কুরআনকে মিথ্যা প্রমাণ করতে গিয়ে নিজেই মুসলিম হলেন কানাডার অধ্যাপক মিলার!

নিউজ ডেস্ক : কানাডার সাবেক খ্রিস্টধর্ম প্রচারক ছিলেন অধ্যাপক ড. গ্যারি মিলার। তিনি পবিত্র কুরআনের মধ্যে ভুল খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। কুরআনের ভুল বের করে যাতে ইসলাম ও কুরআন বিরোধী প্রচারণা চালানো সহজ হয় সেজন্য তিনি এ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কুরআন পড়ার পর তার ভিতরে অদ্ভুত পরিবর্তন আসে। ফলে নিজেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমান হন। ইসলাম গ্রহণের পর তার দেয়া হয়েছে আবদুল আহাদ উমার।বাংলা নিউজ

অধ্যাপক ড. গ্যারি মিলার বলেন, আমি একদিন কুরআন সংগ্রহ করে তা পড়া শুরু করলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম কুরআন নাযিল হয়েছিল আরবের মরুচারীদের মধ্যে। তাই এতে নিশ্চয় মরুভূমি সম্পর্কে কথা থাকবে। কুরআন নাযিল হয়েছিল ১৪০০ বছর আগে। তাই খুব সহজেই এতে অনেক ভুল খুঁজে পাব ও সেসব ভুল মুসলিমদের সামনে তুলে ধরব।

কিন্তু কুরআন পড়ার পরে বুঝলাম আমার এসব ধারণা ঠিক নয়, বরং আমি অনেক আকর্ষণীয় তথ্য পেলাম। বিশেষ করে সূরা নিসার ৮২ নম্বর আয়াতটি আমাকে গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত করে। সেখানে আল্লাহ বলেন, এরা কী লক্ষ্য করে না কুরআনের প্রতি? এটা যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো পক্ষ থেকে নাযিল হতো, তবে এতে অবশ্যই বহু বৈপরিত্য দেখা যেত’।

এরপর আরো গভীরভাবে কুরআন অধ্যয়ন করলেন গ্যারি মিলার। আর তার এই অধ্যয়নই তাকে নিয়ে গেল ইসলামের পথে। ইসলামের দোষ খুঁজতে গিয়ে তিনি হয়ে গেলেন একজন মুসলিম তথা মহাসত্যের কাছে সমর্পিত একজন। তিনি বলেছেন, আমি খুব বিস্মিত হয়েছি যে কুরআনে ঈসার (আ.) মাতা মারিয়ামের নামে একটি বড় পরিপূর্ণ সূরা রয়েছে। আর এ সূরায় তার এত ব্যাপক প্রশংসা ও সম্মান করা হয়েছে যে এত প্রশংসা বাইবেলেও দেখা যায় না। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর নাম মাত্র ৫ বার এসেছে।

এক্সক্লুসিভ রিলেটেড নিউজ

দুর্বৃত্তের জীবনাচারকে মহিমান্বিত করা সমীচীন হবে না ড. সা’দত হুসাইন

ষাটের দশক মাঝামাঝি থেকে শেষের দিকে গড়িয়ে পড়ছে। আমরা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। দেশে আইয়ুব-মোনেমের শাসন চলছে। সরকারবিরোধী ছাত্রসংগঠনগুলোর তোড়জোড় অনেক বেশি। ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন ও মতিয়া গ্রুপ) ও ছাত্রলীগ রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় দল। ছাত্র শক্তি ছোট দল হলেও তাদের তৎপরতা লক্ষ করা যেত। তবে সরকারের বিরোধিতার ব্যাপারে তাদের অবস্থান অবিসাংবাদিতভাবে সুস্পষ্ট ছিল না। সরকারের অন্ধ সমর্থক ছিল ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন (এনএসএফ)। সাধারণ ছাত্ররা একে সরকারের দালাল সংগঠন নামে অ্যাখায়িত করত। এনএসএফের সদস্যরা সরকারের পক্ষে প্রচার চালাত, সরকারের গুণগান করত এবং বিরোধী ছাত্রসংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে মারামারি-হানাহানি করত। এককথায় এরা ক্যাম্পাসে গুণ্ডামি করত। সাধারণ ছাত্ররা এদের এনএসএফের গুণ্ডা হিসেবে জানত।

গুণ্ডাদের মধ্যে দুজন ছাত্র ছিল অতি পরিচিত। দলীয় সদস্যদের কাছে মহাসমাদৃত। এদের একজনের নাম খোকা, অন্যজনের নাম পাসপাট্টু। লোকে এদের নাম একসঙ্গে উচ্চারণ করত খোকা-পাসপাট্টু। দুজনেরই আসল নাম ছিল। তবে ছাত্র-শিক্ষকদের বেশির ভাগই সে নাম জানতেন না। পাসপাট্টুর গায়ের রং ফরসা। শরীরের গঠন বড়সড়। ঢাকাই ছবিতে হিরো কিংবা ভদ্রবেশী ভিলেনের ভূমিকায় নাম লেখালে তা বেমানান হতো না। তার পেটা শরীর। কোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে ভেচকি দিলে লোকজন ছুটে পালাত। খোকা ছিমছাম গড়নের। চোখে পাতলা চশমা। ব্যায়াম করা সুঠাম দেহ। তবে তা মোটেই ভীতিপ্রদ নয়; বরং দেখতে বিদেশি ছবিতে অভিনয় করা ‘প্রফেসর’ মনে হতো। একবার আমাদের এক সতীর্থ বন্ধুকে আঘাত করার জন্য সে তেড়ে আসছিল। আমি তাকে না চিনে ‘করেন কী, করেন কী’ বলে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে আটকে রাখতে চেষ্টা করেছিলাম। সে অবশ্য আমাকে ধাক্কা দিয়ে ছুটে গিয়েছিল। তাকে দেখে মোটেই ভয়াল মনে হয়নি। তার নাম-পরিচয় জানলে এত কাছে গিয়ে তাকে বাধা দিতে হয়তো সাহস করতাম না।

খোকা-পাসপাট্টু দুজনই সায়েন্স ফ্যাকাল্টির অর্থাৎ কার্জন হল অঙ্গনের ছাত্র ছিল। তবে সারা দিন তারা আর্টস ফ্যাকাল্টি অর্থাৎ বর্তমান কলাভবন এবং মধুর ক্যান্টিন ঘুরে বেড়াত। এখানে তারা যত অপকর্ম করত, সন্ধ্যায় কার্জন হলের দিকে ফিরে যেত। খোকা ঢাকা হল বা বর্তমান শহীদুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র ছিল। পাসপাট্টু ফজলুল হক হলে থাকত। পাসপাট্টু বিজ্ঞান বিষয়ে মাস্টার্স পার্ট টুর ছাত্র ছিল। তার নাম পাসপাট্টু হওয়ার এটিও একটি কারণ। আরো কারণও রয়েছে। খোকা স্নাতক পর্যায়ের ছাত্র ছিল। পাসপাট্টু প্রায়ই হলুদ বা আদার রঙের হাফ শার্ট-প্যান্টের ভেতরে ‘টাক ইন’ করে চলত। খোকা ফুল হাওয়াই শার্ট-প্যান্টের ওপরে পরত। তাকে কোনো রকমে হিংস্র মনে হতো না।

খোকা-পাসপাট্টুর নাম জানত না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের ছাত্র-শিক্ষকের খোঁজ পাওয়া সে সময়ে সত্যি দুষ্কর ছিল। তাদের কর্মকাণ্ডের অপ্রকাশিত বুলেটিন সবার মুখে মুখে ফিরত। কর্মকাণ্ড বলতে অপকর্মকে বোঝানো হতো। আজ একে মেরেছে, কাল ওর টাকা-পয়সা কেড়ে নিয়েছে। পরশু কোনো এক ছাত্রের বালিশ-তোশক, বই-খাতা পুড়িয়ে দিয়েছে এমন সংবাদ প্রতিদিন শোনা যেত। কেউ কেউ আবার এদের অপকর্মকে বাহাদুরি হিসেবে দেখত। এরা এক সাপুড়ে জোগাড় করেছিল, যে গলায় সাপ জড়িয়ে এদের সঙ্গে ঘুরত। লোকটার চেহারাও ভীতপ্রদ ছিল। ছাত্র-ছাত্রীরা এ ধরনের সাপ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দায় ঘোরা মোটেই পছন্দ করতেন না। এনএসএফের সদস্যরা অবশ্য সুযোগ পেলেই খোকা-পাসপাট্টুকে এ জন্য বাহবা দিত। একই সঙ্গে এই দুই ছাত্রের, তথা দুর্বৃত্তের বীরত্বগাথা তারা সবিস্তারে বর্ণনা করত। পাসপাট্টুকে কবে-কোথায় সাত-আটজন আক্রমণকারী ঘিরে ফেলেছিল, সেখান থেকে ‘ব্যাক কিক’ মেরে দুই আক্রমণকারীকে ধরাশায়ী করে আর এক আক্রমণকারীর হাত মোচড়ে দিয়ে কিভাবে সে বেরিয়ে পড়েছিল তার বর্ণনা দিতে গিয়ে এনএসএফের সদস্যরা রীতিমতো উচ্ছ্বসিত এবং উত্ফুল্ল হয়ে পড়ত। মনে হতো পাসপাট্টুকে কাছে পেলে তারা এখনই পায়ে ধরে সালাম করে বসবে। তারা মনে করত এমন হিরো তারা বোম্বের ফিল্মেও দেখেনি। খোকার ব্যাপারেও গালগল্পের শেষ ছিল না। খোকা নাকি দস্যু বাহারাম হওয়ার চেষ্টা করছে। সে ফ্লাইং ক্লাবে বিমান চালনা শিখছে, অচিরেই আকাশ থেকে আক্রমণ পরিচালনা করবে। সে হবে এ অঞ্চলের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ খলনায়ক।

সব কল্পকাহিনি (Myth) অসত্য প্রমাণিত করে ১৯৬৮ সালের শেষ দিকে প্রতিপক্ষের আক্রমণে আহত হয়ে ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি হলো পাসপাট্টু। তাকে মারাত্মকভাবে ছুরিকাঘাত করা হয়েছিল। দিন চারেক মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে ইহধাম ত্যাগ করল পাসপাট্টু। তার মৃতদেহ নিজ জেলা বরিশালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তার দাফন হয়। পাসপাট্টুর মৃত্যুতে ঢাকায় কেউ দুঃখ প্রকাশ করেছে বলে মনে হয় না, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। যত দূর মনে পড়ে, তার জন্য কোনো শোকসভা হয়নি। এনএসএফের অবস্থা তখন খারাপের দিকে। শোকসভা করার মতো সামর্থ্য এনএসএফের ছিল না।

একটি করুণ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পাসপাট্টুর গল্পগাথা (Myth) , প্রভাব-প্রতিপত্তি, অত্যাচার-অনাচারের অবসান ঘটল। এর কিছুদিন পর ১৯৬৯ সালের উত্তাল ছাত্র আন্দোলন শুরু হলো। অল্প দিনের মধ্যে তা গণ-আন্দোলনে রূপ নিল। খোকা গা-ঢাকা দিল। তারপর এলো স্বাধীনতাযুদ্ধ। খোকার কোনো খোঁজখবর ছিল না। দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে রেসকোর্সে খোকার লাশ পড়ে আছে বলে জানা গেল। খোকা-পাসপাট্টু যুগের এখানেই শেষ।

যারা শুধু পেশিশক্তি, গুণ্ডামি ও দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে পরিচয় ও প্রতিপত্তির শীর্ষে উঠে যায়, তাদের পরিণতি শেষ পর্যন্ত বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খোকা-পাসপাট্টুর মতো হয়ে থাকে। স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে কলতাবাজার, লালবাগ, এলিফ্যান্ট রোডের কিছু মারদাঙ্গা তরুণের নাম প্রায়ই শোনা যেত। স্বাধীনতার পর এদের নাম খুব একটা শোনা যায়নি। এদের মধ্যে যে অল্প কয়েকজন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে বেঁচে ছিলেন, তাঁদের নাম অবশ্য পরেও বিভিন্ন কারণে শোনা যেত। রাজনৈতিক কারণে এনএসএফের গুণ্ডারা বিতাড়িত হয়ে গা-ঢাকা দিয়েছিল। তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। বহু বছর পরে ভোল পাল্টিয়ে তারা অতিসাধারণ নাগরিকের মতো জীবন কাটাচ্ছিল। দেখা হলে চোখ নিচু করে অন্যদিকে কেটে পড়ত। যেসব সংবাদকর্মী এবং পত্রপত্রিকা তাদের ‘গৌরবগাথা’ প্রচার করতেন, তাঁরাও এই গুণ্ডাদের ব্যাপারে নির্বিকার, নিশ্চুপ। প্রাক-স্বাধীনতা সময়ের পেশিধররা কোনোমতে নিস্তেজ জীবন কাটিয়েছে।

স্বাধীনতার পর নতুন মাস্তান গ্রুপের আর্বিভাব ঘটল। তবে যারা মারাত্মক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং জঘন্যতম অপরাধে জড়িত ছিল, তাদের কর্মকাণ্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও এর আশপাশের এলাকায় সীমিত ছিল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মধ্যে সশস্ত্র হানাহানি তীব্র হয়ে দেখা দিলেও খুনখারাবিতে লিপ্ত দুর্বৃত্তদের নাম-পরিচিতি বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে পড়েনি। এরই মধ্যে স্থানীয়ভাবে কুখ্যাত সাতজনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে খুন করা হয়। কারো ওপর পত্রপত্রিকায় ঘটা করে খবর প্রকাশিত হয়নি। সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা সর্বহারা পার্টি, জাসদ, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি ইত্যাদি রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে নানা ধরনের মারাত্মক অপরাধ সংঘটিত করত। তবে শুধু মারাত্মক পেশাজীবী কিংবা ক্ষমতাধর সন্ত্রাসী হিসেবে কোনো ব্যক্তির নাম শহরে বা পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়েনি। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের হোতারা ছিলেন মূলত রাজনৈতিক নেতা। এঁদের মধ্যে কয়েকজন গণতান্ত্রিক ব্যক্তি রাজনীতি ছেড়ে সশস্ত্র সংগ্রামে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন।

আদর্শ নিরপেক্ষ ছোট ছোট সন্ত্রাসী গ্রুপের নতুনভাবে উত্থান শুরু সামরিক শাসনকালে। সরকারের বিভিন্ন এজেন্সির আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে দুর্বৃত্ত গ্রুপ স্থানীয় পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং নির্দিষ্ট জনপদে, বলা যায় পাড়া-মহল্লায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, মারধর, সম্পত্তি দখল এবং ছিনতাইয়ের মতো কর্মকাণ্ড নির্দ্বিধায় চালিয়ে যেতে থাকে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সরকারি প্রশাসন ওপরের নির্দেশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এদের সহায়তা করে। পত্রপত্রিকা এদের অপকর্মকে কখনো সমালোচনা করে, কখনো গৌরবান্বিত করে প্রকাশ করে। যে কাজ সর্বতোভাবে নিন্দিত হওয়ার কথা, সে কাজকে নন্দিত করতে কেউ কেউ চেষ্টা করেছে। সন্ত্রাসীরা কোথায় ফিল্মি কায়দায় ছিনতাই করেছে, কোথায় সদলবলে সরকারের সম্পত্তি দখল করেছে, কোথায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে টেক্কা দিয়ে তাদের কার্য সিদ্ধি করেছে, তাকে রংচং দিয়ে বর্ণনা করলে প্রকারান্তরে দুর্বৃত্তদের উৎসাহিত করা হয়। উঠতি বয়সের তরুণরা এদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এরশাদ সরকারের পতনের কিছুদিন আগে পর্যন্ত জাতীয় পার্টি ঘেঁষা দুর্বৃত্তদের কীর্তিকলাপ গল্পাকারে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এসব প্রতিবেদনের মাধ্যমে সাধারণ্যে এদের পরিচিতি বেড়েছে।

১৯৯১ সালে দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। নির্বাচনের মাধ্যমে দলীয় সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া মাত্র তাদের অঙ্গসংগঠন, বিশেষ করে ছাত্রসংগঠনের শক্তিমান সদস্য ও নেতারা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। পেশিশক্তির মহড়া দিয়ে তাদের লক্ষ্য হাসিল, সম্পত্তি, প্রতিষ্ঠান দখল এবং অর্থ সংগ্রহের কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় শহরের অছাত্র, দলনিরপেক্ষ, তরুণ সন্ত্রাসীরা। ছাত্রনেতাদের সমর্থনে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজের হল-হোস্টেল তারা দখল করে নেয়। সরকারি দলের সমর্থক দাবি করে মারামারি, খুনাখুনিতে লিপ্ত হয়। অর্থ-সম্পদের সঙ্গে নামের কলেবরও বেড়ে যাবে। কখনো কুৎসিত ডাকনাম, আবার কখনো অভিজাত শ্রেণির পদবি এসে তাদের মূল নামের আগে-পিছে যোগ হয়। কুৎসিত ডাকনামের মধ্যে রয়েছে—কুত্তা, টিয়া, মুরগি, খচ্চর, পিচ্চি, ব্যাঙ্গা, লেংড়া ইত্যাদি। অভিজাত উপাধির মধ্যে রয়েছে—মিনিস্টার, জমিদার. কমান্ডার, শেঠ, কমিশনার, বাদশা, শাহান শাহ ইত্যাদি। খারাপ-ভালো যা-ই হোক না কেন, এসব নাম-পদবির ব্যবহার সন্ত্রাসীদের পরিচিতিকে সম্প্রাসারিত করে, অর্থ সংগ্রহ (চাঁদাবাজি) এবং দখলবাজিতে বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বিশেষণওয়ালা নাম শুনলে দোকানদার, ব্যবসায়ীরা ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি চাঁদা বের করে দেন। তাদের সমীহ করে কথা বলেন। এমনকি তাদের সাজানো অনুষ্ঠান স্পন্সর করতে রাজি হয়ে যান। ফলে তাদের আয়-সম্পদ অনেক বেড়ে যায়।

তরুণ সন্ত্রাসীদের নিজস্ব এবং পারিবারিক পরিচয় খুবই নিম্নস্তরের। এরা মুচি, কসাই, গোর খোদক, সুইপার, ক্লিনার, ডোম, টি-বয়, লোডার, পোর্টার, ছিঁচকে চোর, চোরাচালানির চাকর হিসেবে কাজ করে। দু-একটি দুঃসাহসী কাজ করার পর এদের পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে। কিছু সংবাদকর্মী এদের মহিমান্বিত করে খবর ছাপান, এদের ওপর বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। সাধারণ মানুষ এদের সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়। এতেই এদের কেল্লাফতে। বেশ কয়েক বছর আগে পুরান ঢাকার এক ডোমের ছেলেকে নিয়ে পত্রপত্রিকায় অনেক কল্পকাহিনি প্রকাশ হয়েছিল। তাকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছিল, সে যেন এক বিরাট হিরো, ইচ্ছা করলে সে ফিল্মে যোগ দিতে পারে। আসলে নিষ্ঠুরতা এবং অপরাধমূলক কাজ করা ছাড়া তার আর তেমন কোনো গুণ ছিল না। অনেকটা স্বাভাবিক নিয়মে একসময় সে তিরোহিত হয়। তার এমন কোনো গুণ ছিল না যে লোকে তাকে মনে রাখবে। জীবদ্দশায় তাকে নিয়ে ফলাও করে খবর প্রকাশ করা হতো। মানুষ তার সম্পর্কে জানতে উৎসাহী হতো। দু-একজন তার প্রশংসাও করত।

খুন, গুম, অপহরণ, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের মতো জঘন্য অপরাধের পরিকল্পনাকারী, বাস্তবায়নকারী, সহযোগী ও সুরক্ষা প্রদানকারীকে আইনের আওতায় আনা প্রত্যেক নাগরিকের নৈতিক কর্তব্য। বাস্তব অবস্থার কারণে যদি এ কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করা না যায়, তবে নিদেনপক্ষে এই শ্রেণির অপরাধীকে মনে-প্রাণে ঘৃণা করতে হবে। যথাসম্ভব এদের বয়কট করতে হবে। কোনো অজুহাতে এদের কাজকর্ম তথা অপকর্মকে মহিমাস্বিত (Glorify) করা যাবে না। ফিল্মের নায়কের সঙ্গে এদের তুলনা করা যাবে না। এরা ঘৃণিত। সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য। এদের সে দৃষ্টিতেই দেখতে হবে। সমাজের নোংরা-পোকা হিসেবে এরা বেঁচে থাকবে অথবা মারা যাবে। এর বেশি কিছু নয়।

লেখক : সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব ও পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান