিবোধের পরিচয় দেয়, তা নিশ্চিত করাই প্রধান চ্যালেঞ্জ। কেননা এর সঙ্গে সময়, স্বাস্থ্য, সম্পর্ক এবং ভবিষ্যতের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়–আশয় সরাসরি যুক্ত।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বলতে ফেসবুকই আমাদের দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয়। এর ব্যবহারকারীদের সিংহভাগই তরুণ। ফলে তাদের না বললেও চলে যে ফেসবুক কতটা শক্তিশালী মাধ্যম। এর জনপ্রিয়তা বিশ্বব্যাপী। কারণ, ফেসবুক ব্যবহার করে আমরা আনন্দ পাই। অনলাইনে গুজব যেমন দ্রুত ছড়ায়, তেমনই ভালো খবর ছড়াতেও সময় লাগে না। ফেসবুক বা অনলাইন মাধ্যমগুলোকে ভালো খবর ছড়ানোর মতো কাজেই বেশি বেশি ব্যবহার করতে হবে। তরুণ–তরুণীরা অবশ্য এসব প্রতিদিনই করছে। ফেসবুকে রোজ অনেক ভালো কাজের খবর পাই, ছবি ও ভিডিও দেখি। এর পাশাপাশি এফ কমার্স অর্থাৎ ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসাতেও তাদের আগ্রহ বাড়ছে। অনেকেই ভালো কাজ করছে। ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রেও ফেসবুকের চাহিদা শীর্ষে। ফলে এই খাতেও তারা ভালো কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে। ডেভেলপাররা যেমন ফেসবুকের জন্যই তৈরি করছে গেমস ও অ্যাপ। আবার ভালোর পক্ষে দাঁড়ানোর প্ল্যাটফর্ম হিসেবেও ফেসবুকের ব্যবহার আমরা সারা বিশ্বে দেখছি। সবই কিন্তু করছে ফেসবুকের তরুণ ব্যবহারকারীরা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাণিজ্যিক সুবিধার বাইরে আরও হাজারটা সুবিধা আছে। তাই অভিভাবকদেরও খেয়াল রাখতে হবে, তাঁদের সন্তানেরা যেন ভালো কাজেই ইন্টারনেট বা ফেসবুক ব্যবহার করে। দেশের বাইরের খান একাডেমির কথাই ধরুন। অনলাইনে কত কিছু শেখাচ্ছে। ফেসবুকও কিন্তু একই রকম কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিচিত্র সব বিষয়ে আগ্রহী মানুষেরা মিলে গ্রুপ খুলছে। সেখানে মতবিনিময় হচ্ছে, নতুন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি হচ্ছে। আগ্রহ অনুযায়ী এই গ্রুপগুলোতে যুক্ত হওয়া, আদর্শ ব্যক্তিত্বকে অনুসরণ করা, বিশেষজ্ঞের শরণ নেওয়া—ফেসবুকে সবই কিন্তু সম্ভব। আবার এটাও ঠিক, ফেসবুকে কিছু দেখলেই চোখ বুজে বিশ্বাস করাও বোকামি। এটা গোটা ইন্টারনেটের বেলাতেই প্রযোজ্য। ফেসবুককে খবরের উৎস হিসেবে নেওয়ায় কোনো সমস্যা আমি দেখি না। এটি আর দশটি ওয়েবসাইটের মতোই। তবে খবর পেলে তা যাচাই করা বুদ্ধিমানের কাজ। এ কারণে এবারের ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবসে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের স্লোগান ছিল, ‘সত্য–মিথ্যা যাচাই আগে, ইন্টারনেটে শেয়ার পরে’।
ফেসবুক বা ইন্টারনেটে আসক্তি এখন বড় চিন্তার বিষয়। আদতে এই ‘স্ক্রিন টাইম’ তো কেবল ফেসবুককে ঘিরেই নয়। অতিরিক্ত টেলিভিশন দেখাও স্ক্রিন টাইমের মধ্যে পড়ে। তাই তরুণ–তরুণীদের এ বিষয় অবশ্যই সচেতন হতে হবে। অভিভাবকদের ভূমিকা বেশি। কারণ, একদম ছেলেবেলা থেকে এই অভ্যাস গড়ে উঠছে। দিনের নির্দিষ্ট সময়ে ফোন, কম্পিউটার ব্যবহারের নিয়ম করে দিলে সমাধান পাওয়া সম্ভব। আর তরুণ–তরুণীদেরকে নিজেদের ভালোর জন্যই স্ক্রিন টাইম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
সৈয়দ আলমাস কবীর, সভাপতি, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)

টেলিভিশনের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে ইন্টারনেট

অবসরে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে গল্পগুজব করেন, এমন তরুণের সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে। তবে পরিবারকে আগে যে সময় দিতেন, তা গড় হিসাবে কিছুটা কমেছে। অবশ্য অবসর কাটানোর ক্ষেত্রে এখনো তাঁদের সবচেয়ে বেশি পছন্দ টেলিভিশন। যদিও আগের চেয়ে সেই ঝোঁক কিছুটা কমে আসছে। সেখানে ইন্টারনেটে সময় কাটানোর প্রবণতা অনেক বেড়েছে। অবসরের মাধ্যম হিসেবে এখন টেলিভিশনের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে ইন্টারনেট।
দেশের তারুণ্যের ভাবনা জানতে প্রথম আলোর উদ্যোগে পেশাদার জরিপ সংস্থা ওআরজি-কোয়েস্ট পরিচালিত জরিপে তরুণ–তরুণীদের অবসর কাটানোর এমন চিত্র পাওয়া গেছে। এই জরিপে ১৫–৩০ বছর বয়সী ১ হাজার ২০০ জন অংশ নেন।
দুই বছর আগেও এই জরিপ করেছিল প্রথম আলো। ২০১৭ সালের সেই জরিপের সঙ্গে তুলনা করলে এবার তরুণ–তরুণীদের অবসর জগতে বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। যেমন অবসরে তাঁরা এখন আগের চেয়ে কিছুটা কম ঘুমান। সংবাদপত্র ও পাঠ্যসূচির বাইরের বই পড়া আগের চেয়ে কমেছে।
টেলিভিশন প্রথম পছন্দ হলেও ঝোঁক কমছে
লেখাপড়া, চাকরিসহ নিত্যদিনের কাজের ফাঁকে কিংবা ছুটিতে তরুণ–তরুণীরা নানাভাবে অবসর কাটান। কখনো সময় কাটান সৃষ্টিশীল কাজে, কখনো বিনোদনে। যেমন ২০১৭ সালের জরিপ অনুযায়ী, ৮০ দশমিক ৬ শতাংশ অবসরে টেলিভিশন দেখার কথা বলেছিলেন। দুই বছরের ব্যবধানে টেলিভিশন দেখার হার কিছুটা কমেছে। এবার ৭৮ দশমিক ২ শতাংশ টেলিভিশনের কথা উল্লেখ করেছেন। তবে অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে কোন দেশের টেলিভিশন অনুষ্ঠান বেশি দেখেন, এ ধরনের সুনির্দিষ্ট কোনো প্রশ্ন জরিপে করা হয়নি।
টেলিভিশন দেখার সময়ও কমেছে তাঁদের। আগে দিনে গড়ে প্রায় দেড় ঘণ্টা টিভি দেখার কথা বলেছিলেন তাঁরা। এখন তা কমে ঘণ্টাখানেকে দাঁড়িয়েছে। তাঁদের দেখা পছন্দের অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে নাটক, খবর, সিনেমা ও গান। এর মধ্যে তরুণ–তরুণীদের অর্ধেকের বেশির কাছে জনপ্রিয় হলো নাটক ও খবর। যদিও এ দুটির জনপ্রিয়তা, বিশেষ করে খবরের জনপ্রিয়তা অনেকটা কমেছে। সেই তুলনায় সিনেমা দেখা, গান শোনা কিছুটা বেড়েছে।
সবচেয়ে বেশি পছন্দ টেলিভিশন হলেও তা আগের চেয়ে কমে আসছে। ইন্টারনেটে সময় কাটানোর প্রবণতা বেড়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাট্য সংগঠক ও অভিনেতা রামেন্দু মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের মান তেমন বাড়েনি। এ কারণে টেলিভিশনের প্রতি তাঁদের আগ্রহ হয়তো কমে আসছে। তবে আগের চেয়ে খবরের জনপ্রিয়তা কমার কারণটি পরিষ্কার নয়। হয়তো তাদের রাজনীতিবিমুখতার কারণে তারা খবর কম দেখতে পারে।’
গল্পগুজব ও ইন্টারনেটে যত সময়
তবে তরুণ–তরুণীরা অবসরের পুরোটাই টেলিভিশনে কাটান না। পরিবার–পরিজন ও বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করে ও আড্ডা দিয়ে এবং ইন্টারনেটেও কাটান বড় একটা সময়। জরিপ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে তাঁদের ৪৩ শতাংশ বলেছিলেন, অবসরের দ্বিতীয় পছন্দ পরিবারের সঙ্গে গল্প করে সময় কাটানো। সেখানে এবার ৬০ শতাংশের বেশি পরিবারের সঙ্গে গল্পগুজব করার কথা জানিয়েছেন। অর্থাৎ এখন তাঁদের মধ্যে পরিবারের সঙ্গে অবসর কাটানোর প্রবণতা আগের চেয়ে বেড়েছে। টেলিভিশন দেখা ও গল্পগুজব—এই দুই পছন্দের মধ্যে ব্যবধানও কমে এসেছে। আগে এই দুই পছন্দের মধ্যে ব্যবধান ছিল ৩৭ দশমিক ৬ শতাংশ। এবার তা কমে হয়েছে ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ।
আবার পরিবারের সঙ্গে গল্প বা আড্ডা দিয়ে সময় কাটানো মেয়েদের সংখ্যা পুরুষের চেয়ে বেশি। আর ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। পরিবারের সঙ্গে গল্প বা আড্ডা দেওয়ার সংখ্যা বাড়লেও তাদের সময় দেওয়ার গড় আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে। আগে যেখানে তাঁরা দিনে গড়ে এক ঘণ্টার বেশি সময় দিতেন, সেখানে এখন তার চেয়ে প্রায় ১৫ মিনিট সময় কম দেন।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, এখন তরুণ–তরুণীরা অবসরে সবচেয়ে বেশি সময় দিচ্ছেন ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তাঁরা গড়ে প্রতিদিন ৮৭ মিনিট বা প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় ইন্টারনেটে কাটান। ২০১৭ সালে তা ছিল ৮০ মিনিট। এ প্রবণতা শহুরে ও উচ্চশিক্ষিত তরুণ–তরুণীদের মধ্যে তুলনামূলক বেশি। এই দুই শ্রেণি প্রতিদিন গড়ে ১০০ মিনিটের বেশি সময় কাটায় ইন্টারনেটে।
শহুরে তরুণ–তরুণীদের মধ্যে ইন্টারনেটের জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি হওয়ার কারণও জরিপে উঠে এসেছে। ইন্টারনেট এখন তাঁদের তাত্ক্ষণিকভাবে সংবাদ জানার উৎস। বিদেশে থাকা পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমও এটি। ইন্টারনেট সংবাদ দেখা, গান শোনা এবং টেলিভিশন দেখারও সুযোগ করে দিয়েছে। আবার কোনো তথ্য তাৎক্ষণিক ও দ্রুত জানতে ইন্টারনেটের ব্যবহার হচ্ছে।
ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তাঁদের তৃতীয় পছন্দ হলেও অন্য মাধ্যমগুলোর তুলনায় এটির প্রতি ঝোঁক বেশ বেড়েছে। শীর্ষে থাকা টেলিভিশনের এখন বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে সামনে এসেছে ইন্টারনেট। ২০১৭ সালে তাঁদের ৪১ দশমিক ৬ শতাংশ বলেছিলেন, ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তাঁদের অবসরের পছন্দ। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৫৩ দশমিক ৪ শতাংশ।
তবে বেশির ভাগ তরুণ–তরুণী একমত যে বর্তমানে তরুণ প্রজন্ম ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খুব বেশি সময় ব্যয় করে। যার নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে। এ জন্য তারা দেশে পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব, হতাশা, সাইবার অপরাধ বৃদ্ধি, জালিয়াতি, ধর্ষণ, মাদকাসক্তি এবং ভুয়া সংবাদ ছড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতাকে দুষছে। আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তাঁদের পেশা গড়ার পথে বাধা হিসেবেও কাজ করছে। বয়স্কদের চেয়ে কম বয়সী তরুণ–তরুণীদের ওপর ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নেতিবাচক প্রভাব বেশি। যাঁরা ইন্টারনেট ব্যবহারের ভালো–মন্দ দিকগুলো বুঝতে পেরেছেন, তাঁরাই এই মাধ্যমের সুবিধা পাচ্ছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সুমন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ইন্টারনেট ব্যবহারের পরিধি দ্রুতই বাড়ছে। এর ফলে অচিরেই বিনোদন কিংবা সংবাদের উৎস হিসেবে ইন্টারনেট প্রথম স্থান নিয়ে নেবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে একই সঙ্গে ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্তির বিষয়েও সতর্ক থাকা দরকার বলে মনে করেন তিনি। তাঁরা দিনে গড়ে দুই ঘণ্টার বেশি ইন্টারনেট ব্যবহার করলে তা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইন্টারনেটের পুরো জগৎটা তাঁদের বোঝা দরকার, বোঝানো দরকার। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক কিংবা অভিভাবকদের কী করা উচিত, তা সমাজবিজ্ঞানীরাই ভালো বলতে পারবেন।
সংবাদপত্র, ঘুম ও খেলা
অবসরে ঘুমানো তরুণ–তরুণীদের পঞ্চম পছন্দ। জরিপে তাঁদের ৩৯ শতাংশ বলেছেন, অবসরে ঘুমান। অবশ্য অবসর কাটানোর সময় হিসেবে ঘুমানোর অভ্যাস পছন্দের তালিকায় দ্বিতীয়। অবসরে তাঁরা দিনে গড়ে সোয়া ঘণ্টা ঘুমিয়ে কাটানোর কথা বলেছেন। গতবারের জরিপ অনুযায়ী, তাঁরা দিনে গড়ে ঘুমাতেন ৬৯ মিনিট। অবসরে ছেলেদের (২৭ দশমিক ৪ শতাংশ) চেয়ে মেয়েরা (৫০ দশমিক ৫ শতাংশ) ঘুমানোর কথা বলেছেন বেশি।
২০১৭ সালে তাঁদের ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ বলেছিলেন, অবসরে তাঁরা খেলাধুলা করেন। ২০১৯ সালে তা বেড়ে হয়েছে ২৮ দশমিক ২ শতাংশ। তবে খেলাধুলায় সময় ব্যয় আগের তুলনায় কমেছে। আগে অবসরে দিনে গড়ে ৮০ মিনিট সময় ব্যয় করতেন তাঁরা, এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬২ মিনিট।
জরিপ বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, সংবাদপত্র ও বই (পাঠ্যপুস্তকের বাইরের) পড়ে অবসর কাটানোর প্রবণতা আগের চেয়ে কমেছে। ২০১৭ সালে তাঁদের প্রতি ১০ জনের তিনজন বলেছিলেন, অবসরে তাঁরা সংবাদপত্র ও বই পড়েন। এবার জরিপে মোটের ওপর তাঁদের প্রায় দুজনের উত্তরে এই অভ্যাসের কথা এসেছে। আগে তাঁরা দিনে গড়ে ৩৪ মিনিট সময় দিতেন সংবাদপত্রে, এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৯ মিনিটে।
তবে তথ্য জানার উৎস হিসেবে ছাপা সংবাদপত্র ও অনলাইন নিউজ পোর্টালের গুরুত্ব আগের তুলনায় বেড়েছে। সবচেয়ে বেড়েছে অনলাইন নিউজ পোর্টাল। আগে তাঁদের মাত্র ৯ শতাংশ বলেছিলেন, তথ্য জানার উৎস অনলাইন নিউজ পোর্টাল; এবার তা বেড়ে হয়েছে ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ।
তরুণ–তরুণীদের অবসরভাবনা নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন প্রথম আলোকে বলেন, সময় কাটানোর জন্য সামাজিক মাধ্যম ও ইন্টারনেটে তাঁরা আগের চেয়ে বেশি সময় ব্যয় করেন, এটি বৈশ্বিক চিত্র থেকে খুব ভিন্ন নয়। গণযোগাযোগ ও আন্তর্ব্যক্তিক যোগাযোগ সব সময় পরস্পরবিচ্ছিন্নও নয়। সবার সঙ্গে টেলিভিশন দেখা যেমন পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর পরিপূরক হতে পারে; তেমনি সামাজিক মাধ্যমে পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সময় কাটানোর ছবি দেওয়া বা গল্প শেয়ার করাও কিন্তু আকর্ষণ হতে পারে।
তরুণ–তরুণীদের তথ্য জানার আগ্রহেরও কমতি হয়নি উল্লেখ করে গীতি আরা নাসরিন বলেন, সব মাধ্যমের কাছেই তাঁদের বড় একটি প্রত্যাশিত বিষয় খবর। তথ্য-স্মার্ট থাকতে চান। দ্রুত সেই তথ্য পেতেও চান। সুতরাং বিভিন্ন মাধ্যমে সঠিক তথ্য পাওয়া বা নেতিবাচক তথ্য পাওয়ার মতো যে সমস্যাগুলো তাঁরা শনাক্ত করছেন, সেগুলো অতিক্রম করতে তাঁদের সহায়তা করা, অর্থাৎ তাঁদের মিডিয়া-সাক্ষর করে তোলা এখন একটি জরুরি বিষয়।
অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিনের মতে, ডিজিটাল জগতে অতিরিক্ত সময় কাটানো কমিয়ে আনার জন্য আরও দরকার অবসর কাটানোর বিকল্প সুযোগ তৈরি। তাঁরা খেলাধুলা কম করছেন, কিংবা বই কম পড়ছেন, এ বিষয়ে শুধু ইন্টারনেটকে দুষে তো লাভ নেই। বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুললে, ইন্টারনেটেও তাঁরা ই-বই পড়বেন। কিংবা খেলাধুলার সুযোগ ও পরিসর থাকলে হয়তো এত দূর স্ক্রিননির্ভর তাঁরা হবেন না। সুতরাং তরুণ–তরুণীদের যথাযথ মানসিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য সামগ্রিকভাবে তাঁদের সুস্থ ও গঠনমূলক অবসর কাটানোর সুযোগ তৈরি করা নিয়েও চিন্তা করতে হবে।

বছরটি কেমন গেল

মুহম্মদ জাফর ইকবাল : এ বছরটি প্রায় শেষ। অন্যদের কথা জানি না, আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে সামনের বছরটির জন্য অপেক্ষা করছি। এর প্রধান কারণ সামনের বছরটিকে আমরা টুয়েন্টি টুয়েন্টি বলতে পারব (যখন কেউ চোখে নির্ভুল দেখতে পারে সেটাকে টুয়েন্টি টুয়েন্টি ভিশন বলে!)।
সামনের বছরটি নিয়ে আমরা নানা ধরনের জল্পনা-কল্পনা করছি; কিন্তু এই বছরটি কেমন গেছে? আমি একটা ছোট কাগজে বছরের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার তালিকা লিখতে গিয়ে দেখি বেশিরভাগই মন খারাপ করা ঘটনা। কে জানে আমাদের মস্তিষ্ক হয়তো আনন্দের ঘটনা সহজেই ভুলে যায়, মন খারাপ করা ঘটনা না চাইলেও মনে থাকে।
যেমন ধরা যাক নুসরাতের ঘটনাটি। আমরা গল্প-উপন্যাস লেখার সময় বানিয়ে বানিয়ে নুসরাতের মতো চরিত্র তৈরি করি; কিন্তু সত্যি সত্যি যে আমাদের চারপাশের মানুষের মাঝে নুসরাতের মতো তেজি মেয়েরা থাকে কে জানত?
নুসরাতের ঘটনাটি যে খুব বিচ্ছিন্ন একটি ঘটনা তা কিন্তু নয়; প্রায় নিয়মিতভাবে আমরা খবরের কাগজে এরকম খবর পড়ি, যেখানে একটা ছোট মেয়েকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলা হচ্ছে। এ ধর্ষক ও খুনিরা প্রায় সব সময়ই ধরা পড়ে যায়, তাদের বিচার হয়, শাস্তি হয়; কিন্তু তারপরও মেয়েদের ওপর নিষ্ঠুরতার ঘটনা কমছে না। আমি গবেষক নই, তারপরও মনে হয় ঘটনাগুলো বাড়ছে, কেন বাড়ছে আমরা জানি না।
শুধু আমাদের দেশে বাড়ছে তা নয়, আমাদের পাশের দেশ ভারতবর্ষে নারী ধর্ষণের ঘটনাগুলো রীতিমতো ভয়াবহ, ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’র বদলে নতুন বাক্য চালু হয়েছে, ‘রেপ ইন ইন্ডিয়া’ (ভারতবর্ষের অবস্থা সব দিক দিয়েই ভয়াবহ, তবে আমাদের দেশে সেটা নিয়ে সমালোচনা করলে ছাত্রলীগ এবং দু’একজন মন্ত্রী খুব নাখোশ হন, কারণটা কী?)।
নুসরাতকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া খুব কষ্টের। বিএনপি-জামায়াত এক সময় একেবারে সাধারণ নিরীহ মানুষদের পেট্রলবোমা দিয়ে পুড়িয়ে মারার ব্যাপারে খুব বড় এক্সপার্ট হয়েছিল, সেজন্য তাদের মনের ভেতর কখনও কোনো অনুশোচনা হয় কিনা আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে। সেই পুড়ে যাওয়া মানুষদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে আমাদের দেশে খুব ভালো বার্ন ইউনিট গড়ে উঠেছিল। তাই যখন কেরানীগঞ্জের প্লাস্টিক কারখানায় আগুনে পুড়ে একজন মারা গেল এবং ৩৪ জনকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেয়া হল, তখন আমি ভেবেছিলাম তাদের প্রায় সবাই হয়তো বেঁচে যাবে।
একেবারে সর্বশেষ খবর অনুযায়ী সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ২২ জন মারা গেছে। একেবারে সাধারণ কমবয়সী শ্রমিক, মৃত্যু এসে তাদের যন্ত্রণার উপশম করে গেছে; কিন্তু তাদের আপনজনদের হাহাকারের দায়িত্ব কে নেবে? দুর্ঘটনার ওপর কারও হাত নেই, কিন্তু এ ঘটনাগুলো তো দুর্ঘটনা নয়। খবরের কাগজের খবর অনুযায়ী এ প্লাস্টিক কারখানার অনুমোদন পর্যন্ত ছিল না! আমরা কখনও রানা প্লাজার কথা ভুলব না; কিন্তু সেই ভয়াবহ রানা প্লাজার ঘটনার পর এখন আমাদের গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি সারা পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে নিরাপদ ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। কেরানীগঞ্জের এ নিষ্ঠুর ঘটনার পর কি একই ধরনের ব্যাপার ঘটতে পারে না? এই দেশ কি শ্রমিকদের জন্য একটি নিরাপদ কর্মক্ষেত্র হতে পারে না?
যে মৃত্যুগুলোর কথা আমরা সরাসরি জানতে পাই, শুনতে পাই সেগুলো নিয়ে আমরা বিচলিত হই। কিন্তু যে মৃত্যুগুলোর কথা আমরা জানতে পাই না, শুনতে পাই না সেগুলো নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না। সে রকম মৃত্যু কিন্তু নিঃশব্দে ঘটে যাচ্ছে। এর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে পরিবেশ দূষণ। আমরা যারা ঢাকা শহরে থাকি তারা সব সময়ই এ দূষণ দেখে বড় হয়েছি। আমরা সেটা প্রায় মেনেই নিয়েছিলাম, কখনও কল্পনা করিনি ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ আসলে সারা পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে ভয়াবহ দূষণ, এখানকার বাতাস প্রতিদিন না হলেও মাঝে মাঝেই সারা পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত বাতাস।
বিষয়টি জানার পর থেকে আমি প্রতিদিন বাতাসের খোঁজ নিই, শুনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, আমি এখন পর্যন্ত একদিনও বাতাসকে ‘অস্বাস্থ্যকর’, ‘ভয়ঙ্কর অস্বাস্থ্যকর’ ছাড়া আর কিছু দেখিনি! যারা এ বাতাসে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে, তারা যদি সড়ক দুর্ঘটনা বা অন্য কিছুতে মারা যেতে না পারে, ভয়ঙ্কর রোগে শোকে ভুগে মারা যেতে হবে। হাসপাতালের বিল দিতে দিতে পরিবার সর্বস্বান্ত হয়ে যাবে! আগে বায়ুদূষণের ব্যাপারটি নিয়ে কাউকে মাথা ঘামাতে দেখিনি।
আজকাল মাঝে মাঝেই খবরের কাগজে এ নিয়ে আলোচনা হয়, এমনকি ঢাকার আশপাশে কিছু বেআইনি ইটভাটা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে বলেও খবর বের হয়েছে। ধুলাবালি কমানোর জন্য পানি ছিটানো হয় বলেও জেনেছি। এক সময় ঢাকা শহর খুব পরিপাটি ছিল, আবার এটি একদিন পরিপাটি শহর হবে সেই আশায় আছি। ইচ্ছা করলে এবং চেষ্টা করলে সবই সম্ভব। শুনেছি বড় শহরের মাঝে রাজশাহী শহরটি নাকি খুব সুন্দর একটা শহরে পরিণত হয়েছে। এ নতুন রূপ নেয়ার পর দেখতে যাওয়া হয়নি। দেখার জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি।
সারা বছর নানারকম খারাপ খবরের শিরোনাম হয়ে যে সংগঠনটির নাম এসেছে সেটি হচ্ছে ছাত্রলীগ। লিচু চুরি থেকে শুরু করে ধর্ষণ, খুন, নির্যাতন কিংবা শিক্ষককে পুকুরে ফেলে দেয়া- তাদের কর্মকাণ্ডে কী নেই? আমি অনেকবার বলেছি, আমাদের অত্যন্ত দক্ষ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশাল একটি অর্জনকে ছাত্রলীগের পুঁচকে একজন সদস্য কোনো প্রত্যন্ত এলাকায় একটি অপকর্ম করে মুহূর্তে ধূলিসাৎ করে দিতে পারে।
আমার নিজের চোখে দেখা সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা ছিল, যখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কর্মীরা জয় বাংলা এবং জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিয়ে শিক্ষকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেয়ার দাবি উঠেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই নির্বাচন করাও হয়েছে। আমি একেবারে নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি, যদি সত্যি সত্যি ভালোভাবে ছাত্রছাত্রীদের ভোট দিতে দেয়া হয় তাহলে এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগের কোনো নেতা নির্বাচিত হয়ে আসতে পারবে না।
এ দেশে ছাত্রলীগ যে কী ভয়ঙ্কর একটা জায়গায় পৌঁছে গেছে আমরা সেটা নিশ্চিতভাবে বুঝতে পেরেছিলাম, যখন বুয়েটে আবরারকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। প্রশাসন তাদের পক্ষে, পুলিশ তাদের পক্ষে এবং তাদের কিছুই হবে না সে ব্যাপারে তারা এত নিশ্চিত ছিল যে, তারা পালিয়ে যাওয়ারও প্রয়োজন মনে করেনি।
ছাত্রলীগের সঙ্গে সঙ্গে এ বছর খবরের শিরোনাম হয়েছেন ভাইস চ্যান্সেলররা। শিক্ষা কিংবা গবেষণায় কোনো মহান অবদানের জন্য নয়, নানা ধরনের অপকর্মের জন্য। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ভাইস চ্যান্সেলর হচ্ছেন মোগল সম্রাটদের মতো। তাদের হাতে সব ক্ষমতা। যদিও নানা ধরনের কমিটির সিদ্ধান্ত নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর কথা; কিন্তু বাস্তবে সব কমিটি থাকে তাদের হাতের মুঠোয়। একটি বিশ্ববিদ্যালয় কেমন চলছে সেটি পুরোপুরি নির্ভর করে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের ওপর।
কাজেই সেই ভাইস চ্যান্সেলর মানুষটি যদি নিজে একজন শিক্ষাবিদ কিংবা গবেষক না হন, তাহলে সেই বিশ্ববিদ্যালয়টি গড়ে উঠবে কেমন করে? এ দেশের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এখানে ‘লবিং’ করে ভাইস চ্যান্সেলর হওয়া যায়। এ লবিং ভাইস চ্যান্সেলররা যখন ছাত্রলীগের গায়ের জোর নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চালান, সেখানে আমরা কী আশা করতে পারি? এ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ হয়ে উঠতে পারত। সেটি হয়নি, সেটি যে হবে তার কোনো সম্ভাবনাও দেখছি না। কী দুঃখের ব্যাপার!
আমাদের দেশের ভাইস চ্যান্সেলররা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যে বিষয়গুলো অনুভব করতে পারেন না, আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের দৈনন্দিন কাজকর্মের সঙ্গে না থেকেও সেগুলো বুঝতে পারেন। সমাবর্তন বক্তা হিসেবে আমি বেশ কয়েকবার মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছাকাছি বসে তার নিজের মুখে বক্তব্য শুনেছি। আনুষ্ঠানিক বক্তব্যের মাঝখানে তিনি সাধারণত একেবারে নিজের মতো করে কৌতুকের ভঙ্গিতে অনেক কথা বলেন।
আমি একবার তাকে নিজের লেখাপড়া নিয়েও কৌতুক করতে শুনেছি। কিন্তু তিনি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের লেখাপড়া নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন সেগুলো যুগান্তকারী। আমি দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলাম বলে শুধু টাকার লোভের কারণে এদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা কিভাবে এ দেশের ছেলেমেয়েদের নির্যাতন করেন সেটা খুব ভালো করে জানি।
সমন্বিত একটা ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে খুব সহজেই এদেশের ছেলেমেয়েদের অবিশ্বাস্য একটা যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয়া সম্ভব; কিন্তু সেটি করা হচ্ছে না। আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রথম এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন, যদিও এখন পর্যন্ত এদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতাবান ভাইস চ্যান্সেলর ও অধ্যাপকরা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিতে রাজি হননি। টাকার লোভ একজন মানুষকে কত নিচে নামাতে পারে সেটি নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হতে চায় না।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি শুধু যে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার কথা বলেছেন তা নয়, তিনি সান্ধ্যকালীন কোর্সের বিরুদ্ধেও কথা বলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা এর বিরুদ্ধে, কারণ তারা নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছে তাদের শিক্ষকরা নিজেদের সত্যিকারের কোর্সগুলো না পড়িয়ে সন্ধ্যাবেলার অর্থকরী কোর্সগুলো পড়ানোর জন্য জীবনপাত করছেন।
আমি এক ধরনের কৌতূহল নিয়ে শেষ পর্যন্ত কী হয় সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করছি। এর মাঝেই সান্ধ্যকালীন কোর্সের পক্ষে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি শুরু হয়েছে এবং আমার ধারণা, নানা ধরনের যুক্তিতর্ক দিয়ে সেটা শেষ পর্যন্ত বন্ধ করা হবে না। বাঘ একবার মানুষের রক্তের স্বাদ পেয়ে গেলে অন্য কিছু মুখে দিতে চায় না বলে জনশ্রুতি আছে। টাকাটাও সে রকম, একবার কেউ টাকার স্বাদ পেয়ে গেলে সেখান থেকে বের হওয়া যায় না।
এ বছর বারো মাসজুড়েই নানা ধরনের ঘটনা ঘটেছে; কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি ঘটনা ঘটেছে একেবারে বছরের শেষ মাসের শেষদিকে। একটি হচ্ছে রাজাকারের তালিকা, আরেকটা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের ‘বীরত্বগাথা’।
ইতিহাসে পাকাপাকিভাবে গেঁথে রাখার জন্য স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ দলিল। আমরা যারা একাত্তর দেখেছি তারা জানি একাত্তরে নানা ধরনের স্বাধীনতাবিরোধী ছিল। কেউ রাজাকার, কেউ আলবদর, কেউ আলশামস, কেউ শান্তি কমিটির সদস্য, আবার কেউ হয়তো কোনো দলেই নাম লেখায়নি কিন্তু তারপরও বড় ধরনের বিশ্বাসঘাতক যুদ্ধাপরাধী।
এ নানা ধরনের নামের মাঝে রাজাকার নামটি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছে এবং আজকাল যে কোনো স্বাধীনতাবিরোধী মানুষ বোঝানোর জন্য রাজাকার শব্দটি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু যখন একটি ঐতিহাসিক দলিল তৈরি করা হবে তখন কি তাদের ঐতিহাসিক পরিচয় দিয়ে পরিচিত করা উচিত নয়? তাদের মাঝে কেউ ছিল কাপুরুষ, কেউ ছিল নৃশংস, অপরাধের মাত্রাটিও কি এ তালিকায় উল্লেখ থাকতে পারত না?
কিন্তু রাজাকারের তালিকার এ বিষয়গুলো আমাকে কিংবা আমার মতো আরও অনেককে ক্ষুব্ধ করেনি। এতদিনে আমরা সবাই জেনে গেছি, এ তালিকায় শুধু রাজাকারের নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের নামও আছে। এ তালিকাটি অসম্পূর্ণ হতে পারত, যেখানে কোনো রাজাকারের নাম তোলা হয়নি কিংবা তাদের নাম ভুল বানানে লেখা হতে পারত, তাদের গ্রামের নামে ত্রুটি থাকতে পারত। কিন্তু এছাড়া আর অন্যকিছু কারও কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
যে রাজাকার নয় তার নাম ভুলে লেখা হয়ে থাকলেও আমরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হতাম, কারণ এদেশে রাজাকার শব্দটি হচ্ছে সবচেয়ে খারাপ গালি। একজন মানুষকে রাজাকার বলে গালাগাল করার চেয়ে বড় কোনো অপমান হতে পারে না। সেই অপমানটি করা হয়েছে বেশকিছু মুক্তিযোদ্ধাকে, এর চেয়ে বড় দুঃখের ব্যাপার আর কী হতে পারে?
আমরা সবাই বুঝতে পারছি, এ বিষয়টি মোটেও নিরীহ একটু ভুল নয়, এটি ইচ্ছাকৃত এবং এটি করা হয়েছে রাজাকারের তালিকাটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য। এরপর থেকে যতবার যতভাবে এ তালিকা তৈরি করা হবে, ততবার সবার মনে একটি প্রশ্ন থেকে যাবে যে, এটাও হয়তো সত্যিকারের তালিকা নয়। সবচেয়ে দুঃখের কথা, এ তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে কেউ এত বড় এ অন্যায়ের দায় নিচ্ছে না, একে অন্যকে দোষ দিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, আমরা কোনোদিন জানতে পারব না কেমন করে এত বড় একটি অন্যায় করা হল বিজয়ের মাসে দেশের সবচেয়ে সম্মানিত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে!
এ বছরের দ্বিতীয় ঘটনাটিও কম হৃদয়বিদারক নয়। আমরা সবাই জানি, আজকাল যে কোনো একজন মানুষের সর্বনাশ করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে মানুষটিকে জামায়াত কিংবা শিবির হিসেবে পরিচিত করে দেয়া। সরকারের বিরুদ্ধে কিংবা প্রচলিত পদ্ধতির বিরুদ্ধে কথা বললেও আজকাল এ ঝুঁকিটি নিতে হয়। কত সহজে কত সাধারণ মানুষকে এ অপবাদটি নিতে হচ্ছে তার হিসাব নেই। এভাবে চলতে থাকলে একটি সময় আসবে যখন যারা সত্যিকারের জামায়াত-শিবির হয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করে যাচ্ছে, তাদের আর আলাদা করা যাবে না।
এ দেশে কারা মুক্তিযুদ্ধকে সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ করেছে? একেবারে কোনোরকম দ্বিধা না করে বলে দেয়া যায়, সেটি ঘটেছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সংগঠনের হাতে। নির্বাচিত ডাকসু ভিপি এবং তার সঙ্গে অন্য কিছু ছাত্রকে নির্দয়ভাবে পিটিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সদস্যরা। মুক্তিযুদ্ধ শব্দটিকে এর চেয়ে বড় অবমাননা করা কি সম্ভব? এ দেশের মানুষ কি নিজের অজান্তেই ‘মুক্তিযুদ্ধ’ শব্দটিকে এখন খুব বড় অন্যায়, অনৈতিক ও নিষ্ঠুরতার সঙ্গে যুক্ত হতে দেখছে না? আমরা কেমন করে এটি ঘটতে দিচ্ছি?
এই অর্বাচীন তরুণরা কি জানে তারা কেমন করে এদেশের সবচেয়ে মহান অবদানটির কত বড় অসম্মান করেছে?
২.
কেউ যেন মনে না করে ২০১৯ সালে বুঝি শুধু খারাপ খারাপ ঘটনা ঘটেছে। সেটি মোটেও সত্যি নয়। সবাই কি জানে আমাদের দেশের শিশুরা আন্তর্জাতিক রোবটসংক্রান্ত প্রতিযোগিতায় কতগুলো সোনা, রুপা ও ব্রোঞ্জপদক এনেছে?
আমরা আমাদের এই সোনার শিশুদের মুখের দিকে তাকিয়েই সব দুঃখ-কষ্ট-গ্লানি
দেশ অগ্রসর হলেও আয়বৈষম্য কমেনি
নানামুখী প্রকল্প গ্রহণ ও সরকারের উদ্যোগে দারিদ্র্যের হার কমলেও দেশে আয়বৈষম্য বাড়ছে। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পর যে দারিদ্র্য ছিল, তা এখন কমেছে ঠিকই কিন্তু দূর হয়নি। ভবিষ্যতেও দূর করা সম্ভব হবে না। বরং ধনীর সঙ্গে দরিদ্রের আয়বৈষম্য প্রকট হচ্ছে। দেশকে এগিয়ে নিতে আয়বৈষম্য কমাতে হবে। দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে ভেবে ঢিলেঢালা অবস্থান না নিয়ে সরকারকে আরো কাজ করতে হবে। দারিদ্র্যের সংজ্ঞায়নে আয়ের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংকের বেঁধে দেওয়া ধারণা থেকেও বের হয়ে আসতে হবে।
গতকাল বুধবার বিকেলে রাজধানীর বনানীতে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) আয়োজিত অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলি খানের ‘দারিদ্র্যের অর্থনীতি : অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও বিশিষ্টজনরা এসব কথা বলেন।
বইটি প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। পাঁচ খণ্ডে বইয়ে ১৫টি অধ্যায় রয়েছে, যাতে দারিদ্র্যের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ তুলে ধরেছেন লেখক ড. আকবর আলি খান। দেশ স্বাধীনের পর দারিদ্র্য নিরসনে কুমিল্লা মডেল, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, এনজিও ভূমিকা, ব্র্যাকের ফজলে হাসান আবেদের ভূমিকা, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম ও ইসলামী ব্যাংকের ভূমিকার কথা তুলে ধরেছেন।
পিআরআই চেয়ারম্যান ড. জায়েদী সাত্তারের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিন। স্বাগত বক্তব্য দেন পিআরআই নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর।
ড. ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্জন অসাধারণ। এখন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়নে জোর দিতে হবে। অনেকে বলেছেন দেশে সুশাসন নেই, গণতন্ত্র নেই। আমি সবাইকে চ্যালেঞ্জ করছি—বাংলাদেশের সমান প্রবৃদ্ধি বা অর্থনৈতিক উন্নয়ন করছে এমন দেশ কোথায়, যেখানে বাংলাদেশের চেয়ে সুশাসন অনেক ভালো? বাংলাদেশের অর্জন অনেক সেটাও তো বলতে হবে।’

হে নামাজী আমার ঘরে নামাজ পড় আজ
C
হে নামাজী আমার ঘরে নামাজ পড় আজ
দিলাম তোমার চরন তলে হৃদয়-জায়নামাজ ।।

আমি গুনাহগার বেখবর নামাজ পড়ার নাই অবসর
(তব) চরন ছোয়ায় এই পাপিরে কর সরফরাজ।।

তোমার অজুর পানি মোছ আমার পিরান দিয়ে
আমার এ ঘর হোক মসজিদ তোমার পরশ নিয়ে।

যে শয়তানের ফন্দিতে ভাই
খোদায় ডাকার সময় না পাই
সেই শয়তান যাক দুরে
শুনে তকবীরের আওয়াজ।।

এত জঘন্য অপরাধী পদাসীন হয়ে রাজনৈতিক দলে এত দিন থাকে কিভাবে?
ড. সা’দত হুসাইন
বাংলাদেশে ভয়ংকর সন্ত্রাসী এবং জঘন্য অপরাধীর সংখ্যা প্রচুর। এবং তা যেন বেড়েই চলেছে। দেশের প্রতিটি নগর, শহর, বন্দর, জেলা, উপজেলা, গ্রাম-গঞ্জ, ইউনিয়ন নানা নামের সন্ত্রাসী বাহিনী দ্বারা উপদ্রুত। বাহিনীগুলো তাদের কর্তৃত্বাধীন এলাকার জনগণকে সন্ত্রস্ত রাখছে। এলাকার মানুষের সহায়-সম্পদ, মান-সম্মান, শারীরিক নিরাপত্তা কার্যত এদের মতি-মর্জির ওপর নির্ভর করে। অনেক ক্ষেত্রে এদের চাঁদা দিয়ে প্রকারান্তরে নিরাপত্তা কিনতে হয়। এলাকার প্রশাসন, নিরাপত্তা বাহিনী এদের শাসন করে না; বরং পরোক্ষভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে সুনজরে থাকতে চেষ্টা করে। এদের সঙ্গে সখ্য গড়ে নিজের পদ-পদবি, অবস্থান সুদৃঢ় করতে প্রয়াস পায়। দুর্বৃত্তের দল বিনা বাধায় অপ্রতিরোধ্য গতিতে তাদের দুষ্কর্ম চালিয়ে জনপদের জনমানুষকে অতিষ্ঠ করে তোলে। ওপরের স্তরের নেতা-নেত্রীরা সব কিছু জেনেও না জানার ভান করেন। আসলে তাঁরা নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য দুর্বৃত্ত গোষ্ঠীকে প্রশাসনিক এবং আইনি সমর্থন দিয়ে যান।
অপকর্মের মূল ভূমিকায় থাকে দুর্বৃত্ত গোষ্ঠী, যারা সন্ত্রাসী হতে পারে, লুটেরা হতে পারে কিংবা হতে পারে দখলদার অথবা প্রতারক। সবাই জানে দেশের আর্থিক খাত থেকে হাজার হাজার, সত্যি বলতে কী লক্ষাধিক কোটি টাকা লুটেরা পরিচালক এবং গ্রাহকরা সরিয়ে নিয়েছে। এ টাকা আর ফিরে আসবে বলে মনে হয় না। আন্তর্জাতিক সংস্থা, দাতাগোষ্ঠী এবং গণদাবির চাপে কর্তৃপক্ষ ধীরে ধীরে ঋণখেলাপি লুটেরাদের নাম প্রকাশ করতে শুরু করেছে। যদিও কর্তৃপক্ষ আপ্রাণ চেষ্টা করে, যাতে ঋণখেলাপির বিশদ পরিচয় লোকে না জানতে পারে। তারা শুধু ঋণখেলাপির কম্পানির নাম উল্লেখ করে; কিন্তু কম্পানির মালিকের নামধাম বাধ্য না হলে উল্লেখ করে না। এতদ্সত্ত্বেও যাদের নামধাম প্রকাশ পেয়েছে, তারা নেতৃস্থানীয় রাজনীতিবিদ নন। এরা ব্যবসায়ী অথবা সামাজিক পরগাছা। প্রতারণামূলক কাজের মাধ্যমে এরা জীবিকা অর্জন করে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের টাকা হাতিয়ে নেয়। আর্থিক অঙ্গনে ও সামাজিক বলয়ে এদের যে পরিচিতি এবং প্রতিষ্ঠা তাতে এ ধরনের ব্যক্তিরা শত শত বা হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ সংগ্রহ করতে পারে না। একটু পর্যালোচনা করলে বা খোঁজখবর নিলে বোঝা যায় ক্ষমতাধর কোনো রাজনৈতিক শক্তি এদের পেছনে রয়েছে। কাগজে-কলমে ক্ষমতাধর সমর্থনকারী গোষ্ঠীর নামধাম থাকে না। অথচ এরা লুটেরা খেলাপিদের পক্ষ হয়ে দেন-দরবার করেন। ক্ষমতা দেখান। বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকি দেন। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কার্যকর সমঝোতা গড়ে তোলেন রাজনীতিবিদরা, দৃষ্টির আড়ালে থাকলেও তাদের অলিখিত প্রভাবকে সম্বল করে দুষ্কৃতকারীরা এগিয়ে যায়।
ধরা না পড়া পর্যন্ত দুর্বৃত্ত গোষ্ঠী ক্ষমতাধর রাজনীতিবিদ কিংবা প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দকে তাদের দুষ্কর্ম-অর্জিত অর্থের একাংশ নানা অজুহাতে হিসসা হিসেবে দিয়ে যায়। এটি সরাসরি ক্যাশ স্থানান্তর হতে পারে। বিকল্প হিসেবে দামি উপহার-উপঢৌকনও হতে পারে। প্লট, ফ্ল্যাট, রিসোর্ট, গাড়ি, বৃহৎ শেয়ার, এমনকি শিল্প, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের আংশিক মালিকানা অপকৌশলের মাধ্যমে উপহার-উপঢৌকন হিসেবে ক্ষমতাধর গোষ্ঠী, বিশেষ করে শীর্ষ স্তরের নেতা-নেত্রীকে প্রদান করা হয়। বাইরের লোক এটি সচরাচর জানতে পারে না। নেতা-নেত্রীরা প্রাপ্ত সম্পদের ব্যবস্থাপনায় অংশ নেন না। তারা অনেকটা সুপ্ত অংশীদার (Spleeping partner) হিসেবে থাকেন। প্রতি মাসে বা একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর সম্পদ থেকে অর্জিত মুনাফা তাদের হাতে নীরবে পৌঁছে যায়। তারা আনন্দের সঙ্গে তা ভোগ করেন। সামনে কম পরিচিত ব্যবসায়ী, শিল্পপতি; পেছনে প্রভাবশালী, ক্ষমতাধর রাজনীতিবিদ।
প্রাক-স্বাধীনতাকালেও কিছু শক্তিমান যুবক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। সরাসরি সন্ত্রাসী না হলেও পেশি প্রদর্শন করে প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনের সমর্থকদের ভয় দেখাতে চেষ্টা করত। রাজনৈতিক সংগঠনের মধ্য পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ এদের চিনতেন এবং সৌজন্যমূলক আদর-আপ্যায়নের মাধ্যমে এদের খুশি রাখতে চেষ্টা করতেন। শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এদের প্রত্যক্ষ পরিচয় ছিল না। এদের খুশি করার ব্যাপারে শীর্ষ নেতৃবৃন্দের বাড়তি তৎপরতা ছিল না। সংগঠনের সমর্থনে হৈ-হুল্লোড়, হাঙ্গামা এমনকি শারীরিক আগ্রাসনে অংশ নিলেও শক্তিমান এই গোষ্ঠী কখনো সংগঠনের পদাসীন কর্মকর্তা (ঙভভরপব ইবধত্বৎ) হওয়ার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করেনি; শক্তি প্রদর্শন তো নয়ই। তারা বড়জোর সংগঠনের কোনো উপগোষ্ঠীকে সমর্থন করেছে এবং সে গোষ্ঠীর পক্ষে কাজ করেছে। সে গোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিয়েছে, বিরোধী গোষ্ঠীকে দাবিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছে। সংগঠনের নেতৃত কিন্তু লব্ধ প্রতিষ্ঠ নেতা-নেত্রীর হাতেই ছিল। অর্থসম্পদের দিক থেকে শক্তিমান যুবকরা আহামরি কিছু ছিল না। তারা মাঝারি মানের রেস্টুরেন্টে বসে কখনো নগদে, কখনো বাকিতে আবার কখনো অন্যের পয়সায় চা-নাশতা সহযোগে আড্ডা দিত। সুউচ্চ মানের হোটেলে তাদের যাওয়া-আসা ছিল না। মূল রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সামনে যেতে তারা উৎসাহিত বোধ করত না। দলের শক্তিমান বাহিনী (Musclemen) হিসেবে চলাফেরা করার আনন্দ তাদের জন্য যথেষ্ট ছিল। এর বেশি তাদের কিছু চাহিদা ছিল না।
গত কয়েক দশকে উঁচু পর্যায়ের নেতা-নেত্রীদের মধ্যে মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটেছে। অর্থসম্পদ এবং সস্তা জনপ্রিয়তার প্রতি তাঁদের লোভ-লালসা অনেক বেড়ে গেছে। তাঁবেদারি মোসাহেবি, বৈষয়িক সুবিধা প্রদানের ইচ্ছা ও সক্ষমতাকে তারা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। ফলে একনিষ্ঠ এবং নিঃস্বার্থভাবে অনুগত কর্মীকে বাদ দিয়ে সম্পদশালী, চালবাজ সদস্যকে তাঁরা সংশ্লিষ্ট এলাকার সংগঠনে পদাসীন (Office Bearer) করছেন। সত্যি বলতে কি, কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটি, উপদেষ্টা কমিটি কিংবা বিশেষ কমিটিতেও তাদের স্থান করে দেওয়া হচ্ছে। প্রত্যেক তাঁবেদার, মোসাহেবের পেছনে এক বা একাধিক বড় নেতা উন্নয়ক (Promoter) হিসেবে কাজ করেন। এসব তাঁবেদার সংগঠনের নীতি-আদর্শ সম্পর্কে ওয়াকিফহাল নয়, তারা সততা-নৈতিকতার ধার ধারে না; অনৈতিক, অসামাজিক এবং সন্ত্রাসী কাজে লিপ্ত হওয়া তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। এরাই হয়ে উঠেন সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদাসীন ব্যক্তি রূপে।
পদাসীন হওয়ার পর তাদের অপকর্মের দ্বার খুলে যায়। পদ-পদবি ব্যবহার করে তারা অর্থসম্পদ বৈষয়িক সুযোগ-সুবিধা সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এ লক্ষ্যে যেকোনো অনৈতিক, অসামাজিক কাজ করতে তারা দ্বিধান্বিত হয় না। সাধারণ মানুষের সুবিধা-অসুবিধা, দুঃখ-কষ্ট, যন্ত্রণা-ক্ষতি এসবের প্রতি তারা ধার ধারে না। যা করলে তাদের স্বার্থসিদ্ধি হয় তা-ই তারা করে যায়। কেউ বাধা দিলে তাকে হেনস্তা করতে প্রবৃত্ত হয়। আইন-কানুন, বিধি-বিধান অবলীলাক্রমে তারা এড়িয়ে যায়। তারা বিশ্বাস করে যে জনবল-ধনবলের বদৌলতে যেকোনো অপকর্ম-অপরাধ করে তারা পার পেয়ে যাবে। বাস্তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের বিশ্বাস জয়ী হয়। তারা হয়ে উঠে অপ্রতিরোধ্য। সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সাধারণ প্রশাসনের কর্মকর্তা, ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী সবার কাছে উপহার-উপঢৌকন পৌঁছে যায়। প্রয়োজনমতো আর্থিক সমর্থনও পৌঁছে দেওয়া হয়। কখনো চাহিদা মোতাবেক, কখনো না চাইতেই। এরূপ দান-অনুদান, সাহায্য-সমর্থন পেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, বেসরকারি এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা অপরাধী-সন্ত্রাসীর প্রতি কৃতার্থ থাকেন। এদের বিরুদ্ধে তাঁরা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না; বরং পরোক্ষভাবে এদের যাবতীয় অপরাধ-অপকর্মকে সমর্থন-সহযোগিতা দিয়ে যান। রাষ্ট্র, সমাজ এবং সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পদাসীন দুর্বৃত্তরা রাতারাতি ক্ষমতাধর হয়ে উঠে না। তারা সাধারণত নিম্নবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। সুযোগ পেয়ে দাঁও মেরে প্রথমে কিছুটা সচ্ছলতা অর্জন করে। তারপর ‘গডফাদার’ বা ‘গডমাদার’-এর হাত ধরে ওপরে উঠতে থাকে। গডফাদার, গডমাদার বিনিময়ে যে বৈষয়িক সুবিধা পান, তা নিতান্ত অপ্রতুল নয়। ব্যক্তি বিশেষের কাছে অনুপার্জিত আয়ের (Unearned income) একটা বড় আনন্দ রয়েছে। ‘ফাদার-মাদার’রা সে আনন্দ অবারিতভাবে উপভোগ করেন। দলে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান খাজনা সংগ্রহের (Rent Seeking) সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। বাড়তি আয়ের সুযোগ নেতা-নেত্রীর সঙ্গে দুর্বৃত্ত সদস্যের একধরনের মেলবন্ধন সৃষ্টি করে। দুর্বৃত্ত সদস্য সাধারণ গোছের সমস্যায় পড়লে ‘ফাদার-মাদার’ নেতা-নেত্রীরা তার সাহায্যে এগিয়ে আসেন, তাকে সুরক্ষা দেন। এ ধরনের সুরক্ষা দুর্বত্ত সদস্যকে সাহস জোগায়, তাকে অপকর্মে উৎসাহিত করে, তাকে বেপরোয়া করে তোলে। অত্যাচারে অতিষ্ঠ হলেও সাধারণ মানুষ দুর্বত্ত সদস্যের কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারে না। তারা নীরবে অভিশাপ দিয়ে অপকর্ম সহ্য করে। অসুবিধা হয়, যখন ক্ষমতাধর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনী তাকে হাতেনাতে ধরে ফেলে আদালতে সোপর্দ করে বসে। একই সঙ্গে গণমাধ্যমে তার কীর্তি-কলাপ প্রকাশ করে দেয়। ‘গডফাদার-মাদার’ বুঝতে পারেন এ সময় দুর্বৃত্ত সদস্য থেকে সরে থাকা বাঞ্ছনীয়। দুর্বৃত্ত সদস্যের সঙ্গে মেলবন্ধন তো দূরের কথা, তাদের সঙ্গে সাধারণ সম্পর্কের কথাও তারা অস্বীকার করেন। এককথায় দুর্বৃত্ত সদস্যকে তারা চটজলদি বিসর্জন দেন। সংগঠন থেকে পরিত্যক্ত হলে দুর্বৃত্তের পতন ঘটে। তার প্রভাব ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকে। কাছের মানুষরা দূরে সরে যায়; হারিয়ে যায়। দুর্বৃত্ত সদস্যও একসময় প্রভাব-প্রতিপত্তি হারিয়ে ঝোড়ো কাকের অবয়বে বেঁচে থাকে। বেশির ভাগ সময় তার করুণ অন্তর্ধান ঘটে।
আমাদের রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীরা যদি অনৈতিক আয় ও সম্পদের লোভ-লালসা পরিহার করে কালোত্তীর্ণ নৈতিক মূল্যবোধ আঁকড়ে থাকেন, তবে জঘন্য অপরাধী দলে পদাসীন হওয়া তো দূরের কথা, অনুপ্রবেশই করতে পারবে না। দলের বহির্বৃত্তে অবস্থান করে সময় বিশেষে দলকে নির্দোষ সমর্থন জোগাবে, বিনিময়ে দল থেকে কোনো পদ-পদবি বা বৈষয়িক সুবিধা দাবি করবে না। সন্ত্রাসী-অপরাধীরা তাদের জগতে থাকবে। রাজনৈতিক দলের সংগঠনিক বা নীতিনির্ধারণী বিষয়ে তারা নাক গলাবে না। রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীদের বেশি কাছে তারা ঘেঁষবে না, তাদের পিঠে হাত রেখে কথা বলবে না। বড়জোর দূর থেকে সালাম দিয়ে কেটে পড়বে।
পদ-পদবি থেকে জঘন্য অপরাধী, সন্ত্রাসী, দখলদার, প্রতারকদের সরিয়ে রাজনৈতিক দলকে কলুষমুক্ত করতে হলে রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের হাতে ফিরিয়ে দিতে হবে। বিশাল অর্থসম্পদের লোভ-লালসা থেকে রাজনীতিবিদদের সরে আসতে হবে। রাজনৈতিক মূল্যবোধকে কোনোক্রমে বিসর্জন দেওয়া যাবে না। রাজনীতিবিদদের মূল কাজ দেশ ও জনগণের সেবা। জনগণের ভালোবাসা এবং দেশের কল্যাণ হচ্ছে তাদের বড় সম্পদ। অপরাধীদের দেওয়া অর্থসাহায্য, উপহার-উপঢৌকন রাজনীতিবিদদের চরিত্র নষ্ট করে, মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটায়। পরিণামে সংগঠন এবং রাজনীতিকের সর্বনাশ ডেকে আনে। কোনো অসতর্ক মুহূর্তে অপরাধী, সন্ত্রাসীরা যাতে রাজনীতিবিদদের পকেটে অথবা তার ঘরে পাপের অর্থ-সম্পদ পাঠিয়ে দিতে না পারে সে ব্যাপারে নেতা-নেত্রীকে সাবধান থাকতে হবে। নিজে সৎ হলেই হবে না, অসৎ ব্যক্তি কিংবা জঘন্য অপরাধী যেন সৎ রাজনীতিকদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বা নাম ব্যবহার করে অন্যায় সুবিধা না নিতে পারে, অন্যায় অর্থ অর্জন না করতে পারে অথবা সংগঠনে প্রভাব বিস্তার না করতে পারে সৎ রাজনীতিবিদ তার প্রতি কঠোর দৃষ্টি রাখবেন। ছোট ছোট ফাঁক দিয়ে বিষধর সাপ ঘরে ঢুকে পড়ে। সে ফাঁকগুলো বন্ধ করতে হবে। নিদেনপক্ষে তার প্রতি নিরন্তর সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। একটু কষ্ট হলেও ফাঁকগুলো বন্ধ করে দেওয়াই শ্রেয়।
বঙ্গবন্ধু ও তরুণ প্রজন্ম
হাজার বছরে অনেক মনীষী বাংলার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতির প্রসার ঘটিয়েছেন। নিঃসন্দেহে তাদের অবদান ভোলার নয়; কিন্তু এদের সব অবদানকে বুকে ধারণ করে তিলে তিলে একটি অসামান্য স্বপ্নের বীজ বাঙালির মনে গেঁথে দিয়েছেন খুবই সাফল্যের সঙ্গে কেবল একজনই। সেই স্বপ্নটি হলো, বাঙালির আলাদা একটি রাষ্ট্র হবে। সেই রাষ্ট্রের নায়ক হবেন একজন বাঙালি। এই রাষ্ট্রের ভাষা হবে বাংলা। সেই স্বপ্নের ফেরিওয়ালার নাম শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি পরম মমতায় তাঁকে ডাকেন বঙ্গবন্ধু বলে। তাঁর অসাধারণ বাগ্মিতা, মানবিকতা, সাধারণ মানুষের প্রতি সহমর্মিতার গুণেই তিনি হতে পেরেছিলেন বাংলাদেশের সব মানুষের স্বপ্নের সম্রাট। আমাদের জাতির পিতা। আমার বড়ই সৌভাগ্য যে, আমি ঐতিহাসিক এই ‘মুজিববর্ষে’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারছি। সে জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং ইউজিসির চেয়ারম্যানের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। এই অবস্থানে থেকে আমি ছাত্রছাত্রীর মনে আমার ও আমাদের প্রাণের মানুষ বাঙালির মুক্তির বাতিঘরের ঠিকানা গেঁথে দেওয়ার উদ্যোগ নিতে পারছি।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, তরুণরাই আগামীর বাংলাদেশের ভরসার প্রতীক। স্বপ্নচারী এই তরুণরাই বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছে। তাদের অদম্য প্রাণশক্তির বলেই মুক্তিযুদ্ধে আমরা বিজয়ী হয়েছি। মুক্তিযোদ্ধারা সবাই ছিলেন বয়সে তরুণ। বেশিরভাগই গ্রামের ছেলেমেয়ে। প্রায় ৮০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন সরাসরি কৃষকের সন্তান। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছেলেমেয়েদের সংখ্যা বিপুল হলেও সরাসরি কৃষিকাজে নিয়োজিত তরুণদের সংখ্যাও কম ছিল না। শহরের ছাত্রছাত্রীদের পরিবারের সঙ্গেও গভীর সম্পর্ক ছিল গ্রামবাংলার। এরা সবাই দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দেওয়ার এক অবিস্মরণীয় প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। একাত্তরের সেই দিনগুলো ছিল সত্যি হিরণ্ময়। আনন্দ ও বেদনার সেই দিনগুলোতে তরুণদের আত্মবলিদানের সেই দৃশ্য যারা নিজের চোখে দেখেননি, তারা কল্পনাও করতে পারবেন না- স্বদেশের জন্য প্রাণ বিতরণের সে কী অসামান্য প্রতিযোগিতা! ‘হাজার বছরের নিপীড়িত-নিগৃহীত বাঙালির এই জেগে ওঠার উপাখ্যান আসলেই বিস্ময়কর। আর তা সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুর মোহনীয় নেতৃত্বের গুণেই। তরুণরা তাঁর বজ্রকণ্ঠকে পাথেয় করেই বাংলা মায়ের কোলে মাথা রেখেছে। স্বদেশের মাটিকে নিজেদের রক্তে উর্বর করেছে। যেমনটি উর্বর করেছেন বঙ্গবন্ধু তাঁর পবিত্র রক্ত ঢেলে বাংলাদেশের সবুজ মাটি। এমনি এক স্বপ্ন সঞ্চারি নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি পুরো দেশবাসীকে, বিশেষ করে তরুণদের আরও বেশি করে স্বপ্ন দেখতে উৎসাহ দিতেন। আরও বেশি করে গুণমানের শিক্ষা লাভের অনুপ্রেরণা দিতেন। আর সেই স্বপ্নের সমান হওয়ার আহ্বান জানাতেন। ধ্বংসস্তূপের ওপরে দাঁড়িয়েও তিনি আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্যে ‘কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন’ গঠন করেছিলেন। তারুণ্যের শক্তিকে দেশ নির্মাণে কাজে লাগাবেন বলেই তিনি এমন দূরদর্শী নীতি-উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করতেন, ‘সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই। শোষিত, নির্যাতিত ও লুণ্ঠিত বাংলাদেশের সমাজদেহে সমস্যার অন্ত নেই। এই সমস্যার জটগুলোকে খুলে সুখী ও সমৃদ্ধশালী দেশ গড়তে হলে দেশবাসীকে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়াতে হবে’ (বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭৪)। এমন করে বলতে তিনিই পারেন, যিনি এক রূপান্তরবাদী নেতা। আর তিনিই সেই নেতা, যিনি তাঁর অনুসারীদের, বিশেষ করে তরুণদের মনে লড়াই করার শক্তির সঞ্চার করতে পারেন। সহনেতা তৈরি করতে পারেন। অনুসারীদের নেতৃত্বের ‘ল্যান্ডস্কেপে’ যথার্থভাবে যুক্ত করতে পারেন। আর জাতির সামনে দীর্ঘমেয়াদি ‘ভিশন’ দাঁড় করাতে পারেন। আমাদের বঙ্গবন্ধু ‘সোনার বাংলা’ গড়ব বলে সেই রকম সুদূরপ্রসারী পথনকশা তৈরি করে দিতে পেরেছিলেন। আর তাই বর্তমান তরুণদের কাছেও তিনি এক অবিস্মরণীয় রাষ্ট্রনায়ক।
আমাদের তরুণদের চোখে বঙ্গবন্ধু কেমন? আমরা সম্প্রতি ১৫২৩ জন তরুণ, যাদের বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছর, যাদের ৭৩ শতাংশই শিক্ষার্থী, তাদের প্রশ্ন করেছিলাম, বঙ্গবন্ধু শব্দটি উচ্চারণ করলেই কি দৃশ্যপট তাদের মনে পড়ে! কেন এমনটি মনে হয়? কেমন করে তিনি সমসাময়িক সব নেতাকে ছাড়িয়ে এমন অনন্য হতে পেরেছিলেন? আগামী প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুকে কী হিসেবে স্মরণ করবেন? উল্লেখ্য, প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তরে অন্তত ৬টি অপশন ছিল এবং একটি প্রশ্নের উত্তরে একাধিক অপশন বাছাই করে কিক করার সুযোগ ছিল।
জরিপে অংশ নেওয়া ৭৬ শতাংশ তরুণ জানিয়েছেন যে, বঙ্গবন্ধুর নাম এলেই তাদের মনে প্রথমে আসে ৭ মার্চের ভাষণের কথা। এদের মধ্যে ৭৯ শতাংশ বলেছেন- তারা মনে করেন, ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ ও দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য পুরো জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং দেশ স্বাধীন হয়েছিল; তাই বঙ্গবন্ধুর কথা মনে এলেই তাদের প্রথমে ওই ঐতিহাসিক ভাষণটির কথা মনে আসে।
৬৫ শতাংশ তরুণ জানিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর নাম এলেই তাদের মনে প্রথমে আসে স্বাধীন বাংলাদেশের কথা। এদের মধ্যে ৮১ শতাংশ বলেছেন, বঙ্গবন্ধু নিঃস্বার্থভাবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বলেই এ দেশ স্বাধীন হয়েছিল; তাই তাঁর কথা উঠলেই স্বাধীন বাংলাদেশের কথা মনে আসে। বঙ্গবন্ধুর নাম এলেই আরও যেসব শব্দ বা শব্দগুলোর কথা মনে পড়ে বলে উত্তরদাতারা জানিয়েছেন সেগুলো হলো :জাতির পিতা (৫৯ শতাংশ), ৬ দফা আন্দোলন (৫৬ শতাংশ) এবং সংগ্রামী দেশপ্রেমিক (৫১ শতাংশ)।
সমসাময়িক অন্য রাজনৈতিক নেতাদের ছাপিয়ে বঙ্গবন্ধু কী করে একক জাতীয় নেতা হলেন?- এ প্রশ্নের জবাবে ৮৪ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, বঙ্গবন্ধু তাঁর নেতৃত্বের গুণাবলির কারণে একক জাতীয় নেতা হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। ৭১ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, বঙ্গবন্ধুর আপসহীন মানসিকতা তাঁকে সব শ্রেণির মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল বলে তিনি পুরো বাঙালি জাতির নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। ৬৫ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, বঙ্গবন্ধু সবসময় নিঃস্বার্থভাবে রাজনীতি করেছেন বলে দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে ভরসার পাত্র হয়ে উঠতে পেরেছিলেন আর তাই তিনি হয়েছিলেন একক জাতীয় নেতা। বঙ্গবন্ধুর একক জাতীয় নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পেছনের কারণ হিসেবে আরও যেসব বিষয় উত্তরদাতারা চিহ্নিত করেছেন সেগুলো হলো :বঞ্চিত মানুষের প্রতি বিশেষ মনোযোগ (৬১ শতাংশ), সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা বোঝার সক্ষমতা (৬০ শতাংশ) এবং ভাষা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা (৫৬ শতাংশ)।
৭৭ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, আগামী প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করবে একজন আদর্শ জাতীয় নেতা হিসেবে। ৭১ শতাংশ মনে করেন, বাঙালি জাতির পিতা হিসেবে তিনি আগামী প্রজন্মের মনে থাকবেন। ৬৫ শতাংশ মনে করেন, বঙ্গবন্ধু তাঁর আপসহীন ও নিঃস্বার্থ রাজনীতির কারণে আগামী প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
তরুণদের ওপর পরিচালিত জরিপ থেকে তারা কীভাবে বঙ্গবন্ধুকে দেখে এবং তাদের ভাবনার কতটা জায়াগাজুড়ে কীভাবে তিনি আছেন, সে সম্পর্কে ধারণা পেয়েছি এবং সঙ্গত কারণে আশান্বিতও হয়েছি। তরুণদের ওপর পরিচালিত এই জরিপই বলে দেয় যে, বঙ্গবন্ধুকে দেশের শত্রু বলেছিল ‘তুমি কেউ নও’, সেই বঙ্গবন্ধুই দিন দিন আরও বিরাট, আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন। ‘যে স্বপ্নের লাশ পড়েছিল উদোম আকাশের নিচে’, সেই স্বপ্ন আজ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে দানা বাঁধছে আমাদের তরুণদের মনে। জরিপের ফলাফল নিয়ে আবারও খোলাখুলি আলাপে বসেছি আমার তরুণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। তারা সবাই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে।
এই শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম যে, আগামী প্রজন্মের চিন্তায় ও মননে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা, কর্ম ও দর্শনকে গেঁথে দিতে আমরা কী করতে পারি। আমি খুবই চমৎকৃত হয়েছি যে, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে আমাদের আজকের তরুণরাও এ বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবছে। তারা একটি বিষয়ের ওপর বিশেষ জোর দিচ্ছে। তা হলো, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষকে নিছক উদযাপনের মধ্যে আটকে না রেখে জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর আদর্শ ও দর্শনকে প্রতিফলিত করতে উদ্যোগ নেওয়া দরকার। এ জন্য কেউ পরামর্শ দিয়েছে স্কুল পর্যায় থেকে একেবারে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত তাঁর চিন্তাভাবনা ও কর্মকাণ্ডকে পাঠ্যসূচিতে এমনভাবে নিয়ে আসতে, যাতে করে আগামী প্রজন্মের নাগরিকরা তাদের জীবনে বঙ্গবন্ধুর প্রাসঙ্গিকতাটুকু যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’সহ তাঁর নিজের লেখা গ্রন্থগুলো পাঠ করা এবং এগুলোর ওপর ভিত্তি করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে গ্রুপভিত্তিক পাঠচক্র গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছে কেউ কেউ। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু বিষয়ে সচেতনতা ও আগ্রহ বাড়াতে বিশেষ উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরেছে অনেকে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের প্রেক্ষাপটে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে তরুণদের নিয়ে সাহিত্য সম্মেলন ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা করার পরামর্শও এসেছে তরুণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে যে, আজকের শিক্ষার্থীরা বঙ্গবন্ধুকে তরুণদের মনে গেঁথে দেওয়াটাকে কেবল রাষ্ট্রের একক দায় হিসেবে দেখছে না, বরং একটি সামাজিক ও জাতীয় দায়বোধের জায়গা থেকে ভাবছে। নিজেরাও এ জন্য উদ্যোগী হওয়ার প্রয়োজনীয়তাটি অনুভব করতে পারছে।
কবিগুরু লিখেছিলেন, ‘স্বদেশকে একটি বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে আমরা উপলব্ধি করিতে চাই। এমন একটি লোক চাই, যিনি আমাদের সমস্ত সমাজের প্রতিমাস্বরূপ হইবেন। তাহাকে অবলম্বন করিয়াই আমরা আমাদের বৃহৎ স্বদেশীয় সমাজকে ভক্তি করিব, সেবা করিব। তাহার সঙ্গে যোগ রাখিলেই সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের যোগ রক্ষিত হইবে।’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘স্বদেশী সমাজ’, ররীন্দ্র রচনাবলি ২য় খণ্ড, বিশ্বভারতী, ১৩৯৩, পৃষ্ঠা ৬৩৪)। নিঃসন্দেহে বাংলার মানুষ তাঁর সঙ্গে যোগ রেখেছিলেন বলেই এত দ্রুত দেশটি স্বাধীন করা সম্ভব হয়েছে। এরই মধ্যে ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো উঠে দাঁড়িয়েছে ‘আরেক বাংলাদেশ’, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বুকে নিয়ে তাঁরই সুকন্যার হাত ধরে। এই বাংলাদেশে শিশুরা নিশ্চয় খেলবে, মায়েরা হাসবে। তারুণ্যই এগিয়ে নিয়ে যাবে আমাদের এই দেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার সীমানায়। ‘মুজিববর্ষে’ তরুণরা এই অসামান্য নেতৃত্বের নানা অনুপ্রেরণার উৎস সন্ধান করবে, স্বদেশকে জানবে এবং ভালোবাসবে, সেই প্রত্যাশাই করছি। আমি সর্বদা তাদের পাশেই থাকব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
dratiur@gmail.com
বিশ্ব অর্থনীতিতে সুনামি ঢেউয়ের অপেক্ষায় বাংলাদেশ

বিশ্ব অর্থনীতিতে রীতিমতো তাণ্ডবলীলা চালাচ্ছে কভিড-১৯। অভূতপূর্ব এক দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বৈশ্বিক শিল্পোৎপাদন খাত। চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোসহ বৈশ্বিক অর্থনীতির রথী-মহারথী সব দেশেরই উৎপাদন খাত এখন পুরোপুরি ধরাশায়ী। ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে পুঁজি, মুদ্রা ও পণ্যবাজার। অর্থনৈতিক এ মহাদুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি থেকে নিজ নিজ দেশের আর্থিক খাত, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সর্বোপরি নিজ জনগণকে সুরক্ষা দিতে বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে নেয়া হয়েছে প্রণোদনামূলক নানা পদক্ষেপ। যদিও এ
করোনা সুনামির ঢেউয়ের আঘাত কীভাবে সামাল দেবে বাংলাদেশ, তা এখনো পরিষ্কার নয়।
৮০টিরও বেশি দেশ এরই মধ্যে আংশিক বা পূর্ণভাবে সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। লকডাউনে রয়েছে এর অধিকাংশই। পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত চালু থাকলেও বিদেশীদের ঢুকতে দিতে চাচ্ছে না কেউই। বৈশ্বিক পর্যটন, শিল্পোৎপাদন, সেবা ও আর্থিক খাতকে পুরোপুরি তলানিতে এনে ফেলেছে নভেল করোনাভাইরাস।
চলমান মন্দা কাটাতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো নানা অর্থনৈতিক প্রণোদনা কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে। এরই মধ্যে মার্কিন অর্থনীতিকে বাঁচাতে স্থানীয় সময় অনুযায়ী মঙ্গলবার সকালে ৮৫ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি প্যাকেজ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে জানায় ট্রাম্প প্রশাসন। এর মধ্যে শুধু ৩০ হাজার কোটি ডলার দেয়া হবে এয়ারলাইনস খাত ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে। দুর্যোগকালীন ভাতা হিসেবে নগদ ও করছাড়ের আকারে ৫০ হাজার কোটি ডলারের সহায়তা পাবে মার্কিন জনগণ। বিকালের মধ্যেই এ প্যাকেজ পরিকল্পনার আয়তন বেড়ে ১ লাখ কোটি ডলারের বেশি হচ্ছে বলে জানান দেশটির অর্থমন্ত্রী (ট্রেজারি সেক্রেটারি) স্টিভেন মানিউচিন। পরিকল্পনা সফলভাবে বাস্তবায়ন না করা গেলে যুক্তরাষ্ট্রে কর্মহীনতার হার বেড়ে ২০ শতাংশে দাঁড়াবে বলে শঙ্কিত মার্কিন অর্থমন্ত্রী। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোও গতকাল দেশটির নাগরিক ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ৮ হাজার ২০০ কোটি ডলারের প্যাকেজ পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন।
বড় পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে যুক্তরাজ্যও। দেশটির অর্থমন্ত্রী ঋষি সুনাক এরই মধ্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ৩৩ হাজার কোটি পাউন্ড (৪০ হাজার কোটি ডলার) ঋণ সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। সাড়ে ৪ হাজার কোটি ইউরোর (৫ হাজার কোটি ডলার) সহায়তা প্যাকেজ হাতে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে ইংলিশ চ্যানেলের ওপারের দেশ ফ্রান্সও।
পিছিয়ে নেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও। করোনাভাইরাস আক্রান্ত অর্থনীতিকে মন্দার হাত থেকে বাঁচাতে নীতি ও রাজস্ব সহায়তা নিয়ে নিজ জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে কাতার। এরই মধ্যে ঋণের কিস্তি পরিশোধ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করে দিয়েছে দেশটি। ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় খাতগুলোর জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২ হাজার ৩৩৫ কোটি ডলার। এর মধ্যে ব্যক্তি খাত বরাদ্দ পেয়েছে ২ হাজার ৬০ কোটি ডলার। পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল রাখতে প্রণোদনা দেয়া হয়েছে ২৭৫ কোটি ডলার। বেসরকারি খাতকে পর্যাপ্ত ঋণ সহায়তা দিতে ব্যাংকগুলোয় অতিরিক্ত তারল্য জোগান দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে কাতার কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কম-বেশি সব দেশই এখন রুগ্ণ অর্থনীতিকে বাঁচাতে নানা পদক্ষেপ হাতে নিচ্ছে। তার পরও পরিস্থিতি কবে নাগাদ নিয়ন্ত্রণে আসবে, সে বিষয়ে সন্দিহান সবাই। আস্থা পাচ্ছেন না বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীরাও। বিশ্ববাজারের প্রতিদিনের চিত্র এখন বৈশ্বিক অর্থনীতির দুর্যোগগ্রস্ততারই প্রতিফলন।
চলমান পরিস্থিতি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রতিটি দিনকে করে তুলেছে নরকসম। গতকালও ফ্রাংকফুর্ট, লন্ডন ও প্যারিসসহ গোটা ইউরোপের শেয়ারবাজার সূচকের পতন হয়েছে ৫ শতাংশের বেশি। একই মাপের ধসের মধ্য দিয়ে গেছে এশীয় শেয়ারবাজারও। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে দিনব্যাপী লেনদেন শুরু হতে না হতে ডাও জোনস সূচকের পতন ঘটে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ।
ধস নেমেছে জ্বালানি তেলের বাজারেও। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক দুই বাজার আদর্শ ডব্লিউটিও এবং ব্রেন্টের দাম নেমে এসেছে কয়েক বছরের সর্বনিম্নে, ব্যারেলপ্রতি যথাক্রমে ২৭ ও ২৫ ডলারে। একই দশা মুদ্রাবাজারেরও।
এদিকে করোনা প্রাদুর্ভাবের আগে থেকেই নানামুখী সমস্যার মোকাবেলা করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। প্রধান রফতানি খাত তৈরি পোশাকের রফতানি এখন নিম্নমুখী। ঘাটতি কাটাতে পারছে না রাজস্ব খাত। খেলাপি ঋণের চাপ ও তারল্য সংকটের কারণে আর্থিক খাতের দশাও বেহাল। বিদেশী বিনিয়োগও আসছে না কাঙ্ক্ষিত হারে। কৃষি খাতে উৎপাদন বাড়লেও বিপণন ও কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে দুর্বলতা কাটানো যায়নি। ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে রেমিট্যান্সের বৃহত্তম উৎস মধ্যপ্রাচ্য নিয়েও তৈরি হয়েছে বড় ধরনের শঙ্কা। কারণে-অকারণে অস্থির হয়ে উঠছে নিত্যপণ্যের বাজার। এসব সমস্যার মধ্যেই এখন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে নভেল করোনাভাইরাস।
এখন পর্যন্ত আক্রান্তের হার কম হলেও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে করোনার বড় আঘাত এসেছে অনেক আগেই। পুরোপুরি স্থবির হয়ে গেছে দেশের শীর্ষ আমদানি, রফতানি ও রেমিট্যান্সের বাজারগুলো। প্রতিনিয়ত বাতিল হচ্ছে তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্যের রফতানি আদেশ। আগে থেকেই বিপর্যস্ত ছিল পুঁজিবাজার। করোনার অভিঘাতে ক্রমাগত রক্তক্ষরণের ধারাবাহিকতায় এখন তা নির্জীব হয়ে পড়েছে পুরোপুরি।
এ পরিস্থিতি কাটানোয় এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে সুদহার নামিয়ে এনেছে প্রায় শূন্যে। কমিয়েছে অন্যান্য দেশও। অন্যদিকে বাংলাদেশ এ পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট বা আবছা—কোনো ধারণাও পাওয়া যায়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের ব্যাংকিং খাত এমনিতেই খেলাপি ঋণের ভারে বিপর্যস্ত। এখন করোনার ধাক্কায় অনেক শিল্প খাতই নতুন করে খেলাপির ঝুঁকিতে পড়বে। ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোকে সরকারের পক্ষ থেকে রাজস্ব সহায়তার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও নীতিসহায়তা দিতে হবে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক সভাপতি ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের মতে, পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংককে রাজস্ব ও নীতিসহায়তা দিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এরই মধ্যে নীতিসুদহার কমিয়েছে। বাংলাদেশেও এ সুদহার (রেপো) ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা দরকার। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোর জন্য পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করতে হবে। সরকার ঘোষিত বাজেট কাঠামো পুনর্গঠন করে কিছু খাতের রাজস্ব কমানোর প্রয়োজন হতে পারে।
অর্থনীতির এ দুর্বিপাক মোকাবেলায় বাংলাদেশ ব্যাংককেই মূল ভূমিকা পালন করতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধূরী বলেন, আইলা বা বন্যার মতো প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগের পর বিশেষ এলাকার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেয়। অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ঋণের সুদ মওকুফ কিংবা ঋণের কিস্তি পরিশোধে তিন-ছয় মাসের স্থগিতাদেশ দেয়া হয়। বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক সে অভিজ্ঞতাগুলো কাজে লাগাতে পারে। করোনা বৈশ্বিক অর্থনীতিতেই সুনামি নিয়ে এসেছে, এজন্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশের শিল্প খাতের জন্যও নীতিসহায়তার প্রয়োজন হবে। তবে নীতিসহায়তা ঢালাওভাবে না হয়ে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা খাতের জন্য হলে সেটি মঙ্গল বয়ে আনবে। অন্যথায় সুযোগের অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা থাকবে।
তিনি বলেন, সরকারকেও রাজস্ব সহায়তা নিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াতে হবে। রাজস্ব নীতিতেও পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে। সবার আগে যেটি প্রয়োজন, সেটি হলো পরিস্থিতির যথাযথ মূল্যায়ন ও ক্ষতি উত্তরণের রূপরেখা প্রণয়ন।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, অর্থনীতির চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংকগুলো তারল্যের জোগান দিতে সক্ষম। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকগুলোর হাতে বিনিয়োগযোগ্য তারল্য ছিল ১ লাখ ৫ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা। দেশের সিংহভাগ ব্যাংকেরই এডি রেশিও নির্ধারিত সীমার নিচে রয়েছে।
যদিও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। করোনাভাইরাস সংক্রমণের আগেই বিনিয়োগ খরায় ভুগছিল দেশের বেসরকারি খাত। জানুয়ারিতে ব্যক্তি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছিল ৯ দশমিক ২০ শতাংশে। নিম্নমুখী এ ঋণ প্রবৃদ্ধি দুই দশকের মধ্যেই সর্বনিম্ন। বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগেও এ প্রবৃদ্ধির গতি বাড়াতে সক্ষম হয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
দেশের অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনা একটা আকস্মিক ও অভূতপূর্ব ঘটনা। এর জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেয়ার সময় পায়নি বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. কে এ এস মুরশিদ বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশের সক্ষমতাও খুব সীমিত। অনেক উন্নত দেশও যেখানে হিমশিম খেয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের সমস্যা হওয়ারই কথা। তার পরও একটা চেষ্টা হচ্ছে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার। তবে এ বিষয়টি মূলত ব্যবস্থাপনার। আমদানি-রফতানির বাজার এরই মধ্যে ব্যাহত হয়েছে। এখন পর্যন্ত যেটি নিয়ন্ত্রণে, সেটি হলো অভ্যন্তরীণ বাজার। এ বাজারের নিয়ন্ত্রণ কোনোভাবেই হারানো যাবে না। বৈশ্বিক বাজারের নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে নেই।
তিনি আরো বলেন, এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলো পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাওয়া। প্রভাবটা কম তখনই হবে, যখন কভিড-১৯-এর নিয়ন্ত্রণটা ভালো হবে। যদি ভালো না হয়, তাহলে প্রভাবটা প্রকট হবে। প্রভাব পড়বেই কিন্তু অনেক কিছুই নির্ভর করছে আমাদের সামর্থ্যের ওপর।
ড. কে এ এস মুরশিদ বলেন, আমাদের সক্ষমতা যতটুকু, ততটুকুই আমাদের যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। সুব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে আমাদের সক্ষমতার যথাযথ ব্যবহার করতে পারলেই আমরা লাভবান হব। আমাদের সীমাবদ্ধতা আমরা জানি, কিন্তু এ সীমাবদ্ধতা নিয়েই স্বচ্ছ ও শক্তভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে।
বিষয়টি দুশ্চিন্তায় ফেলেছে দেশের শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদেরও। এ নিয়ে এফবিসিসিআই সহসভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, এখানে বড় বিষয় হলো আমাদের ৪০ লাখ শ্রমিক। যদি দুদিন পর কাজ না থাকে, বন্ধ হয়ে যায়, তখন এরা কীভাবে চলবে? ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রে সংক্রমণ পরিস্থিতি যদি দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হয়, তাহলে আমাদের অর্থনীতিতে কী হবে তা বলতে পারব না, তবে আমাদের রফতানি খাতে একটা ঝড় বয়ে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা সরকারের সহযোগিতা ছাড়া সংশ্লিষ্ট শিল্পোদ্যোক্তাদের নিজস্ব তাগিদে সম্ভব হবে না।
তবে করোনা মোকাবেলায় সরকার প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সচিবালয়ে গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, যে ভাইরাস নিয়ে সারা বিশ্ব বিপদে আছে, সেই ভাইরাস থেকে মুক্ত আছি বলতে পারব না।
আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, আইএমএফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের সদস্য দেশগুলোকে করোনা মোকাবেলায় সহযোগিতা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তারা যখন অর্থছাড় করবে, তখন আমরাও পাব। তবে আমরা সে অর্থের আশায় বসে থাকব না। নিজস্ব তহবিল দিয়েই এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করা হবে
অসুস্থ না হলে মাস্ক পরার প্রয়োজন নেই : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
যদি কেউ নোভেল করোনাভাইরাস সংক্রমিত কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত না হন এবং ভাইরাসটিতে আক্রান্ত কোনো রোগীর সেবা ও পরিচর্যা না করে থাকেন, তাহলে সেসব মানুষকে মাস্ক না পরার সুপারিশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। জাতিসংঘের এই অঙ্গসংগঠনটির এক সিনিয়র কর্মকর্তা সোমবার অর্থাৎ ৩০ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে এমনটাই জানিয়েছেন।
সংস্থাটির জরুরি স্বাস্থ্য কর্মসূচির নির্বাহী পরিচালক ডা. মাইক রায়ান সোমবার জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, গণহারে মাস্ক পরার কারণে সম্ভাব্য কোনো সুবিধা রয়েছে বলে নির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। প্রকৃতপক্ষে, মাস্কটি সঠিকভাবে পরা বা সঠিকভাবে ফিট করার অপব্যবহারের কারণে বিপরীতে কিছু হওয়ারই প্রমাণ পাওয়া গেছে।
মাস্ক ও অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে মাইক রায়ান আরও বলেন, এছাড়া আরও একটি বিষয় হলো, বৈশ্বিকভাবে এসব সরঞ্জামের ব্যাপক এক সংকট দেখা দিয়েছে। যেসব স্বাস্থ্যকর্মী সামনে থেকে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার কাজটি করছেন, বর্তমানে তারাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। কেননা তারা প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে ভাইরাসটির সংস্পর্শে আসছেন। তাদের মাস্ক না থাকার বিষয়টি ভয়াবহ।
এছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংক্রামক রোগ বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. মারিয়া ভ্যান কারকোভ আজকের সংবাদ সম্মেলনে বলেন, যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আমরা তাদের ক্ষেত্রে মাস্ক ব্যবহারের বিষয়টিতেই সবচেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছি। তারা হলেন, সামনে থেকে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া স্বাস্থ্যকর্মী।’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম গেব্রেয়সেসও সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
ডা. মারিয়া ভ্যান আরও বলেন, কমিউনিটির মানুষজনকে আমরা মাস্ক পরার সুপারিশ ততক্ষণ পর্যন্ত করবো না, যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি অসুস্থ না হন। কেননা শুধু অসুস্থ হলেই আপনার মাধ্যমে ভাইরাসটি বিস্তার লাভ করবে। আমরা তাদেরকেই মাস্ক পরার সুপারিশ করবো যারা অসুস্থ এবং যারা অসুস্থদের সেবা দিচ্ছেন।

বৈশ্বিক অর্থনীতিতে কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবের অভিঘাত এরই মধ্যে দ্রুততর এবং ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের (জিএফসি) চেয়ে আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, এমনকি তা ১৯৩০ সালের মহামন্দার চেয়েও। আগের দুটি ঘটনায় পুঁজিবাজারের ৫০ শতাংশ বা তার বেশি পতন ঘটা, ঋণবাজার রুদ্ধ হওয়া, অনেক করপোরেট প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে পড়া, বেকারত্ব হার ১০ শতাংশের ওপরে উন্নীত এবং জিডিপি বার্ষিক ১০ শতাংশ বা তারও বেশি সংকুচিত হয়েছিল। তবে এসব ঘটতে সময় লেগেছিল প্রায় তিন বছর। একইভাবে বর্তমান সংকটে মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যেই বিশ্বব্যাপী কঠিন সামষ্টিক, অর্থনৈতিক ও আর্থিক পরিণাম (আউটকাম) বাস্তব রূপ লাভ করেছে।
চলতি মাসের প্রথম দিকে ঠিক ১৫ দিনের মাথায় যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজার বিয়ার টেরিটরিতে (সূচকের শীর্ষ অবস্থান ২০ শতাংশ পতন) নিমজ্জিত হয়েছে—এ ধরনের পতন এ-যাবত্কালের সবচেয়ে দ্রুতগতির। এখন বাজারের ৩৫ শতাংশ অধোগতি ঘটেছে, ঋণবাজার অনেকটাই রুদ্ধ হয়েছে এবং ক্রেডিট স্প্রেড (জাংক বন্ডের মতো) ২০০৮ সালের মাত্রায় উন্নীত হয়েছে। এমনকি গোল্ডম্যান স্যাকস, জেপি মরগান ও মরগান স্ট্যানলির মতো মূলধারার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাক্কলন করে যে যুক্তরাষ্ট্রে জিডিপি প্রথম প্রান্তিকে বার্ষিক ৬ শতাংশ এবং দ্বিতীয় প্রান্তিকে ২৪-৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমবে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী স্টিভেন মানিউচিন সতর্ক করেছেন যে বেকারত্ব হার ২০ শতাংশের ওপরে উন্নীত হতে পারে (জিএফসির সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ)।
অন্য কথায়, সামষ্টিক চাহিদার প্রতিটি উপাদানই—ভোগ, মূলধন ব্যয়, রফতানি—নজিরবিহীনভাবে নিম্নমুখী হচ্ছে। অধিকাংশ ভাষ্যকার যদিও এক প্রান্তিকের জন্য উৎপাদন লক্ষণীয় মাত্রায় পতনসহ একটি ভি-আকারের অধোগতি এবং তারপর পরবর্তী সময়ে দ্রুতগতিতে পুনরুদ্ধার অনুমান করে আসছেন, তবে এখন এটি পরিষ্কার হওয়া উচিত যে কভিড-১৯ সংকট পুরোপুরিভাবে আরো অনেক কিছুতে গড়াবে। এ মুহূর্তে চলমান বৈশ্বিক অর্থনীতির সংকোচন দেখতে ভি, ইউ কিংবা এল আকারের নয়; বরং এটি দেখতে অনেকটা আই আকারের। মানে এটি একটি উল্লম্ব রেখা, যা আর্থিক বাজার ও প্রকৃত অর্থনীতির নিম্নগামিতারই প্রতিফলন ঘটায়।
আক্ষরিক অর্থে মহামন্দা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এতটা বন্ধ হয়নি, যতটা আমরা সাম্প্রতিক সময়ে চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে দেখেছি কিংবা এখনো দেখছি। সর্বোত্তম ঘটনার দৃশ্যপট (বেস্ট কেস সিনারিও) হবে অধোগতির—জিএফসির চেয়েও যা অধিক ভয়াবহ (হ্রাসকৃত বৈশ্বিক সার্বিক উৎপাদনের দিক থেকে); তবে তা হবে স্বল্পমেয়াদি, চলতি বছরের চতুর্থ প্রান্তিক নাগাদ ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি আবার ফিরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। সেক্ষেত্রে বাজারগুলো তখনই পুনরুদ্ধার হওয়া শুরু করবে, যখন সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে আলো দেখা যাবে।
তবে সর্বোত্তম ঘটনার দৃশ্যপট মনে হয় কিছু শর্ত বা অবস্থার ওপর নির্ভর করবে। প্রথমত. যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং অন্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিগুলোকে বিস্তৃতভাবে কভিড-১৯-এর পরীক্ষা, কনট্যাক্ট ট্রেসিং, চিকিৎসা ব্যবস্থা, কোয়ারেন্টিন প্রয়োগ এবং চীনের মতো পূর্ণমাত্রার লকডাউন বাস্তবায়ন চালিয়ে যেতে হবে। আবার যেহেতু করোনাভাইরাস প্রতিরোধের টিকা উন্নয়ন এবং ব্যাপক মাত্রায় তা উৎপাদনে ১৮ মাস সময় লাগবে, সেহেতু ভাইরাসবিরোধী এবং অন্য চিকিৎসাবিদ্যাগত (থেরাপিউটিক) প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও কৌশলগুলো বিস্তৃতভাবে প্রয়োগ দরকার হবে।
দ্বিতীয়ত, আর্থিক খাতের নীতিনির্ধারকদের (এক মাসের কম সময়ের মধ্যে যারা যা করেছেন, জিএফসির পর তাদের তা করতে সময় লেগেছিল তিন বছর) সংকটকালে অগতানুগতিক পদক্ষেপগুলো নেয়া অবশ্যই অব্যাহত রাখতে হবে। তার মানে হলো, শূন্য বা ঋণাত্মক সুদহার, সম্প্রসারিত সম্মুখদর্শী নির্দেশনা, কোয়ান্টিটেটিভ ইজিং, ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতায় ক্রেডিট ইজিং (প্রাইভেট অ্যাসেট কেনা), মানি মার্কেট ফান্ড এবং এমনকি বড় করপোরেশনের কমার্শিয়াল পেপার ও করপোরেট বন্ড ফ্যাসিলিটিজের মতো ব্যবস্থাগুলো নিতে হবে। ইউএস ফেডারেল রিজার্ভ বিশ্ববাজারে ডলারের বিপুল তারল্য ঘাটতি সামলাতে সংস্থাটির ক্রস-বর্ডার সোয়াপ লাইন সম্প্রসারণ করেছে, তবে অনগদযোগ্য সম্পদ থাকা এখনো সমর্থ ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ প্রদানে উৎসাহিত করতে ব্যাংকগুলোকে আমাদের অধিক সুবিধা জোগানো প্রয়োজন।
তৃতীয়ত, পরিবারগুলোয় ‘হেলিকপ্টার ড্রপের’ সরাসরি নগদ অর্থ ছাড়সহ সরকারগুলোকে ব্যাপক আর্থিক প্রণোদনা দিতে হবে। চলমান অর্থনৈতিক অভিঘাতের সম্প্রসারণশীল আকারের বাস্তবতায় উন্নত অর্থনীতিগুলোর জিডিপির ২-৩ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ বা ততোধিক আর্থিক ঘাটতি (ফিসক্যাল ডিফিসিট) বাড়াতে হবে। ব্যক্তি খাতের পতন ঠেকাতে কেবল কেন্দ্রীয় সরকারগুলোরই বড় ও যথেষ্ট শক্তিশালী স্থিতিপত্র রয়েছে।
কিন্তু এসব ঘাটতি ও অর্থায়িত হস্তক্ষেপগুলোকে অবশ্যই পুরোপুরিভাবে নগদীকরণকৃত (মনিটাইজড) হতে হবে। যদি সেগুলোকে স্ট্যান্ডার্ড সরকারি ঋণের মাধ্যমে অর্থায়ন করা হয় তাহলে সুদহার লক্ষণীয়ভাবে বাড়বে এবং পুনরুদ্ধারও আরো সহজ ও সুগম হবে। বিরাজমান পরিস্থিতিতে বামপন্থী ঘরানার আধুনিক আর্থিক তত্ত্ব-সমর্থিত দীর্ঘকাল ধরে প্রস্তাবিত হেলিকপ্টার ড্রপসহ হস্তক্ষেপগুলো মূলধারার হস্তক্ষেপ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
দুর্ভাগ্যক্রমে সর্বোত্তম ঘটনার দৃশ্যপট সৃষ্টির জন্য উন্নত দেশগুলোয় জনস্বাস্থ্যগত সাড়া ও পদক্ষেপ মহামারী নিয়ন্ত্রণে আনতে যতটা প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশ অপ্রতুলতার সমস্যায় পড়েছে। একই সঙ্গে বর্তমানে যেসব আর্থিক নীতি-প্যাকেজ নেয়া হয়েছে, তা সময়মতো পুনরুদ্ধারের পরিস্থিতি তৈরিতে যথেষ্ট কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হচ্ছে। এ অবস্থায় আগের মহামন্দার চেয়ে খারাপ ও গভীরতর নতুন মহামন্দার ঝুঁকি দিন দিন বেড়েই চলেছে।
মহামারী না থামা পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে অর্থনীতি ও বাজারগুলোয় পতন অব্যাহত থাকবে। তবে এমনকি মহামারী কমবেশি নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও ২০২০ সালের শেষ নাগাদ সার্বিক প্রবৃদ্ধি তখনো আগের ধারায় ফিরে আসবে না। সর্বোপরি তখন নতুন মিউটেশনের মাধ্যমে অভিযোজিত হয়ে আরেকটি ভাইরাস মৌসুম শুরু হতে পারে। সেক্ষেত্রে অনেকেই যে ধরনের চিকিৎসাবিদ্যাগত হস্তক্ষেপগুলোর (থেরাপিউটিক ইন্টারভেনশন) জন্য প্রহর গুনছেন, সেগুলো আশার তুলনায় কম কার্যকর হতে পারে। কাজেই অর্থনীতিগুলো আবারো সংকুচিত এবং বাজারগুলোর আবারো পতন ঘটবে।
অধিকন্তু, আর্থিক সাড়া বা পদক্ষেপ দেয়ালে আঘাত করলে বিপুল ঘাটতির নগদায়ন উচ্চ মূল্যস্ফীতি ঘটাবে, বিশেষত যদি ভাইরাসসংক্রান্ত পর্যায়ক্রমিক ঋণাত্মক সরবরাহ অভিঘাত সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধি হ্রাস করে। এবং অনেক দেশ এসব দেনা নিজেদের মুদ্রায় বাস্তবিক অর্থে ধারণ করতে পারবে না। সেক্ষেত্রে উদীয়মান বাজারের সরকার, করপোরেশন, ব্যাংক ও পরিবারগুলোকে কে বেইলআউট করবে?
যেকোনোভাবে এমনকি মহামারী ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় যদি নিয়ন্ত্রণে আনাও যায়, তবু বৈশ্বিক অর্থনীতিতে কিছু ‘সাদা রাজহাঁসের’ (সুনিশ্চিত) ঝুঁকি থেকে যাবে। মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন সামনে আসায় কভিড-১৯-এর সংকট পশ্চিম এবং চীন, রাশিয়া, ইরান, উত্তর কোরিয়াসহ অন্তত চার সংশোধনবাদী শক্তির (যে শক্তিগুলো এরই মধ্যে অপ্রতিসমভাবে ভেতর থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে দুর্বল করতে সাইবার যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে) মধ্যে সংঘাত বৃদ্ধির পথ প্রশস্ত করবে। মার্কিন নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর অনিবার্য সাইবার হামলা বিতর্কিত চূড়ান্ত ফলাফলের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। ফলে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের অভিযোগ ঘিরে অতিমাত্রায় সহিংসতা ও জনবিশৃঙ্খলা তৈরির সমূহ আশঙ্কা রয়েছে।
একইভাবে আগে যেমনটা বলেছি, বাজারগুলো চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যকার যুদ্ধের ঝুঁকি ব্যাপকভাবে অবমূল্যায়ন করছে; চীন-আমেরিকার সম্পর্কের অবনতি ত্বরান্বিত হওয়ায় দুটি দেশই কভিড-১৯ মহামারীর মাত্রার জন্য একে অন্যকে দুষবে। বর্তমান সংকট বোধহয় চলমান বলকানাইজেশনকে বেগবান করছে এবং সামনের মাস-বছরগুলোয় বৈশ্বিক অর্থনীতিকে বিভক্ত ও দুর্বল করবে।
এই ত্রিমুখী ঝুঁকি—বেসামাল মহামারী, অপর্যাপ্ত অর্থনৈতিক নীতি হাতিয়ার ও ভূরাজনৈতিক সাদা রাজহাঁসের ঘটনা (সুনিশ্চিত ও অবশ্যম্ভাবী ঘটনা) বৈশ্বিক অর্থনীতিকে ধারাবাহিক মন্দায় ফেলা এবং আর্থিক বাজারের বিপর্যয়ের জন্য যথেষ্ট হবে। ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের সময় একটি বলপূর্বক ( যদিও দেরিতে) নীতি সমর্থন বৈশ্বিক অর্থনীতিকে পতনের অতলগহ্বর থেকে টেনে তুলেছিল। আমরা সেদিক থেকে এবার অতটা সৌভাগ্যবান না-ও হতে পারি।
[স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট]

শিক্ষা
• জেনে রাখুন
শিক্ষা সংবাদ
ঘরে থাকার সময়ে অনলাইন কোর্স
তাহমিদা হোসাইন
০৫ এপ্রিল ২০২০, ১১:০৫
আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০২০, ১১:০৫
প্রিন্ট সংস্করণ

প্রতীকী ছবিকরোনাকালে গৃহবন্দী থাকার এই সময়ে নিজেকে এগিয়ে রাখতে পারেন অনলাইনে কোর্স করে। কোর্সেরা (www.coursera.org) আর এডেক্সের (www.edx.org) মতো ওয়েবসাইটগুলো অনলাইন কোর্স করার জন্য দারুণ জনপ্রিয়। এই ওয়েবসাইটগুলোতে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি), ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে গুগল, মাইক্রোসফটের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন কারিগরি কোর্স করার সুযোগ রয়েছে। জেনে নিই এমন কিছু কোর্সের তথ্য।
নিজেকে জানতে যে কোর্স
প্রকৌশলবিদ্যায় পড়াশোনা করলেও নিজের আগ্রহ থেকে আমি অনলাইনে বেশ কিছু কোর্স সম্পন্ন করেছি। শুরু করেছিলাম ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘দ্য সায়েন্স অব ওয়েল-বিং’ নামের একটি কোর্স করার মাধ্যমে। কোর্সটি ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্যায়ের সব শিক্ষার্থীকেই করতে হয়। অনলাইনে এ পর্যন্ত কোর্সটি পাঁচ লাখ চার হাজারের বেশি শিক্ষার্থী সম্পন্ন করেছেন। আপনি যে বিষয়েই পড়ুন না কেন, নিজের জীবন, নিজের মনের ওপর ইতিবাচক প্রভাব তৈরির গুরুত্ব নিয়েই কোর্সটি সাজানো হয়েছে। এটি চার সপ্তাহের কোর্স।
ঠিকানা: https://bit.ly/39F2R9h
কম্পিউটার বিজ্ঞান
অনলাইনের আরেকটি জনপ্রিয় কোর্স হচ্ছে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সিএস৫০ ইন্ট্রোডাকশন টু কম্পিউটার সায়েন্স’। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই কোর্সটি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে তৈরি করা। ১২ সপ্তাহের কোর্সটি অনলাইনে প্রোগ্রামিং ভাষা, কম্পিউটার বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় আর গাণিতিক চিন্তাভাবনা বিকাশ সম্পর্কে শেখায়।
কোর্সটির ঠিকানা: https://bit.ly/2x4rDT3
ব্যবসায় শিক্ষা
অর্থ সংস্থান, প্রকল্প ব্যবস্থাপনা, বিপণন, নেতৃত্ব বিষয়ে এডেক্সের ব্যবসাবিষয়ক অনলাইন কোর্সগুলো শুরু করতে পারেন। এমআইটির সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট, হোয়ার্টন স্কুলের স্ট্র্যাটেজিক ম্যানেজমেন্ট, রচেস্টার ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট কোর্স শুরু করতে পারেন। কোর্সগুলোর
ঠিকানা: https://bit.ly/2X8wNZ2
ভাষাশিক্ষা ও যোগাযোগ দক্ষতা
অনলাইনে আপনি ভাষাশিক্ষাসহ যোগাযোগ দক্ষতা, প্রেজেন্টেশন তৈরিসহ বিভিন্ন বিষয়ে কোর্স করতে পারেন। আইইএলটিএস, টোয়েফেলের মতো ইংরেজি ভাষা দক্ষতার পরীক্ষা থেকে শুরু করে চীনা বা জার্মান ভাষা শেখার সুযোগ মিলছে এডেক্স আর কোর্সেরার মতো অনলাইন পোর্টালে। যোগাযোগ দক্ষতা বিকাশের জন্য ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিপেয়ারিং টু নেটওয়ার্ক ইন ইংলিশ করতে পারেন। ঠিকানা: https://bit.ly/2UImFo6
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘দ্য আর্ট অব পারসুয়েসিভ রাইটিং অ্যান্ড পাবলিক স্পিকিং’ কোর্সের মাধ্যমে ৮ সপ্তাহে দক্ষ বক্তা হয়ে ওঠার কৌশল শিখতে পারছেন।
কোর্সের ঠিকানা: https://bit.ly/3dYcmnI
চাকরির জন্য যেসব দক্ষতা প্রয়োজন সে সম্পর্কেও এডেক্সের মাধ্যমে শিখতে পারবেন। বিজনেস কমিউনিকেশন, টিমওয়ার্ক ও কলাবুরেশন, ক্রিটিক্যাল থিংকিং ও প্রবলেম সলভিং, ভিজ্যুয়াল প্রেজেন্টেশনসহ নানা দক্ষতার বিভিন্ন কোর্স চালু আছে রচেস্টার ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির। একেকটি কোর্স তিন সপ্তাহের করে।
ঠিকানা: https://bit.ly/34bQ3Gv
কারিগরি শিক্ষা
কারিগরি শিক্ষার সুযোগ মিলছে অনলাইন সাইটগুলোতে। গুগল আইটি সাপোর্ট কোর্সটি এখন পর্যন্ত ২ লাখ ৮০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী সম্পন্ন করেছেন। এ ছাড়া গুগল আইটি অটোমেশন, ক্লাউড আর্কিটেকচার, মেশিন লার্নিংসহ বিভিন্ন কোর্স সরাসরি করা যাচ্ছে অনলাইন থেকে।
ঠিকানা: https://bit.ly/2xRS3HC
এ ছাড়া মাইক্রোসফট এক্সেল, ওয়ার্ডসহ বিভিন্ন সফটওয়্যারের ওপর অনলাইনে কোর্স শেখার সুযোগ আছে। ঠিকানা: https://bit.ly/34hccmU
যা খেয়াল রাখতে হবে
প্রতিদিন এক থেকে দুই ঘণ্টা সময় বরাদ্দ করলে খুব সহজেই দ্রুত কোর্স সম্পন্ন করা যায়। সব অনলাইন কোর্সের ভাষা ইংরেজি। তাই ইংরেজি ভাষা প্রাথমিকভাবে বোঝার দক্ষতা থাকা বেশ জরুরি। সব অনলাইন কোর্সই বিনা মূল্যে পড়ার জন্য নাম নিবন্ধন করতে পারবেন। সনদ নিতে চাইলে বাড়তি অর্থ আপনাকে জমা দিতে হবে।

করোনাজনিত পরিস্থিতিতে শিগগিরই যে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেবে, সে এক অনিবার্য বাস্তবতা। তবে সে ক্ষেত্রে এক দেশ থেকে অন্য দেশের পার্থক্য হবে শুধু এটুকু যে কোথাও তা অনেক আগেই শুরু হয়ে যাবে আবার কোথাও তা দেখা দেবে একটু পরে। একইভাবে মন্দার পরিধি ও মাত্রার ক্ষেত্রেও থাকবে এই তারতম্য। কোথাও হয়তো তা নিয়ন্ত্রণসীমার মধ্যে থেকে যেতে পারে আবার কোথাও তা নিয়ন্ত্রণসীমার বাইরে চলে গিয়ে সৃষ্টি করতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত মানবিক বিপর্যয়। তবে কোথায় কী ঘটবে, তার অনেকটাই নির্ভর করছে মন্দা-প্রস্তুতির ধরন ও পরিস্থিতি মোকাবেলার কৌশলের ওপর, যেমনটি লক্ষ করা গেছে করোনার চিকিৎসা পরিস্থিতি মোকাবেলার ক্ষেত্রে। উপযুক্ত কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে চীন, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়া একে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে; অন্যদিকে তা করতে না পারায় চরম মূল্য দিতে হয়েছে এবং হচ্ছে ইউরোপের অনেক দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রকে। ফলে এরূপ অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সর্বসাম্প্রতিক বৈশ্বিক অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশ কী করতে পারে, তা নিয়েই এখানে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।
করোনাপূর্ব সময়ের বিবেচনায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর একটি প্রধান দুর্বলতা এই যে প্রবৃদ্ধির হারে অনেকখানি এগিয়ে থাকলেও মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার ওপরে থেকেও দারিদ্র্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। যেকোনো সময় ধপ করে এরা দারিদ্র্যসীমার নিচে পড়ে যেতে পারে। দ্বিতীয় দুর্বলতা, কৃষিই বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখলেও অপেক্ষাকৃত কম প্রবৃদ্ধি হারের এই খাতে জনসংখ্যার বিরাজমান আধিক্য সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ এ খাতে কর্মরতদের একটি বড় অংশই ছদ্মবেকার, করোনার মতো পরিস্থিতিতে একটু চাপে পড়লেই যারা পূর্ণ বেকার হয়ে পড়তে পারে।
এদিকে করোনার কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবেলায় সরকার এরই মধ্যে রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার অনুদান তহবিল বরাদ্দ করেছে, যা মূলত পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কর্মীদের বেতন-ভাতা প্রদানে ব্যয় করবে। ধারণা করা যায়, ক্রমান্বয়ে অন্যান্য সংগঠিত খাতও সরকারের কাছ থেকে অনুরূপ অনুদান আদায় করে নিতে সক্ষম হবে এবং সে ক্ষেত্রে ক্ষমতাকেন্দ্রের সঙ্গে যাদের যোগাযোগ যত নিবিড়, বাংলাদেশের সামাজিক অভিজ্ঞতা বলে, তারা তত বেশি সুবিধা আদায় করে নিতে সক্ষম হবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, করোনাজনিত অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলায় রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ও সহায়তার বেশির ভাগই যাবে বিত্তবান শ্রেণির হাতে, যারা ঝুঁকিতে পড়লেও তা সামাল দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু দারিদ্র্যঝুঁকিতে থাকা ৫০ শতাংশসহ নিম্ন আয়ের অপরাপর যে মানুষ আজ চরম বিপর্যয়ে নিপতিত হওয়ার আশঙ্কার মুখে রয়েছে, তাদের কী হবে?
নিম্নবিত্তের সাধারণ মানুষের অবস্থা হবে করুণ থেকে করুণতর। এর মূল কারণ, নিম্ন আয় শ্রেণির মানুষ তাদের স্বার্থের প্রশ্নে বিত্তবান শ্রেণির মতো মোটেও সংগঠিত নয়। তৈরি পোশাক থেকে হিমায়িত খাদ্য, ওষুধ থেকে চামড়া, রিয়েল এস্টেট থেকে জনশক্তি রপ্তানি, ব্যাংকিং-বীমা থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যলয়, আমলা থেকে আড়তদার, চিকিৎসক থেকে প্রকৌশলী—সবারই নিজ নিজ গোষ্ঠী বা শ্রেণিভিত্তিক সমিতি বা সংগঠন আছে। তারা সবাই জানে কিভাবে চাপ প্রয়োগ করে অথবা ছলে-বলে-কৌশলে কিংবা প্রয়োজনে ব্ল্যাকমেইল করে দাবি বা আর্থিক সুবিধা আদায় করতে হয়। কিন্তু জমিতে খেটে খাওয়া কৃষক, মুটে-মজুর বা রিকশাচালক, ছোট্ট দোকানি অথবা ফুটপাতের বিক্রেতা, মাঝি-জেলে কিংবা পাহারাদার—নিম্ন আয় শ্রেণির এই সাধারণ মানুষের কারোরই কোনো সংগঠন নেই। ফলে তারা মোটামুটি বঞ্চিতই হবে।
উপমহাদেশের অতীত অভিজ্ঞতাও মোটামুটি এ আশঙ্কাকেই সামনে তুলে ধরে। এ অঞ্চলে অতীতে যতবারই বড় ধরনের বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, দুর্ভিক্ষ, মহামারি, দাঙ্গাহাঙ্গামা, যুদ্ধবিগ্রহ বা অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি হয়েছে ততবারই সুবিধাবাদী শ্রেণির মানুষ তাদের বিত্ত-বৈভব আরো বাড়িয়ে তুলেছে। বিপরীতে বিত্তহীন বা নিম্নবিত্তের মানুষ নিঃশেষিত হতে হতে মৃত্যু বা চূড়ান্ত মানবেতর জীবনের মুখে নিপতিত হয়েছে। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে, যা পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে বিশেষভাবে পরিচিত, শুধু বাংলায়ই ৩০ লাখ মানুষ অনাহারে মারা গিয়েছিল। তবে তা খাদ্যের অভাবে নয়, পর্যাপ্ত খাদ্য থাকা সত্ত্বেও সামর্থ্যের অভাবে তা ক্রয় করতে না পারার কারণে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বছরে প্রায় পৌনে পাঁচ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য উৎপাদনকারী বর্তমান বাংলাদেশে, যেখানে মানুষের গড় মাথাপিছু আয় প্রায় এক হাজার ৯০৯ মার্কিন ডলার, সেখানে তেমন পরিস্থিতির আর কখনোই পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। তবে পাশাপাশি এটাও সত্য যে স্বাধীনতা-উত্তর গত ৪৯ বছরের মধ্যে সম্পদের এমন চরম বৈষম্যও এ দেশে আর কখনো দেখা যায়নি।
এ অবস্থায় রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বিবেকবান প্রাজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের কাছে প্রথম প্রস্তাব : করোনাজনিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবেলায় খণ্ড খণ্ড ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত না নিয়ে একসঙ্গে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করুন। তা না হলে কম অগ্রাধিকার খাতে অর্থ বরাদ্দ বা ব্যয় হয়ে যাওয়ার পর অধিক জরুরি খাতের জন্য অর্থের ঘাটতি দেখা দিতে পারে এবং এতে সম্পদের ব্যাপক অপচয় ঘটার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
দ্বিতীয় প্রস্তাব : কৃষি খাতের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করুন। কারণ অর্থনৈতিক মন্দা বা বিপর্যয় দেখা দিলে শেষ পর্যন্ত এই কৃষিই হবে আমাদের বাঁচার মূল রক্ষাকবচ। অথচ সত্য এই যে কৃষির পক্ষে সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করার মতো কোনো সংগঠন কৃষকের নেই, যেমনটি অন্যান্য খাতে রয়েছে। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে যে ২০০৮-০৯-এর বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার সময় অনেক শক্তিশালী দেশই ম্রিয়মাণ হয়ে পড়লেও বস্তুত এই কৃষি খাতের কারণেই বাংলাদেশকে তা খুব একটা কাবু করতে পারেনি। সরকার যেন তার মন্দা মোকাবেলা কর্মসূচিতে কৃষিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করে।
তৃতীয় প্রস্তাব : ২০২০-২১ অর্থবছরের আসন্ন বাজেটে কৃষক ছাড়াও নিম্ন আয় গোষ্ঠীর অন্যান্য শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য যেন জীবিকাসহায়ক ও জীবনধারণমূলক পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকে। সে ক্ষেত্রে কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা), সামাজিক বনায়ন ইত্যাদির আওতা সম্প্রসারণ করে আনুপাতিক হারে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা যেতে পারে। গ্রামীণ নারীদের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী বিআরডিবি, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান যাতে উৎসাহব্যঞ্জক মূল্যে কিনে নেয়, তার ব্যবস্থা রাখতে হবে। আর গ্রাম ও শহর—সর্বত্র আরো ব্যাপক হারে টিসিবি কর্তৃক ন্যায্য মূল্যে পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে।
চতুর্থত : মন্দা দেখা দিলে খুব স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যালয়গুলোতে, বিশেষ করে গ্রামের বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধি পাবে। এই ঝরে পড়ার হার রোধকল্পে বিদ্যালয়গুলোর জন্য খাদ্য ও শিক্ষা উপকরণের বিতরণ বাড়াতে হবে। অন্যদিকে তেমনি তা দরিদ্র পরিবারের জন্য খাদ্য সহায়তার পরিমাণ বাড়াতেও কাজে আসবে।
পঞ্চমত : সম্পদের সীমাবদ্ধতার কথা ভেবে ঝুঁকি মোকাবেলার সামর্থ্য আছে এমন বিত্তবান শ্রেণির জন্য আর্থিক প্রণোদনা দানের বিষয়টি যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তা না হলে এই বিপদের দিনে স্বল্প আয়ের ও স্বল্পবিত্তের মানুষের আর্থিক সহায়তাদানের বিষয়টি বাধাগ্রস্ত হতে বাধ্য।
সব মিলিয়ে মূলকথা হচ্ছে, ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে দূরে অবস্থিত নিম্ন আয় গোষ্ঠীর অসংগঠিত সাধারণ মানুষকে প্রস্তাবিত সমন্বিত পরিকল্পনার (যদি তা গ্রহণ করা হয়) একেবারে প্রথমেই স্থান দিতে হবে। তা না হলে করোনাজনিত অর্থনৈতিক বিপর্যয় মোকাবেলায় অনাকাঙ্ক্ষিত করুণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদি বিবেচনা থেকে বলব, দেশে বর্তমানে যে চরম বৈষম্য ও বৈষম্যমুখী প্রবণতা বিরাজ করছে, আসন্ন মন্দার কালে দরিদ্রের পক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে সে বৈষম্য আরো বেড়ে যাবে, যা বৈষম্যের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৩ বছর সংগ্রাম করে অর্জিত এই স্বাধীন দেশে কারোরই কাম্য হতে পারে না।

লেখক : পরিচালক, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
নাৎসিবাদের আলামত এখন ইসরাইলে

ইউরি অ্যাভনেরি ছিলেন একজন ইসরাইলি লেখক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ এবং দ্য পিস ব্লক কোয়ালিশন ‘গুশ শালুম পিস মুভমেন্টে’র প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ৯৫ বছর বয়সে মারা যান ২০১৮ সালের ৩ জুলাই। তরুণ বয়সে ছিলেন জায়নবাদী ইসরাইলের আধা সামরিক সংগঠন ইরগুনের সদস্য। ইরগুন ১৯৩১-৪৮ সময় পরিধিতে সক্রিয় ছিল ম্যান্ডেটেড ফিলিস্তিনে। দুই মেয়াদে নেসেট সদস্যও ছিলেন। একটি সংবাদ সাময়িকীও প্রকাশ করেন ১৯৫০ থেকে ১৯৯৩ সালে তা বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত। তিনি বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন ইসরাইল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব বিষয়ে।
তার এক বন্ধু তাকে পরামর্শ দিয়ে বলেছিলন : ‘প্লিজ ডোন্ট রাইট অ্যাবাউট ইয়াইর গোলান। আরো বলেছিলেন : ‘বামপন্থীদের মতো তার বিরুদ্ধে কিছু লিখলে, তা তার জন্য ক্ষতিকর হবে।’ ইয়াইর গোলান হচ্ছেন ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল। ২০১৬ সালেও তিনি ছিলেন ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনীর ডেপুটি চিফ অব জেনারেল স্টাফ। বর্তমানে তিনি ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়নের একজন নেসেট সদস্য।
বন্ধুর কাছ থেকে এই সতর্ক-পরামর্শ পেয়ে ইউরি অ্যাভনেরি এক অস্বস্তি নিয়ে কয়েক সপ্তাহ লেখা থেকে বিরত ছিলেন। কিন্তু এর কয়েক সপ্তাহ পর তিনি আর চুপ থাকতে পারেননি। তখন তিনি একটি লেখায় উল্লেখ করেন, তিনি ইসরাইলে নাৎসিবাদের নানা আলামত দেখতে পাচ্ছেন। এই লেখায় তিনি ইসরাইলের নাৎসিবাদ-সমতুল্য আচরণ দেখে তার উদ্বেগ প্রকাশ করেন মৃত্যুর দুই বছর আগে। তখনো ইয়াইর গোলান ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন।
ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ থাকার সময় ইয়াইর গোলান ‘হলোকাস্ট মেমোরিয়েল ডে’-র এক অনুষ্ঠানে ভাষণ দিয়েছিলেন ইউনিফর্ম পরে। তার ভাষণটি ছিল আগে থেকে তৈরি করা। একটি সুবিবেচিত ভাষণ। এই ভাষণ নিয়ে তখন বেশ একটা হইচই পড়ে যায়, যা আজো থামেনি। এই ভাষণের পরপর লেখা হয় ডজন ডজন লেখা। এসব কিছু লেখায় তার প্রতি ছিল নিন্দা জ্ঞাপন। আবার কিছু লেখায় তাকে উচ্চ প্রশংসা করা হয়। তখন তার ভাষণে ছিল কিছু সত্য উচ্চারণ : ‘কেউই অনুত্তম বা নিঃস্পৃহ থাকতে পারে না।’ তার ভাষণে গুরুত্বপূর্ণ একটি বাক্য ছিল এমন : ‘If there is something that frightens me about the memories of the Holocaust, it is the knowledge of the awful processes which happened in Europe in general, and in Germany in particular, 70, 80, 90 years ago, and finding traces of them here in our midst, today, in 2016.’

এর মোটমুটি অর্থ দাঁড়ায় : ‘হলোকাস্টের কোনো স্মৃতি যদি আমাকে ভীতসন্ত্রস্ত করে থাকে, তবে তা হচ্ছেÑ সেই ভয়ানক প্রক্রিয়ার জ্ঞান, যা সাধারণভাবে ঘটেছিল ইউরোপে এবং বিশেষত জার্মানিতে সেই ৭০, ৮০, ৯০ বছর আগে এবং তার আলামত আজ এই ২০১৬ সালে এসে আমাদের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে।’
২০১৬ সালে ইয়াইর গোলান তার তোলপাড় করা এ বক্তব্যটি দিয়েছিলেন। সে হিসাবে ৯০ বছর আগে ছিল ১৯২৬ সাল। সেটি ছিল জার্মান প্রজাতন্ত্রের শেষ কয়টি বছরের একটি। আর ৮০ বছর আগে ছিল ১৯৩৬ সাল। এটি ছিল নাৎসিদের ক্ষমতায় আসার তৃতীয় বছর। আর ৭০ বছর আগের বছরটি ছিল ১৯৪৬ সাল, যে সালটি হচ্ছে হিটলারের আত্মহত্যার পরের বছর এবং সেই সাথে নাৎসি রাইখের পরিসমাপ্তির বছর।
এ বক্তব্য দেয়ার সময় ইউরি অ্যাভনেরি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেন, এ বক্তব্য বিষয়ে তার লেখা উচিত। তিনি তার এক লেখায় জানান, ‘একজন শিশু হিসেবে আমি প্রত্যক্ষ করেছি ওয়েমার রিপাবলিকের শেষ বছরগুলো। জার্মানিকে ওয়েমার রিপাবলিক বলার কারণ এর সংবিধানের রূপদান করা হয়েছিল ওয়েমার শহরে। এটি ছিল গেঁটে ও শিলারের শহর। একজন রাজনীতি-সচেতন বালক হিসেবে আমি দেখেছি নাৎসিদের ক্ষমতায় আরোহণ এবং নাৎসি শাসনের প্রথম বছরের প্রথম অর্ধেকটা সময়। আমি জানি ইয়াইর গোলান কী বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। যদিও আমরা ভিন্ন ভিন্ন প্রজন্মের মানুষ, আমাদের প্রেক্ষাপট ছিল একই। আমাদের উভয়ের পরিবার এসেছিল জার্মানির পশ্চিমাঞ্চলের ছোট্ট এক শহর থেকে।’
তিনি বলেন : ‘ইসরাইলে কড়া ঐশিক আদেশ বা কমান্ডমেন্ট রয়েছে : কোনো কিছুকেই হলোকাস্টের সাথে তুলনা করা যাবে না। হলোকাস্ট হচ্ছে অনন্য। এটি ঘটেছিল আমাদের ওপর, ইহুদিদের ওপর। কারণ আমরা অনন্য।’ ধার্মিক ইহুদিরা আরো বাড়িয়ে বলবে : ‘কারণ ঈশ্বর আমাদের বেছে নিয়েছেনÑ বিকজ গড হ্যাজ চুজেন আস’।
ইউরি অ্যাভনেরি বলেন : ‘আমি সেই কমান্ডমেন্ট ভঙ্গ করেছি। গোলানের জন্মের ঠিক আগে আমি হিব্রু ভাষায় একটি বই প্রকাশ করি। এর নাম : The Swastika। এতে আমার শৈশবের স্মৃতিচারণ রয়েছে এবং চেষ্টা করেছি তা থেকে একটা উপসংহার বা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে।’
প্রসঙ্গত, হিটলারের সহযোগী অ্যাডলফ আইখম্যান ছিলেন ‘ফাইনাল সলিউশন’ বাস্তবায়নের অন্যতম কারিগর। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি ছিলেন ইহুদি বিতাড়ন ও জার্মানির কিলিং সেন্টারগুলোর পরিচালনা ও হলোকাস্টের মূলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকান কর্তৃপক্ষ আইখম্যানকে গ্রেফতার করে বন্দিশিবিরে আটকে রাখে। তবে জাল কাগজপত্র দেখিয়ে তিনি পালতে সক্ষম হন। পালিয়ে আর্জেন্টিনায় চলে গিয়ে রিকার্ডো ক্লিমেন্ট নামে পরিবারের সাথে শান্তিতেই বসবাস করছিলেন। আর কাজ করছিলেন বুয়েন্স আয়ার্সের মার্সিডিজ-বেঞ্চ কারখানায়। ইসরাইলের গোয়েন্দা বাহিনী মোশাদ তাকে আর্জেন্টিনা থেকে অপহরণ করে ১৯৬০ সালের ২০ মে ইসরাইলে নিয়ে আসে। এ নিয়ে অবশ্য তখন নানা প্রশ্ন ওঠে। আর্জেন্টিনা অভিযোগ করে : এর মাধ্যমে ইসরাইল জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের স্বীকৃত সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে। ইসরাইলে আইখম্যানের বিচার শুরু হয় ১৯৬১ সালে। তখন হলোকাস্ট বিষয়টি সাধারণ মানুষের মধ্যে নতুন করে আলোচনায় আসে।
হলোকাস্টের মূল সংগঠক আইখম্যানের বিচারের প্রাক্কালে ইউরি অ্যাভনেরি বিস্মিত হয়ে লক্ষ করলেন, তখনকার ইসরাইলের তরুণদের মাঝে নাৎসি যুগের সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান-ঘাটতি রয়েছে। তার বইয়ের মধ্যে আলোকপাত নেই সে সম্পর্কে। যখন হলোকাস্ট সঙ্ঘটিত হয়, এর আগেই তিনি ইসরাইলে গিয়ে বসবাস করছিলেন। কিন্তু তখন বছরজুড়ে তিনি একটি বিষয় নিয়ে ভাবিত ছিলেন। এমনকি পরবর্তী জীবনেও। তার প্রশ্ন ছিল : বিশ্বের সবচেয়ে সংস্কৃতিবান দেশ জার্মানিতে কী করে এমন একটি হলোকাস্ট ঘটতে পারল। এটি গেঁটের, বিটোভেনের ও কান্টের জন্মভূমি। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল : কী করে এরা গণতান্ত্রিকভাবে হিটলারের মতো একজন অসংলগ্ন কথাবার্তা বলা মানসিক বৈকল্যের মানুষকে তাদের নেতা নির্বাচিত করল?
ইউরি অ্যাভনেরির লেখা বইটির শেষ অধ্যায়ের শিরোনাম : ‘ইট ক্যান হ্যাপেন হিয়ার!’ তিনি এই শিরোনামটি নিয়েছিলেন আমেরিকান ঔপন্যাসিক সিনক্লেয়ারের বই “ইট ক্যান’ট হ্যাপেন হেয়ার” থেকে। বইটিতে বর্ণনা করেন যুক্তরাষ্ট্রের নাৎসিদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি। সে যা হোক, ইউরি অ্যাভনেরি এ অধ্যায়ে আলোচনা করেন নাৎসিদের মতো ইহুদি পার্টিরও সম্ভাবনা রয়েছে ইসরাইলে ক্ষমতায় আসার। তার উপসংহার ছিল : ‘নাৎসি পার্টি বিশ্বের যেকোনো দেশের ক্ষমতায় আসতে পারে। আর পরিস্থিতি অনুকূল হলে ইসরাইলেও।’
এই বইটি ব্যাপকভাবে এড়িয়ে চলে ইসরাইলি জনতা। তখন ছিল অভাবিত নির্বাচনী ঝড়ো-হাওয়া। তা ছাড়া তখন ইসরাইলিরা প্ররোচিত হচ্ছিল আইখম্যানের বিচারসংশ্লিষ্ট নানা উদঘাটন নিয়ে। তখন একজন সুখ্যাত পেশাজীবী সৈনিক ইয়াইর গোলান বললেন সেই একই বিষয় নিয়ে। এটি তাৎক্ষণিভাবে তৈরি করা কোনো মন্তব্য ছিল না। বরং এটি ছিল সরকারি কোনো অনুষ্ঠানে একজন জেনারেলের সামরিক পোশাক পরিহিত অবস্থায় দেয়া মন্তব্য, যা আগে থেকেই সুচিন্তিতভাবে তৈরি করা। তার এই ভাষণ যে ঝড় তোলে, তা এখনো শেষ হয়নি।
ইসরাইলিদের রয়েছে একটি আত্মরক্ষামূলক অভ্যাস : যখন কোনো অপ্রচলিত সত্য নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়, তখন এরা এর নির্যাসটিই এড়িয়ে মেতে ওঠে গুরুত্বহীন মাধ্যমিক কোনো বিষয় নিয়ে। দেখা যাবেÑ মুদ্রণ গণমাধ্যমে, টেলিভিশনে ও রাজনৈতিক প্লাটফর্মে প্রকাশ করা ডজন ডজন প্রতিক্রিয়ায় কোনোটিতেই জেনারেলের এই যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য নিয়ে কোনো বাদানুবাদ তোলা হয়নি। বরং এই প্রশ্নে যে তীব্র বিতর্ক চলল, তা হচ্ছেÑ একজন উচ্চপদস্থ কোনো সামরিক কর্মকর্তা কি এমন মতামত দিতে পারেন, যা সাধারণ মানুষকে উদ্বিগ্ন করে? সামরিক পোশাক পরে তিনি কি তা করতে পারেন? অধিকন্তু একটি সরকারি অনুষ্ঠানে তিনি কি এ ধরনের বক্তব্য দিতে পারেন?
কিন্তু প্রশ্নটা হওয়া উচিত ছিল : একজন সামরিক কর্মকর্তার কি তার রাজনৈতিক দৃঢ়বিশ্বাস বা প্রত্যয় সম্পর্কে চুপ থাকা উচিত? কিংবা তিনি কি তা প্রকাশ করতে পারবেন শুধু কোনো সীমাবদ্ধ অধিবেশনেই? ক্ষুব্ধ বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুর কথা মতো তা কি শুধু প্রকাশ করা যাবে ‘রিলিভেন্ট কোনো ফোরামে’?
জেনারেল গোলান সেনাবাহিনীর ভেতরে একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় অফিসার ছিলেন। তার উজ্জ্বল সম্ভাবনা ছিল ডেপুটি চিফ অব স্টাফ থেকে চিফ অব স্টাফ হওয়ার। কিন্তু জেনারেল গোলানের সে স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। তবে তিনি অনন্য এক সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। ইসরাইলের ফিলিস্তিনি নিধন ও দমনপীড়ন নিয়ে মহাসত্যটির প্রতিই তিনি কৌশলী ইঙ্গিত দিয়েছেন। তবে তার ইঙ্গিত ছিল স্পষ্ট : ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের ওপর নাৎসিদের মতো ফ্যাসিবাদ চালাচ্ছে। বিবেকবান মানুষই শুধু এ ধরনের সাহস দেখাতে পারেন।
এ ধরনের সাহসের ইতিহাস আরো আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ‘দ্য পাঞ্চ’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি লেখা থেকে জানা যায়, তখন জার্মানিতে একদল জুনিয়র সামরিক কর্মকর্তা আয়ারল্যান্ড প্রশ্নে সরকারি নীতির বিরোধিতা করে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছিলেন। এসব তরুণ সামরিক কর্মকর্তারা বলেছিলেন, তারা তাদের রাজনৈতিক প্রত্যয়ের প্রতি অবিচল থেকে এই বিবৃতি দিয়েছেন। এ জন্য প্রয়োজনে তারা তাদের চাকরিজীবন উৎসর্গ করতে পারেন।
১৯২৯ সালে শুরু হয় নাৎসিদের ক্ষমতায় আরোহণের পালা। তখন ভয়ানক বিশ্ব-অর্থসঙ্কট জার্মানিতেও আঘাত হানে। একটি ছোট্ট চরম ডানপন্থী পার্টি হঠাৎ করেই হয়ে ওঠে আমলযোগ্য এক রাজনৈতিক শক্তি। সেখান থেকে চার বছরেই এটি হলো সে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। আর ক্ষমতায় এলো কোয়ালিশন করে।
ইউরি অ্যাভনেরি বলেন : ‘জেনারেল গোলানের বিরুদ্ধে অভিযোগÑ তিনি ইসরাইলকে নাৎসি জার্মানির সাথে তুলনা করেছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, ইসরাইলে যদি এমন কোনো ঘটনা ঘটে যা ওয়েমার রিপাবলিককে ধ্বংস করেছিল, তবে ইসরাইলও এক দিন একইভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে। আর এটি ছিল একটি অর্থপূর্ণ তুলনা। ১৯১৬ সালের নির্বাচনের পর থেকে তেমন সব ঘটনাই ঘটে চলেছে। এসব ঘটনার সাথে নাৎসিদের ঘটানো ঘটনার ভয়ানক মিল রয়েছে। তবে এটি সত্য, প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি ভিন্ন। জার্মানির ফ্যাসিবাদের জন্ম প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবমাননাকর আত্মসমর্পণ, ১৯২৩-২৫ সময় পরিধিতে ফ্রান্স ও বেলজিয়ামের জার্মানির কয়লাখনি ও শিল্প এলাকা দখল, ১৯২৯ সালের ভয়ানক অর্থনৈতিক সঙ্কট ও লাখ লাখ মানুষের বেকারত্বের ঘটনাগুলোর সম্মিলিত প্রভাব থেকে। এখন আমরা ইসরাইলিরা সামরিক দিক থেকে এক বিজয়ী জাতি। যাপন করছি আয়েশি এক জীবন। তবে আমাদের সামনে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির বিপজ্জনক একটা হুমকি অবশ্যই আছে : এসব বিপদের সৃষ্টি হয়নি আমাদের পরাজয়সূত্রে, যেমনটি ঘটেছিল জার্মানির বেলায়। অবশ্য আজকের ইসরাইলের ও সে কালের জার্মানির মধ্যে মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। কিন্তু মিল যেটুকু আছে তার উল্লেখ করার জন্য যথেষ্ট। দখল করা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ফিলিস্তিনিদের প্রতি প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসরাইলের বৈষম্য নাৎসি জার্মানির প্রথম পর্যায়ের সাথে তুলনীয়। অধিকৃত ফিলিস্তিনে তাদের ওপর ইসরাইলিদের পরিচালিত দমন-পীড়নের সাথে তুলনা করা যায় মিউনিখ বিট্রেইলের পর প্রটেক্টরেটে চেকদের ওপর জার্মানদের দমন-পীড়নের সাথে।’
তিনি স্বীকার করছেন : ‘ইসরাইলি নেসেটে বৃষ্টির মতো ফ্যাসিবাদী বিল পাস করা হচ্ছে। আর যেগুলো এরই মধ্যে কার্যকর করা হয়েছে, তা চরমভাবে মিলে যায় নাৎসি শাসনের প্রথম দিকে রাইখস্ট্যাগে গৃহীত আইনগুলোর সাথে। কিছু রাবিশ আইনে আহ্বান রয়েছে আরব দোকানগুলো বয়কটের, যেমনটি ঘটেছিল তখনকার জার্মানিতে। নিয়মিত ফুটবল মাঠে ইসরাইলিরা চিৎকার করে বলে : ‘ডেথ টু অ্যারাবস’। পার্লামেন্টের একজন সদস্য বলেছেন, হাসপাতালে ইহুদি ও আরব নবজাতকদের আলাদা রাখতে হবে। একজন প্রধান রাব্বি ঘোষণা দিয়েছেন : ঈশ্বর গয়িম তথা অ-ইহুদিদের বানিয়েছেন ইহুদিদের সেবা করার জন্য। শিক্ষা ও সংস্কৃতিমন্ত্রী ব্যস্ত সব চরম ডানপন্থী আদলে স্কুল, থিয়েটার ও শিল্পকলা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বশীভূত করার কাজে। এটি চলছে কর্তৃত্ববাদী জার্মানির Gleichschaltung-এর আদলে। ইসরাইলের গৌরব সুপ্রিমকোর্ট বিরতিহীনভাবে জাস্টিস মিনিস্টারের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। গাজা উপত্যকা এখন বিশাল এক ঘেটো। অবশ্য ইসরাইলে এমন একজন সুজন নেই যিনি ফ্যাসিবাদী হিটলার ও ফ্যাসিবাদী নেতানিয়াহুর মধ্যে দূরতম তুলনাটুকু করতে পারেন। ইসরাইলের প্রতিটি রাজনৈতিক দল কেবল ফ্যাসিবাদী গন্ধই ছড়ায়। আজ নাৎসি কোনো সরকার বেঁচে থাকলে সেখানে নেতানিয়াহু নিশ্চিত একটি স্থান পেয়ে যেতেন।’
ইসরাইলের বর্তমান সরকারের একটি স্লোগান হচ্ছে : ‘রিপ্লেস ওল্ড এলিটস’। অপর দিকে নাৎসিদের স্লোগান ছিল : ‘রিপ্লেস দাস সিস্টেম’। যখন নাৎসিরা ক্ষমতায় এলো তখন সব উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তারা ছিলেন নাৎসিবিরোধীদের গোঁড়া সমর্থক। এমনকি তারা হিটলারবিরোধী অভ্যুত্থানের কথাও ভাবছিলেন। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক নেতাকে এক বছরের মাথায় ফাঁসি দেয়া হয়। হিটলার তার দলের বিরোধীদের নিষ্ক্রিয় করেন।
অতএব যথার্থ উচ্চারণ : ইসরাইলিরা আসলেই নাৎসি ফ্যাসিবাদের সতেজ ক্রীড়া ক্ষেত্র।

1. উপসম্পাদকীয়
করোনা : মহামন্দা ও খাদ্য সঙ্কটের আশঙ্কা!
• মুজতাহিদ ফারুকী

• ০৭ এপ্রিল ২০২০, ২১:১৯




তাহিদ ফারুকী –
করোনাভাইরাসে এরই মধ্যে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে পুরো বিশ্ব। ২০৫টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ১৩ লাখ ছাড়িয়েছে। মৃতের সংখ্যা ৭০ হাজারের কাছাকাছি। উৎপত্তিস্থল চীন ছাড়া আর কোনো দেশেই এর তীব্রতা কমেনি। বরং বাড়ছে। এখন পর্যন্ত এর কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার করা যায়নি। তাই সংক্রমণ ঠেকানোর একমাত্র উপায় হলো, মানুষে মানুষে শারীরিক দূরত্ব রক্ষা করা। সে জন্য আক্রান্তদের যেমন বিচ্ছিন্ন করে রাখা হচ্ছে তেমনি অন্য সব মানুষকে ঘরে অবস্থান করতে বলা হয়েছে। বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, শিল্প-কারখানা, বাজার-ঘাট, শপিংমল। বন্ধ হয়ে গেছে বিমান চলাচল, সামাজিক সভা-সমাবেশ, ক্রীড়া অনুষ্ঠান, নৌ-চলাচল, দেশের অভ্যন্তরের সব যানবাহন।
এর ফলে বন্ধ হয়ে গেছে যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। বিশ্বের ইতিহাসে অভূতপূর্ব এই প্রেক্ষাপটে বিশ্বজুড়ে এক মহামন্দার আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছে। বলা হচ্ছে, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিশ্বের অর্থনীতিতে যে সঙ্কটের মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল, এবারের করোনাভাইরাসের ফলেও ঠিক একই ধরনের সঙ্কট দেখা দেবে। কেউ কেউ বলছেন, মহামন্দা দেখা দিতে পারে বিশ্ব অর্থনীতিতে। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অর্থনৈতিক ইতিহাসের অধ্যাপক আলব্রেখট রিচেল ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, দুই বিশ্বযুদ্ধ দুনিয়ার অর্থনীতিকে যে সঙ্কটে ফেলেছিল, করোনাভাইরাসের কারণে সেরকম সঙ্কট দেখা দেবে। রিচেল বলেন, ১৯৩০ এর দশকের শুরুতে যে মহামন্দা দেখা দিয়েছিল এটা তার থেকেও খারাপ হতে পারে।
অর্থনৈতিক সঙ্কটের যেসব আলামত যেমন, চাহিদা কমে যাওয়া, উৎপাদনে অতিমন্দা, বেকারত্ব অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া, আর্থিক সঙ্কট এবং তারপর প্রবল ঋণ সঙ্কট ইত্যাদি বিশ্বকে গ্রাস করতে যাচ্ছে। কিভাবে এবং কত দিনে এই অচলাবস্থার অবসান হবে সেটাও কেউ বলতে পারছে না। জাতিসঙ্ঘ বলছে, করোনার সংক্রমণ বন্ধ হলেও এরপর বিশ্বজুড়ে খাদ্য সঙ্কট দেখা দিতে পারে। লকডাউন কত দিন স্থায়ী হবে সে সম্পর্কে কোনো রকম ধারণা না থাকায় দেশে দেশে বিত্তবান মানুষ সবার আগে খাদ্য মজুদের দিকে ঝুঁকেছে। তারা প্রয়োজনের চেয়েও বেশি খাদ্য মজুদ করছে। ফলে বিশ্বজুড়ে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত হতে পারে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম) এক প্রতিবেদনে বলেছে, গোটা বিশ্বের কোনো প্রান্তেই খাদ্য জোগানের কোনো অভাব নেই। কিন্তু লকডাউনের মেয়াদ যদি বাড়ানো হয়, আর বিত্তশালী ও খাদ্য সরবরাহকারীরা যদি আতঙ্কে অতিরিক্ত খাদ্য মজুদ করতে শুরু করেন, তা হলে অদূর ভবিষ্যতে খাবার পাবেন না দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষ। বিশেষ করে পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকার গরিব দেশগুলো এতে প্রবল সমস্যায় পড়বে। এই পরিস্থিতি যাতে সৃষ্টি না হয়, সে জন্য সব দেশের সরকারকে খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে কড়া নজরদারি করার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। খাবার নিয়ে যাতে কোনো ধরনের কালোবাজারি না হয় সে দিকেও নজর দিতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে বিশ্বের সব দেশের সমন্বিত পরিকল্পনা ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরি বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে লেখা নিবন্ধে তিনি বলেন, করোনা সঙ্কট মোকাবেলায় ব্যর্থ হলে এর প্রভাবে সারা বিশ্বে আগুন জ্বলতে পারে। বাস্তবতা হচ্ছে, করোনার পরে বিশ্ব আর কখনোই একই রকম থাকবে না।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রভাব কতটা পড়তে পারে সে বিষয়েও বিশেষজ্ঞরা কথা বলছেন। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে। চাকরি হারাতে পারেন অনেক মানুষ। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রফতানি আয় এমনিতেই পড়তির দিকে। জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি কমেছে চার দশমিক সাত নয় ভাগ। অব্যাহতভাবে কমেছে পোশাক রফতানি। কারণ আমাদের তৈরী পোশাকের প্রধান আমদানিকারক হলো ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র। করোনাভাইরাসের কারণে পুরো ইউরোপ ও আমেরিকার অবস্থা খুবই নাজুক। বাংলাদেশের পোশাক রফতানির ৬২ ভাগ যায় ইউরোপে আর ১৮ ভাগ যায় যুক্তরাষ্ট্রে। স্বাভাবিকভাবেই রফতানিতে ধস নেমেছে। তৈরী পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, এরই মধ্যে বিপুল পরিমাণ ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে। রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচকই নি¤œমুখী। তার মধ্যেও ভালো করছিল রেমিট্যান্স। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ১০৪২ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ ভাগ বেশি। এই গতি ধরে রাখা এখন কঠিন হয়ে যাবে বাংলাদেশের জন্য। যেসব দেশ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সেখানে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় বন্ধ। সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশী শ্রমিক বা ব্যবসায়ীরা কর্মচ্যুত হলে দেশে পরিবারের কাছে আগের মতো টাকা পাঠাতে পারবেন না। তাই স্বভাবতই রেমিট্যান্স কমতে থাকবে। এর প্রভাব পড়বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে।
আমরা জানি, দেশের অর্থনীতির প্রধান দু’টি খাত হলো তৈরী পোশাক রফতানি ও প্রবাসী আয়। রফতানি আয় কমে গেলে দেশের শিল্প-কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের আয় কমে যাওয়া বা কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা দেখা দেবে। অন্য দিকে প্রবাসীরা টাকা পাঠাতে না পারলে তাদের পরিবার আর আগের মতো খরচ করতে পারবেন না। অর্থাৎ তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ব্যবসাবাণিজ্যে। কমে যাবে বেচাকেনা। আর চাহিদা কমে গেলে পণ্য প্রস্তুকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তীর মুখে পড়বে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এরই মধ্যে বলেছে, করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষতি হতে পারে ৩০০ কোটি ডলারের মতো। আর চাকরি হারাতে পারে প্রায় ৯ লাখ মানুষ। এতে করে জিডিপি কমে যেতে পারে এক দশমিক এক ভাগ।
তবে আমাদের উদ্বেগের জায়গাটি কিন্তু খাদ্যসামগ্রীর সম্ভাব্য সঙ্কট নিয়ে। করোনাভাইরাস মহামারীর প্রকোপে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এ অবস্থায় বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তা চরম ঝুঁকিতে পড়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ভোক্তারা ঝুঁকেছেন অতিরিক্ত খাবার মজুদের দিকে। অনেক দেশও আপৎকালীন পরিস্থিতি সামলে ওঠার লক্ষ্যে খাদ্যপণ্য রফতানি বন্ধ রাখার পরিকল্পনা করেছে। একই পথে হাঁটছে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ডের মতো এশিয়ার শীর্ষ চাল রফতানিকারক দেশগুলো। ফলে এ অঞ্চল থেকে চালের রফতানি হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। এ অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হলে অনেক দেশ চরম খাদ্য সঙ্কটে পড়বে বলে সতর্কবার্তা দিয়েছে জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। এফএও’র জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ডেভিড ডাউই বলেন, কোনো কোনো দেশ খাদ্য রফতানি বন্ধ করলে বিশ্ববাজারে খাদ্য-ঘাটতি দেখা দিতে পারে। জানা যাচ্ছে, করোনা মহামারীর প্রভাবে অভ্যন্তরীণ সরবরাহ নিশ্চিত করতে সম্প্রতি ভিয়েতনাম চালের নতুন বিক্রয় চুক্তি সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছে। শীর্ষ চাল রফতানিকারক দেশগুলোর তালিকায় ভিয়েতনামের অবস্থান তৃতীয়। দেশটির প্রধানমন্ত্রী জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মধ্য এপ্রিল পর্যন্ত চালের রফতানি নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রীকে নির্দেশ দিয়েছেন। ভিয়েতনাম ছাড়াও চালের রফতানি সাময়িকভাবে বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে এশিয়ার অন্যতম শীর্ষ চাল রফতানিকারক দেশ কম্বোডিয়াও। একই আভাস দিয়েছে মিয়ানমারও।
এশিয়া অঞ্চলের চালের বাজার বিশ্লেষক ডেভিড ডাউই বলেন, এশিয়ার দেশগুলো খুব একটা সতর্ক না হয়েই চালের রফতানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। তারা কেবল নিজেদের জন্য পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে চাইছে।
অন্য দিকে অনেক দেশ আবার মনোনিবেশ করেছে বাড়তি আমদানির দিকে। ফিলিপাইন এশিয়ার অন্যতম শীর্ষ চাল উৎপাদনকারী দেশ। করোনাভাইরাসের প্রকোপে খাদ্য সঙ্কট দেখা দিতে পারে এমন আশঙ্কায় দেশটি চালের আমদানি বাড়াচ্ছে। বর্তমান বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ বাজার সামলে নিতে চীন এ বছর রেকর্ড পরিমাণ চাল কিনতে পারে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। বিশ্বজুড়ে চালের রফতানি চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় দামও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। মার্চে থাইল্যান্ডের ৫ শতাংশ ভাঙা চালের রফতানিমূল্য বেড়ে টনপ্রতি ৫১০ ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা ২০১৩ সালের পর থেকে সর্বোচ্চ রফতানি মূল্য।
বাংলাদেশ চাল উৎপাদনে স্বয়ম্ভর দেশ। গত ১৫ মার্চ পর্যন্ত দেশে খাদ্যশস্য মজুদের পরিমাণ ১৭ লাখ ৩৯ হাজার ৪৯৫ টন। এর মধ্যে গম আছে তিন লাখ ১৯ হাজার টন। বাকি ১৪ লাখ ২০ হাজার টন চাল। ফলে দেশে খাদ্য সঙ্কট নেই। তেমন সম্ভাবনাও নেই বলে মনে করছেন সরকার। আমরা আশ্বস্ত থাকতে চাই যে, করোনাভাইরাস পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দেশে খাদ্য নিয়ে কোনো রকম সঙ্কট দেখা দেবে না
করোনা-উত্তর মহামন্দা ও বাংলাদেশ
কোভিড-১৯ উত্তর বিশ্ব আর কোনো দিন আগের অবস্থায় ফিরে আসবে না বলে মার্কিন করোনাভাইরাস বিজ্ঞানী ড. অ্যান্টনি ফৌসি যে মন্তব্য করেছেন তাকে অনেকে সত্য হিসাবে ধরে নিতে শুরু করেছেন। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে একই ধরনের মন্তব্য করেছেন বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ কর্মকর্তারাও। অতীতেও মহামারী আর অর্থনৈতিক মহামন্দা পৃথিবী প্রত্যক্ষ করেছে। কিন্তু জ্ঞাত ইতিহাসে এবারের মহামারীতে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক, সামাজিক এমনকি রাজনৈতিক যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির আভাস দেখা যাচ্ছে, তাতে বিশ্ববাসীকে বিরল কোনো অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর মধ্যে লক্ষাধিক ব্যক্তি করোনায় মারা গেছে। বিভিন্ন রাষ্ট্র এর ক্ষয়ক্ষতির যেভাবে নিয়ন্ত্রিত প্রকাশ করেছে, তাতে ধারণা করা হয় যে, প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা এর দ্বিগুণ হতে পারে।
সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হলো, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুÑ উভয় ক্ষেত্রে তালিকার শীর্ষে উঠে আসছে বিশ্বের জ্ঞানবিজ্ঞান প্রযুক্তি ও সমর শক্তিতে শীর্র্ষ দেশ আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্র। আমেরিকানদের মৃত্যুর সংখ্যা দুই লাখ ছাড়ানোর আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন খোদ দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
Ad by Valueimpression
সমাজকাঠামোর প্রতিটি ক্ষেত্রে আঘাত
এবারের মহামারীর আঘাতটি এক দিকে দ্রুত সংক্রমণশীল আর বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত, অন্য দিকে সমাজকাঠামোর প্রতিটি ক্ষেত্রকে এটি আঘাত করছে, তছনছ করে দিচ্ছে। সবচেয়ে শঙ্কার বিষয়টি হলোÑ এ পর্যন্ত হওয়া গবেষণা ও পর্যবেক্ষণে বলা হচ্ছে, ভাইরাসটি ধরন ও প্রকারে পরিবর্তিত হয়ে বিধ্বংসী হয়ে উঠছে ক্রমাগতভাবে। বিশ্ববিখ্যাত ইসলামিক স্কলার মুফতি ইসমাইল মেন্ক বলেছেন, করোনাভাইরাসের এখন যে বিধ্বংসী অবস্থা তা মহাপ্রলয় প্রক্রিয়ার সূত্রপাত বলে মনে হচ্ছে। তিনি পবিত্র কুরআনের মহাপ্রলয়সংশ্লিষ্ট আয়াত এবং মহানবী সা:-এর বাণীগুলো তুলে এনে তার আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করেছেন। থিওলজির বিষয়গুলোকে অনুমানসর্বস্ব ও অতিলৌকিক বিষয় হিসেবে অনেকে চিহ্নিত করতে চান। কিন্তু এবারের করোনাভাইরাসের পর বিজ্ঞানীদের আসমানের দিকে আর ধর্মবেত্তাদের বিজ্ঞানের দিকে হাত বাড়ানোর যে কথা বিখ্যাত ভারতীয় লেখিকা অরুন্ধতী রায় বলেছেন, তা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়। করোনাভাইরাসের তাৎক্ষণিক পরিবর্তনটি সম্ভবত এই যে প্রচলিত বৈশ্বিক ব্যবস্থা বা ধারণা ভেঙেচুরে হয়তো এক নতুন পৃথিবীর সৃষ্টি হচ্ছে অথবা মহাবিলুপ্তি-উত্তর নতুন মহাজাগরণের সময়ের দিকে মানবজাতি এগিয়ে যাচ্ছে।
মহামারী মহামন্দা মহাপ্রলয় মহাজাগরণের ধর্মতাত্ত্বিক বা দর্শনগত বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতা আমাদের নেই। এ বিষয়ে যারা প্রভূত জ্ঞান ও ক্ষমতা সংরক্ষণ করেন এই আলোচনা তাদের জন্য নির্ধারিত। আমি এই লেখায় বৈশ্বিক মহামন্দার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ অর্থনীতি এবং সমাজকাঠামো যে মহাপ্রতিকূল এক সময়ের মুখোমুখি হতে পারে সে অবস্থার ওপর আলোকপাত করার চেষ্টা করব। এই চেষ্টা কোনোভাবেই ভীতি ছড়ানোর জন্য নয়, বরং এটি যে বৈরী অবস্থার মুখোমুখি আমরা হতে পারি তার আগাম ধারণা নিয়ে এ ব্যাপারে প্রস্তুতি যতটা সম্ভব নেয়ার জন্য, অন্তত মানসিকভাবে হলেও।
মহামন্দা অতীত ও বর্তমান
গত এক শতকের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক মহামন্দা ছিল ১৯৩০-এর দশকে বিশ্বব্যাপী সংঘটিত মন্দা। এই মন্দা শুরু হয় ১৯২৯ সালে আর শেষ হয় ১৯৩০ এর দশকের শেষের দিকে। এটি ছিল বিংশ শতাব্দীর দীর্ঘ সময়ব্যাপী ও ব্যাপক প্রভাব বিস্তারকারী মন্দা। একবিংশ শতাব্দীতে এই মহামন্দাকে বিশ্ব অর্থনীতির পতনের উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
১৯২৯ সালের ৪ সেপ্টেম্বর স্টক বাজারে দরপতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই মন্দা শুরু হয়। পরে ১৯২৯ সালের ২৯ অক্টোবর এই খবর বিশ্বব্যাপী স্টক মার্কেটে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯২৯ সাল থেকে ১৯৩২ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী জিডিপি প্রায় ১৫ শতাংশ হ্রাস পায়। কিছু অর্থনীতি ১৯৩০ এর দশকের মাঝামাঝিতে আগের অবস্থায় এলেও অনেক দেশের অর্থনীতিতে মহামন্দার প্রভাব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু পর্যন্ত ছিল।
ধনী ও দরিদ্র সব দেশেই সেই মহামন্দার বিধ্বংসী প্রভাব ছিল। ব্যক্তিগত আয়, কর, মুনাফা ও মুদ্রা মূল্যমানের ব্যাপক পতন ঘটে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যর ৫০ শতাংশ কমে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার ২৫ শতাংশ বেড়ে যায় এবং কিছু কিছু দেশে বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩ শতাংশে। পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে মহামন্দার প্রভাব ছিল তীব্র, বিশেষ করে যেসব শহর ভারী শিল্পের ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল ছিল। অনেক দেশে নির্মাণকাজ একরকম বন্ধই ছিল। শস্যের মূল্য শতকরা ৬০ ভাগে নেমে এসেছিল। কৃষক ও গ্রামীণ এলাকাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ব্যাপকভাবে।
মহামন্দার দু’টি ধ্রুপদী তত্ত্ব হলো কেইনেসীয় চাহিদা চালিত এবং অর্থকেন্দ্রিক ব্যাখ্যা। চাহিদা চালিত তত্ত্বে বলা হয়, বাজারের ওপর আস্থা হারানোর ফলে ভোগের পরিমাণ ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত ব্যয় কমে যায়। একবার মূল্যহ্রাস পাওয়ার ফলে অনেক মানুষ ধারণা করে নতুনভাবে বাজারে বিনিয়োগ না করে তারা তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে। টাকা বিনিয়োগ না করায় মূল্যহ্রাস পেলে তারা লাভবান হয় এবং চাহিদা কমায় স্বল্পমূল্যে অধিক পণ্য ক্রয় করতে পারে। অর্থকেন্দ্রিক ব্যাখ্যাকারীরা মনে করেন মহামন্দা সাধারণ দরপতন হিসেবে শুরু হয় কিন্তু অর্থ সরবরাহ সঙ্কুচিত হতে থাকলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে থাকে এবং এই সাধারণ দরপতন মহামন্দার রূপ ধারণ করে।
অতীতের মহামন্দার যেসব বৈশিষ্ট্য তার সবই এবারের করোনা-উত্তর মহামন্দায় দেখা যেতে পারে।
কিভাবে মন্দার মোকাবেলা?
সরকার বৃহদাকার অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ, টাকার জোগান বৃদ্ধি, সরকারি খরচ বৃদ্ধি এবং করের পরিমাণ কমিয়ে মন্দার মোকাবেলা করার চেষ্টা করে। বিনিয়োগ, ব্যবসায়িক সংস্থাগত লাভ ও চাকরির সুযোগ একই সাথে কমে যাওয়ার মতো মন্দার অনেক বৈশিষ্ট্য আছে, যেগুলো একই সাথে দেখা দিতে পারে।
মূলধারার বেশির ভাগ অর্থনীতিবিদ মনে করেন, অর্থনীতিতে অপর্যাপ্ত গড় চাহিদার কারণে মন্দা দেখা দেয় এবং তারা মন্দার সময় সম্প্রসারণমূলক বৃহদাকার অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণের পক্ষপাতী। অর্থনীতিকে মন্দার কবল থেকে মুক্ত করার নানা কৌশল আছে। নীতিনির্ধারকরা অর্থনীতির কোন শাখা অনুসরণ করছেন তার ওপর নির্ভর করে কৌশলগুলো ভিন্ন ভিন্ন হয়। মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে অর্থনীতিতে পরিবর্তন আনার প্রক্রিয়ায় বিশ্বাসীরা সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি ব্যবহারের পক্ষপাতী। আবার কেইনসের অনুসারী অর্থনীতিবিদরা অর্থনীতির বৃদ্ধিতে গতি আনার জন্য সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি করার কথা বলেন। জোগানের ওপর জোর দেন যেসব অর্থনীতিবিদ, তারা ব্যবসায় পুঁজির বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য কর-ছাড়ের প্রস্তাব করেন। অবাধ বাণিজ্য নীতিতে বিশ্বাসী অর্থনীতিবিদরা বাজারের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতার ওপর সরকারি হস্তক্ষেপ না করার পরামর্শ দেন।
মন্দা এবং রাজনীতি
মহামন্দার পর অনেক দেশ রাজনৈতিক বিপ্লবের সম্মুখীন হয়। ইউরোপ ও ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশে একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরাচারী শাসনের কাছে গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়ে, বিশেষ করে ১৯৩৩ সালে প্রতিষ্ঠিত নাৎসি জার্মানি। লিউফাউন্ডল্যান্ডের কর্তৃত্বের ফলে স্বেচ্ছায় গণতন্ত্র ছেড়ে দিতে হয়।
অর্থনৈতিক পরিস্থিতির জন্য সাধারণত দেশের সমসাময়িক প্রশাসনকেই প্রশংসা অথবা দোষের ভাগী হতে হয়। এর ফলে একটি মন্দা ঠিক কখন শুরু হয়েছে, তা নিয়ে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। কোনো অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ যদি এমন
একটি স্তরে পৌঁছায় যেখানে তার পক্ষে টিকে থাকা আর সম্ভব নয়, তা হলে তার ফলাফলই হয় অর্থনৈতিক চক্রের অধোগতি আর সংক্ষিপ্ত একটি পতনের দ্বারা সেই পরিস্থিতি সংশোধিত হয়। তাই এই আবর্তের কোনো নির্দিষ্ট পর্যায়ের কারণকে আলাদা করা খুব একটা সহজ কাজ নয়।
সাধারণভাবে মনে করা হয়, মন্দা এবং তার তীব্রতার ওপর সরকারের কাজকর্মের কিছু প্রভাব থাকে। অর্থনীতিবিদরাও বলেন যে, সাধারণত মন্দা সম্পূর্ণরূপে এড়ানো সম্ভব নয় এবং তার কারণগুলোও সঠিকভাবে বোঝা যায় না। ফলে, আধুনিক সরকার ও প্রশাসন মন্দা প্রশমিত করতে কিছু পদক্ষেপ নেয়, কিন্তু সেগুলো নিয়েও মতবিরোধ থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই পদক্ষেপগুলো মন্দা আটকানোর ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয় এবং এই পদক্ষেপগুলো নেয়ার কারণে মন্দা কম তীব্র অথবা দীর্ঘায়িত হয়েছে কি না, তা স্থির করাও কঠিন হয়।
করোনার প্রভাব ও পরিণতি
করোনাভাইরাসের প্রভাব এখন তার উত্থানপর্ব অতিক্রম করছে। গত ডিসেম্বরে চীনের উহানে এটির সূচনা ঘটার পর এপ্রিলের মাঝামাঝি নাগাদ ১০০ দিন পূর্তিতে এটি ইউরোপ আমেরিকাসহ বিশ্বের ব্যাপকসংখ্যক দেশে বিস্তারমান রয়েছে। আরো তিন থেকে ছয় মাস এর মহামারী প্রভাব অটুট থাকতে পারে। এর মধ্যে সূচনাকালের দেশগুলো তাদের করোনা প্রভাব কাটিয়ে আবার আগের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু বা বিস্তৃত করায় মনোযোগী হবে। ২০২০ সালের শেষ নাগাদ সময়টি অর্থনৈতিক ও সামাজিক পুনরুদ্ধার কাজ শুরুতেই চলে যেতে পারে। ফলে নতুন কোনো ভাইরাসের সংক্রমণ না ঘটলেও চলমান সালটি বৈশ্বিক অবস্থার করোনা-উত্তর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অধোগতির সময় হিসাবেই থাকবে। এই সময়ে বিশ্বে নির্মাণশিল্প মুখ থুবড়ে পড়বে, ব্যক্তিগত সক্ষমতা হ্রাসের কারণে বাজারের চাহিদা ব্যাপকভাবে কমে যাবে, রেমিট্যান্স আয়ে ধস নামবে, স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় বাড়বে। সামগ্রিকভাবে সমাজের তথা জনগণের অর্থনৈতিক সক্ষমতা কমে যাবে। আইএমএফ এখনো আশাবাদী থাকলেও ২০২০ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হওয়ার ধারণা সঠিক হবে বলে মনে হয় না। এই বৈশ্বিক বাস্তবতা সামনে রেখে বাংলাদেশের অবস্থা বিশ্লেষণ করতে হবে।
বাংলাদেশের বাস্তবতা
এপ্রিলের মাঝামাঝি নাগাদ বাংলাদেশ করোনাভাইরাসের দ্রুত সংক্রমণশীল অবস্থা অতিক্রম করছে। মধ্য মার্চ থেকে লকডাউনের যে প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে সেটি চূড়ান্ত অবস্থার দিকে যাচ্ছে। করোনা আক্রান্তের এখন জ্যামিতিক বিস্তৃতি তথা কমিউনিটি সংক্রমণ বাড়ছে। রাজধানী ঢাকা, নিকটবর্তী শহর নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে এর দ্রুত বিস্তার ঘটছে। করোনা পরীক্ষার সুবিধা বিস্তৃত করার সাথে সাথে আক্রান্তের সংখ্যা সরকারি হিসাবে লাফিয়ে বাড়ছে, একই সাথে বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। চলমান লকডাউন মে মাসের শেষ পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
করোনাভাইরাসে বাংলাদেশে মৃত্যু বা ক্ষয়ক্ষতি কোন পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে তা নিয়ে বেশ মতপার্থক্য রয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বলেছেন, জাতিসঙ্ঘের ফাঁস হওয়া দলিলে বাংলাদেশে মৃতের সংখ্যা ২০ লাখে উঠে যেতে পারে বলে যে বক্তব্য তা ভুল ও অতিরঞ্জিত। আমারও ব্যক্তিগতভাবে সেটিই মনে হয়।
প্রভাব হবে অনেক গভীর
তবে করোনা শিকারের সংখ্যা বাংলাদেশে যাই হোক না কেন এর প্রভাব আগে থেকে বাংলাদেশের ক্রমাবনতিশীল অর্থনীতিতে অনেক গভীর হতে পারে। বাংলাদেশে আগামী মাসে বাজেট ঘোষণা করা হবে। বাস্তবভিত্তিক করতে হলে এই বাজেটের আকার বা বরাদ্দ ডলারের হিসাবে হবে সঙ্কুচিত। কারণ ২০২০ অর্থবছরের রাজস্ব আয়ের যে ৫০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়িয়েছিল তার বিপরীতে ৬ মাসে অর্জিত হয়েছে মাত্র সাড়ে ৫ শতাংশ। করোনা আক্রান্ত শেষার্ধে তা আরো ঋণাত্বক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে অথবা বিদেশী উৎস থেকে ঋণ নিয়ে বাজেটের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বাস্তবতাও এখন নেই। বিশ্বব্যাপী মন্দার কারণে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের তহবিল অথবা চীন বা জাপানের সহায়তাÑ কোনোটাই আগের মাত্রায় থাকবে না। এর ফলে নতুন অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি সঙ্কুচিত করতেই হবে, রাজস্ব ব্যয়ের রাশ টেনে ধরতে হবে। অথচ শিল্প কলকারখানা সচল রাখতে হলে প্রণোদনা সহায়তা দিতে হবে, মানুষকে ক্ষুধা অনাহার থেকে বাঁচাতে সামাজিক নিরাপত্তা জাল বিস্তৃত করতে হবে, গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত আবার অর্থনীতির চাকা সচল করতে, কৃষি এবং ক্ষেতখামারে উৎপাদন প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখে সম্ভাব্য খাদ্যসঙ্কট মোকাবেলা করতে হলে অর্থের প্রবাহ বাড়াতে হবে। এক দিকে অর্থের অভাব অন্য দিকে অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন এই দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জ জয় বাংলাদেশ কিভাবে করবে সেটিই হবে বড় বিষয়।
করোনাভাইরাসের প্রভাব সমাজে পড়েছে শ্রেণী নির্বিশেষে। ভাইরাস-উত্তর বাস্তবতা হলো নি¤œবিত্ত মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে বিত্তশালী পর্যন্ত সবারই অর্থনৈতিক সক্ষমতার অবনমন ঘটছে। নি¤œবিত্তরা সক্ষমতা হারালে রাষ্ট্রের সামাজিক নিরাপত্তা জাল এবং দান-খয়রাতের ওপর নির্ভরশীল হয়। সেটি না থাকলে আকালে বেঘোরে প্রাণ হারায়। মধ্যবিত্তরা অর্ধাহার-অনাহারে দুঃসময় কাটিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। সমাজের অপেক্ষাকৃত সক্ষমরা তাদের ব্যবসা বা শিল্পোদ্যোগকে প্রাপ্য সহায়তা কাজে লাগিয়ে আবার সচল করার চেষ্টা করে। এই প্রক্রিয়ায় প্রতিটি শ্রেণী পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীল। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়াবে সবশ্রেণীর মানুষকে যার যার অবস্থান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর পরিবেশ সৃষ্টি এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়া।
প্রশ্ন হলো সেটি কিভাবে সম্ভব? করোনাভাইরাস সংক্রমণের সময়ে রাষ্ট্রকে জনগণের জীবন বাঁচাতে স্বাস্থ্যসেবা যতটা সম্ভব নিশ্চিত করতে এবং হতদরিদ্রদের কাছে খাবার পৌঁছাতে হবে। সরকার রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনীর সহায়তায় এবং জরুরি অর্থ সম্প্রসারণ পদক্ষেপের মাধ্যমে সে চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে দূরে রাখা হলে বাস্তবতার নিরিখে সর্বোচ্চ পদক্ষেপ সরকার কার্যকর করতে পারবে। এ জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তাও কাজে লাগাতে হবে। এরপর মহামারীর প্রকোপ কমে আসার সাথে সাথে ঘরবন্দী অবস্থা থেকে মানুষ বের হবে। তখনকার বাস্তবতা হবে ব্যাপক বেকারত্ব ও কর্মহীনতা। বিদেশ থেকেও লাখ লাখ প্রবাসী চাকরিহারা হয়ে দেশে ফিরে আসবে। বেসরকারি খাতের অনেক ব্যবসা ও শিল্পোদ্যোগ এর মধ্যে রুগ্ন হয়ে প্রায় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কৃষক ও খামারিদের উৎপাদন ক্ষতির কারণে আর্থিক সহায়তা না পেলে সেগুলোকে সচল করতে পারবে না।
বাংলাদেশে ছোট বড় উদ্যোগে আর্থিক সহায়তা দানের দু’টি কাঠামোর একটি হলো আনুষ্ঠানিক ব্যাংক খাত, আরেকটি এনজিও বা স্বেচ্ছাসেবী খাত। গত এক দশকব্যাপী বৈরী পৃষ্ঠপোষকতার কারণে এনজিওগুলোর সমাজ উন্নয়নে অবদান রাখার সক্ষমতা অনেকখানি কমে গেছে। করোনা-উত্তর মহামন্দা পরিস্থিতিতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে সক্ষমতা ফেরাতে হলে এনজিও কার্যক্রমে প্রাণ সঞ্চার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গ্রামমুখী গ্রোথ সেন্টার তৈরির জন্য আনুষ্ঠানিক ব্যাংক খাতকেও কাজে লাগানো যেতে পারে। এ ব্যাপারে ইসলামী ব্যাংকগুলোকে বিশেষভাবে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে যাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গ্রামীণ শাখা রয়েছে। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হবে ব্যাংক খাতে বিনিয়োগযোগ্য কার্যকর তহবিল সৃষ্টি।
ব্যাংকগুলোর বর্তমান যে তারল্য পরিস্থিতি তাতে জরুরি কোনো পদক্ষেপ না নিলে এটি নিশ্চিত করা যাবে না। এ ধরনের একটি মহামন্দা পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য টাকার সরবরাহ বৃদ্ধি করতে ব্যাংকগুলোর বাধ্যতামূলক তহবিল সংরক্ষণ হার আরো নমনীয় করাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে মুদ্রানীতির সাধারণ ব্যাকরণের চেয়েও রাষ্ট্রের প্রয়োজন ও সঙ্কট উত্তরণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
ব্যাংক খাতই মূল
যেকোনো সামাজিক ও শিল্পোদ্যোগে জরুরি অর্থায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংক খাতের সক্ষমতা অতি জরুরি একটি বিষয়। আমরা যতই শাক দিয়ে মাছ ঢেকে রাখার চেষ্টা করি না কেন, বাস্তবতা হলো ব্যাংকগুলোর হিসাবে যে টাকা আছে, সেই টাকা বাস্তবে নেই। আর এই টাকার বড় অংশ ব্যাংক মালিকরা পরস্পরের যোগসাজশে নামে-বেনামে বের করে নিয়ে গেছেন। এই অর্থ ব্যাংকের হিসাবে নিয়মিত ঋণ হিসাবে দেখানোর কারণে শরীরের ভেতরের ক্যান্সারটি বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে না। আবার প্রদর্শিত কল্পিত আয় থেকে রাষ্ট্রকে কর পরিশোধ করতে গিয়ে ব্যাংক-স্বাস্থ্যকে আরো সঙ্কটাপন্ন করা হচ্ছে। সংসদে অর্থমন্ত্রীর তথ্য অনুুসারে যে পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা ব্যাংক পরিচালকদের কাছে ঋণ রয়েছে তা আদায়ে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষত এর যে অংশ দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যেভাবেই হোক সেটিকে আবার দেশের অর্থনীতিতে ফিরিয়ে আনতে হবে। এটি সরকার অথবা রাষ্ট্রের ডিপ স্টেট চাইলে অসম্ভব নয়। এই প্রক্রিয়ায় লুটেরা মানসিকতার পরিচালকদের হাত থেকে ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ পেশাদার ও সৎ উদ্যোক্তাদের হাতে স্থানান্তর করতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্প্রসারণশীল উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যাংকের তহবিল পুনরুদ্ধারের এই পদক্ষেপ সফল করা গেলে রাষ্ট্রের পক্ষে সীমিত সম্পদ দিয়েও গ্রাম থেকে রাজধানী পর্যন্ত আবার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চাঙ্গা করা সম্ভব হবে।
মনে রাখতে হবে, এবারের চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় এবং বাঁচা-মরার ইস্যু। ১৯২৯ সালের মহামন্দা গোটা বিশ্বে এখনকার মতো এতটা সর্বব্যাপী ও গভীর ছিল না। ফলে এবার বিশ্বের জন্য চ্যালেঞ্জ উত্তরণ যেমন কঠিন তেমনিভাবে বাংলাদেশের জন্য তা আরো কঠিন। এ চ্যালেঞ্জ রাষ্ট্রক্ষমতায় কে থাকল না থাকল তার চেয়ে বড় হলো এটি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সক্ষমভাবে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ জয়ের কোনো বিকল্প নেই।
mrkmmb@gmail.com
________________________________________
কষ্টার্জিত প্রবৃদ্ধি করোনায় ভেস্তে যাবে?
সারাবিশ্ব এখন মারাত্মক ছোঁয়াচে করোনাভাইরাস বা কভিড-১৯-এর মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে এবং ব্যাপকতর আক্রমণ ঠেকাতে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা আরোপে বাধ্য হয়ে চলেছে। প্রায় প্রতিটি দেশ এখন পরস্পর থেকে স্ব-আরোপিত যোগাযোগ-বিচ্ছিন্নতা প্রতিপালন করছে। বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষ এখন লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন, সেলফ কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন, হোম কোয়ারেন্টাইন এবং/অথবা বাধ্যতামূলক ছুটিতে গৃহবন্দি থাকতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণের বৃহদাংশও এখন গৃহবন্দি, যদিও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা জনগণকে মানাতে সরকারকে খুবই বেগ পেতে হচ্ছে।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হওয়া মানুষের সংখ্যা বাংলাদেশে এখনও আতঙ্কিত হওয়ার পর্যায়ে না পৌঁছালেও অর্থনীতিতে যে মহাবিপর্যয় সৃষ্টি হয়ে গেছে, সেটিকে আতঙ্কজনক বললে অত্যুক্তি হবে না। কারণ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৮.১৫ শতাংশে পৌঁছে যাওয়ায় অর্থনীতিতে উন্নয়নের যে জোয়ার আমাদের অতি দ্রুত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মহাসোপানে আরোহণের সুযোগ করে দেওয়ার কথা ছিল, এই চলমান বৈশ্বিক মহামারির আঘাতে ইতোমধ্যেই সে সম্ভাবনা বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছে। বিশ্বব্যাপী এই মহামারির দাপট দ্রুত কমানোর কোনো সমাধান দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। অতএব, মহামারির অর্থনৈতিক অভিঘাতও এক-দুই বছরে হয়তো স্তিমিত হবে না। করোনাভাইরাস মহামারির ছোবলে বিশ্ব অর্থনীতি ১৯২৯-৩৩-এর মহামন্দার চাইতেও ভয়াবহ যে আরেকটি মহামন্দায় ইতোমধ্যেই পতিত হয়েছে, তার ঢেউ বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও মহাবিপর্যয়কর সুনামির সৃষ্টি করবেই। সুনামি কথাটা হয়তো এ ক্ষেত্রে পুরোপুরি খাটে না। কারণ, ইতোমধ্যেই বিশ্ব অর্থনীতি যে একটা মহা-সংকোচনের গিরিখাতে নিক্ষিপ্ত হয়েছে, অদূর ভবিষ্যতে তা থেকে কোনো দেশের অর্থনীতিই মহাক্ষতিগ্রস্ত না হয়ে নিষ্ফৃ্কতি পাবে না। ক্ষতির মাত্রা কমানোর প্রাণপণ প্রয়াসই মৃত্যুর মিছিল থামানোর পর সব দেশের নীতি-প্রণেতাদের অহর্নিশ সাধনায় পরিণত হবে।
ইতোমধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক অবশ্য তাদের প্রাক্কলনে জানিয়েছে যে, করোনা-পরবর্তী ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সামান্য কমলেও তা ৭.৮ শতাংশের মতো হতে পারে, যা পরবর্তী বছরে আবার ৮ শতাংশ অতিক্রম করবে। এত তাড়াতাড়ি এ ধরনের আশাবাদী পূর্বাভাস প্রদানের ভিত্তি কী, সেটি বোঝা গেল না! আমি নিজে এত বেশি উচ্চাশা পোষণ করতে পারছি না। আমার সন্দেহ, অর্থনীতির যে ধস এবং লাইনচ্যুতি ইতোমধ্যেই সংঘটিত হয়ে গেছে, তার ধকল এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের বিশেষজ্ঞরা সঠিকভাবে বিশ্নেষণ করতে পারেননি। বাংলাদেশের অর্থনীতির সব খাতই চলমান করোনাভাইরাস মহামারির ছোবলে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর মধ্যে রপ্তানি খাতের চাহিদায় ধস, বৃহৎ ও মাঝারি শিল্প খাতের উৎপাদন সংকোচন, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প খাতের টিকে থাকার সংকট, জনশক্তি রপ্তানি বাজার সংকোচন ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহে ধস, প্রবাসীদের কর্মসংস্থানে ধস এবং দেশে ফেরার আসন্ন হিড়িক, পর্যটন-হোটেল-মোটেল-রেস্তোরাঁর ব্যবসায়ে ধস, নির্মাণ খাত ও নির্মাণ সামগ্রী উৎপাদন খাতের ধস, পরিবহন ব্যবস্থার লণ্ডভণ্ড অবস্থা- এগুলো সহজে চোখে পড়াই স্বাভাবিক। কিন্তু কৃষি খাত, ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ ও বাজার ব্যবস্থা, দোকানপাট-শপিংমল-গ্রামীণ হাট-বাজারের দীর্ঘ অচলাবস্থা, ভোক্তাদের ব্যবহার্য ইলেকট্রনিক পণ্যের বাজারের ধস, ব্যাংকগুলোর আমানত প্রবাহ সংকোচন, শিক্ষা খাতসহ সেবা খাতের তছনছ অবস্থা- এগুলোর মাধ্যমেও সংকোচনের অভিঘাত অচিরেই দৃশ্যমান হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই অভিঘাতগুলোর সম্মিলিত যোগফল বর্তমান অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে কমপক্ষে ১-১.৫ শতাংশ এবং আগামী অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে ২-৩ শতাংশ কমিয়ে দিতে পারে, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক যা-ই বলুক না কেন।

প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে অর্থনীতির এই মহাবিপর্যয় মোকাবিলার উদ্দেশ্যে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার পাঁচটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন, যেগুলোকে অত্যন্ত সময়োপযোগী বলতেই হবে। পরবর্তী সময়ে ঘোষণা করেছেন কৃষি খাতের প্রণোদনা। ২৫ এপ্রিল ছুটি শেষ হওয়ার পর তখনকার বাস্তবতার নিরিখে অদূর ভবিষ্যতে এগুলোর ফলোআপ হিসেবে আরও অনেক নতুন পদক্ষেপ আসবে নিঃসন্দেহে। পোশাক শিল্প খাত, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা, অন্যান্য রপ্তানিকারক শিল্প কারখানা- এগুলো প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা প্যাকেজগুলো থেকে উদার সহায়তা পাবে, যা তাদের জন্য স্বস্তিকর হবে। প্রধানমন্ত্রী হয়তো তাৎক্ষণিক ও স্বল্পমেয়াদি প্রণোদনা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করেছেন। বিশেষত, দেশের রপ্তানি খাত যেহেতু আগামী এক-দুই বছর প্রচণ্ড সংকোচনের শিকার হবে, তাই ওদিকে প্রাথমিক দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই হবে। যাতে রপ্তানি খাতের শ্রমিকদের আসন্ন ছাঁটাই ও বেকারত্ব থেকে রক্ষা করা যায়, তার জন্য ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ সঠিক পদক্ষেপ বিবেচিত হবে। দেশের চার কোটি দরিদ্র মানুষকে বাঁচানোর ব্যাপারটিও প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে যথাযথ গুরুত্ব পায়নি বলে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ অভিযোগ করছে। অন্যদিকে, প্রবাসী বাংলাদেশিদের জীবন ও জীবিকা এই মহামারির ফলে অচিরেই আরও বেশি কঠিন বিপর্যয়ের গিরিখাতে নিক্ষিপ্ত হতে যাচ্ছে, সেটিও আমাদের দৃষ্টিসীমায় রাখতেই হবে।
আশঙ্কা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দামে যে ধস নেমেছে, সেটি মোটেও স্বল্পমেয়াদি হবে না। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যের তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোতে বাংলাদেশি জনশক্তির চাহিদা মারাত্মকভাবে সংকুচিত হলে লাখ লাখ প্রবাসীকে চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরতে হবে। এর ফলে শুধু রেমিট্যান্স প্রবাহে যে ধস নামবে, তা নয়। দেশের বেকারত্ব সমস্যাকেও এই চাকরি হারানো প্রবাসীরা মারাত্মক পর্যায়ে নিয়ে যাবে। গ্রামীণ অর্থনীতির গতিশীলতাও এর ফলে উল্লেখযোগ্যভাবে শ্নথ হয়ে যাবে। দেশের রপ্তানি আয়ের সংকোচন এবং রেমিট্যান্স প্রবাহের সংকোচনের যুগপৎ অভিঘাতে আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের চলতি হিসাব মানে কারেন্ট অ্যাকাউন্টে বড়সড় ঘাটতি সৃষ্টি হবে, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে আমাদের আমদানি-সক্ষমতায় এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্রমাবনতিতে। এর পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয়ে বড়সড় ঘাটতি সৃষ্টি হবে, যার ফলে সরকারের উন্নয়ন বাজেট কাটছাঁট করতেই হবে। এমনকি, সরকারের পৌনঃপুনিক বা রাজস্ব ব্যয় সংস্থানেও আগামী বছর সংকট সৃষ্টি হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
চলমান অনেক প্রকল্পই অর্থায়ন সংকটে স্থবির হয়ে যাবে, এটিও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বৈদেশিক ঋণের প্রবাহ সংকুচিত হয়ে যাবে, মেগা প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন অনেক পিছিয়ে যাবে। মোদ্দাকথা হলো, দেশের কষ্টার্জিত অর্থনৈতিক গতিশীলতা যাতে লণ্ডভণ্ড না হয়ে যায়, সে জন্য অদূর ভবিষ্যতে আরেকটি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও পুনর্বাসন কর্মসূচিকে যুদ্ধকালীন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার সহকারে নীতি-প্রণেতাদের সঠিক নির্দেশনায় জাতির সর্বাত্মক মিশনে পরিণত করতে না পারলে অর্থনীতি এই গভীর গিরিখাত থেকে আবারও উন্নয়নের মহাসড়কে উঠে আসা কঠিন হয়ে যাবে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বর্তমান মহামারির কবলে নিক্ষিপ্ত বিশ্ব অর্থনীতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় সংকটের গিরিখাতে পড়ার সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন। এর ধ্বংসযজ্ঞ থেকে উত্তরণের জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর মার্শাল প্ল্যানের মতো আরেকটি পুনরুদ্ধার-পুনর্বাসন-পুনর্নির্মাণ কর্মসূচির প্রয়োজন হবে বলে মত ব্যক্ত করেছেন ইউরোপীয় বেশ কয়েকজন রাষ্ট্রপ্রধান। ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধক্ষেত্র পূর্ব সীমান্তের মাত্র কয়েকটি অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছেছিল, কিন্তু এতদসত্ত্বেও যুদ্ধের প্রস্তুতির ডামাডোলে তদানীন্তন বাংলা ১৯৪৩-৪৪ সালে ‘পঞ্চাশের মন্বন্তরের’ কবলে নিক্ষিপ্ত হওয়ায় প্রায় ৫০ লাখ মানুষের মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল। আজকের বাংলাদেশের সৌভাগ্য যে, এখন আমরা ঔপনিবেশিক বিদেশি প্রভুদের খামখেয়ালিপনার অসহায় শিকার হবো না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা আমাদের নিজস্ব মার্শাল প্ল্যান প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে সংকটের গিরিখাত থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে উন্নয়নের মহাসড়কে দ্রুত ফিরতে সক্ষম হবোই ইনশাআল্লাহ, এটাই হোক আজকের প্রার্থনা।
অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি
বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Amrto sen

“আমাদের আবার দেখা হবে,” রানি এলিজাবেথ ১৯৩৯ সালের একটা গানের অনুষঙ্গেই সম্প্রতি এ কথা বললেন। তার এই কথার পিছনে একটা অনুপ্রেরণামূলক প্রণোদন ছিল, এটাই আমরা চাইছিলাম। কিন্তু এই মহামারি শেষ হলে আবার যখন আমাদের দেখা হবে, কেমন পৃথিবী দেখব আমরা? আমরা কি যৌথভাবে এই সঙ্কটের মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতা থেকে নতুন কিছু লাভ করব?
করোনাভাইরাসের আগেও পৃথিবী গুরুতর সব সমস্যায় পূর্ণ ছিল। দেশে দেশে অসাম্য ছিল লাগামছাড়া, দেশগুলির অভ্যন্তরেও তা লক্ষণীয় ছিল। বিশ্বের ধনীতম দেশ আমেরিকায় লক্ষ লক্ষ মানুষ চিকিৎসা পরিষেবার আওতার বাইরে ছিলেন, আকস্মিক অসুস্থতায় কিছু করার ছিল না। অতিমাত্রায় কঠোরতা ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষে দুর্বল মানুষের জন্য কিছু করে উঠতে বাধা দিচ্ছিল। ব্রাজিল থেকে বলিভিয়া, পোল্যান্ড থেকে হাঙ্গেরি— সর্বত্র গণতন্ত্র বিরোধী রাজনীতি মাথাচাড়া দিচ্ছিল।

এই মহামারির বিরুদ্ধে যৌথভাবে লড়াই করার অভিজ্ঞতা কি মহামারির আগেকার এই সব সমস্যার উপশমে সাহায্য করবে?
একসঙ্গে কাজ করার এই প্রয়োজনবোধ নিশ্চিতভাবে গণ-কর্মকাণ্ডে একটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানুষ অধিক মাত্রায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতার গুরত্বকে বুঝতে পেরেছিল। জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল এবং বিশ্বব্যাঙ্ক ১৯৪৪-’৪৫ এর মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়। ভেরা লিনের সেই ‘উই উইল মিট এগেইন’ গানটি গাওয়ার খুব বেশি দিন পরের ঘটনা নয় এগুলো।
যাই হোক, এই অভিজ্ঞতা থেকে কোনো দেশ কি দীর্ঘমেয়াদি কোনো উন্নতির শিক্ষা লাভ করতে পারে? আমরা কয়েকটির ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে খাদ্যাভাবের কারণে ইংল্যান্ডে যে অপুষ্টির প্রবাহ তৈরি হয়েছিল, যুদ্ধের পরে তা দ্রুত কমে আসে। খাবারের জোগানে বিরাট ধস থেকে ইংল্যান্ড রেশনিং ব্যবস্থার দ্বারা ও সামাজিক স্তরে বাধা-নিষেধ আরোপ করে খাদ্যের সমবণ্টন চালু করে। অপুষ্টির ক্রমাগত প্রবাহে তা কাজে আসে। চিকিৎসা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও এই বণ্টন কাজে আসে।
এ সবের ফল দাঁড়ায় অসাধারণ। ১৯৪০ এর যুদ্ধের দশকে ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসে সদ্যোজাত ছেলেদের সম্ভাব্য আয়ুসীমা ৬.৫ বছর করে বেড়ে যায়, যা তার আগের দশকে ছিল ১.২ বছর। সদ্যোজাত মেয়েদের ক্ষেত্রে যুদ্ধের দশকে সম্ভাব্য আয়ুসীমা বেড়ে যায় ৭ বছর, যুদ্ধের আগের দশকে যা ১.৫ বছর ছিল। সামাজিক ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও পিছিয়ে থাকা মানুষের দিকে অধিক মাত্রায় নজর দেওয়ার ফলে যা উঠে আসে, আমরা তাকে ‘কল্যাণকর রাষ্ট্রব্যবস্থা’ বলে থাকি। যুদ্ধের কালে এবং যুদ্ধের পরে সামাজিক ন্যায়ের অন্যতম প্রবক্তা আনেউরি বেভান ১৯৪৮ সালে ইংল্যান্ডে প্রথম ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস হাসপাতাল, ম্যানচেস্টারের পার্ক হসপিটালের দ্বারোদ্ঘাটন করেন।
সাম্প্রতিক এই সঙ্কট থেকে কি এমন কিছু ইতিবাচক ঘটনা ঘটতে চলেছে? একটা সঙ্কট থেকে উত্তীর্ণ হতে গিয়ে যে শিক্ষাটা পাওয়া যায়, তা নির্ভর করে কীভাবে সেই সমস্যার মোকাবিলা করা হল এবং কোন সমস্যাগুলির আশু সমাধান করা হল তার উপর।
এ ক্ষেত্রে রাজনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, যার মধ্যে শাসক আর শাসিতের সম্পর্কও বর্তমান। যুদ্ধের সময়ে এক দিকে যদি ইংল্যান্ডে খাদ্যের সুষম বণ্টন আর চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত ঘটে থাকে, তা হলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যেরই অন্য দিকে বাংলায় ঘটেছিল ১৯৪৩ এর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ এই মন্বন্তরে মারা যান, ব্রিটিশ সরকার এই দুর্ভিক্ষ আটকানোর জন্য বিশেষ কিছুই করেনি। সাম্প্রতিক মহামারির ক্ষেত্রে সামাজিক ন্যায়ের বিষয়টি তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো স্থান অধিকার করে নেই। আমেরিকায় সাদা মানুষের চাইতে অনেক বেশি মাত্রায় কোভিড-১৯ এর শিকার হচ্ছেন আফ্রিকান আমেরিকানরা। শিকাগোয় এই মহামারিতে যত জন মারা গিয়েছেন, তার মধ্যে ৭০ শতাংশ আফ্রিকান আমেরিকান, যারা মোট বাসিন্দার এক তৃতীয়াংশ। ব্রাজিল বা হাঙ্গেরি অথবা ভারতের মতো দেশে অভ্যন্তরীণ বৈষম্য এই যন্ত্রণার দিনেও কিছু কম নয়।
ভারতের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উল্লেখযোগ্যভাবে লক্ষণীয়। অসাম্য এখানে বিপুল। স্বাধীনতার পর থেকে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে, এখানে দুর্ভিক্ষ ঘটেনি। তা সত্ত্বেও গণ-সমাজের আলোচনায় উঠে আসা বিষয়গুলি থেকে আঁচ করা যায় বঞ্চিত মানুষের কথা, বিপন্নকে সুরক্ষা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা— ইত্যাদি ব্যাপারে সরকারি স্তরে বিভিন্ন বাধা প্রদান, সেই সঙ্গে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে খর্ব করার কথা।
সচ্ছল মানুষের জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থার অধিকতর সুবন্দোবস্ত এবং তারই পাশাপাশি গরিব মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবার একান্ত অভাবের বৈপরীত্য, তার সঙ্গে আধুনিক জাতপাত-ভিত্তিক অসাম্য যুক্ত হয়ে এমন এক অবস্থা হয়ে রয়েছে যে, ভারত এই মহামারি মোকাবিলা করতে গিয়ে বিপুলভাবে উপকৃত হতে পারে। যদিও এখনও পর্যন্ত এখানে তেমন সাম্যাবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা দেখা যায়নি, বরং হঠাৎ লকডাউন ঘোষণা করে, ট্রেন-বাস বন্ধ করে পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা না ভেবে যা করা হয়েছে, তা অভাবনীয়। দরিদ্রতম এই সম্প্রদায়ের মানুষ নিজের বাড়ি থেকে শত শত মাইল দূরে রীতিমতো বিপাকে পড়ে রইলেন।
এ কথা সত্য যে, সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়াকে রোধ করতে পারে, কিন্তু এটা প্রয়োগ করতে হলে পরিপূরক ব্যবস্থা প্রয়োজন। লকডাউনের ফলে বিপর্যস্ত মানুষের আয়, খাদ্য, চিকিৎসা ইত্যদি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অনেক দেশের মতো ভারতেরও ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস প্রয়োজন। কিন্তু এই মহামারি থেকে সেদিকে কোনো প্রবণতা কি দেখা দেবে?
দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, আবার যখন আমাদের দেখা হবে, আমরা সেই ফেলে আসা অসাম্যের পৃথিবীর থেকে খুব দূরে চলে যাব না। এভাবে যাওয়াও হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু এই দুঃসময়ে অনেক দেশেই বিবিধ যন্ত্রণার উপশমের চেষ্টা করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে খানিক কম অসাম্য-যুক্ত বিশ্বকে গড়ে তোলার এক আদর্শকে লালন করা হচ্ছে। আমরা সঙ্কটের মাঝখানটাও এখনও পার হইনি, এই সময়ে এমন একটা আশা রাখা কি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে?
লেখক: নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ভারতীয় বাঙালি অর্থনীতিবিদ। সূত্র: আনন্দবাজার

কে হচ্ছেন বিশ্বের প্রথম ট্রিলিয়নেয়ার?

বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের সবারই নিট সম্পদের পরিমাণ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। ১৯১৬ সালে জন ডি রকফেলার প্রথম বিলিয়নেয়ারের স্বীকৃতি পান। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের সম্পদ বাড়লেও সেটি বিলিয়ন ডলারের সীমা পার হয়নি। তবে বয়স ও সম্পদ বাড়ার হার বিবেচনা করলে বর্তমানে বেশকিছু শীর্ষ ধনী রয়েছেন, ভবিষ্যতে যাদের সম্পদ ট্রিলিয়ন ডলারের মাইলফলক ছোঁয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

ট্রিলিয়ন ডলারের অংকটি অবশ্য বেশ বড়। ১ ট্রিলিয়ন ডলার ১ হাজার বিলিয়ন বা ১ লাখ কোটি ডলারের সমতুল্য, বর্তমানে যা মেক্সিকো কিংবা দক্ষিণ কোরিয়ার নমিনাল জিডিপির সমান। ১ ট্রিলিয়ন ডলার দিয়ে এক্সনমবিল ও ম্যাকডোনাল্ড’স কেনার পরও কোকা-কোলাকে কেনার মতো পর্যাপ্ত অর্থ থাকবে। বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ ধনী অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোসের সম্পদের পরিমাণ ১১২ বিলিয়ন ডলার। ফলে ট্রিলিয়ন ডলারের মাইলফলকে পৌঁছতে তাকে আরো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।

বিশ্বের প্রথম ট্রিলিয়নেয়ার কে হচ্ছেন—এ নিয়ে পশ্চিমা দুনিয়ার আর্থিক বিশ্লেষক, ফিন্যান্সিয়াল জার্নাল ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিনিয়তই বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করছে। ইনভেস্টোপিডিয়ার মতে, বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ধনীদের মধ্যে কেউই প্রথম ট্রিলিয়নেয়ার হতে পারবেন না। এর কারণ হিসেবে তারা বলছে, অন্যতম শীর্ষ ধনী কার্লোস স্লিম ও ওয়ারেন বাফেটের যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকলেও এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের বয়স। যদি কার্লোস স্লিম প্রতি বছর কর-পরবর্তী ২৫ শতাংশ হারে রিটার্ন পান, তাহলে ১ ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদ অর্জনে তার ১১ বছর সময় লাগবে। অবশ্য এদিক দিয়ে বিল গেটস স্লিমের চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন। তার বয়স বর্তমানে ৬৪ বছর। যদিও বর্তমানে সম্পদ অর্জনের তুলনায় দাতব্য কার্যক্রমে তার আগ্রহ বেশি। কিন্তু যদি বিল গেটস আরো বেশি সম্পদ অর্জনে মনোযোগী হন, তাহলে তাকে নতুন বিনিয়োগের খাত খুঁজে বের করতে হবে, কারণ মাইক্রোসফটের প্রবৃদ্ধি দিয়ে ট্রিলিয়ন ডলার অর্জন করাটা কঠিন হবে।

কথায় আছে, টাকায় টাকা আনে। বিত্তশালীদের কাছে প্রচুর আকর্ষণীয় বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে, যা সাধারণের নেই। ১০০ বিলিয়ন ডলারের সম্পদকে দ্বিগুণ করতে হলে আরেকটি ভিয়েতনাম খুঁজে পেতে হবে, যা সচরাচর দেখা যায় না। যখন বিনিয়োগকারীরা ওয়ারেট বাফেটের কাছ থেকে শোনেন যে, তাকে সম্ভাবনাময় বিনিয়োগের খাত খুঁজে পেতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে, তখন বুঝতে হবে তার কাছে কাজে লাগানোর মতো ন্যূনতম ১০০ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ রয়েছে।

অন্ট্রাপ্রেনিউর ডটকমের চোখে সম্ভাব্য ট্রিলিয়নেয়ার যারা
বিশ্বের ধনী কোম্পানি ও ব্যক্তিদের গত পাঁচ বছরের সম্পদের তথ্য পর্যালোচনা করে অন্ট্রাপ্রেনিউর ডটকম একটি তালিকা তৈরি করেছে, যেখানে দেখানো হয়েছে বর্তমান শীর্ষ ধনীদের সম্পদের প্রবৃদ্ধি গতি বজায় থাকলে কখন তারা ট্রিলিয়নেয়ার হতে পারবেন? এর মধ্য থেকে বিশ্বের ১১ জন ধনী ব্যক্তি কত বছর বয়সে ট্রিলিয়নেয়ার হতে পারবেন, সেটি ইনফোগ্রাফিকসে দেখানো হয়েছে।

সমস্যা হচ্ছে, সম্পদ অর্জনের পথে বর্তমানে অন্যতম বাধা সরকারের বিভিন্ন ধরনের নীতি ও বিধিবিধান। আঠারো শতকে যারা মনোপলি ও শোষণের মাধ্যমে অঢেল সম্পদ অর্জন করেছিলেন, বর্তমানে এ ধরনের কর্মকাণ্ড প্রায় পুরো পৃথিবীতেই অবৈধ। তার ওপর আগের তুলনায় করের পরিমাণ অনেক বেশি এবং এক্ষেত্রে সরকারগুলো আগের মতো কোনে ধরনের ফাঁকফোকর সেভাবে দিচ্ছে না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে সৃজনশীল ও উদ্যমী উদ্যোক্তারা এসব বাধাবিপত্তি অতিক্রম করতে পারবেন না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, অতি ধনী হওয়াটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কঠিন হয়ে গেছে।

আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, যথেষ্ট সম্পদ অর্জনের পর অনেকের মাঝেই আর আগের মতো সম্পদ অর্জনের ক্ষুধা কিংবা ঝুঁকি নেয়ার মানসিকতা থাকে না। অথচ তারাই কিন্তু যখন তাদের কাছে হারানোর মতো কিছু ছিল না, তখন বড় ধরনের ঝুঁকি নিয়ে অঢেল সম্পদ অর্জন করেছেন। জন পলসন, জর্জ সরোস ও জিম সিমন্সের কথাই ধরা যাক। তারাই যথেষ্ট সম্পদশালী এবং তারা তাদের বিনিয়োগের লেভারেজ নিয়ে সন্তুষ্ট। এ মানুষগুলো আগের মতো ঝুঁকি নেবেন, সেটা বিশ্বাস করা কঠিন। প্রশ্ন হচ্ছে, পলসন ও অন্যরা কি টেন টু ওয়ান লেভারেজ প্রয়োগ করবেন এবং ১ ট্রিলিয়ন সম্পদ অর্জনের দিকে ছুটবেন? হয়তো তাই। কিন্তু তারা যা সম্পদ অর্জন করেছেন সেটি তাদের কয়েক জেনারেশনের জন্য যথেষ্ট, তাহলে কেন তারা নিজেদের সম্পদকে ঝুঁকিপূর্ণ এবং প্রায় অসম্ভব জুয়ার পেছনে বিনিয়োগ করবেন।

কিন্তু তাই বলে কি এমন কেউ নেই, যারা ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদ অর্জনের দিকে যাবেন না। অবশ্য সরকারি নেতা ও স্বৈরশাসকদের এ তালিকা থেকে বাদ দেয়াই সংগত হবে, কারণ তাদের অর্জিত সম্পদ প্রচলিত ও গ্রহণযোগ্য মাধ্যমে আসেনি। জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকের সহপ্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গের বয়স মাত্র ৩৫ বছর এবং তার সম্পদের পরিমাণ ৭৭ বিলিয়ন ডলার। যদি জাকারবার্গের সম্পদ কর পরিশোধের পর প্রতি বছর ১০ শতাংশ হারে বাড়ে, তাহলে তার ৬৫তম জন্মদিনের আগেই তিনি ট্রিলিয়নেয়ার হয়ে যাবেন। কিন্তু এ পরিমাণ সম্পদ অর্জনের জন্য ফেসবুককে অবিশ্বাস্য রকমের বড় হতে হবে। বর্তমানে ফেসবুকে জাকারবার্গের যে পরিমাণ মালিকানা রয়েছে, তাতে ট্রিলিয়নেয়ার হওয়ার জন্য ফেসবুককে এক্সনমবিলের বর্তমান আকারের তুলনায় ১০ গুণ বড় হতে হবে।

ইনভেস্টোপিডিয়ার মতে, ট্রিলিয়নেয়ার হওয়ার জন্য আরেকজন সম্ভাবনাময় প্রার্থী হচ্ছেন ক্রেইগ ভেন্টার। সেলেরা জেনোমিকসের প্রতিষ্ঠাতা এবং সিনথেটিক লাইফ নিয়ে গবেষণার জন্য বিখ্যাত ভেন্টার একাধারে মেধাবী ও উচ্চাভিলাষী দুটোই। যদিও তিনি এখনই ক্যান্সারকে তার গবেষণার বিষয়বস্তু বানাননি, বরং তিনি সিনথেটিক বায়োলজিতেই (ক্লিন বায়োফুয়েল) তার গবেষণা সীমাবদ্ধ রেখেছেন। কিন্তু কল্পনা করে দেখুন, ক্যান্সারের নিরাময় খুঁজে পাওয়া গেলে তার মূল্য কী দাঁড়াবে? যুক্তরাষ্ট্রে ক্যান্সারের নিরাময়ের জন্য প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ ব্যয় হয় এবং এর সতিকারের নিরাময় মাল্টি ট্রিলিয়ন ডলারের সুযোগ তৈরি করবে। ক্লিন বায়োফুয়েল ভেন্টারকে ট্রিলিয়নেয়ারে পরিণত করবে না, কিন্তু ধারণাটিকে একেবারে বাতিলের খাতায়ও ফেলার সুযোগ নেই।

এদের বাইরে আর কেউ কি রয়েছেন, যাদের ট্রিলিয়ন ডলারের উচ্চাভিলাষী আসনে পৌঁছনোর সক্ষমতা রয়েছে। এক্ষেত্রে মুদ্রাস্ফীতি এটিকে সহজ করে দিতে পারে, কিন্তু তার পরও এটি অবিশ্বাস্য এবং পিলে চমকানোর মতো ব্যাপার। যেমন ধরুন, কেউই কিন্তু অনুমান করেনি যে বিল গেটস সফটওয়্যারের ব্যবসা করে বিলিয়নেয়ার হবেন কিংবা আল ম্যান ইনসুলিন পাম্পের জন্য বিলিয়নেয়ার হয়ে যাবেন। তার মানে হচ্ছে, বিশ্বের প্রথম ট্রিলিয়ন ডলার আইডিয়াটি কারো কল্পনা থেকেই আসবে এবং বর্তমানে এটিকে হাস্যকর বলেই মনে হবে।

ইনভেস্টোপিডিয়া, ব্লুমবার্গ ও অন্ট্রাপ্রেনিউর ডটকম অবলম্বনে

মেহেদী হাসান রাহাত

কুরআনকে মিথ্যা প্রমাণ করতে গিয়ে নিজেই মুসলিম হলেন কানাডার অধ্যাপক মিলার!

নিউজ ডেস্ক : কানাডার সাবেক খ্রিস্টধর্ম প্রচারক ছিলেন অধ্যাপক ড. গ্যারি মিলার। তিনি পবিত্র কুরআনের মধ্যে ভুল খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। কুরআনের ভুল বের করে যাতে ইসলাম ও কুরআন বিরোধী প্রচারণা চালানো সহজ হয় সেজন্য তিনি এ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কুরআন পড়ার পর তার ভিতরে অদ্ভুত পরিবর্তন আসে। ফলে নিজেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমান হন। ইসলাম গ্রহণের পর তার দেয়া হয়েছে আবদুল আহাদ উমার।বাংলা নিউজ

অধ্যাপক ড. গ্যারি মিলার বলেন, আমি একদিন কুরআন সংগ্রহ করে তা পড়া শুরু করলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম কুরআন নাযিল হয়েছিল আরবের মরুচারীদের মধ্যে। তাই এতে নিশ্চয় মরুভূমি সম্পর্কে কথা থাকবে। কুরআন নাযিল হয়েছিল ১৪০০ বছর আগে। তাই খুব সহজেই এতে অনেক ভুল খুঁজে পাব ও সেসব ভুল মুসলিমদের সামনে তুলে ধরব।

কিন্তু কুরআন পড়ার পরে বুঝলাম আমার এসব ধারণা ঠিক নয়, বরং আমি অনেক আকর্ষণীয় তথ্য পেলাম। বিশেষ করে সূরা নিসার ৮২ নম্বর আয়াতটি আমাকে গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত করে। সেখানে আল্লাহ বলেন, এরা কী লক্ষ্য করে না কুরআনের প্রতি? এটা যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো পক্ষ থেকে নাযিল হতো, তবে এতে অবশ্যই বহু বৈপরিত্য দেখা যেত’।

এরপর আরো গভীরভাবে কুরআন অধ্যয়ন করলেন গ্যারি মিলার। আর তার এই অধ্যয়নই তাকে নিয়ে গেল ইসলামের পথে। ইসলামের দোষ খুঁজতে গিয়ে তিনি হয়ে গেলেন একজন মুসলিম তথা মহাসত্যের কাছে সমর্পিত একজন। তিনি বলেছেন, আমি খুব বিস্মিত হয়েছি যে কুরআনে ঈসার (আ.) মাতা মারিয়ামের নামে একটি বড় পরিপূর্ণ সূরা রয়েছে। আর এ সূরায় তার এত ব্যাপক প্রশংসা ও সম্মান করা হয়েছে যে এত প্রশংসা বাইবেলেও দেখা যায় না। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর নাম মাত্র ৫ বার এসেছে।

এক্সক্লুসিভ রিলেটেড নিউজ

দুর্বৃত্তের জীবনাচারকে মহিমান্বিত করা সমীচীন হবে না ড. সা’দত হুসাইন

ষাটের দশক মাঝামাঝি থেকে শেষের দিকে গড়িয়ে পড়ছে। আমরা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। দেশে আইয়ুব-মোনেমের শাসন চলছে। সরকারবিরোধী ছাত্রসংগঠনগুলোর তোড়জোড় অনেক বেশি। ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন ও মতিয়া গ্রুপ) ও ছাত্রলীগ রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় দল। ছাত্র শক্তি ছোট দল হলেও তাদের তৎপরতা লক্ষ করা যেত। তবে সরকারের বিরোধিতার ব্যাপারে তাদের অবস্থান অবিসাংবাদিতভাবে সুস্পষ্ট ছিল না। সরকারের অন্ধ সমর্থক ছিল ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন (এনএসএফ)। সাধারণ ছাত্ররা একে সরকারের দালাল সংগঠন নামে অ্যাখায়িত করত। এনএসএফের সদস্যরা সরকারের পক্ষে প্রচার চালাত, সরকারের গুণগান করত এবং বিরোধী ছাত্রসংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে মারামারি-হানাহানি করত। এককথায় এরা ক্যাম্পাসে গুণ্ডামি করত। সাধারণ ছাত্ররা এদের এনএসএফের গুণ্ডা হিসেবে জানত।

গুণ্ডাদের মধ্যে দুজন ছাত্র ছিল অতি পরিচিত। দলীয় সদস্যদের কাছে মহাসমাদৃত। এদের একজনের নাম খোকা, অন্যজনের নাম পাসপাট্টু। লোকে এদের নাম একসঙ্গে উচ্চারণ করত খোকা-পাসপাট্টু। দুজনেরই আসল নাম ছিল। তবে ছাত্র-শিক্ষকদের বেশির ভাগই সে নাম জানতেন না। পাসপাট্টুর গায়ের রং ফরসা। শরীরের গঠন বড়সড়। ঢাকাই ছবিতে হিরো কিংবা ভদ্রবেশী ভিলেনের ভূমিকায় নাম লেখালে তা বেমানান হতো না। তার পেটা শরীর। কোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে ভেচকি দিলে লোকজন ছুটে পালাত। খোকা ছিমছাম গড়নের। চোখে পাতলা চশমা। ব্যায়াম করা সুঠাম দেহ। তবে তা মোটেই ভীতিপ্রদ নয়; বরং দেখতে বিদেশি ছবিতে অভিনয় করা ‘প্রফেসর’ মনে হতো। একবার আমাদের এক সতীর্থ বন্ধুকে আঘাত করার জন্য সে তেড়ে আসছিল। আমি তাকে না চিনে ‘করেন কী, করেন কী’ বলে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে আটকে রাখতে চেষ্টা করেছিলাম। সে অবশ্য আমাকে ধাক্কা দিয়ে ছুটে গিয়েছিল। তাকে দেখে মোটেই ভয়াল মনে হয়নি। তার নাম-পরিচয় জানলে এত কাছে গিয়ে তাকে বাধা দিতে হয়তো সাহস করতাম না।

খোকা-পাসপাট্টু দুজনই সায়েন্স ফ্যাকাল্টির অর্থাৎ কার্জন হল অঙ্গনের ছাত্র ছিল। তবে সারা দিন তারা আর্টস ফ্যাকাল্টি অর্থাৎ বর্তমান কলাভবন এবং মধুর ক্যান্টিন ঘুরে বেড়াত। এখানে তারা যত অপকর্ম করত, সন্ধ্যায় কার্জন হলের দিকে ফিরে যেত। খোকা ঢাকা হল বা বর্তমান শহীদুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র ছিল। পাসপাট্টু ফজলুল হক হলে থাকত। পাসপাট্টু বিজ্ঞান বিষয়ে মাস্টার্স পার্ট টুর ছাত্র ছিল। তার নাম পাসপাট্টু হওয়ার এটিও একটি কারণ। আরো কারণও রয়েছে। খোকা স্নাতক পর্যায়ের ছাত্র ছিল। পাসপাট্টু প্রায়ই হলুদ বা আদার রঙের হাফ শার্ট-প্যান্টের ভেতরে ‘টাক ইন’ করে চলত। খোকা ফুল হাওয়াই শার্ট-প্যান্টের ওপরে পরত। তাকে কোনো রকমে হিংস্র মনে হতো না।

খোকা-পাসপাট্টুর নাম জানত না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের ছাত্র-শিক্ষকের খোঁজ পাওয়া সে সময়ে সত্যি দুষ্কর ছিল। তাদের কর্মকাণ্ডের অপ্রকাশিত বুলেটিন সবার মুখে মুখে ফিরত। কর্মকাণ্ড বলতে অপকর্মকে বোঝানো হতো। আজ একে মেরেছে, কাল ওর টাকা-পয়সা কেড়ে নিয়েছে। পরশু কোনো এক ছাত্রের বালিশ-তোশক, বই-খাতা পুড়িয়ে দিয়েছে এমন সংবাদ প্রতিদিন শোনা যেত। কেউ কেউ আবার এদের অপকর্মকে বাহাদুরি হিসেবে দেখত। এরা এক সাপুড়ে জোগাড় করেছিল, যে গলায় সাপ জড়িয়ে এদের সঙ্গে ঘুরত। লোকটার চেহারাও ভীতপ্রদ ছিল। ছাত্র-ছাত্রীরা এ ধরনের সাপ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দায় ঘোরা মোটেই পছন্দ করতেন না। এনএসএফের সদস্যরা অবশ্য সুযোগ পেলেই খোকা-পাসপাট্টুকে এ জন্য বাহবা দিত। একই সঙ্গে এই দুই ছাত্রের, তথা দুর্বৃত্তের বীরত্বগাথা তারা সবিস্তারে বর্ণনা করত। পাসপাট্টুকে কবে-কোথায় সাত-আটজন আক্রমণকারী ঘিরে ফেলেছিল, সেখান থেকে ‘ব্যাক কিক’ মেরে দুই আক্রমণকারীকে ধরাশায়ী করে আর এক আক্রমণকারীর হাত মোচড়ে দিয়ে কিভাবে সে বেরিয়ে পড়েছিল তার বর্ণনা দিতে গিয়ে এনএসএফের সদস্যরা রীতিমতো উচ্ছ্বসিত এবং উত্ফুল্ল হয়ে পড়ত। মনে হতো পাসপাট্টুকে কাছে পেলে তারা এখনই পায়ে ধরে সালাম করে বসবে। তারা মনে করত এমন হিরো তারা বোম্বের ফিল্মেও দেখেনি। খোকার ব্যাপারেও গালগল্পের শেষ ছিল না। খোকা নাকি দস্যু বাহারাম হওয়ার চেষ্টা করছে। সে ফ্লাইং ক্লাবে বিমান চালনা শিখছে, অচিরেই আকাশ থেকে আক্রমণ পরিচালনা করবে। সে হবে এ অঞ্চলের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ খলনায়ক।

সব কল্পকাহিনি (Myth) অসত্য প্রমাণিত করে ১৯৬৮ সালের শেষ দিকে প্রতিপক্ষের আক্রমণে আহত হয়ে ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি হলো পাসপাট্টু। তাকে মারাত্মকভাবে ছুরিকাঘাত করা হয়েছিল। দিন চারেক মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে ইহধাম ত্যাগ করল পাসপাট্টু। তার মৃতদেহ নিজ জেলা বরিশালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তার দাফন হয়। পাসপাট্টুর মৃত্যুতে ঢাকায় কেউ দুঃখ প্রকাশ করেছে বলে মনে হয় না, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। যত দূর মনে পড়ে, তার জন্য কোনো শোকসভা হয়নি। এনএসএফের অবস্থা তখন খারাপের দিকে। শোকসভা করার মতো সামর্থ্য এনএসএফের ছিল না।

একটি করুণ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পাসপাট্টুর গল্পগাথা (Myth) , প্রভাব-প্রতিপত্তি, অত্যাচার-অনাচারের অবসান ঘটল। এর কিছুদিন পর ১৯৬৯ সালের উত্তাল ছাত্র আন্দোলন শুরু হলো। অল্প দিনের মধ্যে তা গণ-আন্দোলনে রূপ নিল। খোকা গা-ঢাকা দিল। তারপর এলো স্বাধীনতাযুদ্ধ। খোকার কোনো খোঁজখবর ছিল না। দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে রেসকোর্সে খোকার লাশ পড়ে আছে বলে জানা গেল। খোকা-পাসপাট্টু যুগের এখানেই শেষ।

যারা শুধু পেশিশক্তি, গুণ্ডামি ও দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে পরিচয় ও প্রতিপত্তির শীর্ষে উঠে যায়, তাদের পরিণতি শেষ পর্যন্ত বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খোকা-পাসপাট্টুর মতো হয়ে থাকে। স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে কলতাবাজার, লালবাগ, এলিফ্যান্ট রোডের কিছু মারদাঙ্গা তরুণের নাম প্রায়ই শোনা যেত। স্বাধীনতার পর এদের নাম খুব একটা শোনা যায়নি। এদের মধ্যে যে অল্প কয়েকজন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে বেঁচে ছিলেন, তাঁদের নাম অবশ্য পরেও বিভিন্ন কারণে শোনা যেত। রাজনৈতিক কারণে এনএসএফের গুণ্ডারা বিতাড়িত হয়ে গা-ঢাকা দিয়েছিল। তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। বহু বছর পরে ভোল পাল্টিয়ে তারা অতিসাধারণ নাগরিকের মতো জীবন কাটাচ্ছিল। দেখা হলে চোখ নিচু করে অন্যদিকে কেটে পড়ত। যেসব সংবাদকর্মী এবং পত্রপত্রিকা তাদের ‘গৌরবগাথা’ প্রচার করতেন, তাঁরাও এই গুণ্ডাদের ব্যাপারে নির্বিকার, নিশ্চুপ। প্রাক-স্বাধীনতা সময়ের পেশিধররা কোনোমতে নিস্তেজ জীবন কাটিয়েছে।

স্বাধীনতার পর নতুন মাস্তান গ্রুপের আর্বিভাব ঘটল। তবে যারা মারাত্মক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং জঘন্যতম অপরাধে জড়িত ছিল, তাদের কর্মকাণ্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও এর আশপাশের এলাকায় সীমিত ছিল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মধ্যে সশস্ত্র হানাহানি তীব্র হয়ে দেখা দিলেও খুনখারাবিতে লিপ্ত দুর্বৃত্তদের নাম-পরিচিতি বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে পড়েনি। এরই মধ্যে স্থানীয়ভাবে কুখ্যাত সাতজনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে খুন করা হয়। কারো ওপর পত্রপত্রিকায় ঘটা করে খবর প্রকাশিত হয়নি। সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা সর্বহারা পার্টি, জাসদ, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি ইত্যাদি রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে নানা ধরনের মারাত্মক অপরাধ সংঘটিত করত। তবে শুধু মারাত্মক পেশাজীবী কিংবা ক্ষমতাধর সন্ত্রাসী হিসেবে কোনো ব্যক্তির নাম শহরে বা পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়েনি। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের হোতারা ছিলেন মূলত রাজনৈতিক নেতা। এঁদের মধ্যে কয়েকজন গণতান্ত্রিক ব্যক্তি রাজনীতি ছেড়ে সশস্ত্র সংগ্রামে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন।

আদর্শ নিরপেক্ষ ছোট ছোট সন্ত্রাসী গ্রুপের নতুনভাবে উত্থান শুরু সামরিক শাসনকালে। সরকারের বিভিন্ন এজেন্সির আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে দুর্বৃত্ত গ্রুপ স্থানীয় পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং নির্দিষ্ট জনপদে, বলা যায় পাড়া-মহল্লায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, মারধর, সম্পত্তি দখল এবং ছিনতাইয়ের মতো কর্মকাণ্ড নির্দ্বিধায় চালিয়ে যেতে থাকে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সরকারি প্রশাসন ওপরের নির্দেশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এদের সহায়তা করে। পত্রপত্রিকা এদের অপকর্মকে কখনো সমালোচনা করে, কখনো গৌরবান্বিত করে প্রকাশ করে। যে কাজ সর্বতোভাবে নিন্দিত হওয়ার কথা, সে কাজকে নন্দিত করতে কেউ কেউ চেষ্টা করেছে। সন্ত্রাসীরা কোথায় ফিল্মি কায়দায় ছিনতাই করেছে, কোথায় সদলবলে সরকারের সম্পত্তি দখল করেছে, কোথায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে টেক্কা দিয়ে তাদের কার্য সিদ্ধি করেছে, তাকে রংচং দিয়ে বর্ণনা করলে প্রকারান্তরে দুর্বৃত্তদের উৎসাহিত করা হয়। উঠতি বয়সের তরুণরা এদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এরশাদ সরকারের পতনের কিছুদিন আগে পর্যন্ত জাতীয় পার্টি ঘেঁষা দুর্বৃত্তদের কীর্তিকলাপ গল্পাকারে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এসব প্রতিবেদনের মাধ্যমে সাধারণ্যে এদের পরিচিতি বেড়েছে।

১৯৯১ সালে দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। নির্বাচনের মাধ্যমে দলীয় সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া মাত্র তাদের অঙ্গসংগঠন, বিশেষ করে ছাত্রসংগঠনের শক্তিমান সদস্য ও নেতারা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। পেশিশক্তির মহড়া দিয়ে তাদের লক্ষ্য হাসিল, সম্পত্তি, প্রতিষ্ঠান দখল এবং অর্থ সংগ্রহের কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় শহরের অছাত্র, দলনিরপেক্ষ, তরুণ সন্ত্রাসীরা। ছাত্রনেতাদের সমর্থনে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজের হল-হোস্টেল তারা দখল করে নেয়। সরকারি দলের সমর্থক দাবি করে মারামারি, খুনাখুনিতে লিপ্ত হয়। অর্থ-সম্পদের সঙ্গে নামের কলেবরও বেড়ে যাবে। কখনো কুৎসিত ডাকনাম, আবার কখনো অভিজাত শ্রেণির পদবি এসে তাদের মূল নামের আগে-পিছে যোগ হয়। কুৎসিত ডাকনামের মধ্যে রয়েছে—কুত্তা, টিয়া, মুরগি, খচ্চর, পিচ্চি, ব্যাঙ্গা, লেংড়া ইত্যাদি। অভিজাত উপাধির মধ্যে রয়েছে—মিনিস্টার, জমিদার. কমান্ডার, শেঠ, কমিশনার, বাদশা, শাহান শাহ ইত্যাদি। খারাপ-ভালো যা-ই হোক না কেন, এসব নাম-পদবির ব্যবহার সন্ত্রাসীদের পরিচিতিকে সম্প্রাসারিত করে, অর্থ সংগ্রহ (চাঁদাবাজি) এবং দখলবাজিতে বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বিশেষণওয়ালা নাম শুনলে দোকানদার, ব্যবসায়ীরা ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি চাঁদা বের করে দেন। তাদের সমীহ করে কথা বলেন। এমনকি তাদের সাজানো অনুষ্ঠান স্পন্সর করতে রাজি হয়ে যান। ফলে তাদের আয়-সম্পদ অনেক বেড়ে যায়।

তরুণ সন্ত্রাসীদের নিজস্ব এবং পারিবারিক পরিচয় খুবই নিম্নস্তরের। এরা মুচি, কসাই, গোর খোদক, সুইপার, ক্লিনার, ডোম, টি-বয়, লোডার, পোর্টার, ছিঁচকে চোর, চোরাচালানির চাকর হিসেবে কাজ করে। দু-একটি দুঃসাহসী কাজ করার পর এদের পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে। কিছু সংবাদকর্মী এদের মহিমান্বিত করে খবর ছাপান, এদের ওপর বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। সাধারণ মানুষ এদের সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়। এতেই এদের কেল্লাফতে। বেশ কয়েক বছর আগে পুরান ঢাকার এক ডোমের ছেলেকে নিয়ে পত্রপত্রিকায় অনেক কল্পকাহিনি প্রকাশ হয়েছিল। তাকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছিল, সে যেন এক বিরাট হিরো, ইচ্ছা করলে সে ফিল্মে যোগ দিতে পারে। আসলে নিষ্ঠুরতা এবং অপরাধমূলক কাজ করা ছাড়া তার আর তেমন কোনো গুণ ছিল না। অনেকটা স্বাভাবিক নিয়মে একসময় সে তিরোহিত হয়। তার এমন কোনো গুণ ছিল না যে লোকে তাকে মনে রাখবে। জীবদ্দশায় তাকে নিয়ে ফলাও করে খবর প্রকাশ করা হতো। মানুষ তার সম্পর্কে জানতে উৎসাহী হতো। দু-একজন তার প্রশংসাও করত।

খুন, গুম, অপহরণ, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের মতো জঘন্য অপরাধের পরিকল্পনাকারী, বাস্তবায়নকারী, সহযোগী ও সুরক্ষা প্রদানকারীকে আইনের আওতায় আনা প্রত্যেক নাগরিকের নৈতিক কর্তব্য। বাস্তব অবস্থার কারণে যদি এ কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করা না যায়, তবে নিদেনপক্ষে এই শ্রেণির অপরাধীকে মনে-প্রাণে ঘৃণা করতে হবে। যথাসম্ভব এদের বয়কট করতে হবে। কোনো অজুহাতে এদের কাজকর্ম তথা অপকর্মকে মহিমাস্বিত (Glorify) করা যাবে না। ফিল্মের নায়কের সঙ্গে এদের তুলনা করা যাবে না। এরা ঘৃণিত। সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য। এদের সে দৃষ্টিতেই দেখতে হবে। সমাজের নোংরা-পোকা হিসেবে এরা বেঁচে থাকবে অথবা মারা যাবে। এর বেশি কিছু নয়।

লেখক : সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব ও পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান

পারিবারিক শিষ্টাচার ও আমাদের যুব সমাজ

মানব সভ্যতার আদিম এবং প্রাচীনতম সংগঠন হ”েছ পরিবার । পরিবার হচ্ছে একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের ক্ষুদ্রতম একক; কিন্তু এ ক্ষুদ্রতম এককের ওপরই নির্ভর করে একটি জাতির সভ্যতা। পরিবারের ভালো-মন্দ রাষ্ট্রকেও আলোড়িত করে। পরিবার হচ্ছে মানুষ তৈরির কারখানা। পরিবারেই মানবশিশুর জন্ম হয়, পরিবারেই বিকশিত হয় এবং ধাপে ধাপে পূর্ণাঙ্গ মানুষে পরিণত হয়। পরিবারেই ভালো মানুষের জন্ম হয়, আবার খারাপ মানুষের জন্ম হয়। পরিবারেই রাষ্ট্রনায়কদের জন্ম হয়, আবার সভ্যতা ধ্বংসকারী নরপিচাশের জন্ম হয়। পরিবার নামক এই সংগঠনটি মানব সভ্যতার শুরুতে ছিল এবং শেষ পর্যন্ত থাকবে ,তবে তার আঙ্গীক বা কাঠামোর পরিবর্তন হ”েছ এবং ভবিষ্যতে হবে । পরিবার ভালো-মন্দের পার্থক্য, গড়ে দেয় , ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, শালীনতা, বিনয় ই পারিবারিক শিষ্টাচার।

শিষ্টাচার — মানুষের আচার-আচরণ, কথা, বার্তা, কার্যকলাপ, ভাববিনিময় ইত্যাদি সুন্দররূপে, ভদ্ররূপে প্রকাশিত হওয়াই শিষ্টাচার। শিষ্টাচার হল মানুষের চরিত্রের অলংকার। যেসব গুণাবলি মানুষের চরিত্রকে সুন্দর, আকর্ষণীয় ও গৌরাম্বিত করে তুলে তার মধ্যে শিষ্টাচার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সত্য কথন, পরোপকার, ক্ষমা, দয়া-দানশীলতা, ভক্তি, শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা, সম্প্রীতি ও ভালোবাসা, ক্ষমা, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, শালীনতা, বিনয়, ভদ্রতা ইত্যাদি বিশ্বজনীন গুণাবলি নিজের মধ্যে ধারণ, অনুশীলন এবং এর বিপরীত বিষয়গুলো বর্জন করাই হচ্ছে শিষ্টাচার।

শিষ্টাচারের অভ্যাস বা কৌশল রপ্ত করার প্রাথমিক ও প্রধান শিক্ষালয় হল পরিবার। একজন শিশু কিছু বুঝতে শিখলেই সে মা-বাবা, ভাইবোন এবং নিকটাত্মীয়ের কথা, বার্তা ও আচার-আচরণ অনুসরণ করার চেষ্টা করে। সংসারে যদি মা-বাবার মধ্যে অশান্তির সৃষ্টি হয়, ঝগড়া-ফ্যাসাদ লেগে থাকে, তাহলে শিশুর মনে বিরূপ প্রভাব পড়ে। ফলে ভবিষ্যতে নেতিবাচক মানুষ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

পক্ষান্তরে মা-বাবা বা সংসারের অন্য বড়দের সৌহার্দ্যপূর্ণ সহঅবস্থান ও ভালোবাসা পূর্ণ পরিবেশে বেড়ে উঠা শিশু পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়, একজন সত্যিকার মানুষ হিসেবে গড়ে উঠে। নৈতিক শিক্ষা পারিবারিক শিক্ষার একটি বড় দিক। নৈতিক শিক্ষা শিশুর মধ্যে সৎ গুণাবলির সঞ্চার করে। আর এ সৎ গুণ তার ভবিষ্যৎ জীবনকে সুন্দর করে তোলে।

শিশুরা যা দেখে তাতেই প্রশ্ন করে। অনেক সময় বড়রা বিরক্ত হয়ে ছোটদের ধমক দিয়ে থাকে; কিন্তু এটি ঠিক নয়। এতে শিশুর শেখার বা জানার আগ্রহ নষ্ট হয়ে যায়। কারণ শিশুরা প্রশ্নই করে নতুন কিছু জানার জন্য। তাকে ধমক বা শাসন না করে বিষয়বস্তু বুঝিয়ে বলুন। তাদের সঙ্গে কোমল আচরণ করুন। পাশাপাশি এ শিষ্টাচার শেখাতে হবে, বড়দের জরুরি কোনো কথা বলার সময় যেন অহেতুক প্রশ্ন না করে বা বিরক্ত না করে।অনেকে প্রাইভেসির নামে সন্তানকে দূরে সরিয়ে রাখে, আবার অনেকে সন্তানকে ভালোবাসে বলে নিজের প্রাইভেসি নষ্ট করে। সন্তানকে শেখাতে হবে কারও রুমে ঢুকতে হলে তার অনুমতি নিয়ে ছালাম দিয়ে রুমে ঢুকতে হবে।

পরিবারের বড়দের যথাযথ সম্মান এবং ছোটদের স্নেহ-ভালোবাসা দিতে হবে। কারও মতামতকে উপেক্ষা না করে ধৈর্যসহকারে শুনতে এবং গুরুত্ব দিতে হবে। তার মতামতও যুক্তিসঙ্গত এবং ফলপ্রসূ হতে পারে।
ছোট বলে পাত্তা না দিলে একসময় তার মন বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পারে। পাশাপাশি তাকে গুরুত্ব দিলে সে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে এবং বড়দের প্রতি বিশ্বস্ত ও অনুগত থাকবে। আজকের শিশু আগামী দিনের যুবক , শিশু বয়সে শিষ্টাচারের শিক্ষা না পেলে যৌবন বয়সে তার ভিতরে এ অভ্যাস গড়ে উঠবে না। পরিবারে ছোট-বড় সবার মাঝে পারস্পরিক সালাম বিনিময়ের অভ্যাস গড়ে তুলুন। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় বাবা-মা, কারও বাবা-মা না থাকলে স্ত্রীকে বলে বের হোন। ছোটরা অবশ্যই বড় কাউকে না বলে বাইরে যাবে না। বাসায় ফেরার পর সবাইকে ছালাম দিন এবং খোঁজখবর নিন। এতে পারিবারিক বন্ধন দৃঢ হবে অন্যের প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি হবে ।
জীবন-জীবিকার তাগিদে ব্যস্ততা থাকতেই পারে। ব্যস্ততা যতই থাকুক না কেন, অন্ততপক্ষে দিনে একবার পরিবারের সঙ্গে খাওয়া প্রয়োজন।খাবার টেবিলে বয়োজ্যেষ্ঠদের খাবার উঠিয়ে দিন বা সাধাসাধি করুন। এতে মনে তিনি সুখ পাবেন। ভাববে বৃদ্ধ হলেও তারা সংসারে অপাঙক্তেয় নয়। তাদের স্বাস্থ্যের নিয়মিত খোঁজখবর নিতে হবে। এতে তারা নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাববে।পারিবারিক কোনো বিষয়ে সবাই মিলে একমতে পৌঁছাতে চেষ্টা করুন। পারিবারিক অনুষ্ঠানে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করুন। পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর বিবাহ কেন্দ্রিক যে জীবন গড়ে উঠে তা কিন্তু সাধারণত সুখ-শান্তি দিয়েই শুরু হয়।
এ সুখ-শান্তি বজায় রাখতে হলে স্বামী-স্ত্রী পরস্পর-পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে হবে। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। একজনের কাজ কর্মে অন্যজনকে যথাসম্ভব সহযোগিতা করতে হবে।স্ত্রী সংসারের কাজ করতে করতে অস্থির যাবে আর স্বামী সোফায় বসে পায়ের ওপর পা তুলে হুকুম দিয়ে যাবে এটি ঠিক নয়। গৃহস্থালি কাজে স্ত্রীকে সহযোগিতা করায় অগৌরবের কিছু নেই। এটি শুধু কাজ নয়, এটি স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। নিজের আত্মীয়স্বজন বা অন্যদের সামনে তাকে হেয় করা উচিত নয়।
পরিবারের কোনো আত্মীয়স্বজন বেড়াতে এলে অনেকে উটকো ঝামেলা মনে করেন। মেহমান এলে তাদের সাদরে গ্রহণ করুন এবং যথাসম্ভব আপ্যায়নের ব্যবস্থা করুন। হাসিমুখে কথা বলুন। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ ও সদ্ভাব বজায় রাখুন। তাদের সঙ্গে বিনয়ীভাবে কথা বলুন এবং বিপদে-আপদে সহযোগিতা করুন। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করুন। মেহমান এবং প্রতিবেশীর মাধ্যমেই কিন্তু আপনার পরিবারের ইমেজ বাইরে প্রচারিত হয়।

ব্যক্তি জীবনে বিনয়ী ও ভদ্র আচরণে অভ্যস্ত হোন। ভুল করলে ক্ষমা প্রার্থনা করুন- এতে লজ্জার কিছু নেই। প্রশংসা করুন যখন কেউ সেটা প্রাপ্য হয়। কারণ প্রশংসা পেতে সবাই ভালোবাসে। বস্তুনিষ্ঠ বিতর্ক করুন, কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়। নিজের মধ্যে শিষ্টাচারের গুণাবলি ধারণ করুন এবং তা নিজে ও নিজ পরিবারে অনুশীলন করুন। আমাদের সবার শিষ্টাচারই পরিবার এবং সমাজকে সুখময় ও শান্তিময় করে তুলবে ।
আমাদের পরিবারগুলোতে শিষ্টাচারের বর্তমান অব¯’া :- আমাদের পরিবারগুলো থেকে দিন দিন শিষ্টাচার লোপ পা”েছ। পরিবারের মধ্যে কোন নিয়ন্ত্রন নাই । স্ত্রী ,স্বামীর কথা শোনে না ,স্বামী স্ত্রীর কথা শোনে না । পুত্র বা কন্যা পিতা মাতার কথা শোনে না । কেউ কাউকে মানতে চায় না । ফলে পরিবারে সর্বদা অশানিÍ বিরাজ করে । যার ফলশ্রæতিতে পারিবারিক নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বিভীষিকাময় ও ভয়াবহ হচ্ছে। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন বয়সের নারী ও শিশু এর শিকার হচ্ছে। অনেকেই এটা নীরবে সহ্য করে যাচ্ছে। কিন্তু এর ক্ষতিকর প্রভাব আমাদের এই প্রিয় দেশ আক্রান্ত হচ্ছে। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পরিবারে, শিশু ও অন্য ছেলেমেয়েদের ওপর পড়ছে।যেসব পরিবারের সন্তানেরা এ রকম অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মধ্যে বড় হয়, তারা শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে থাকে। তাদের মধ্যে নেতিবাচক মানসিকতা গড়ে ওঠে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই সন্তানেরা তাদের মায়ের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে এবং শরীরে আঘাত করে। কারণ, তারা এটা পরিবার থেকে শিখেছে এবং এটা অবশ্যই অনাকাঙ্ক্ষিত ও সভ্যতাবিবর্জিত। ভবিষ্যতে এসব সন্তান তাদের নিজেদের পরিবারের মধ্যেও অশান্তি এবং এই প্রকার আচরণ করবে। কিন্তু যদি পরিবারের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মমত্ববোধ ও শ্রদ্ধাবোধ থাকত, তাহলে এসব পরিবারের সন্তানদের মধ্যেও ভালো আচরণ গড়ে উঠত। তারা পরিবার ও সমাজের সবার সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করত, যেটা একটা ভালো ও উন্নত রাষ্ট্রের জন্য সহায়ক হিসেবে কাজ করত।

পারিবারিক শিষ্টাচার রক্ষায় যুব সমাজের করনীয় :- পারিবারিক বন্ধন, শৃঙ্খলা সম্প্রীতি টিকিয়ে রাখার জন্য পারিবারিক শিষ্টাচারের গুরত্ব অস্বীকার করার কোন উপায় নাই । শিষ্টাচার জিনিসটি আসলে হঠাৎ করে মানুষ আয়ত্ত করতে পারে না। এর জন্য দরকার হয় দীর্ঘদিনের একটি সুস্থ পরিবেশ ও অভ্যাস। এটা যেমন কেউ মায়ের পেট থেকেও শেখে না আবার প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরেও হঠাৎ করে কেউ শিখতে পারেন না। তবে শিষ্টাচারের অভ্যাসগুলো গড়ে তোলার শুরুটা হয় পরিবার থেকে। তারপরে কিন্ডারগার্টেনে। এরই ধারাবাহিকতায় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়, পরিশেষে কর্মক্ষেত্রে। তাই যে কোন মূল্যে পারিবারিক শিষ্টাচারকে ধরে রাখতে হবে আর এ ক্ষেত্রে যুব সমাজকে সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে । যুব সমাজ তাদের সৃজনশীল মেধা ,জ্ঞান দক্ষতা ও প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে পরিবার তথা সমাজের অনেক পরিবর্তন সাধন করতে পারে । আমাদের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াশং যুব । বাংলাদেশে বর্তমানে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের আওতায় রয়েছে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৬ শতাংশ যার সিংহ ভাগ হলো যুব, যাদের বয়স ১৮-৩৫ বছর। সুতারং আমাদের প্রতিটি পরিবারে রয়েছে এক বা একাধিক যুব/যুব নারী যারা পরিবর্তনের রুপকার । প্রতিটি পরিবারে যেন সত্য কথন, পরোপকার, ক্ষমা, দয়া-দানশীলতা, ভক্তি, শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা, সম্প্রীতি ও ভালোবাসা, ক্ষমা, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, শালীনতা, বিনয়, ভদ্রতা ইত্যাদি বিশ্বজনীন গুণাবলী বিদ্যামান থাকে সে বিষয়ে পরিবারের প্রতিটি যুব সদস্যকে অগ্রীন ভূমিকা পালন করতে হবে । একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, পারিবারিক শিষ্টাচারের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় শিষ্টাচার । আর মানব সভ্যতার ধারা অব্যাহত রাখার জন্য জীবনের প্রতিটি স্তরে শিষ্টাচারের গুরত্ব অপরিসীম । যে সমাজে বা রাষ্ট্রে শিষ্টাচারের ঘাটতি রয়েছে সে সমাজ বা রাষ্ট্র ততবেশী বিশৃঙ্খল । একটা আদর্শ কল্যানমূলক রাষ্ট্রের ভিত্তি হতে পারে শিষ্টাচার ।
পরিবার,সমাজ এবং রাষ্ট্রে শান্তি শৃঙ্খলা ও ¯ি’তিশীলতা বজায় রাখার জন্য সকল স্তরে শিষ্টাচারের প্রচলন অব্যাহত রাখতে হবে । তা না হলে পরিবার,সমাজ এবং রাষ্ট্রে শান্তি শৃঙ্খলা ও ¯ি’তিশীলতা বজায় রাখা কঠিন । কারন শুধু আইন দিয়ে সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখা সম্ভব নহে । মানুষ যদি আইন মানতে না চায় , তবে তাকে জোর করে বেশিক্ষন আইন মানতে বাধ্য করা যায় না । আইন মানার জন্য তার নিজের ভিতর থেকে উপলদ্ধির সৃষ্টি হতে হবে, আর সে উপলদ্ধির সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন পারিবারিক নৈতিক শিক্ষা , প্রয়োজন পারিবারিক শিষ্টাচার ।
অতএব পারিবারিক নির্যাতনের মতো সভ্যতাবিবর্জিত কাজ থেকে সবাইকে সরে আসতে হবে। আমাদের দেশকে সুখ ও সমৃদ্ধিতে ভরিয়ে দিতে হলে অবশ্যই পরিবারের শান্তিকে প্রাধান্য দিতে হবে।

কর্মসংস্থান : যুব সমাজের প্রত্যাশা এবং বাস্তবতা ।

সুজলা সুফলা শস্য শ্যমলা আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ । দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যামে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ আমরা অর্জন করি আমাদের বহুল প্রত্যাশিত স্বাধীনাতা । অগ্নিঝরা মার্চ এর সেই দিনগুলি প্রতিটি বাঙ্গালীকে অনুপ্রানিত করে নতুন করে শপথ নিয়ে দেশকে গড়ার ,দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির অগ্রযাত্রায় নিজেকে সম্পৃক্ত করার । আজ সময় এসেছে লক্ষ শহীদের রক্ত দিয়ে অর্জিত স্বাধীনাতকে অর্থবহ রুপ দেওয়ার । সময় এসেছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সেনারবাংলা গড়ার । সেই সেনারবাংলা গড়ার জন্য প্রস্তুত আজকের যুব সমাজ ।
একটি দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে যুবসমাজের ওপর। এদের আকাঙ্খক্ষা প্রবল। প্রত্যাশা আকাশছোঁয়া। এই যুবসমাজকে এদের ইচ্ছা-আকাক্সক্ষার স্ফুরণ ঘটানোর সুযোগ জাতি হিসেবে যদি আমরা করে দিতে না পারি, তবে এটি হবে আমাদের মানবসম্পদ অপচয়ের শামিল। তাই যেকোনো জাতির জন্য একটি বড় কাজ হচ্ছে, এদের মেধা বিকাশের উপযুক্ত সুযোগ করে দেয়া। একটি সুন্দর ও গর্বিত দেশ উপহার দেয়ার জন্য দেশের মাটি যুব সমাজকেই চায় সবচেয়ে বেশি করে। তাই যুবসমাজের প্রাথমিক কাজ হচ্ছে, নিজেদের উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত-প্রশিক্ষিত করে তোলা, যাতে এরা নিজেদেরকে যথাযোগ্য ভবিষ্যৎ নাগরিক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারে। দেশের অর্থনীতিকে অব্যাহতভাবে সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর পর্যায়ে নিয়ে পৌঁছানোর জন্য নিজেদেরকে দক্ষ করে তুলতে হবে। একই সাথে তাদেরকে লিখতে, পড়তে, ভাবতে ও বিশ্লেষণ করতে জানতে হবে দেশের বিদ্যমান সমস্যগুলোকে; যাতে এরা সক্ষম হয় এসবের সমাধানসূত্র বের করতে। কারণ একটি দেশের সামগ্রিক সাফল্য নির্ভর করে এই যুবসমাজ নিজেদের কতটুকু যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারল, তার ওপর। ।
কমসংস্থান কোন পথে ———-
ছাত্র জীবন শেষে একজন যুবক চায় তার যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থান ,যার সংগে জড়িত তার রুটি রুজি সামাজিক মান মর্যদা । একজন অভিভাবক ও অপেক্ষায় থাকে তার আদরের সন্তান লেখাপড়া শেষে সে নিজের কাজের মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে , সহযোগিতা করবে পরিবারকে ,পাড়া প্রতিবেশীকে ,আতœীয় স্বজনকে সমাজকে ,দেশকে । কিন্ত বাস্তবে তা কতটুকু সম্ভব হচ্ছে ?
দেশে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্ব বেশি । চাকরি না পাওয়ার ফলে নিজেদের পরিবারের গলগ্রহ ভাবতে ভাবতে তাঁদের মনে যে হতাশা ও গ্লানি জমে ওঠে, তা দুঃসহ। হতাশা তাঁদের মা-বাবাকেও ছাড়ে না। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিত ছেলের/মেয়ের বেকারত্ব ,তাদের মা-বাবার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দেয়। উচ্চশিক্ষিত বেকারদের নিয়েও কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। দেশে এত বিশ্ববিদ্যালয়, এত অনার্স-মাস্টার ডিগ্রিধারী লোকের দরকার আছে কি না, তা কেউ ভেবে দেখে না। প্রতিবছর হাজার হাজার যুবক-যুবতী মাস্টার ডিগ্রি নিয়ে বেরিয়ে এসে কোথায় কী কাজ করবেন, সে চিন্তাও কেউ করে বলে মনে হয় না। দরিদ্র মা-বাবার কষ্টার্জিত টাকা খরচ করে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে আট বছর ধরে অর্নাস ও মাস্টার ডিগ্রি অর্জন করার পরও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের চাকরি পাওয়ার জন্য লাখ টাকা ঘুষ দিতে প্রস্তুত, তবু চাকরি মিলছে না—আমার দেশের উচ্চশিক্ষিত যুবসমাজের জন্য এহেন করুণ দুর্দশায় আমরা কেন ও কী করে পৌঁছালাম, এর জন্য কারা দায়ী এবং এই দুর্দশা থেকে আমরা কীভাবে উদ্ধার পেতে পারি, তা নিয়ে গভীর গবেষণা হওয়া জরুরি

৯ জানুয়ারি /২০১৯ ঢাকায় বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) সম্মেলনকক্ষে আয়োজিত এক সেমিনারে কিছু তথ্য-পরিসংখ্যান তুলে ধরে নবগঠিত সংস্থা সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট রিসার্চ (সিডিইআর তথা সিডার), ‘কর্মসংস্থান পর্যালোচনা ২০১৭’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে। এই প্রতিবেদনে দুটি চিত্র উঠে এসেছে, যাকে খুবই অস্বস্তিকর বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। এ দুটি হলো দেশের ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী প্রায় ২৫ শতাংশ তরুণ নিষ্ক্রিয়। তাঁরা কর্মবাজারে নেই, শিক্ষায় নেই, প্রশিক্ষণও নিচ্ছেন না। এঁদের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ। বিশ্বব্যাপী এ ধরনের তরুণদের নিট নামের একটি সূচক দিয়ে প্রকাশ করা হয়। যার মানে হলো ‘নট ইন এমপ্লয়মেন্ট, এডুকেশন অর ট্রেনিং’।
বাড়ছে শিক্ষার হার। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। প্রতিবছর যতসংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা শেষ করে শ্রমবাজারে পা রাখছেন, সেই হারে সৃষ্টি হচ্ছে না কর্মসংস্থান। সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকা এবং প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় দক্ষতা অর্জিত না হওয়ায় এসব শিক্ষিতরা উদ্যোক্তা হিসেবেও আত্মপ্রকাশ ঘটাতে পারছেন না। আবার উচ্চশিক্ষা অর্জনের পর যে কোনো কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতেও কুণ্ঠাবোধ করছেন তারা। ফলে ক্রমেই বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। রাষ্ট্র দক্ষ জনসম্পদ গড়তে শিক্ষার পেছনে কোটি কোটি টাকা খরচ করলেও এসব শিক্ষিত যুবসমাজ পরিবার ও দেশের কোনো কাজেই আসতে পারছে না। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বেকারত্বের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ কাতারে। আর গড় বেকারত্বের তুলনায় শিক্ষিত বেকারের হার এ দেশে দ্বিগুণেরও বেশি। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ছিল ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। অন্যদিকে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্ব ১০ দশমিক ৭ শতাংশ, যা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ২৮টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশে সব সময়ই বেকারত্বের হার ৫ শতাংশের নিচে দেখানো হয়ে থাকে , যা অনেক উন্নত দেশ এর তুলনায় কম । কারণ এ দেশে একজন মানুষ সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করলেই তাঁকে কর্মজীবী হিসেবে গণ্য করা হয়।
জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে (এসডিজি)বেকারত্বের হার কমিয়ে ফেলতে বলা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন এবং বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এ দেশে প্রতিবছর উচ্চশিক্ষা অর্জন করছেন ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী। সংস্থাটির সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ২০১৭ সালে শুধু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে (ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১২টি অধিভুক্ত ও অঙ্গীভূত কলেজের শিক্ষার্থী ব্যতীত) ¯স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়সহ বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ৫ লাখ ২ হাজার ১২৬ জন শিক্ষার্থী। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে বের হন ৭১ হাজার ৯০৫ জন। এ ছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ¯স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করা প্রায় সাড়ে চার লাখ ছাড়াও রয়েছেন মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা শেষ করা শিক্ষার্থী। ঝরে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা আরও বেশি। প্রতিবছর উচ্চশিক্ষা নিয়ে শ্রমবাজারে আসা এসব শিক্ষার্থীর প্রায় অর্ধেক থাকছেন বেকার। বাকিদের অধিকাংশের যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি মিলছে না। বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্টের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট রিসার্চ কর্তৃক পরিচালিত ‘কর্মসংস্থান ও শ্রমবাজার পর্যালোচনা ২০১৭’ শীর্ষক সমীক্ষা মতে, দেশে উচ্চশিক্ষিতদের (¯স্নাতক ও স্নাতকোত্তর) মধ্যে বেকারত্বের হার ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ। সেই তুলনায় কম শিক্ষিতদের বেকারত্বের হার কম। দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়াদের বেকারত্বের হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ স্কিলস ফর টুমরোস জবস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের কলেজগুলো থেকে স্নাতক সম্পন্ন করা ৭০ শতাংশ গ্র্যাজুয়েট বেকার থাকে এবং বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে প্রতিবছর ২১ লাখ কর্মক্ষম মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে প্রায় ১৩ লাখের। কাজ পাচ্ছে না প্রায় আট লাখ কর্মক্ষম মানুষ। সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান এর মতে, এখানে যত শিক্ষিত, বেকারত্ব তত বেশি। অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিতরা যে কোনো কাজ নির্দ্বিধায় করতে পারে। কিন্তু এমএ-বিএ পাস করে কেউ চায়ের দোকান দেবে না, রিকশাও চালাবে না। আবার শিক্ষিতদের জন্য যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মও সৃষ্টি হচ্ছে না। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় নিজে কিছু করার মতো দক্ষতাও তৈরি হচ্ছে না। এ কারণে শিক্ষিত বেকার বাড়ছে। সরকার কর্মসংস্থান সৃষ্টির নানা উদ্যোগ নিয়েছে। তবে চাকরি সৃষ্টি করলেই হবে না, যোগ্যতা অনুযায়ী সম্মানজনক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের মতে, দেশের শিক্ষা খাত শ্রমবাজারের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। শিল্প যে ধরনের শিক্ষা ও দক্ষতার কর্মী খুঁজছে, তা মিলছে না। ফলে বিদেশ থেকে লোক এনে কাজ করাতে হচ্ছে।

একটি জাতির সাফল্যধারা অব্যাহতভাবে ধরে রাখতে হলে দেশটির সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে- যুবসমাজকে উপযুক্ত শিক্ষা-প্রশিক্ষায় শিক্ষিত-প্রশিক্ষিত করে তোলার সহজ সুযোগ সৃষ্টি করা। তাদের সমৃদ্ধ করে তুলতে হবে হালনাগাদ আধুনিক জ্ঞানে ও প্রজ্ঞায় যথার্থ অর্থেই জ্ঞনবান ও প্রজ্ঞাবান। ভুললে চলবে না, যুবকাল হচ্ছে জীবনের বসন্তকাল। স্বপ্ন দেখা ও আবিষ্কারের কাল। তাই যুবসমাজ পারে সব বাধা ঠেলে জাতিকে উন্নতির র্স্বর্ণশিখরে পৌঁছে দিতে। এরা পারে জাতিকে নেতৃত্ব দিয়ে সঠিক গন্তব্যে নিয়ে পৌঁছাতে। কারণ, এরা সমাজের লড়াকু শ্রেণী। এরাই পারে লড়াই করে সমাজের যাবতীয় অসঙ্গতি, দারিদ্র্য, বৈষম্য ও শোষণ দূর করে জাতিসত্তার বিকাশ ঘটাতে। কিন্তু এসবের জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত একটি পরিবেশ। নইলে এরা ভালো নৈতিকতা ও মূল্যবোধ নিয়ে গড়ে উঠতে পারবে না। ফলে এরা কখনোই কোনো দ্বন্দ্ব-সমস্যা মোকাবেলায় ইতিবাচক সাড়া দিতে সক্ষম হবে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি পারছি আমাদের যুবসমাজের সামনে সেসব সুযোগ হাজির করতে ? পারছি কি তাদের নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধসম্পন্ন একটি সুষ্ঠু পরিবেশের মধ্যে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দিতে ? বিবেকবান হলে বলতেই হবে, এর জবাব নেতিবাচক। তথ্য-পরিসংখ্যান তো তেমনটিই সমর্থন করে।

বাংলাদেশে বর্তমানে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের আওতায় রয়েছে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৬ শতাংশ যার সিংহ ভাগ হলো যুবক—যাদের বয়স ১৮-৩৫ বছর। তাদের মধ্যে উচ্চ শিক্ষিতের সংখ্যা (বিবিএ, এম.বি.এডিগ্রিধারী) অনেক—যারা কর্মসংস্থানের অপেক্ষায় দিন গুনছে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকারি কিংবা বেসরকারি খাতে চাকুরির বাজার খুবই প্রতিযোগিতাপূর্ণ, আবার সুযোগ সংকীর্ণ। ফলে আতœ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রটি খোলা আছে তাদের জন্য যারা উদ্যোগকে পেশা হিসাবে বেছে নিতে চায়। কিন্তু পরিবেশ সহায়ক কি? যদি না থাকে তবে তৈরি করতে হবে। এর জন্য সরকারের নির্দেশনায় সরকারি/বেসরকারি অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান গুলো সহজ শর্তে তহবিল জোগানোর ব্যবস্থা করবে।কমাতে হবে প্রশাসনিক জটিলতা। পাশাপাশি বাড়াতে হবে উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ—আর এ প্রশিক্ষণ প্রদানের বড় কাজটি করেছ সরকারী প্রতিষ্ঠান যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর । পাশাপাশি টি,টি,সি , জনশক্তি ও কর্মসংস্থান ব্যুরো , টি,এস,সি , সমাজসেবা অধিদপ্তর, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর ।

সম্ভবনার নতুন দিগন্ত
নতুন সহস্রাব্দে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে প্রধান শ্রমশক্তি বলে মনে করা হ”েছ ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীকে। বর্তমান সরকার তার নির্বাচনী ইশতিহারে আগামী ৫ বছরে ১কোটি ৫০ লক্ষ বেকার যুবকের কর্মসং¯’ান লক্ষ্য নির্ধারন করেছেন ।
আই,টি খাত – কর্মসং¯’ানের বড় খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে আই,টি খাত দেশে সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবা খাতে রপ্তানি ২০১৮ সালে ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বেসিস সূত্রে জানা গেছে, দেশের অভ্যন্তরীণ সফটওয়্যারের বাজারও বড় হ”েছ। দেশের বাজার দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশই আবার দেশি সফটওয়্যার নির্মাতারা দখল করেছেন। দেশের ৬০টি ব্যাংকের মধ্যে ২৭টি ব্যাংকেই দেশি সফটওয়্যার ব্যবহৃত হ”েছ। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারের টার্গেট বা লক্ষ্য ছিল, ২০১৮ সালের মধ্যে এক বিলিয়ন রপ্তানি আয় করা। এ ছাড়া ২০২১ সালের মধ্যে ৫ বিলিয়ন ডলারের সফটওয়্যার ও সেবাপণ্য রপ্তানি করা। সফটওয়্যার রপ্তানিতে ক্যাশ ইনসেনটিভ দেওয়াসহ, এখাতের উন্নয়নের নেওয়া নানা পদক্ষেপের কারণে ২০১৮ সালে সফটওয়্যার রপ্তানি বেড়েছে।
আমাদের সফটওয়্যার ১৮০টি দেশে রপ্তানি হয়। আমাদের সফটওয়্যার আয়ারল্যান্ডের পুলিশ ব্যবহার করে, সিকিউরিটি জন্য আমাদের সফটওয়্যার আছে, মোবাইল অপারেটররা ব্যবহার করছে। এটার গতি অতীতের সঙ্গে তুলনা করলে সম্ভাবনা এখন অনেক বেশি।’দিন দিন প্রতিটি প্রতিষ্ঠান প্রযুক্তিনির্ভর হ”েছ, এ কারণে ২০৩০ সালে আইটি সেক্টরে ২০ লাখ দক্ষ জনবল প্রয়োজন হবে। দেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে। আর উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে প্রয়োজন দক্ষ মানবসম্পদ। একটি প্রতিষ্ঠান সফলভাবে পরিচালিত হবে তখনই, যখন পরিচালনার ভার থাকবে দক্ষ কর্মীর হাতে। প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের দক্ষতা, প্রেষণা, প্রতিষ্ঠানকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় ।
আউটসোসিং/ফ্রিল্যানন্সিং – – বাংলাদেশে সম্ভাবনাময় খাত গুলোর অন্যতম ফ্রি ল্যানন্সিং । ঘরে রসে আয় করার সহজ রাস্তা ,ইতোমধ্যে অনেক বেকার যুবক এই সেক্টরকে তাদের ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে ।ফ্রিল্যান্সারদের নিয়ে কাজের একটি বিশাল বাজার তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ খাতের উদ্যোক্তারা ফ্রিল্যান্সারদের নিয়ে কাজ করতে শুরু করেছেন। এ খাত থেকেও অর্থ আয়ের নতুন নতুন উপায় নিয়ে কাজ করছেন তাঁরা।
এন্টারপ্রেনার ডটকমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমান দুনিয়ায় ফ্রিল্যান্সিংকেও পুরোপুরি পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন অনেকেই। এখানে প্রকল্প ভিত্তিতে একের পর এক কাজের সুযোগ থাকে। যেকোনো জায়গায় বসে বিশ্বের যেকোনো কাজ করা যায়। এ ক্ষেত্রে ফ্রিল্যান্সারের কাজের ওপর ছড়ি ঘোরানোর কেউ থাকে না বলে প্রতি বছর এখাতে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক, অর্থাৎ এপ্রিল থেকে জুন মাসে ফ্রিল্যান্সিংয়ের বৈশ্বিক ধারা (ট্রেন্ড) প্রকাশ করেছে ফ্রিল্যান্সারদের অর্থ লেনদেনের জনপ্রিয় অনলাইন মাধ্যম পেওনিয়ার। প্রতিষ্ঠানটি প্রথমবারের মতো বৈশ্বিক গিগ অর্থনীতির সূচক প্রকাশ করেছে, যেখানে বাংলাদেশের স্থান অষ্টম। গত বছরের তুলনায় এ বছর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ২৭ শতাংশ। সে কারণে বাংলাদেশ অষ্টম স্থানে রয়েছে।২৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হওয়ায় বাংলাদেশের ঠিক ওপরে আছে ভারত। বাংলাদেশের পর ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে রাশিয়া ও ১৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে অবস্থান করছে সার্বিয়া।। এ ক্ষেত্রে অনেকেই সফল হয়েছেন। যেহেতু এ খাতটি বড় হচ্ছে তাই এখাতে উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে ।

পর্যাটন খাত – পর্যটন খাতের তর“ণদের কর্মসং¯’ান দেশে গুর“ত্বপূর্ণ বিষয়। কর্মসং¯’ান বাড়াতে পর্যটন খাতের বিকাশ অত্যন্ত জর“রি। একজন পর্যটকের আগমনে বিভিম্নভাবে ১১ জনের কর্মসং¯’ানের সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া পর্যটক আগমন মানেই দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচিত হওয়া। এতে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার ক্ষেত্র বাড়ে। অজানাকে জানার এবং অদেখাকে দেখার প্রবৃত্তি মানুষের চিরন্তন- এই ধারণা থেকেই পর্যটনের উদ্ভব। তাই পর্যটন শিল্প এগিয়ে যাবেই। আমাদের লক্ষ্য হ”েছ, পর্যটকদের সামনে বাংলাদেশকে তুলে ধরা। পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালের জাতীয় আয়ের ৬২ ভাগ আসে পর্যটন খাত থেকে। মালদ্বীপের জাতীয় আয়ের সিংহভাগ আসে ট্যুরিজম খাত থেকে। এশিয়ানভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া পর্যটন শিল্পে অনেক এগিয়ে গেছে। আমাদের এ রকম সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ।বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন, নয়নাভিরাম সবুজ পাহাড়, কুমিল্লার ময়নামতিসহ হাজারো প্রাচীন ঐতিহ্যে উজ্জ্বল দেশ বাংলাদেশ । পর্যটন খাতের তর“ণদের কর্মসং¯’ান সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে ।
ওষুধ শিল্পখাত – ওষুধ শিল্পে বাংলাদেশ নবদিগন্ত উন্মোচন করেছে। বাংলাদেশ আর ওষুধ আমদানিকারক দেশ নয়, রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের অনেক ওষুধ কোম্পানি উন্নত দেশগুলোর বিখ্যাত সনদ লাভ করেছে। বর্তমানে বিশ্বের ১৬০ দেশে যা”েছ বাংলাদেশের ওষুধ। এই খাতের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। সংশিষ্টরা বলছেন, বিগত চার দশকে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। এই মুহূর্তে বিশ্বের অনুন্নত ৪৮ দেশের মধ্যে ওষুধ উৎপাদনে শীর্ষে বাংলাদেশ। ২৫৭ কোম্পানির ২৪ হাজার ব্র্যান্ডের ওষুধ রয়েছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বছরে ২৫ হাজার কোটি টাকার ওষুধ বিদেশে যা”েছ। বাংলাদেশে একসময় বার্ষিক ৮০ শতাংশ ওষুধ বাইরের দেশ থেকে আমদানি করতে হতো, সেখানে এখন আমদানি হয় মাত্র ৩ শতাংশ। একসময় বিদেশি কোম্পানিগুলো এ দেশের ওষুধের বাজারের ৭৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করত। সেখানে এখন তারা নিয়ন্ত্রণ করে মাত্র ৭ শতাংশ। অদূর ভবিষ্যতে এ হার আরো কমে আসবে বলে মনে করেন আমাদের দেশের সচেতন মহল। ধারাবাহিকভাবে প্রতিবছর ওষুধ রফতানি

বাড়ছে। আমরা আশা করছি, এই ধারা অব্যাহত থাকবে। একই সঙ্গে এ খাত বিকাশে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়ারও পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। ওষুধ শিল্পে তর“ণদের কর্মসং¯’ান সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে ।
আধুনিক ধারার মৎস চাষ :- মাছ চাষের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পুকুর,খাল বিল, জলাশয় , ডোবা নালা যা ছাড়া মাছ চাষ কল্পনা করা যায় না । প্রযুক্তির অগ্রগতির সংগে সংগে এখন পদ্ধতির ও পরিবর্তন হয়েছে । মাছ চাষের জন্য এখন আর পুকুর,খাল বিল, জলাশয় , ডোবা নালার প্রয়োজন হয় না । আধুনিক পদ্ধতিতে ঘরের ভিতর (রাস) এবং বায়োফ্লকে পদ্ধতিতে মাছের চায় করা হ”েছ । জঅঝ (রাস) মূলত ঘরের ভিতরে ট্যাংকের মধ্যে অধিক ঘনত্বে এবং একটি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে মাছ উৎপাদন প্রক্রিয়া। যেখানে মাছ চাষের জন্য উপযুক্ত জলাশয় বা পানি নেই, সেখানেও এই পদ্ধতি ব্যাবহার করা যায়। এই পদ্ধতিতে মাছ চাষ খুবই লভজনক কিন্তু এর প্রধান সমস্যা হল অধিক বিনিয়োগ । এই পদ্ধতিতে দেশী শিং, দেশী-বিদেশী মাগুর, পাবদা, টেংরা বা গুলশা, টেলাপিয়া, পাংগাস, চিংড়ি, ভেটকি ইত্যাদি নানা প্রজাতির মাছ চাষ করা যায়। এই পদ্ধতিতে বিশুদ্ধ পানিতে সাস্থ সম্মত মাছ চাষ করা হয়। এই পদ্ধতিতে পুকুরের পরিবর্তে একাধিক বিভিন্ন আকৃতির ট্যাংক ব্যাবহার করে মাছ চাষ করা হয়। এই পদ্ধতিতে একই পানি পুনরায় ব্যাবহারের জন্য বিভিন্ন রকম ফিল্টার ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
এই পদ্ধতি যেখানে খাল বিল বা উন্মুক্ত জলাশয় নাই বিশেষ করে শহরের বেকার যুবকরা এই পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে অধিক লাভবান হতে পারে ।এখানে বিনিয়োগ একটু বেশী হলে ও ঝুকি কম ।
বর্তমানে দেশের এ বিপুল বেকার যবদের সরকারী ভাবে চাকুরী প্রদান করা সম্ভব নহে কারন সরকারের বর্তমান পদের কয়েক গুন বেকার জনসংখ্যা রয়েছে । তাই বেসরকারী এবং ব্যক্তিখাতকে এগিয়ে আসতে হবে । আমরা যদি প্রতিটি বেকার যুবকের কর্মসং¯’ানের ব্যব¯’া করতে পারি তবে অচিরেই বাংলাদেশ মালেশিয়া বা সিংগাপুরের কাতারে সামিল হবে । তবেই না বাসÍবায়ন হবে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন।

সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় : আমাদের যুব সমাজ।

সুজলা সুফলা শস্য শ্যমলা আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ । দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যামে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ আমরা অর্জন করি আমাদের বহুল প্রত্যাশিত স্বাধীনাতা । অগ্নিঝরা মার্চ এর সেই দিনগুলি প্রতিটি বাঙ্গালীকে অনুপ্রানিত করে নতুন করে শপথ নিয়ে দেশকে গড়ার ,দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির অগ্রযাত্রায় নিজেকে সম্পৃক্ত করার । আজ সময় এসেছে লক্ষ শহীদের রক্ত দিয়ে অর্জিত স্বাধীনাতকে অর্থবহ রুপ দেওয়ার । সময় এসেছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সেনারবাংলা গড়ার । সেই সেনারবাংলা গড়ার জন্য প্রস্তুত আজকের যুব সমাজ ।
একটি দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে যুবসমাজের ওপর। এদের আকাঙ্খক্ষা প্রবল। প্রত্যাশা আকাশছোঁয়া। এই যুবসমাজকে এদের ইচ্ছা-আকাক্সক্ষার স্ফুরণ ঘটানোর সুযোগ জাতি হিসেবে যদি আমরা করে দিতে না পারি, তবে এটি হবে আমাদের মানবসম্পদ অপচয়ের শামিল। তাই যেকোনো জাতির জন্য একটি বড় কাজ হচ্ছে, এদের মেধা বিকাশের উপযুক্ত সুযোগ করে দেয়া। একটি সুন্দর ও গর্বিত দেশ উপহার দেয়ার জন্য দেশের মাটি যুব সমাজকেই চায় সবচেয়ে বেশি করে। তাই যুবসমাজের প্রাথমিক কাজ হচ্ছে, নিজেদের উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত-প্রশিক্ষিত করে তোলা, যাতে এরা নিজেদেরকে যথাযোগ্য ভবিষ্যৎ নাগরিক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারে। দেশের অর্থনীতিকে অব্যাহতভাবে সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর পর্যায়ে নিয়ে পৌঁছানোর জন্য নিজেদেরকে দক্ষ করে তুলতে হবে। আর এ দক্ষ জন শক্তি গড়ে তোলার ল্ক্ষ্যে বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতিহারে ঘোষনা ছিল এরুপ “ তারুন্যের শক্তি বাংলাদেশের সমৃদ্ধি ” তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে এবং স্বাবলম্বী তরুণ সমাজ গঠন করতে ২০২১ সালের মধ্যে ‘তরুণ উদ্যোক্তা নীতি’, একটি দক্ষ ও কর্মঠ যুবসমাজ তৈরি করতে ২০২৩ সালের মধ্যে ‘কর্মঠ প্রকল্প’ এবং প্রতি উপজেলায় যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে স্বল্প ও অদক্ষ তরুণদের দক্ষতা বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা নিবে আওয়ামী লীগ। কারণ একটি দেশের সামগ্রিক সাফল্য নির্ভর করে এই যুবসমাজ নিজেদের কতটুকু যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারল, তার ওপর। ।
আন্দোলন সংগ্রামে অধিকার আদায়ে আমাদের যুব সমাজ – ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ৫২ এর মাতৃভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ সব স্বপ্নের সূচনা তরুণদের চোখে-মুখেই ধরা দিয়েছে আলোর ঝলকানি হয়ে। মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, সৈয়দ নিসার আলী ওরফে তিতুমীর, জ্বলে উঠেছিল এই তারুণ্যের শক্তি নিয়েই; যাদের বঞ্চিত বুকে ফেনিয়ে উঠেছিল উপনিবেশের বেঁধে দেওয়া পুঞ্জীভূত অভিমান। ৬৯ এর গন অভ্যুত্থান ,৬ দফার আন্দোলন সর্বশেষ ৯ মাসের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অজিত আমাদের স্বাধীনাতা ।

বর্তমান সরকারের গৃহীত বাস্তবমুখী পদক্ষেপ সমূহ-

শিক্ষা, দক্ষতা ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি- স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষাকে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যুগোপযোগী করতে কারিগরি শিক্ষা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে অধিকতর বিনিয়োগ করা হবে ।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার জন্য আর্থিক ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অগ্রাধিকার পাবে।
প্রতিটি উপজেলায় ‘যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ স্থাপন করা হবে। বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ দেয়ার পাশাপাশি এই কেন্দ্রগুলোকে পর্যায়ক্রমে ‘তরুণ কর্মসংস্থান কেন্দ্র’ হিসেবে গড়ে তোলা হবে।
দক্ষতা বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য দুটি নতুন প্রকল্প হাতে নেয়া হবে। ‘কর্মঠ প্রকল্প’-এর অধীনে “স্বল্প শিক্ষিত/স্বল্প দক্ষ/অদক্ষ” শ্রেণীর তরুণদের শ্রমঘন, কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের উপোযোগী জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা হবে। ‘সুদক্ষ প্রকল্প’-এর অধীনে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা ও যোগানের মধ্যে যে ভারসাম্যহীনতা রয়েছে তা দূর করতে নানামুখি কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে।
জাতীয় পর্যায়ে স্বল্প, মধ্যম ও উচ্চ শিক্ষিত তরুণদের তথ্য সম্বলিত একটি ইন্টিগ্রেটেড ডাটাবেইজ তৈরি করা হবে। এর মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রয়োজন ও তরুণদের যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরির জন্য আবেদন করার আহ্বান জানাতে পারবে।
বেকারত্বের হার ২০২৩ সালে ১২ শতাংশে নামিয়ে আনা এবং কর্মসংস্থানে কৃষি, শিল্প ও সেবার অংশ যথাক্রমে ৩০, ২৫ ও ৪৫ শতাংশে পরিবর্তন করা হবে। ২০২৩ সাল নাগাদ অতিরিক্ত ১ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। এছাড়া উক্ত সময়ে নতুনভাবে ১ কোটি ১০ লক্ষ ৯০ হাজার মানুষ শ্রমশক্তিতে যুক্ত হবে।
তরুণ যুবসমাজকে দক্ষ জনশক্তিতে রুপান্তর ও কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা’ আওয়ামী লীগের দেয়া এই অঙ্গীকারে দেশের তরুণ সমাজে নতুন উদ্দীপনা জেগেছে।বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকারি কিংবা বেসরকারি খাতে চাকুরির বাজার খুবই প্রতিযোগিতাপূর্ণ, আবার সুযোগ সংকীর্ণ। ফলে আতœ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রটি খোলা আছে তাদের জন্য যারা উদ্যোগকে পেশা হিসাবে বেছে নিতে চায়। তাদের জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণ আর এ প্রশিক্ষণ প্রদানের বড় কাজটি করেছ সরকারী প্রতিষ্ঠান যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর । পাশাপাশি টি,টি,সি , জনশক্তি ও কর্মসংস্থান ব্যুরো , সমাজসেবা অধিদপ্তর, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরসহ সরকারের একাধিক মন্ত্রনালয় ও অধিদপ্তর ।
আত্মকর্মসংস্থান ও তরুণ উদ্যোক্তা তৈরি

তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবণতা ও আত্মকর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে কর্মসংস্থান ব্যাংক এর মাধ্যমে বিনা জামানতে ও সহজ শর্তে জনপ্রতি দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ সুবিধা ইতোমধ্যে প্রদান করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে এই সুবিধা আরও বিস্তৃত করা হবে।
তরুণ উদ্যোক্তাদের মধ্যে যারা সম্ভাবনার ছাপ রাখতে সক্ষম হবে তাদের জন্য আর্থিক, প্রযুক্তি, উদ্ভাবনসহ অন্যান্য সরকারি সুযোগ সুবিধা আরও বৃদ্ধি করা হবে।
তরুণ উদ্যোক্তা তৈরি করার জন্য প্রণয়ন করা হবে একটি যুগোপযোগী ‘তরুণ উদ্যোক্তা নীতি’।

ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচি – বেকারত্বের করাল গ্রাসে পতিত যুবসমাজকে বের করে নিয়ে আসতে ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ‘ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচি’ বাস্তবায়নের যে কাজ অগ্রগায়ণ করা হচ্ছে তার সাতটি পর্ব থেকে ইতিমধ্যে ৩৭ জেলার ১২৮টি উপজেলায় ১ লাখ ৯৩ হাজার ৯৮৫ জন যুবককে প্রশিক্ষিত করে তোলা হয়েছে; যার ১ লাখ ৯১ হাজার ৬৫০ জন বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থায় নিযুক্ত হয়েছেন আর অস্থায়ী কর্ম শেষে তাদের ৮৩ হাজার ১৪ জন আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত হয়েছেন।
সম্ভবনার নতুন দিগন্ত
বেকারমুক্ত শিল্পনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সারা দেশে ১০০টি ইকোনমিক জোন গড়ে তোলা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ৯০টির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২৮টি জোনের ভূমি, কলকারখানা, রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলছে পুরোদমে। ১২টি ইকোনমিক জোনে দেশি-বিদেশি অন্তত ২১টি প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে উৎপাদনে রয়েছে। সেসব কারখানা থেকে উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। আগামী ১৫ বছরের মধ্যে এসব জোনে অন্তত ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের পরিকল্পনা করা হয়েছে। যার মাধ্যমে দেশ পুরোপুরি বেকারমুক্ত হবে বলে মনে করে বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটি (বেজা)। জোনগুলোয় গড়ে ওঠা শিল্প বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের মাধ্যমে ২০৪১ সালের আগেই সারা দেশে শিল্পবিপ্লব ঘটবে বলে মনে করে বেজা। এসব জোনের মাধ্যমে ইতিমধ্যে ৩০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। বেজার ধারণা, শুধু মিরসরাইয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরেই অন্তত ৭ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে।
নতুন সহস্রাব্দে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে প্রধান শ্রমশক্তি বলে মনে করা হচ্ছে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীকে। বর্তমান সরকার তার নির্বাচনী ইশতিহারে আগামী ৫ বছরে ১কোটি ৫০ লক্ষ বেকার যুবকের কর্মসংস্থান লক্ষ্য নির্ধারন করেছেন ।

আই,টি খাত – – কর্মসংস্থানের বড় খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে আই,টি খাত দেশে সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবা খাতে রপ্তানি ২০১৮ সালে ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বেসিস সূত্রে জানা গেছে, দেশের অভ্যন্তরীণ সফটওয়্যারের বাজারও বড় হ”েছ। দেশের বাজার দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশই আবার দেশি সফটওয়্যার নির্মাতারা দখল করেছেন। দেশের ৬০টি ব্যাংকের মধ্যে ২৭টি ব্যাংকেই দেশি সফটওয়্যার ব্যবহৃত হ”েছ।
আমাদের সফটওয়্যার ১৮০টি দেশে রপ্তানি হয়। আমাদের সফটওয়্যার আয়ারল্যান্ডের পুলিশ ব্যবহার করে, সিকিউরিটি জন্য আমাদের সফটওয়্যার আছে, মোবাইল অপারেটররা ব্যবহার করছে। এটার গতি অতীতের সঙ্গে তুলনা করলে সম্ভাবনা এখন অনেক বেশি।’দিন দিন প্রতিটি প্রতিষ্ঠান প্রযুক্তিনির্ভর হ”েছ, এ কারণে ২০৩০ সালে আইটি সেক্টরে ২০ লাখ দক্ষ জনবল প্রয়োজন হবে। ইতোমধ্যে আমাদের যুবরা আইটি খাতে অনেক সফলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে । একেবারে সংক্ষেপে যাদের কথা না বললে তারা হচ্ছে টেন মিনিট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আয়মান সাদিক ,জনপ্রিয় ওয়েব সাইট সহ প্রতিষ্ঠাতা জাভেদ করিম ,খান একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা ইমরান খান সহ অনেকে ।

আউটসোসিং/ফ্রিল্যানন্সিং – – বাংলাদেশে সম্ভাবনাময় খাত গুলোর অন্যতম ফ্রি ল্যানন্সিং । ঘরে রসে আয় করার সহজ রাস্তা ,ইতোমধ্যে অনেক বেকার যুবক এই সেক্টরকে তাদের ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে ।ফ্রিল্যান্সারদের নিয়ে কাজের একটি বিশাল বাজার তৈরি হয়েছে। এন্টারপ্রেনার ডটকমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমান দুনিয়ায় ফ্রিল্যান্সিংকেও পুরোপুরি পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন অনেকেই। প্রতিষ্ঠানটি প্রথমবারের মতো বৈশ্বিক গিগ অর্থনীতির সূচক প্রকাশ করেছে, যেখানে বাংলাদেশের স্থান অষ্টম। গত বছরের তুলনায় এ বছর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ২৭ শতাংশ। সে কারণে বাংলাদেশ অষ্টম স্থানে রয়েছে।২৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হওয়ায় বাংলাদেশের ঠিক ওপরে আছে ভারত। বাংলাদেশের পর ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে রাশিয়া ও ১৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে অবস্থান করছে সার্বিয়া।। এ ক্ষেত্রে অনেকেই সফল হয়েছেন। যেহেতু এ খাতটি বড় হচ্ছে তাই এখাতে উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে ।
পর্যাটন খাত – পর্যটন খাতের তর“ণদের কর্মসং¯’ান দেশে গুর“ত্বপূর্ণ বিষয়। কর্মসং¯’ান বাড়াতে পর্যটন খাতের বিকাশ অত্যন্ত জরুরি। একজন পর্যটকের আগমনে বিভিম্নভাবে ১১ জনের কর্মসং¯’ানের সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া পর্যটক আগমন মানেই দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচিত হওয়া। এ জন্য প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ।বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন, নয়নাভিরাম সবুজ পাহাড়, কুমিল্লার ময়নামতিসহ হাজারো প্রাচীন ঐতিহ্যে উজ্জ্বল দেশ বাংলাদেশ । পর্যটন খাতের তর“ণদের কর্মসং¯’ান সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে ।
ওষুধ শিল্পখাত — ওষুধ শিল্পে বাংলাদেশ নবদিগন্ত উন্মোচন করেছে। বাংলাদেশ আর ওষুধ আমদানিকারক দেশ নয়, রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের অনেক ওষুধ কোম্পানি উন্নত দেশগুলোর বিখ্যাত সনদ লাভ করেছে। বর্তমানে বিশ্বের ১৬০ দেশে যা”েছ বাংলাদেশের ওষুধ। এই খাতের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। সংশিষ্টরা বলছেন, বিগত চার দশকে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। এই মুহূর্তে বিশ্বের অনুন্নত ৪৮ দেশের মধ্যে ওষুধ উৎপাদনে শীর্ষে | বাংলাদেশে একসময় বার্ষিক ৮০ শতাংশ ওষুধ বাইরের দেশ থেকে আমদানি করতে হতো, সেখানে এখন আমদানি হয় মাত্র ৩ শতাংশ। ওষুধ শিল্পে তর“ণদের কর্মসং¯’ান সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে ।
আধুনিক ধারার মৎস চাষ :- মাছ চাষের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পুকুর,খাল বিল, জলাশয় , ডোবা নালা যা ছাড়া মাছ চাষ কল্পনা করা যায় না । প্রযুক্তির অগ্রগতির সংগে সংগে এখন পদ্ধতির ও পরিবর্তন হয়েছে । মাছ চাষের জন্য এখন আর পুকুর,খাল বিল, জলাশয় , ডোবা নালার প্রয়োজন হয় না । আধুনিক পদ্ধতিতে ঘরের ভিতর (রাস) এবং বায়োফ্লকে পদ্ধতিতে মাছের চায় করা হ”েছ । জঅঝ (রাস) মূলত ঘরের ভিতরে ট্যাংকের মধ্যে অধিক ঘনত্বে এবং একটি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে মাছ উৎপাদন প্রক্রিয়া। যেখানে মাছ চাষের জন্য উপযুক্ত জলাশয় বা পানি নেই, সেখানেও এই পদ্ধতি ব্যাবহার করা যায়। এই পদ্ধতিতে মাছ চাষ খুবই লভজনক কিন্তু এর প্রধান সমস্যা হল অধিক বিনিয়োগ । এই পদ্ধতিতে দেশী শিং, দেশী-বিদেশী মাগুর, পাবদা, টেংরা বা গুলশা, ‡Zলাপিয়া, পাংগাস, চিংড়ি, ভেটকি ইত্যাদি নানা প্রজাতির মাছ চাষ করা যায়। এই পদ্ধতিতে বিশুদ্ধ পানিতে সাস্থ সম্মত মাছ চাষ করা হয়। এই পদ্ধতি যেখানে খাল বিল বা উন্মুক্ত জলাশয় নাই বিশেষ করে শহরের বেকার যুবকরা এই পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে অধিক লাভবান হতে পারে ।
বর্তমানে দেশের এ বিপুল বেকার যুবদের সরকারী ভাবে চাকুরী প্রদান করা সম্ভব নহে কারন সরকারের বর্তমান পদের কয়েক গুন বেকার জনসংখ্যা রয়েছে । তাই বেসরকারী এবং ব্যক্তিখাতকে এগিয়ে আসতে হবে । আমরা যদি প্রতিটি বেকার যুবকের কর্মসংস্থানের ব্যব¯’v করতে পারি তবে অচিরেই বাংলাদেশ মালেশিয়া বা সিংগাপুরের কাতারে সামিল হবে । তবেই না বাসÍবায়ন হবে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন।
তথ্য সূত্র- সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার-২০১৮,জাতীয় দৈনিক পত্রিকা ,বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশনা সমূহ ।

অভিন্ন নদীর সমস্যা সমাধানে

সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামনিয়াম জয়শঙ্কর বাংলাদেশ সফর করেছেন। তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনার সময় বলেছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে উভয়পক্ষ লাভবান হবে এমন একটি ফর্মুলা বের করতে ভারত সম্মত রয়েছে। তিনি আরও জানিয়েছেন, তার দেশ অভিন্ন নদীর সমস্যা সমাধানে বদ্ধপরিকর। ভারত থেকে আমাদের দেশে ৫৩টি নদী প্রবেশ করেছে। দেশের সাধারণ মানুষ জানে- আন্তর্জাতিক নীতি অনুযায়ী তো নয়ই, বরং একটা নদীর জীবন রক্ষার নূ্যনতম পানিও উজানের দেশ থেকে পাওয়া যায় না। জানামতে, গঙ্গা নদীর পানি নিয়ে দু’দেশের মধ্যে একটা চুক্তি হলেও তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে আর তিস্তা নদীর পানি চুক্তি নিয়ে টালবাহানা চলমান। এমতাবস্থায় ভারত অভিন্ন নদীর সমস্যা সমাধানে বদ্ধপরিকর হলে দায়টা বাংলাদেশের ওপর পড়ে। জনগণ জানে না আমাদের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় বা জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের দেশের আন্তর্জাতিক নদীগুলোর জন্য কী কী পরিকল্পনা বিদ্যমান? আন্তর্জাতিক নীতি অনুযায়ী নূ্যনতম কত পানি নদীর জীবন রক্ষার জন্য, পরিবেশ রক্ষার জন্য, নৌপথ ব্যবহারের জন্য, কৃষিকাজে সেচের জন্য, জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য, নিজেদের ব্যবহারের জন্য আমরা পেতে পারি? নদীতে পানির প্রাপ্যতার সঙ্গে প্রয়োজনের সমন্বয়ই সমস্যার সমাধান।

ভারত উজানের দেশ হওয়ায় একতরফাভাবে নদীর পানি প্রত্যাহার করেই চলেছে। তারা অভিন্ন নদীর সমস্যা সমাধানে বদ্ধপরিকর হওয়ার পরও একতরফা পানি প্রত্যাহার থেকে কোনো সময় সরে আসেনি। ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে গঙ্গা নদীর পানি প্রত্যাহারের ফল নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন হচ্ছে না। গজলডোবায় বাঁধ দিয়ে তিস্তার পানি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। এখন তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে টালবাহানা করতে আলোচনার প্রয়োজন পড়ছে না। টিপাইমুখ বাঁধ দিয়ে মেঘনা-সুরমা নদীর পানি প্রত্যাহারের যে ব্যবস্থা করা হয়েছে, তা নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন নেই। অ্যাকুইডাক্ট বা কৃত্রিম পানি প্রণালি তৈরি করে মহানন্দার সম্পূর্ণ পানি প্রত্যাহার করে নিতে আলোচনার প্রয়োজন নেই। কোনো আলোচনার প্রয়োজন নেই ভারতজুড়ে নদীর আন্তঃসংযোগ নিয়ে। তবে আলোচনার প্রয়োজন ব্রহ্মপুত্র নদের উৎসমুখে চীনের বিশাল জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ নিয়ে। এ ক্ষেত্রে আমাদের মাথাব্যথা না থাকলেও আমরা জানি চীনা উদ্যোগ বিষয়ে আলোচনা না করার অর্থ সাপের লেজে পা দেওয়া।

অভিন্ন নদী নিয়ে আলোচনার জন্য প্রস্তুতি প্রয়োজন। কারণ আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। অভিন্ন নদী গঙ্গায় ফারাক্কা নির্মাণকালে ভারত-পাকিস্তান যে আলোচনা হয়, সেখানে পানির চাহিদা নিয়ে এক প্রকার ছেলেখেলা করা হয়। ১৯৫৪ সালে তৎকালীন পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প সম্পর্কে ভারত সরকারকে অবহিত করে এবং দুই হাজার কিউসেক পানির চাহিদার কথা জানায়। দুই দেশের মধ্যে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের প্রথম বৈঠক বসে নয়াদিল্লিতে ১৯৬০ সালের জুন মাসে। ততদিনে ওয়াপদা চালু হয়ে গিয়েছে। পানি মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি পানি বিদ্যুৎ অথরিটি কাজ করছে। সেই বৈঠকে তখনকার পানি চাহিদা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় সাড়ে তিন হাজার কিউসেকে। বিশেষজ্ঞরা এভাবেই ধারাবাহিকভাবে পানির চাহিদা বাড়িয়ে যান। ১৯৬৮ সালের মে মাসে নয়াদিল্লির সচিব পর্যায়ের বৈঠকে এপ্রিল মাসের জন্য চাহিদা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৪৯ হাজার কিউসেক। আমাদের বর্তমান প্রস্তুতিও এমন পর্যায়ে আছে কি-না ভেবে দেখা জরুরি।

ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের পাশাপাশি আমাদের ‘আশু সমস্যার আশু সমাধান’-এর নীতি নদীর জীবনকে হুমকির মুখে ফেলেছে। প্রধানমন্ত্রী কয়েকদিন আগে একনেক সভায় বলেছেন, এখন থেকে নদীতে আর স্লুইসগেট নির্মাণ করা যাবে না। প্রধানমন্ত্রীকে সাধুবাদ জানাই। নদীমাতৃক এই দেশটার প্রাণ নদীগুলোতে স্লুইসগেট নির্মাণ করে নদীর জীবন সংকটাপন্ন করে তোলা হয়েছে, তা অনুধাবন করে এমন নির্দেশ প্রদান করার জন্য। প্রয়োজনের তুলনায় অনেক ছোট স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয়েছে এবং সেই ছোট স্লুইসগেটগুলোরও যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়নি। প্রয়োজনের তুলনায় ছোট ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ করে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ করা হয়েছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, সবুজ বিপ্লব, গোলাপি বিপ্লব, স্থল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, ভরাট ও দখল, দূষণ, যথেচ্ছ ব্যবহার ইত্যাদি নানাবিধ কারণও নদী ধ্বংসে কম ভূমিকা রাখেনি।

সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন দেশের অভিন্ন নদীগুলোর জীবন রক্ষায় কী কী উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন তার একটা রূপরেখা তৈরি করে রাখতে পারে। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে কেউই চায় না বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা অতীতের মতো গঙ্গার পানি নিয়ে আলোচনার সময় যা করেছিলেন তার পুনরাবৃত্তি করুক। তাই দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে আমরা যাতে চাহিদার যৌক্তিকতা যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে পারি তার প্রস্তুতি রাখা জরুরি। স্মরণ রাখা প্রয়োজন, উজানের একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে দেশের নদীগুলো গভীরতা হারিয়ে ফেলেছে, নদীর ধারণক্ষমতা কমে গেছে। প্লাবনভূমির কথা ভুলে গিয়ে নদীর মূল প্রবাহভূমি দখল ও ভরাটের মহাযজ্ঞ দেশব্যাপী চলেছে। তাই ইহকালে করার কোনো সম্ভাবনা নেই জেনেও ভারত যেহেতু অভিন্ন নদী সমস্যা সমাধানে বদ্ধপরিকর, তাই আন্তর্জাতিক নীতি অনুসারে তারা যদি পানি দিয়ে দেয় তাহলে দেশের অবস্থা কী হবে তা অনুমান করতেও ভয় হয়। সে বিষয়ে আমাদের প্রস্তুতি কতটুকু ভেবে দেখা প্রয়োজন। যদিও যে একটা মাত্র নদীর পানি চুক্তি হয়েছে, সেখানেও বাংলাদেশকে অনৈতিকভাবে কম পানি সরবরাহ করে বঞ্চিত করা হয়েছে।

বাংলাদেশের নদীতে চাহিদামতো পানি না পাওয়ার কারণে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে, দেশের নিম্ন বদ্বীপে প্রায় ২০ লাখ টন পলি জমা হচ্ছে আর উচ্চ বদ্বীপে গাছ মরে যাচ্ছে ও নদী গভীরতা হারাচ্ছে। পানিতে লবণাক্ততা বাড়ছে, মরুকরণের শঙ্কা দেখা যাচ্ছে, জীববৈচিত্র্য ও নৌচলাচল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, জনস্বাস্থ্যেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে এবং পানির মান কমে যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গও এমন প্রভাবের বাইরে নেই। তাই দেশের সাধারণ মানুষের ভাবনায় আসতেই পারে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলে গেছেন তা কথার কথা মাত্র। বিন্দুমাত্র আন্তরিকতা থাকলে এমন রসিকতা তিনি করতেন বলে মনে হয় না। তবে এই রসিকতা আমাদের আন্তরিক করে তুলতে পারে। আমরা নিজেদের চাহিদার ব্যাপারে সোচ্চার হতে পারি। সোচ্চার হওয়ার জন্য, প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে গতিশীল ও দায়িত্বশীল হতে উদ্বুদ্ধ করতে পারি। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তত্ত্বাবধানে নদী-সংশ্নিষ্ট ১৫টি মন্ত্রণালয় যৌথ উদ্যোগে নদীর সব ধরনের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে তা থেকে দেশ ও জাতির কল্যাণের একটা সুপারিশমালা তৈরি করতে পারে। এই সুপারিশের ভিত্তি আরও শক্তিশালী করতে পারে দেশের সব বিশেষজ্ঞকে সমন্বয় করে। এখানে আমাদের ভুল পরিকল্পনাগুলোকে চিহ্নিত করে তারও সমাধান করা অত্যন্ত জরুরি।

আমাদের আরও মনে রাখা দরকার, উজানের দেশ ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহারের পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন করেই চলেছে। তিস্তা নদীর পানির হিস্যা পেতে ভারতের সঙ্গে ৪০ বছরের ওপর সময় ধরে আলোচনা চলছে। ইতিবাচক ফল এখনও কিছু হয়নি। ভারত নিজেদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক মতানৈক্যের অজুহাত দেখিয়ে বাংলাদেশকে ন্যায্য পানির হিস্যা থেকে বঞ্চিত রেখেছে। পাশাপাশি গজলডোবায় তিস্তা নদীর বাঁধই শুধু নয়, এ বাঁধের মাধ্যমে তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশে ভয়াবহ ভাঙন ও নদীর গতিপথ পরিবর্তনের জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষ গজলডোবা বাঁধের ভাটিতে সীমান্তের জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত এক কিলোমিটারের মধ্যে ভারতীয় এলাকায় সুপরিকল্পিতভাবে ৫টি স্পার নির্মাণ করেছে। বিশ্বের অনেক নদী অভিন্ন। এক নয়, একাধিক দেশ নিয়ে প্রবাহিত। এ দেশগুলো সম্মিলিতভাবে যৌথ ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলছে। অথচ ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তিস্তা নদীর মতো করেই আমাদের অন্য অভিন্ন নদীগুলোর পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলেছে। বর্তমানে তারা হয়তো এভাবেই অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে উভয়পক্ষই লাভবান হবে এমন একটা সমাধানসূত্র বের করতে সম্মত হয়েছে। এভাবেই অভিন্ন নদীর সমস্যা সমাধানে তারা বদ্ধপরিকর। আমাদের তিস্তা নদীর পাশাপাশি তিস্তা সেচ প্রকল্পও এখন হুমকির মুখে। ৫৩টি নদীর সবগুলোরই কমবেশি একই অবস্থা। মহাজোট সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের সুসম্পর্ক বিদ্যমান। দেশে প্রবাহিত সব অভিন্ন নদীকে বাঁচাতে মহাজোট সরকার এই সুসম্পর্ককে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিকভাবে ব্যবহার করবে, এটাই কাম্য। যত তাড়াতাড়ি সব নদী নিয়ে আলোচনা শুরু করা হবে, ততই মঙ্গল। আন্তর্জাতিক নীতি অনুসারে নূ্যনতম পানি প্রাপ্তি নিশ্চিত করা না গেলে দেশের অস্তিত্ব রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে।

সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ

কর্মসংস্থানেই সমৃদ্ধি

বাজেটে কী হয়, বাজেটের টাকা বারোভূতে খায়।’ বাজেট সম্পর্কে এমন মন্তব্য যেমন-তেমন ব্যক্তির নয়; একজন অতীত অর্থমন্ত্রীর। ভোক্তা বাজেট বলতে বোঝে এক অর্থবছরের সরকারি আয়-ব্যয়ের সম্ভাব্য হিসাব-নিকাশ। সে হিসাব-নিকাশের বিবরণ সংবলিত ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট আজ সংসদে পাস হবে। প্রস্তাবিত বাজেট সংসদের ভেতরে ও বাইরে নানাভাবে বিচার-বিশ্নেষণ হয়েছে। তাতে ভোক্তা মোটা দাগে বুঝেছে, বাজেট গতানুগতিক। অর্থাৎ অতীতের আর সব বাজেটের ধারাবাহিকতা মাত্র। কর, শুল্ক্ক, ভ্যাট ও মুনাফা আহরণ বৃদ্ধি দ্বারা সরকার আয় বাড়াবে। সে আয় রাজস্বসহ নানাবিধ উন্নয়ন খাতে ব্যয় হবে। সে ব্যয় চলতি অর্থবছরের তুলনায় ২২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হওয়ায় বাজেট ঘাটতি হবে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। ব্যাংক ঋণে এ ঘাটতির সিংহভাগ পূরণ হবে। অথচ চলতি অর্থবছরে ব্যাংকগুলোতে বিনিয়োগ/ঋণদানযোগ্য আমানতের পরিমাণ সর্বসাকল্যে মাত্র ৬৪ হাজার কোটি টাকা। তাই ঋণপ্রবাহ এখন সংকটে থাকায় ব্যক্তি খাত চরম বিনিয়োগ সংকটে আছে। ফলে ব্যক্তি খাতে প্রত্যাশিত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি অনিশ্চিত।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে দক্ষ ও সক্ষম জনসম্পদ বৃদ্ধি পায়। ফলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে আর্থিক প্রবৃদ্ধিও বৃদ্ধি পায়। এ বৃদ্ধি আবার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে। এভাবেই শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ ও আর্থিক প্রবৃদ্ধি চক্রাকারে বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে। তাতে একদিকে জাতি দক্ষ ও সু-স্বাস্থ্যসম্পন্ন জনসম্পদে সমৃদ্ধ হয়, অন্যদিকে এই সম্পদের প্রবৃদ্ধি নানামুখী উন্নয়ন ও অগ্রগতি অব্যাহত রাখে এবং নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। কিন্তু আমাদের উচ্চতর প্রবৃদ্ধির সঙ্গে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে সরকারি বিনিয়োগের এই তাত্ত্বিক ভিত্তি ভোক্তা খুঁজে পাচ্ছে না। বরং বিচার-বিশ্নেষণে দেখা যায়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে সরকারি বরাদ্দ বৃদ্ধি একদিকে ভোক্তার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য-ব্যয় বাড়ায় এবং মানহীন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ করে; অন্যদিকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো সেবা খাত বাণিজ্যে পরিণত করার ক্ষেত্র তৈরি করে এবং সে বাণিজ্য সম্প্রসারণে মুখ্য ভূমিকা রাখে। তাই জাতিকে দক্ষ ও সু-স্বাস্থ্যসম্পন্ন জনসম্পদে সমৃদ্ধ করা এবং নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে প্রস্তাবিত বাজেট কঠিন চ্যলেঞ্জের সম্মুখীন।

শ্রমবাজারে এখন স্বল্পশিক্ষিতদের তুলনায় উচ্চশিক্ষিতদের কর্মসংস্থান খুবই সীমিত। উচ্চ প্রবৃদ্ধি আমাদের শ্রমবাজারের গুণগত পরিবর্তন আনতে পারেনি। আবার বাজার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পণ্য ও সেবা উৎপাদন এবং সরবরাহে নানামুখী পরিবর্তন আসছে। এমন পরিবর্তনশীল, কর্মপরিবেশ-সম্পৃক্ত শ্রমবাজার উপযোগী শ্রমশক্তি উৎপাদনে আমরা সফল হইনি। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে সরকারি বিনিয়োগ কাজে আসেনি। রাজস্ব আহরণ এবং বাজেটে তার বিলি-বণ্টনে সে লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্ব পায়নি। উন্নয়ন নীতি ও কৌশল সে লক্ষ্যে গৃহীত না হওয়ায় বাজেট গতানুগতিক ধারাবাহিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির উপযোগীও হতে পারেনি। সুতরাং শ্রমবাজার উপযোগী শ্রমশক্তি উৎপাদনের লক্ষ্যে মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে সংস্কার কার্যক্রম গৃহীত হতে হবে এবং তাতে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি বিনিয়োগ অব্যাহত থাকতে হবে। সে লক্ষ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য উন্নয়ন নীতি ও কৌশল গৃহীত হতে হবে। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেট ভোক্তার সে প্রত্যাশা পূরণে অক্ষম।

প্রতি বছর প্রায় ২২ লাখ তরুণ (বয়স :১৫-২৯ বছর) শ্রমবাজারে আসছে। বর্তমানে এরাই দেশের মোট শ্রমশক্তির এক-তৃতীয়াংশ; ৪ কোটির ওপরে। আমাদের মোট জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই শ্রমশক্তি। এ শক্তিকে সম্পদে পরিণত করা আজ আমাদের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। এ শ্রমশক্তি কাজে সম্পৃক্ত হলে সে কাজে সম্পদ বৃদ্ধি হবে। সে বৃদ্ধি উচ্চতর প্রবৃদ্ধি দেবে। তাই জনবল উন্নয়ন সর্বোচ্চ মনোযোগ পাবে। অথচ তেমন মনোযোগ পায়নি। তবে মনোযোগ পায় সরকারি খাতে নিয়োজিত প্রায় ২০ লাখ শ্রমশক্তি। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি সমন্বয়ে তাদের বেতন ও ভাতাদি বৃদ্ধি হয়। সঙ্গে নানা সুযোগ-সুবিধা- আর্থিক ছাড়ে ফ্ল্যাট-প্লট, করমুক্ত ভাতা, স্বল্প সুদে গাড়ি-বাড়ি কেনার ঋণ, পেনশন, স্বামী-স্ত্রীর পেনশন একজনের অবর্তমানে অন্যজন উত্তরাধিকারী, প্রতিবন্ধী সন্তানও উত্তরাধিকারী ইত্যাদি। আবার অনেকেই ঘুষ-দুর্নীতিসহ নানা রকম অবৈধ আর্থিক সুবিধা নেন। এমন শ্রমশক্তি দেশের সম্পদ ও সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি তথা প্রবৃদ্ধি অর্জনে ইতিবাচক নয়।

সরকারি খাতের বাইরে মোট শ্রমশক্তির ৮৫ শতাংশেরই কাজের সংস্থান অপ্রাতিষ্ঠানিক। অর্থাৎ ব্যক্তি খাতভিত্তিক। এ খাতে সরকারি খাতের তুলনায় সুযোগ-সুবিধা নেই বললেই চলে। বেতন বৃদ্ধি ও পদোন্নতি অনিয়মিত এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনিশ্চিত। অনেক ক্ষেত্রেই কোনো বেতন কাঠামোও নেই। মূলত এই বিপুল পরিমাণ শ্রমশক্তির ওপরেই প্রবৃদ্ধি নির্ভরশীল। অথচ তারা সুযোগ-সুবিধা ও আয় বৈষম্যের ভয়ানক শিকার। সরকারি ও ব্যক্তি খাতে নিয়োজিত শ্রমশক্তির মধ্যে এমন বিদ্যমান বৈষম্য নিরসনের বিষয়টি একেবারেই সরকারের বিবেচনায় নেই। এমন বৈষম্য বজায় রেখে কোনো জাতির পক্ষে দক্ষ ও সু-স্বাস্থ্যসম্পন্ন জনসম্পদে সমৃদ্ধ হওয়া সম্ভব নয়। তেমন জনসম্পদ ব্যতীত টেকসই প্রবৃদ্ধিও অসম্ভব। সরকারি ও ব্যক্তি খাত মিলিয়ে সার্বিক কর্মকাণ্ডে অর্থপ্রবাহ এবং এর বৃদ্ধিতে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়। কিন্তু বাজেট কেবল সরকারি আয়-ব্যয় নিয়ে হয়। প্রবৃদ্ধি কেবল সরকারি ব্যয় ও বিনিয়োগে নির্ভরশীল নয়। তাই প্রবৃদ্ধির প্রশ্নে বাজেট সীমাবদ্ধতার শিকার।

ব্যক্তি খাত এখন বিনিয়োগ ও সুশাসন সংকটের শিকার। এ খাতে ঋণপ্রবাহ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও অর্জিত হয়নি। ব্যাংকই এ খাতের একমাত্র ঋণের উৎস। অথচ ব্যাংকগুলো আমানতই পাচ্ছে না। বেশি বেশি সুদ প্রস্তাবেও কাজ হয়নি। এ বছরে সব ক’টি ব্যাংকের বিনিয়োগযোগ্য আমানত সর্বসাকল্যে নেমে এসেছে ৬৪ হাজার কোটি টাকায়। অথচ এ আমানত গত বছরেও ছিল প্রায় দ্বিগুণ। আবার ঋণের টাকাও যথাসময়ে পরিশোধ হচ্ছে না। ফলে আদায় অনিশ্চিত ঋণের পরিমাণ এখন প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা। সেইসঙ্গে বিদেশে অর্থ পাচার তো আছেই। রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় এখন অনেক বেশি। তাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে। এক সময় রিজার্ভ দিয়ে ৮ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যেত। এখন তা ৪ মাসে নেমে এসেছে। বেকার যুবক কাজের প্রত্যাশায় নৌকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিচ্ছে। এসব অবস্থা মোকাবেলায় কেবল ঋণখেলাপিদের ছাড় দেওয়া ব্যতীত আর কিছুই করা হয়নি। তাতেও হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ব্যক্তি খাত উদ্যোক্তা সংঘবদ্ধ দুর্নীতির সহায়তায় এমন অবস্থা মোকাবেলা করছে। সংঘবদ্ধ দুর্নীতি ছাড়া ব্যবসায় টিকে থাকা যাচ্ছে না। সঠিক ও সুস্থভাবে কোনো ব্যবসা চালানো যায় না। শক্তিশালী লবিং ব্যতীত উদ্যোক্তার পক্ষে কোনো সুযোগ-সুবিধা পাওয়া সম্ভব নয়। তাই বিদ্যমান সুশাসন সংকটে ব্যক্তি খাত উদ্যোক্তাকে বিপথগামী হতে হয়। এমন সব ব্যক্তি খাতের পক্ষে যুগোপযোগী কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা এবং বেশি বেশি কর, শুল্ক্ক ও ভ্যাট দিয়ে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। তাই ভোক্তা দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন চায়। সে লক্ষ্যে বাজেটে বরাদ্দ চায়।

অনেকেই আক্ষেপ করে বলেছেন, কর-জিডিপি অনুপাত ভারতের ২০। এমনকি ভুটানের ৩০। অথচ বাংলাদেশের ৯। কেবল ফর্মাল করই নয়; ভোক্তারা ইমফর্মাল করও (করের টাকা আত্মসাৎ, ঘুষের বিনিময়ে ছাড় দেওয়া কর ও ওই ঘুষ, পণ্য বা সেবা সরবরাহে ঘুষ, দুর্নীতি এবং নানা চাঁদা ও কমিশন) দেয়। সেই ইমফর্মাল কর বিবেচনায় নেওয়া হলে কর-জিডিপি অনুপাতের দিক দিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়াত, তা বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ফর্মাল কর থেকে রাজস্ব আহরণ প্রবৃদ্ধি ১৭ শতাংশ। অর্থাৎ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এই প্রবৃদ্ধি ভোক্তাকে বাড়তি কত হাজার টাকা ইনফর্মাল কর দিতে বাধ্য করবে, তার হিসাব কেউ রাখে না। কে না জানে, মূল্যস্টম্ফীতি ও মুদ্রাস্টম্ফীতি ঘুষ, চাঁদা, কমিশন, এমনকি তছরুপের রেট বাড়ায়। এমন সব ইনফর্মাল কর থেকে ভোক্তার সুরক্ষা ব্যতীত কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধির কোনো নীতি/ কৌশল ন্যায্য ও যৌক্তিক হতে পারে না। সরকারকে তা বিশেষভাবে অনুধাবন করা দরকার।

দুর্নীতির ব্যাপারে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি, সারা সমাজ দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে- প্রধানমন্ত্রীর এমন অভিব্যক্তি, এমনকি ‘দুর্নীতিবাজদের খতম কর’ জনগণের জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর এমন নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও ভোক্তা তথা জনগণকে ফর্মাল করের পাশাপাশি ইনফর্মাল করও দিতে হয়। অর্থমন্ত্রীর লক্ষ্য ফর্মাল কর থেকে ৬ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ। ফর্মাল-ইনফর্মাল কর মিলিয়ে এখনই ভোক্তাদের কাছ থেকে কমবেশি এ পরিমাণ অর্থ আদায় হয়। ইনফর্মাল কর ফর্মাল করে রূপান্তর করা হলে অর্থমন্ত্রীর নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা এখনই অর্জিত হতে পারে। সে জন্য দরকার সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা প্রতিপালন করা। তা না করে কালো টাকা সাদা করা, এমপিওভুক্ত মানহীন শিক্ষার সম্প্রসারণ; রাষ্ট্রপতি-মন্ত্রী, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার দেশের পরিবর্তে বিদেশে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ, দক্ষ ও উপযুক্ত শ্রমশক্তি দেশে তৈরির পরিবর্তে আমদানি করার সুযোগ সৃষ্টি করা- এমন সব দৃষ্টান্ত কোনো জাতির দৈন্যদশারই বহিঃপ্রকাশ। অথচ আমাদের জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ শ্রমশক্তি। জনগণের অধিকাংশই শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা আজ বাজার থেকে ক্রয় করতে সক্ষম; অতীতে এমন অবস্থা ছিল না। আমাদের এ সক্ষমতা এনে দিতে পারে উন্নত দেশ বা জাতিতে পরিণত হওয়ার মর্যাদা।