সামষ্টিক অর্থনীতি : আত্মসাৎ অপচয় অপব্যয় প্রসঙ্গ ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্নে বিভোর বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন প্রয়াস প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে অন্তর্নিহিত শক্তি ও সম্ভাবনা শনাক্তকরণ যেমন জরুরি, তেমনি এর অন্তর্নিহিত দুর্বলতা, অসঙ্গতি ও অপারগতার দিকটিও আরও বেশি সচেতন-সতর্কতার সঙ্গে বারবার পর্যালোচনাযোগ্য। কেননা অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন শুধু ভাব-ভাবনার তথা প্রচার-প্রচারণার বিষয় হয়ে থাকলে এবং এ ব্যাপারে বাস্তব উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা ও স্বচ্ছতা জবাবদিহিতার আবশ্যকতার উপলব্ধি যদি অমনোযোগিতার হাতে বন্দি থাকে কিংবা প্রগলভতায় ভিন্ন খাতে প্রবাহের প্রয়াস পরিলক্ষিত হয় তা হলে স্বপ্ন দেখাই শুধু সার হবে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাস্তবতার বাসর পাবে না।
বছরচারেক আগে টিআইবির রিপোর্টে উল্লেখিত হয়েছিল, সে সময় অনুষ্ঠিত তিনটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে প্রার্থীরা অতিমাত্রায় অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন। মাঠপর্যায়ে (অর্থাৎ সিটি করপোরেশন এবং ওয়ার্ড পর্যায়ে) যারা ভোটপ্রার্থী তারা ভোটারদের কাছে নিজেদের তুলে ধরবেন এবং ভোটাররা ভোটপ্রার্থীদের অতীত ও বর্তমান অবস্থান এবং তাদের ভবিষ্যৎ কর্মসূচি বাছবিচার করে অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করবেন, এটিই ধ্রুপদ প্রত্যাশা। কিন্তু ভোটারদের কাছে প্রার্থীর পৌঁছানোর পদ্ধতি-প্রক্রিয়াটা যদি হয় অনৈতিক, বিরক্তি ও বিব্রতকর এবং বিশেষ করে এ ব্যাপারে অতিরিক্ত আর্থিক ব্যয় সংশ্লেষের ব্যাপার ঘটে যায় তা বেশ উদ্বেগজনক। কেননা এ নির্বাচনে অংশগ্রহণে প্রার্থীরা যদি বড় ধরনের আর্থিক বিনিয়োগ ও পেশি প্রদর্শন করেন তা হলে গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়া মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। আর এ জাতীয় বিচ্যুতির সুদূরপ্রসারী ক্রিয়া-প্রক্রিয়াও অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। এটি যেন এ দেশের সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যে কোনো নির্বাচনে (এমনকি পেশাজীবী সংগঠন, সমিতি কিংবা ক্লাবের নির্বাচনে) প্রার্থী ‘সৎ, মেধাবী, যোগ্য, সমাজসেবক’ এসব বিশ্লেষণে বিভূষিত করে নির্বাচনে নিজেকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে উপস্থাপন করতে পারলেই ভোটে যেন জিতে যাবেন। সর্বত্র মনে হচ্ছে, শুধু ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কে কত খরচ করতে পারবে তার প্রতিযোগিতা চলছে। সে সময় ভোটের দুসপ্তাহ আগেই দেখা গিয়েছিল গোটা মেট্রোপলিটন পোস্টারে ছেয়ে গেছে। এ বাবদ কয়েক হাজার টন কাগজ, কালি, দড়ি-রশি সবই সাবাড় হয়েছে। কিন্তু কেন? এই বিপুল ব্যয়ের টাকা কোথা থেকে এসেছে এবং পরবর্তীকালে প্রার্থীরা এ খরচ কীভাবে উসুল করতে চাইবেন। মূল প্রশ্নটি সেখানে। একজন প্রার্থীর নিজের ছবিসহ তার মার্কা কী তা জানানোর জন্য হাজার হাজার পোস্টার বানানো এবং টানানোর প্রয়োজন আছে কি? এর পেছনে যে খরচ তার আয়ের উৎস এবং তা উসুলে যে পথ-পন্থা ধরা হবে তা যে ‘জনসেবামূলক’ হবে না এটা সবাই জানে। অথচ এই পরিমাণ অর্থ গঠনমূলক কোনো কাজে ব্যয় করলে সেটিই হতে পারত আসল সমাজসেবা।

জাপানে যে কোনো নির্বাচনে প্রার্থীদের প্রচারপত্র প্রকাশের জন্য রাস্তার মোড়ে রক্ষিত পাবলিক বিলবোর্ড আছে সেখানে একটি পোস্টার সাঁটার মতো খালি জায়গাগুলো ছক করে রাখা আছে। ওই জায়গাটি ব্যবহারে অর্থের বিনিময়ে অনুমতি নিতে হয় সিটি করপোরেশনে আবেদন করে। নির্দিষ্ট স্থানে শুধু একটা পোস্টার লাগানো যাবে এবং ভোটাররা সেখান থেকে জানতে পারবেন প্রার্থী সম্পর্কে। ওই বিলবোর্ডের নির্ধারিত জায়গা ছাড়া আর কোথাও কোনো প্রার্থীর পোস্টার দেখা যাবে না। একজন ভোটারকে হাজার হাজার পোস্টার দেখিয়ে যদি প্রার্থীর পরিচিতি নিশ্চিত করতে হয় এবং সে জন্য বিপুল অর্থ, কাগজ, কালি, দড়ি, শ্রমিক ব্যবহৃত হতে হয় তা হলে সেই ব্যয় জিডিপিতে তেমন কোনো অবদান রাখবে কি? এটি একটি অনাবশ্যক বাড়তি ব্যয়। এ জাতীয় অপচয়ের অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। দ্রুত উন্নয়ন প্রত্যাশী একটি দেশের জন্য এ জাতীয় অনুৎপাদনশীল ব্যয় বা ব্যয়ের স্বভাব সমীচীন নয়। যে দেশের মানুষ নিম্নবিত্ত অবস্থায় থেকে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক উলম্ফনে উদ্বাহু অবস্থানে আতঙ্কিত থাকে সে দেশে রাজপথে অসংখ্য প্রচার প্রগলভ বিলবোর্ড এবং ইদানীং দেখামতে সড়ক দ্বীপে প্রায় প্রতিটি লাইট পোস্টের সঙ্গে ডিজিটাল বিজ্ঞাপন প্রচারের বাহার দেখলে মনে হবে বিপণন বিত্তবৈভবের অর্থনীতি এটি। যে দেশে একই সঙ্গে ডিজিটাল ট্রাফিক লাইট এবং ট্রাফিক পুলিশের পেছনে ব্যয় হয় সে দেশ উন্নয়ন অনুগামী এটা সহজে বলা যাবে না।
ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে মূল্যবান ও কারুকার্যসংবলিত আধুনিক সিগন্যাল বাতি বসানো আছে। ডিজিটাল পদ্ধতির এসব সিগন্যাল সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা ব্যয় স্বাভাবিকভাবেই বেশি। বাস্তবে দেখা যায়, এগুলোর প্রকৃত ব্যবহার একেবারে নেই। বিপুলসংখ্যক ট্রাফিক পুলিশ তাদের মান্ধাতা আমলের আমলাতান্ত্রিক উপস্থিতি দিয়ে, সম্পূর্ণ অযান্ত্রিক পদ্ধতিতে, ‘নিজের ব্যক্তিগত খেয়ালখুশি ও বিচার’মতো ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করে চলছে। একদিকে ডিজিটাল সিগন্যাল লাইটও জ্বলছে আবার তার বিপরীত বলয়ে ট্রাফিকের ম্যানুয়েল (ব্যক্তিগত) কসরতও চলছে। এ অব্যবস্থাপনায় শুধু ট্রাফিক পুলিশের নয়, সড়ক ব্যবহারকারী লাখ লাখ মানুষের সহস্র শ্রমঘণ্টা বিনষ্ট হচ্ছে। মহার্ঘ মূল্যে ক্রয় করা এবং সংস্থাপিত সিগন্যালিং সিস্টেমের ব্যবহারিক কার্যকারিতা না থাকলেও সেগুলো নিয়মিত জ্বলছে, ইনডিকেশন দিয়ে চলছে এবং সেগুলোর সংস্থাপন ও ব্যবস্থাপনা ব্যয় নিশ্চয়ই এখনো বহন করতে হচ্ছে। এই মশহুর অপচয় ও অপব্যয় একটি মধ্যম আয়ের খায়েশধারী দেশের জন্য ব্যয়বহুল বালসুলভ ব্যবস্থা নয় কি? বছর দুই আগে মহানগরের দুই মেয়র মহোদয় সিটি করপোরেশন সিগন্যালিং সিস্টেমে ফিরে যাওয়ার একটা প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু কাদের কারসাজিতে তা দুদিনেই প্রত্যাহার করতে হয় তার বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ ও প্রতিকার প্রয়োজন। প্রয়োজনে একটির পর একটি পয়েন্টে পর্যায়ক্রমে প্রকৃত ব্যবস্থায় ফেরায় স্থির প্রাজ্ঞ থাকতে হবে।
মধ্যম আয়ের দেশ অভিলাষী একটি দেশে সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় আর্থিক ‘অন্তর্ভুক্তি’র দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষ পুষ্টিকর ও উপাদেয় এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু তা শুধু কথার কথায় কিংবা বিদেশে বিশেষ সেমিনারে স্বীকৃতি ও প্রশংসাপ্রাপ্তির মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে বিকশিত হতে পারে না। অন্তর্ভুক্তির দর্শনকে সার্বিকভাবে টেকসই ও বাস্তবায়নযোগ্য করা উচিত। প্রশাসনে, আর্থ-সামাজিক পরিবেশে, সংস্থায়, প্রতিষ্ঠানে, দেশজ সংস্কৃতিতে সর্বত্র পক্ষভুক্তকরণের দৃষ্টিভঙ্গি ও বিচ্যুতকরণ ব্যবস্থাপনার উপস্থিতিতেই অন্তর্ভুক্তি উন্নয়ন দর্শন যাতে ব্যর্থতায় পর্যবসিত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। রাষ্ট্রের সেবা ও সুবিধাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে (ক্ষেত্রবিশেষে) বিশেষ প্রাধান্য প্রাপ্তি এবং অন্যায়-অনিয়মে প্রতিকার, প্রতিবিধানে পক্ষপাতিত্ব কিংবা অপারগতার মধ্যে অন্তর্ভুক্তির মতো কার্যকর দর্শন হারিয়ে যেতে পারে না। শত শত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে দীর্ঘদিন কর্মহীন অবস্থায় বেতন-ভাতাদি আহরণ করতে হচ্ছে, ঊর্ধ্বতন পদে উন্নীত হয়েও স্বপদে কাজ করতে হচ্ছে, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব ঘটার কারণে যে ২-৩ গুণ ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, ব্যাংকিং খাতে বড় দাগে আত্মসাৎ ও লোপাট হচ্ছে, তা তো যে কোনো বিবেচনায় ‘গুডস অ্যান্ড সার্ভিস প্রডিউস না হয়েও অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়।’ নানান অস্থিরতায় উৎপাদন ব্যাহত হয়ে সরবরাহে বিঘœ ঘটে, নানান দুর্ঘটনায়, দুর্নীতিতে, অগ্নিকা-ে যে বিপুল ক্ষতি হয় সেটিই বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি দুই ডিজিটে যাওয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিচ্ছে।
একদিকে বলা হচ্ছে, দেশে মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারীর সংখ্যা কমছে, সার্বিক দরিদ্রতা হ্রাস পেয়েছে, তার বিপরীতে ধনী-দরিদ্র সব শিক্ষার্থীকে ভর্তুকির টাকায় বিনামূল্যে পাঠ্যবই সরবরাহের যৌক্তিকতার যথার্থতার সামঞ্জ্যসতা খুঁজে পাওয়া যায় না। সবার হাতে বই পৌঁছাতে পারার সামাজিক তাৎপর্য নিশ্চয়ই আছে কিন্তু এই আর্থিক ব্যয়ের স্বচ্ছতা ও প্রভাবক ভূমিকা পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে। বিদ্যুতে ব্যাপক ভর্তুকি, শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনায় কার্যকর মনোযোগ দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ ব্যতিরেকে পাবলিক ফান্ড থেকে বেসরকারি খাত সব শিক্ষকের পূর্ণ বেতন-ভাতার ভারবহন এবং ধনী-দরিদ্র, স্কুলগামী/উপস্থিত/অনুপস্থিত নির্বিশেষে সবাইকে পাঠ্যবই দেওয়া বাবদ ব্যয়ে (যার সিংহভাগই ভর্তুকি) চলে যায়। শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন নিশ্চিত না করে এই অর্থব্যয় কাউন্টার প্রডাকটিভ যাতে না হয় সেদিকে লক্ষ রাখা দরকার।
বাংলাদেশের মতো জনসংখ্যাবহুল, স্বল্প কৃষিজমি, বেকারের ভারে ন্যুব্জ, অতি আমদানিনির্ভর অর্থনীতিতে শ্রমঘননির্ভর শিল্প প্রতিষ্ঠা, বৈদেশিক মুদ্রা আনয়নকারী ও প্রযুক্তিবাহী বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু এ দেশে বিগত সাড়ে চার দশকে আসা বৈদেশিক বিনিয়োগের স্থিতিপত্র কষলে দেখা যায় বা যাবে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ সূত্রে বৈদেশিক মুদ্রা ততটা আসেনি যতটা বরং দেশি মুদ্রায় অর্জিত মুনাফা বৈদেশিক মুদ্রায় রূপান্তরিত হয়ে বিদেশে চলে গেছে (যেমন টেলিকম সেক্টরে) বা যাচ্ছে। আসেনি তেমন কোন শ্রমঘন শিল্প। বাংলাদেশের অদক্ষ শ্রমিকরা যখন অধিক অর্থ ব্যয় করে (একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন) স্বল্প মজুরিতে বিদেশ গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে মানবেতর জীবনযাপন করছে এবং দেশে শিক্ষিত বেকারের মিছিল যখন দ্রুত ধাবমান, তখন এ দেশে স্টেট অব আর্টে চালিত কতিপয় বিদেশি শিল্প (যেমন সিমেন্ট, সিগারেট, টেলিকম, শিপিং) গড়ে উঠছে আর গার্মেন্টসহ প্রায় সব বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে মধ্য ও উচ্চপর্যায়ে বিদেশিদেরই মোটা বেতনে অধিক কর্মসংস্থান হয়েছে বা হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে বিদেশিরা বছরে ৬ বিলিয়ন ডলার বেতন, পারিশ্রমিক বাবদ নিয়ে যাচ্ছে (ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস ২১ এপ্রিল ২০১৫)। দুর্ভাগ্যের বিষয়, দেশে রেমিট্যান্স আসছে অধিক অর্থ ব্যয় করে বিদেশে যাওয়া অদক্ষ শ্রমিকদের কাছ থেকে। সেকেন্ড হোম কিংবা মেধা পাচার হয়ে যাওয়া শিক্ষিত, পেশাজীবীদের কাছ থেকে অর্থনীতি কোনো প্রত্যাবসন পায় না। তারা দেশি পুঁজি বা মুদ্রা বরং বিদেশে নিয়ে যান। আবার অন্যদিকে দেশে প্রত্যাবাসিত অর্থের টাকা অলস হয়ে যাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়া থেকে তা বোঝা যায়। আমদানিনির্ভর অর্থনীতিতে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ একটি আনুপাতিক পর্যায় পর্যন্ত হওয়া বা থাকার আবশ্যকতা রয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে সদাচঞ্চল ও সক্রিয় অর্থনীতির জন্য রিজার্ভ অবশ্যই ভালো। কিন্তু অলসভাবে পড়ে থাকার কারণে রিজার্ভের বৃদ্ধি এবং সেই বৃদ্ধির জন্য আত্মতৃপ্তি ও গর্ববোধ বেমানান বৈকি। কেননা ‘প্রশান্তিবোধ’ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের সচেতনতায় শৈথিল্য আনতে পারে। অতিরিক্ত তারল্য বিনিয়োগ ব্যর্থতার পরিচয় বহন করে, মানি সাপ্লাইয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। গত কয়েক বছর ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় হার স্টেটিক রাখতে গিয়ে আত্মঘাতী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সামষ্টিক অর্থ ব্যবস্থাপনায় অলস অতিরিক্ত রিজার্ভ একটা ‘অতি নিরাপদ’ ধারণার জন্ম দিয়ে কর্ম ও দায়িত্ব সচেতনতাকে প্রভাবিত করে ব্যয়ে দায়িত্বহীন ও বলগাহীন করে দিতে পারে।
একটি বৃহৎ দেশ ও অর্থনীতির পেটের মধ্যে, বিরানব্বই শতাংশ উন্মুক্ত সীমান্ত পরিবেষ্টিত ছোট একটি দেশ ও অর্থনীতির সীমান্ত বাণিজ্য অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থাকে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যবস্থাপনাকে কীভাবে পদে পদে প্রভাবিত করতে পারে বাংলাদেশ এর ভূরাজনৈতিক অবস্থান তার বড় উদাহরণ। বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশেষ করে বহির্বাণিজ্য ইনফর্মাল ট্রেড আর অসমর্থিত বাণিজ্য বিনিময়-বিনিয়োগতাড়িত, শাসিত। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের উন্নয়ন অভিমুখী অর্থনীতি হিসেবে পদে পদে হিসেবি, সচেতন ও স্বাবলম্বী হওয়ার বিকল্প নেই। উৎসবের অর্থনীতির এক হিসাবে দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ থেকে বছরে ৩৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের শুধু প্রাণিসম্পদ আমদানি হলেও তার সিংহভাগ লেনদেন চলে হুন্ডি বা অসমর্থিত ব্যবস্থায়। আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে অন্তর্ঘাতমূলক ব্যবস্থা হলো বাংলাদেশে আমদানিকৃত ওইসব পশুর কাঁচা চামড়া সীমান্ত বিনিময় বাণিজ্যে পাচার হয়ে যায়। এ বিষয়গুলোর প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিকারমুখী সংস্কার ব্যবস্থাপনা অত্যাবশ্যক হবে মধ্যম আয়ের দেশের পথে হাঁটতে হলে।
কর জিডিপি রেশিওর কথা এসেই যায় সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় পারদর্শিতার বিচার-বিশ্লেষণ করতে গেলে। বাংলাদেশে কর জিডিপির রেশিও ১০-১১-এর কাছাকাছি ঘুরপাক খাচ্ছে। সাধারণ হিসাব অনুযায়ী জিডিপির ন্যূনতম ১৭ ভাগ কর রাজস্ব আহরিত হওয়ার কথা। হচ্ছে ১০-১১ ভাগ। অর্থাৎ জিডিপির প্রায় ৬ শতাংশ কর (যা জাতীয় বাজেট ঘাটতির চেয়ে বেশি) পরিশোধিত হচ্ছে না বা আহরিত হচ্ছে না অর্থাৎ ন্যায্য কর রাজস্ব আহরিত হলে বাজেটে ঘাটতি হতো না। কর রাজস্ব আহরণের পথে অগ্রসর হওয়ার পথে যুক্তিযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে করদাতা ও আহরণকারীর মনোভঙ্গিকে দায়িত্বশীল, উন্নত ও পরিশীলিতকরণের অবকাশ অনস্বীকার্য। অনস্বীকার্য পদ্ধতি সহজীকরণ ও করদাতা বান্ধবকরণের যৌক্তিকতাও। নাগরিকরা অবশ্যই কর দেবেন। করখেলাপি বা ব্যাহতকারীকে যথাজবাবদিহিতার আওতায় আনতে কঠোর পদক্ষেপ যেমন জরুরি, তেমনি কর দেওয়ার পরিবেশ তৈরি, করদাতা ও আহরণকারীর মধ্যকার যোগাযোগটি অধিকতর স্বচ্ছতা ও সহায়তাধর্মী হওয়া আবশ্যক। প্রয়োজন করের আওতা ও করদাতার সংখ্যা বাড়ানোর জন্য গবেষণালব্ধ পদ পদক্ষেপ গ্রহণে অবিরাম অবিচল থাকা। প্রদত্ত কিংবা আহরিত করের টাকা সবার মধ্যে বাজেট বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমান ও ন্যায্যতার সঙ্গে পুনর্বণটন বা পুনঃপ্রদানে (ঞৎধহংভবৎ) থাকতে হবে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতামূলক পথ বা পন্থা। বাজেট বণ্টন, বরাদ্দ ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা, পাবলিক ফান্ড ব্যবহারের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত না হলে আহরিত করের টাকা ব্যয়ের বিপরীতে গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস যথাযথ উৎপাদিত হবে না। ওই অর্থ অপাত্রে পড়ে অধিকতর অনিয়ম ও দুর্নীতিগ্রস্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, যা প্রকারান্তরে করদানে নিরুৎসাহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে এ পন্থা রীতিমতো হুমকিস্বরূপ।
সব উন্নয়ন ভাবনায় আস্থা একটি বড় জিনিস। বিশেষ করে ব্যাংক ও পুঁজিবাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে নিকট-অতীতের কয়েকটি অর্থবছরে ব্যাংকিং খাতে ও পুঁজিবাজারে যেসব আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে বা হচ্ছে তাকে ‘সামান্য ক্ষতি’ হিসেবে দেখার অবকাশ নেই এ জন্য যে, আখেরে এসব ক্ষত বৃহৎ আকারে ব্যাংকিং সেক্টর, মানি মার্কেট ও পুঁজিবাজারকে আস্থাহীন করে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। একটি প্রাগ্রসরমান অর্থনীতিতে আস্থা বিনষ্টকারী এ ধরনের বিচ্যুতি বিভ্রান্তি বহুমুখী প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে থাকে।
য় ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

About Islamic knowledge

• ঈমান ও আক্বীদাহ
o
• কুর’আন ও তাফসীর
• হাদীস
o
o
o
• মালটিমিডিয়া
o
o
o
o
• ইসলামিক বই
o
• আখলাক | ব্যক্তিত্ব

• এখান থেকে শুরু করুন

রহমান রহীম আল্লাহ্ তায়ালার নামে-

মুল প্রবন্ধঃ ProductiveMuslim.com | অনুবাদঃ মুসাফির শহীদ

আমরা যারা নিয়মিত সালাত আদায় করার চেষ্টা করি, আমাদের সবগুলো সালাত ঠিক থাকলেও ‘ফজরের সালাত’ নিয়ে কিছুটা সমস্যায় পড়তে হয়। অনেকেই অনেক চেষ্টা করেও পারি না ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠতে। কীভাবে করা যায় এ সমস্যার সমাধান? আমি শুধু দু’ একদিনের কথা বলছি না, বলছি প্রতিদিনকার কথা। আসুন জেনে নেই এ ব্যাপারে কিছু কার্যকরী কৌশল।

প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আমরা যখন প্রতিদিন সূরা আল-ফাতিহা তিলাওয়াত করি, দিনে কমপক্ষে ১৭ বার, আমরা এই আয়াতটিও তিলাওয়াত করিঃ
“আমরা একমাত্র তোমারি ইবাদত করি এবং শুধুমাত্র তোমারি সাহায্য প্রার্থনা করি।” [সূরা আল-ফাতিহাঃ ০৫]
আমরা কি সত্যিই আল্লাহর ইবাদত করতে চাই? “অবশ্যই!” তাহলে আল্লাহর সাহায্যও চাই? “হুম!” আবার ফজরের সালাতের জন্যও জেগে উঠতে চাই? “জ্বী, ভাই!” কিন্তু তারপরও আমরা পারি না কেন? কারণ, আমাদের চাওয়ায় আন্তরিকতার অভাব।
আপনার কি কখনও ঘুমাতে যাওয়ার মুহূর্তে এমন অনুভূতি হয়েছে যে, আপনি অবশ্যই ফজরের সালাতের জন্য উঠবেন কিংবা আগে থেকেই আপনি জানতেন সেদিন বেশি ঘুমাবেন? নিচের দৃশ্যপট দুটি কল্পনা করার চেষ্টা করুন। আমি মনে করি, আমরা প্রায় সকলেই এই ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি।
দৃশ্যপটঃ ১
আপনার হৃদয় ঈমানে পরিপূর্ণ, আপনি বিতির পড়েছেন, কিছুটা কুর’আন তিলাওয়াত-ও করেছেন এবং যদিও আপনার হাতে ফজর পর্যন্ত ঘুমানোর জন্য মাত্র দু’ ঘণ্টা সময় আছে, তারপরও জেগে উঠার ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত। কারণ, আপনি আপনার মন, হৃদয় ও দেহকে প্রস্তুত করে নিয়েছেন। এমনকি মাঝে মাঝে ওয়াক্ত পার হয়ে গিয়ে সালাত মিস করার ভয়ে মাঝ রাতেও ঘুম থেকে জেগে উঠেছেন। যদি আপনি এ ধরনের কোন ঘটনার সম্মুখীন না হয়ে থাকেন, তবে এমন সময়ের কথা ভাবুন যেদিন আপনাকে খুব ভোরে বাস কিংবা ট্রেন ধরতে হয়েছিল। আর ভাবুন, কীভাবে আপনার মন, হৃদয় ও দেহ সজাগ ছিল। হয়তো অনেক দেরিতে ঘুমিয়েও জেগে উঠেছিলেন বাস কিংবা ট্রেনের জন্য।
দৃশ্যপটঃ ২
আপনার জীবনে হয়তো এমন অনেক দিন আছে যেগুলোতে আপনি প্রকৃতপক্ষেই বেশি ঘুমাতে চান। যার জন্য আপনি আগে থেকেই ‘অতিরিক্ত ঘুমানোর’ পরিকল্পনা করেন। তারপরও আপনি জেগে উঠেছেন, আর তখনই শুরু হয়েছে ‘Snooze Alarm’ এর সাথে যুদ্ধ এবং আধুনিক শয়তানের কৌশল, “আর মাত্র পাঁচ মিনিট…”
এই দুটি দৃশ্যপটের মধ্যে একটি দৃশ্যপট বর্ণনা করে ‘আপনি অবশ্যই ঘুম থেকে জেগে উঠবেন’ আপনার এ ধরনের গভীর মানসিকতার কথা, আর অন্য দৃশ্যপটটি বর্ণনা করে ‘আপনি ঘুম থেকে উঠতে পারবেন না’ এ ধরনের মানসিকতার কথা। কারণ, আপনার অন্তর এটা চায় না, আর আপনিও শয়তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠার চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত নন। নিচে আমি কিছু কৌশলের কথা বর্ণনা করছি যেগুলো আপনাকে সব সময় দৃশ্যপটঃ ১ এর মত সফলতা অর্জনে সাহায্য করবে ইনশা আল্লাহ্।

আধ্যাত্মিক কৌশল
১. আল্লাহকে চেনাঃ এটা ফজরের সালাতের জন্য জেগে উঠার চাবিকাঠি এবং এক নম্বর কৌশল। আপনি যদি জানেন আপনি কার ইবাদত করছেন, আর এ-ও জানেন যে, তিনি চান আপনি প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে তাঁর ইবাদত করুন, তাহলে আপনি জেগে উঠবেনই! ‘আল্লাহ’ কে- এ ব্যাপারে আমাদের জ্ঞানের কমতিই আমাদেরকে দৃশ্যপট-২ এর দিকে ধাবিত করে। তাই আপনার প্রভুকে জানুন, আর এটাই আপনার চাবিকাঠি।
২. আন্তরিকতাঃ ফজরের সালাতের জন্য জেগে উঠার ব্যাপারে আন্তরিক হোন। নিজেকে শুধু এটুকু বলবেন না যে, ‘যদি আমি ফজরের ওয়াক্তে উঠতে পারি তবে ভালো হবে’, বরং আন্তরিকতার সাথে বলুন, ‘আমি ফজরের ওয়াক্তে জেগে উঠবোই ইনশা আল্লাহ!’
৩. ঘুমাতে যাওয়ার আগে ওযু করাঃ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বারা ইবনে আযেব রা.-কে বলেছিলেন―
«إذا أخذت مضجعك فتوضأ وضوءك للصلاة». مسلم (৪৮৮৪)
যখন তুমি বিছানায় যাবে তখন নামাযের ওযুর মত ওযু করবে। [মুসলিম : ৪৮৮৪]
৪. বিতিরের সালাত ও দু’আঃ বিতিরের সালাত আদায় না করে ঘুমাবেন না, আর বিতিরের সালাত আদায়ের সময় আল্লাহর কাছে অনুনয়-বিনয় করুন যাতে তিনি আপনাকে ঘুম থেকে জেগে উঠতে সাহায্য করেন।
৫. সামান্য কুর’আন তিলাওয়াত করুনঃ মহা গ্রন্থ আল-কুর’আনের মাধ্যমে দিনের সমাপ্তি অবশ্যই আপনার মনোযোগকে ফজরের সালাতের জন্য জেগে উঠার দিকে নিবন্ধিত করবে। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘুমাতে যাওয়ার আগে সূরা আল-সাজদাহ ও সূরা আল-মূলক (৩২ ও ৬৭ নম্বর সূরা) তিলাওয়াত করার পরামর্শ দিতেন।
৬. ঘুমাতে যাওয়ার আগে আল্লাহকে স্মরণ করুনঃ এটা আমার বর্ণনাকৃত প্রথম পয়েন্টেরই অংশ। আর এখানেই আপনি আপনার সকল অনুনয়-বিনয় আল্লাহর কাছে জানাবেন। প্রথম প্রথম দু’আগুলো পড়ার জন্য আপনি ছাপিয়ে নিতে পারেন কিংবা দু’আর বই ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু এক বা দু’ সপ্তাহের মধ্যেই দু’আগুলো আপনার মুখস্থ হয়ে যাবে ইনশা আল্লাহ। আর ঠিক ঘুমিয়ে পড়ার আগেই সেগুলো নিয়মিত পড়বেন।
৭. ফজরের সালাত আদায়কারীদের জন্য ঘোষণাকৃত পুরস্কারগুলোর কথা স্মরণ করুনঃ মুনাফিকের হাত থেকে বেঁচে থাকা, শেষ বিচারের দিন আলোকিত হওয়া, সারাদিন আল্লাহর নিরাপত্তায় থাকা, জীবন থেকে অলসতা কেটে যাওয়া, কর্মঠ হওয়া- এই পুরস্কারগুলোর কথা স্মরণ করুন, ইনশা আল্লাহ আপনি জেগে উঠতে পারবেন।
এছাড়া অন্যান্য যে সব কৌশল আপনাকে ফজরের সালাতের জন্য জেগে উঠতে সাহায্য করবে, সেগুলো হলঃ
• জাগিয়ে দেয়ার জন্য বন্ধু বা পরিবারের সদস্যদের বলাঃ পরিবারের অন্যান্য সদস্য কিংবা বন্ধুদের বলুন আপনাকে জাগিয়ে দিতে। আর পরস্পরকে সাহায্য করুন। যদি আপনি আগে জেগে উঠেন তবে স্বার্থপর না হয়ে অন্যদেরও জাগিয়ে তুলুন।
• দেড় (১.৫) ঘন্টা ঘুমানোর নিয়মঃ একটি গোপন কৌশল জানিয়ে দিচ্ছি, ঘুম বিজ্ঞানে একটি তত্ত্ব আছে যাতে বলা হয়েছে, প্রত্যেক মানুষ তার ঘুমের একটি পূর্ণ চক্র সম্পন্ন করে দেড় ঘন্টায়। কাজেই আপনি যদি দেড় (১.৫ ঘন্টা) এর গুণীতকে (যেমনঃ ১.৫ ঘন্টা, ৩ ঘন্টা কিংবা ৪.৫ ঘন্টা ইত্যাদি) জেগে উঠতে পারেন, তবে আপনি থাকবেন সতেজ ও পুনরিজ্জ্বীবিত। তা নাহলে আপনার মাঝে আলসেমি থেকে যাবে। তাই ফজরের সালাত যদি ভোর পাঁচটায় হয়, আর আপনি বারোটা বাজে ঘুমান, তবে অবশ্যই আপনার এলার্ম সাড়ে চারটায় দিন। কারণ, এতে আপনি সাড়ে চার ঘন্টা ঘুমাতে পারবেন (অবশ্য ঘুম আসতে আপনার যদি সময়ের প্রয়োজন হয় তবে তা যোগ-বিয়গ করে নিবেন)।
• দুপুরে সামান্য ভাত ঘুম দিনঃ আরেকটি কৌশল, যা নেয়া হয়েছে সুন্নাহ ও অনেকের পরামর্শ থেকে, আর তা হল দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর সামান্য ভাত ঘুম দেয়া। মাত্র আধ ঘন্টার ঘুমই আপনাকে করে তুলবে উজ্জীবিত।
কৌশলগুলো মেনে চলার চেষ্টা করুন, ইনশা আল্লাহ আপনি সফল হবেনই।
[toggle title=”Read External link Disclaimer” state=”close” ]এ ওয়েব সাইটের সাথে সম্পৃক্ত অন্য ওয়েব সাইট অথবা অন্য ওয়েব সাইটে প্রদত্ত বিষয়-বস্তুর সাথে এ ওয়েব সাইটে প্রদত্ত বিষয়-বস্তুর সম্পৃক্ততা এবং এর সাথে সম্পৃক্ত অন্য ওয়েব সাইটে প্রবেশ করার ব্যাপারে কোনো দায়-দায়িত্ব কুরআনের আলো বহন করে না। তাতে প্রবেশ করবেন নিজ দায়িত্বেই। কারণ, সে সকল ওয়েব সাইট আমাদের দখলে নেই এবং তার বিষয়-বস্তু কিংবা ওয়েব সংক্রান্ত অন্যান্য প্রযুক্তিও আমাদের আয়ত্বে নেই। এবং এটাও মনে করা যাবে না যে, কুরআনের আলোর সাথে সম্পৃক্ত অন্যান্য ওয়েব সাইটে উপস্থাপিত জ্ঞান ও তথ্যের ব্যাপারে কুরআনের আলো একমত। কুরআনের আলো সে সব ওয়েবের লিংক দিয়ে শুধু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চায়। তাছাড়া সে সব ওয়েব সাইটে প্রদত্ত তথ্যের কোনো দায়-দায়িত্ব কুরআনের আলো কখনও বহন করে না।[/toggle]
(সংগ্রহ করা হয়েছে এই ব্লগ থেকে )

‘আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক’
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Twitter, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। “কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা” [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]
• ট্যাগ
• ফজর
• ফজর সালাত
• ফজরের সালাত
• fojor namaz
• Productivity
শেয়ার করুন


পূর্ববর্তী নিবন্ধসীরাহ কেন পড়া উচিৎ? – তিনি ইসলামের বাস্তব প্রতিচ্ছবি – প্রথম পর্ব
পরবর্তী নিবন্ধজুম’আর দিনের ফযীলত
সম্পর্কিত নিবন্ধলেখক থেকে আরো

বইঃ নামাযে আমরা কি পড়ি ?

কার্যকর অধ্যনের ৫টি ফলপ্রসূ বৈশিষ্ট্য

জুম’আর দিনের ফযীলত
পাঠকের মন্তব্য
• Facebook
• WordPress
0ফ্যানমত
289অনুগামিবৃন্দঅনুসরণ করা
4,627গ্রাহকদেরসাবস্ক্রাইব
অন্য সদস্যরা এখন কি পড়ছেন
• বছরের শ্রেষ্ঠ ১০ দিনে করণীয় ১০ আমল 9 seconds ago
• কুরআনের সহজ সরল বাংলা আনুবাদসহ, তেলাওয়াতের সিডি (mp3) 11 seconds ago
• কীভাবে আপনি জান্নাত লাভ করবেন পর্ব – ১ 13 seconds ago
• মানুষকে ‘মাওলানা’ বলা যাবে কি ? 23 seconds ago
• যে চৌদ্দটি আমলে রিজিক বাড়ে 52 seconds ago
• সদ্য বিবাহিত ছেলে-মেয়ের জন্য অমুল্য উপদেশ 54 seconds ago
• ফেব্রুয়ারী মাসে ঘটে যাওয়া মুসলিম জাহানের কিছু খবর 1 minute, 13 seconds ago
• তাফসীর ইবনে কাসীর – Tafsir Ibn Kasir – [1 to 18 Parts] 1 minute, 20 seconds ago
• আপনি কিভাবে শয়তান থেকে বাঁচবেন – পর্ব ১ 1 minute, 46 seconds ago
• শেইখ মতিউর রহমান মাদানীর তাফসীরের লেকচার সমগ্র 1 minute, 52 seconds ago
UserOnline
471 Online
471 জন ভিজিটর

আজকের জনপ্রিয় পোস্ট
• কুরআনের সহজ সরল বাংলা আনুবাদসহ, তেলাওয়াতের সিডি (mp3)1,971 views
• Translation of Quran in Bangla Language – Free Download1,481 views
• তাফসীর ইবনে কাসীর – Tafsir Ibn Kasir – [1 to 18 Parts]1,183 views
• কুরআনের তেলাওাত সহ বাংলা অনুবাদ (অডিও – mp3)1,165 views
• ডঃ জাকির নায়েকের লেকচার সমগ্র – বাংলা ডাবিং1,063 views
• কীভাবে আপনি জান্নাত লাভ করবেন পর্ব – ১849 views
• Translation of Sahih Bukhari in Bangla Language [All Parts] – Free Download631 views
• কীভাবে আপনি জান্নাত লাভ করবেন পর্ব – ২503 views
• শেইখ মতিউর রহমান মাদানী লেকচার সমূহ488 views
• বিদ‘আতের দশটি কুফল480 views
সর্বাধিক পঠিত

কুরআনের সহজ সরল বাংলা আনুবাদসহ, তেলাওয়াতের সিডি (mp3)
April 29, 2011

আমাদের ঘরের মাঝের আগন্তুক
January 10, 2017

বইঃ আর রাহীকুল মাখতুম – ফ্রী ডাউনলোড
January 13, 2017
জনপ্রিয় বিভাগ
• ইসলামিক বই92
• আখলাক | ব্যক্তিত্ব81
• সাম্প্রতিক বিষয়াদি78
• ইবাদত74
• বোনদের জন্য69
• সিয়াম (রোজা) ও রামাদান68
• পরিবার ও সমাজ61
• সালাত60
• কুর’আন ও তাফসীর48
• এখান থেকে শুরু করুন

© Copyright © 2017 – QuranerAlo.com – All Rights Reserved
সৌভাগ্যময় জীবনের পূর্ণাঙ্গ উপায় পর্ব
শাইখ আব্দুর রহমান বিন নাসের আস-সাদী | অনুবাদক: মোঃ আমিনুল ইসলাম | সম্পাদক: আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া ও মোঃ আব্দুল কাদের
পর্ব -১ | পর্ব – ২
الحمد لله وحده و الصلاة و السلام على من لا نبي بعده و على آله و صحبه أجمعين و من تبعه إلى يوم الدين
সমস্ত প্রশংসা এক আল্লাহর জন্য; আর সালাত (দুরূদ) ও সালাম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি, যার পরে আর কোন নবী নেই এবং শান্তি বর্ষিত হউক তাঁর পরিবার-পরিজন, সাহাবীবৃন্দ ও যারা কিয়ামত পর্যন্ত নিষ্ঠার সাথে তাঁর আনুগত্য করবেন তাদের প্রতি।
১. ঈমান ও সৎকর্ম: সৌভাগ্যময় জীবন লাভের অন্যতম প্রধান ও আসল উপায় হল ঈমান ও সৎকর্ম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ مَنۡ عَمِلَ صَٰلِحٗا مِّن ذَكَرٍ أَوۡ أُنثَىٰ وَهُوَ مُؤۡمِنٞ فَلَنُحۡيِيَنَّهُۥ حَيَوٰةٗ طَيِّبَةٗۖ وَلَنَجۡزِيَنَّهُمۡ أَجۡرَهُم بِأَحۡسَنِ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ﴾ [النحل:97]
মুমিন হয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎকাজ করবে, তাকে আমি নিশ্চয়ই পবিত্র জীবন দান করব এবং তাদেরকে তাদের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করব।”— [ সূরা আন-নাহল: ৯৭]
সুতরাং যে ব্যক্তি ঈমান ও সৎ আমলের সমন্বয় সাধন করতে পারবে, তার জন্য আল্লাহ তা‘আলা ইহকালে পবিত্রময় জীবনের এবং ইহকালে ও পরকালে উত্তম প্রতিদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
আর এর কারণ সুস্পষ্ট। কেননা, মুমিনগণ আল্লাহর প্রতি বিশুদ্ধ ঈমানের ফলে সৎকাজ করে এবং দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য মন-মানসিকতা ও নৈতিক চরিত্রকে সংশোধন করে। তাদের সাথে মৌলিক নীতিমালা রয়েছে, যার দ্বারা তারা তাদের নিকট উপস্থাপিত সকল প্রকার হাসি-আনন্দ, অস্থিরতা ও দুঃখ-বেদনার কারণসমূহ উপলব্ধি করতে পারে।
এই নীতিমালা গ্রহণ, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও উপকারী ক্ষেত্রে তার যথাযথ ব্যবহার দ্বারা তারা রাগ-বিরাগ ও অন্যায়-অপরাধের কেন্দ্রবিন্দু সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারে। সুতরাং এই দৃষ্টিকোণ থেকে তারা যখন তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করবে, তখন এর দ্বারা তাদের জন্য আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি হবে, তার স্থায়িত্ব ও বরকতের ব্যাপারে আশা জাগবে এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারীদের সাওয়াবের প্রত্যাশা তৈরি হবে। এর ফলে সৃষ্ট এই আনন্দের কল্যাণ ও বরকতের দ্বারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রতিষ্ঠিত হবে।
আর তারা উপলব্ধি করতে পারবে দুঃখ-কষ্ট, ক্ষয়-ক্ষতি ও দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে। এ ক্ষেত্রে তাদের পক্ষে প্রতিরোধ করা সম্ভব হলে পরিপূর্ণ প্রতিরোধ করবে; তার কিছুটা লাঘব করা সম্ভব হলে লাঘব করবে এবং প্রতিরোধের কোন উপায় না থাকলে সর্বোত্তম ধৈর্য ধারণ করবে। আর এর দ্বারা তাদের দুঃখ-কষ্টের প্রভাব বলয় থেকে বের হয়ে আসার যথাযথ প্রতিরোধ গড়ে তোলার যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও শক্তি-সামর্থ সঞ্চয় হবে। ধৈর্য এবং প্রতিদান ও সওয়াবের আশা পোষণ করা বড় মর্যাদাপূর্ণ কাজ, যার সাথে দুঃখ-কষ্ট মিশে আছে। আর তার থেকে উত্তরণের উপায় হল আনন্দে থাকা, উত্তম আশা-আকাঙ্খা পোষণ করা এবং আল্লাহর অনুগ্রহ ও সওয়াবের প্রত্যাশা করা। যেমন বিশুদ্ধ হাদিসে রয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
« عَجَبًا لأَمْرِ الْمُؤْمِنِ إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ خَيْرٌ وَلَيْسَ ذَاكَ لأَحَدٍ إِلاَّ لِلْمُؤْمِنِ إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ ».
“মুমিনের কর্ম-কাণ্ডে অবাক হওয়ার বিষয় হল তার সকল কাজই মঙ্গলজনক। সে সুখ-শান্তি লাভ করলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে; ফলে তা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর দুঃখ-কষ্টে পতিত হলে সে ধৈর্য ধারণ করে; ফলে তাও তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর এই সুযোগ মুমিন ব্যতীত অন্য কারও ভাগ্যে জুটে না।”— [মুসলিম, যুহুদ, বাব-১৪, হাদিস নং-৭৬৯২]
সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানিয়ে দিলেন যে, মুমিনের প্রাপ্তি ও কল্যাণ দিগুণ। হাসি-আনন্দ ও দুঃখ-কষ্ট সকল অবস্থায়ই সে তার কর্ম-কাণ্ডের সুফল ভোগ করবে। এ জন্যই আপনি দু’টি জিনিস পাবেন, যেগুলো কল্যাণ বা অকল্যাণের প্রতিনিধিত্ব করে। আবার উভয়ের অর্জন পদ্ধতির মধ্যে ব্যবধানও অনেক। আর এই ব্যবধানটি হবে ঈমান ও সৎকর্মের ক্ষেত্রে উভয়ের পার্থক্য অনুযায়ী। এই গুণের অধিকারী ব্যক্তি এ দু’টি গুণ দ্বারা কল্যাণ ও অকল্যাণ লাভ করে, যা আমরা আলোচনা করেছি; যেমন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, ধৈর্য ধারণ ইত্যাদি। এতে করে তার জন্য আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি হবে; দূর হয়ে যাবে দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা, হৃদয়ের সংকীর্ণতা ও জীবনের দুঃখ-কষ্ট এবং ইহজগতে তার জীবন হয়ে উঠবে অর্থবহ ও সুখময়।
আর অপর ব্যক্তি অপকর্ম, দাম্ভিকতা ও স্বেচ্ছাচারিতা দ্বারা অপরাধ প্রবণ হয়ে উঠে। ফলে তার নৈতিকতা বিনষ্ট হয় এবং অধৈর্য ও অতি লোভের কারণে তার নৈতিক চরিত্র পশুর চরিত্রের মত গড়ে উঠে। এতদ্ব সত্ত্বেও সে মানসিকাবে অশান্ত ও অস্হির। তার এই অস্থিরতার পিছনে বহুবিধ কারণ রয়েছে; যেমন তার প্রিয়াদেরকে হারানোর আশঙ্কা ও তাদের পক্ষ থেকে নতুন নতুন বহু দ্বন্দ্ব-সংঘাতের আশঙ্কা; আরও একটি কারণ হচ্ছে নফসের অস্থিরতা, যা অর্জন করুক আর নাই করুক সার্বক্ষণিক আরও কিছু পেতে আগ্রহবোধ করে। সে যদি নির্ধারিত অংশ পেয়েও যায়, তবুও সে উল্লেখিত কারণে (নতুন নতুন পেতে) অস্থির হয়ে উঠে। আর এসব উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, আতঙ্ক ও অসন্তুষ্টির কারণে সে দুঃখ-কষ্ট অনুভব করে। সুতরাং তার দুর্ভাগ্যময় জীবন, স্বজনপ্রীতি ও চিন্তারোগ এবং ভয়-ভীতি যা তাকে খারাপ অবস্থা ও বীভৎস কষ্টের দিকে ঠেলে দিয়েছে; তার এমন পরিণতি নিয়ে প্রশ্ন করো না। কারণ, সে সওয়াবের আশা করে না। আর তার নিকট ধৈর্যের মত এমন সম্পদও নেই যা তাকে শান্তনা ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দেবে।
আর এ ধরনের প্রত্যেকটি বর্ণনাই অভিজ্ঞতালব্ধ বাস্তব উদাহরণ। যেমন এই শ্রেণীর একটি বিষয়কে নিয়ে যখন আপনি চিন্তা-ভাবনা করবেনে এবং তাকে মানুষের বাস্তব অবস্থার সম্মুখে উপস্থাপন করবেন, তখন ঈমানের দাবি অনুযায়ী আমলকারী মুমিন ব্যক্তি ও যে ব্যক্তি এমন কাজ করেনি তাদের উভয়ের মধ্যে অনেক বড় ব্যবধান দেখতে পাবেন। আর সে বিষয়টি হল, আল্লাহ প্রদত্ত রিযিক ও তিনি তাঁর বান্দাদেরকে বিভিন্ন প্রকারের যেসব অনুগ্রহ ও সম্মান দান করেছেন, তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকতে দীন-শরীয়ত অনেক বেশি উৎসাহ প্রধান করেছে।
সুতরাং মুমিন যখন অসুস্থতা অথবা দারিদ্র অথবা অনুরূপ কোন মান-সম্মান বিনষ্টকারী বিপদ-মুসিবত দ্বারা পরীক্ষার সম্মুখীন হয়, তখন তার ঈমান ও আল্লাহ প্রদত্ত রিযিকের প্রতি সন্তুষ্ট থাকার কারণে আপনি তার চোখে-মুখে আনন্দের ঝলক দেখতে পাবেন এবং সে আন্তরিকভাবে এমন কিছু চাইবে না, যা তার ভাগ্যে নেই। এ অবস্থায় সে তার চেয়ে খারাপ অবস্থাশালী ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে শান্তনা অনুভব করে; তার চেয়ে ভাল অবস্থাশালী ব্যক্তির দিকে তাকায় না। কোন কোন সময় তার আনন্দ-ফুর্তি ও মনের প্রফুল্লতা আরও বৃদ্ধি পায় ঐ ব্যক্তির অবস্থা দেখে, যে ব্যক্তি দুনিয়াবী সকল উদ্দেশ্য হাসিল করেও পরিতৃপ্ত হতে পারেনি।
অনুরূপভাবে যে ব্যক্তির নিকট ঈমানের দাবি অনুযায়ী আমল নেই, তাকে যখন অভাব-অনটন দ্বারা অথবা দুনিয়াবী চাওয়া-পাওয়ার কিছু থেকে বঞ্চিত করার দ্বারা পরীক্ষায় ফেলা হয়, তখন তাকে আপনি দুঃখ-কষ্টে চরম বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে পাবেন।
অপর আরেকটি দৃষ্টন্ত হল: যখন ভয় ও আতঙ্কের কারণসমূহ প্রকাশ পায় এবং মানুষ নানান অসুবিধা দ্বারা কষ্ট অনুভব করে, তখন তার মধ্যে বিশুদ্ধ ঈমান, দৃঢ় মনোবল, মানসিক প্রশান্তি এবং উদ্ভূত এই সঙ্কট মোকাবিলায় চিন্তায়, কথায় ও কাজে সামর্থবান হওয়ার মত গুণাবলী বিদ্যমান থাকে, তবে সে নিজেকে এই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতেও প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। আর এই পরিস্থিতি মানুষকে আনন্দ দেবে এবং তার হৃদয়কে মজবুত করবে।
অনুরূপভাবে আপনি ঈমান হারা ব্যক্তিকে পাবেন সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থায়। যখন সে ভয় ও আতঙ্কের অবস্থায় পতিত হবে, তখন তার হৃদয় অস্বস্তি অনুভব করবে; স্নায়ুতন্ত্রগুলো দুশ্চিন্তায় উত্তেজিত হয়ে উঠবে; তার অভ্যন্তরে বিরাজ করবে ভয় ও আতঙ্ক এবং তার মধ্যে বিরাজ করবে বাহ্যিক আতঙ্ক ও অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা। ফলে তার বাস্তব অবস্থা উদ্ঘাটন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। আর এ শ্রেণীর মানুষের যদি স্বভাবগত উপায়-উপকরণ বা উদ্দেশ্যসমূহ হাসিল না হয়, যা অর্জনে অনেক প্রশিক্ষণের প্রয়োজন; তবে তাদের শক্তি-সামর্থ ভেঙ্গে পড়বে এবং স্নায়ুতন্ত্রগুলো উত্তেজিত হয়ে উঠবে। আর এরূপ হবে ঈমানের ঘাটতির কারণে, যা ধৈর্যধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রখে। বিশেষ করে সঙ্কটকালে ও দুঃখ-দুর্দশার সময়ে।
সুতরাং পুণ্যবান ও পাপী, মুমিন ও কাফির উভয়ে অর্জনীয় বীরত্ব অর্জনে অংশগ্রহণ করে। আরও অংশীদারিত্ব রয়েছে এমন স্বভাব-চরিত্রে, যা ভয়ানক পরিস্থিতিতে সদয় হয় এবং বষয়টিকে সহজ করে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মুমিন ব্যতিক্রম তার ঈমানী শক্তি, ধৈর্য, আল্লাহর উপড় ভরসা ও নির্ভরশীলতা এবং তার সওয়াবের প্রত্যাশার কারণে। এসব বিষয়ের কারণে তার সাহস ও বীরত্ব আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে, আতঙ্কের চাপ কমতে থাকে এবং তার নিকট কঠিন কাজগুলো সহজ হতে থাকে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ إِن تَكُونُواْ تَأۡلَمُونَ فَإِنَّهُمۡ يَأۡلَمُونَ كَمَا تَأۡلَمُونَۖ وَتَرۡجُونَ مِنَ ٱللَّهِ مَا لَا يَرۡجُونَۗ ﴾ [النساء:104]
“যদি তোমরা যন্ত্রণা পাও, তবে তারও তো তোমাদের মতই যন্ত্রণা পায় এবং আল্লাহর নিকট তোমরা যা আশা কর, তারা তা আশা করে না।” — [ সূরা আন-নিসা: ১০৪]
আর তারা আল্লাহর বিশেষ সাহায্য লাভ করে এবং তার সাহায্য সকল প্রকার ভয়-ভীতিকে ওলট-পালট করে দেয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَٱصۡبِرُوٓاْۚ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلصَّٰبِرِينَ ﴾ [الأنفال:46]
“তোমরা ধৈর্যধারণ কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।” —[সূরা আল-আনফাল: ৪৬]

২. সৃষ্টির প্রতি ইহসান: উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতা দূর করার অন্যতম উপায় হচ্ছে কথা, কাজ ও বিভিন্ন প্রকারের সদ্ব্যবহার দ্বার সৃষ্টির প্রতি ইহসান করা। উল্লেখিত প্রতিটি কাজই উত্তম ও ইহসান। এর দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা পুণ্যবান ও পাপীর কর্ম-কাণ্ড অনুসারে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তা দূর করেন। কিন্তু তার থেকে মুমিনের জন্যই পরিপূর্ণ অংশ রয়েছে। আর সে ব্যতিক্রম এই জন্য যে, তার ইহসানের কার্যক্রম পরিচালিত হয় ইখলাসের সাথে সওয়াবের প্রত্যাশায়। ফলে আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য সহজ করে দেন তার প্রত্যাশিত কল্যাণকর কাজের মহৎ উদ্যোগ গ্রহণ করতে। আর তিনি তার ইখলাস ও আন্তরিকতার কারণে সকল দুঃখ-কষ্ট দূর করে দেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ لَّا خَيۡرَ فِي كَثِيرٖ مِّن نَّجۡوَىٰهُمۡ إِلَّا مَنۡ أَمَرَ بِصَدَقَةٍ أَوۡ مَعۡرُوفٍ أَوۡ إِصۡلَٰحِۢ بَيۡنَ ٱلنَّاسِۚ وَمَن يَفۡعَلۡ ذَٰلِكَ ٱبۡتِغَآءَ مَرۡضَاتِ ٱللَّهِ فَسَوۡفَ نُؤۡتِيهِ أَجۡرًا عَظِيمٗا ﴾ [النساء:114]
“তাদের অধিকাংশ গোপন পরামর্শে কোন কল্যাণ নেই, তবে কল্যাণ আছে যে নির্দেশ দেয় দান-খয়রাত, সৎকাজ ও মানুষের মধ্যে শান্তি স্থাপনের; আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় কেউ তা করলে তাকে অবশ্যই আমি মহাপুরস্কার দান করব।” —[সূরা আন-নিসা: ১১৪]
সুতরাং তার থেকে সংঘটিত এ ধরনের সকল কর্মকাণ্ডকে আল্লাহ তা‘আলা কল্যাণময় বলে ঘোষণা করেছেন। আর কল্যাণ মানেই কল্যাণকে স্বাগত জানায় এবং অকল্যাণকে প্রতিরোধ করে। আর সওয়াবের প্রত্যাশী মুমিনকে আল্লাহ মহাপুরস্কার দান করবেন। আর সকল প্রকার বড় পুরস্কারের মধ্যে অন্যতম পুরস্কার হচ্ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, দুঃখ-কষ্ট ইত্যাদি দূর করে দেয়া।
৩. কাজ-কর্ম ও উপকারী জ্ঞান অর্জনে ব্যস্ত থাকা: স্নায়ুতন্ত্রের উত্তেজনা জনিত অস্থিরতা ও পাপ-পঙ্কিলতার মধ্যে ডুবে থাকা মনকে দূরে রাখার অন্যতম উপায় হচ্ছে কাজ-কর্ম ও উপকারী জ্ঞান অর্জনে ব্যস্ত থাকা। কেননা, তা মনকে ঐসব কর্ম-কাণ্ড থেকে বিরত রাখে, যা তাকে অস্থির করে তোলে। এ কারণে সে কোন কোন সময় ঐসব কারণকে ভুলে থাকবে, যা তাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে বাধ্য করে। ফলে সে মানসিকভাবে আনন্দ অনুভব করবে এবং তার মধ্যে কর্মচাঞ্চল্য বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু মুমিন অন্যান্যদের থেকে ব্যতিক্রম তার ঈমান ও ইখলাসের সাথে সওয়াবের প্রত্যাশায় জ্ঞান অর্জন ও শিক্ষাদান ব্যবস্থায় কর্মতৎপর হওয়ার পাশাপাশি উত্তম আমল করার কারণে। যদি তা ইবাদত কেন্দ্রিক হয়, তবে তা ইবাদত হিসেবেই গণ্য হবে। আর তা যদি দুনিয়াবী অথবা প্রকৃতিগত কোন কর্ম-কাণ্ড হয়ে থাকে, তবে তার ফলাফল নিয়তের বিশুদ্ধতার উপর নির্ভর করবে। আর সে যদি এর দ্বারা আল্লাহর আনুগত্যের ব্যাপারে সাহায্য কামনা করে, তবে তার এ কাজের প্রভাবে দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনা দূর হবে। সুতরাং মনের অস্থিরতা ও পাপ-পঙ্কিলতা দ্বারা পরীক্ষা করা হয়; অতঃপর এর কারণে সে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়, তখন তার প্রতিষেধক ঔষধ হচ্ছে: “ঐ কারণটিকে ভুলে থাকা, যা তাকে পাপ-পঙ্কিলতা ও অস্থিরতার মধ্যে ফেলে দিয়েছে এবং নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত রাখা।”
৪. সকল চিন্তাকে দৈনন্দিন কাজের গুরুত্বের উপর ঐক্যবদ্ধ করা: দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতা দূর করার অন্যতম আরও একটি উপায় হল সকল চিন্তাকে চলমান (বর্তমান) দিনের কাজের গুরুত্বের উপর ঐক্যবদ্ধ করা এবং ভবিষ্যতকালীন ও অতীতকালীন কর্ম-কাণ্ড নিয়ে বেশি চিন্তা-ভাবনা বন্ধ করা। এ জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর নিকট সকল প্রকার দুশ্চিন্তা থেকে আশ্রয় চেয়েছেন, যা ইমাম বুখারী ও মুসলিম র. বর্ণিত হাদিসে রয়েছে। সুতরাং অতীতের কোন বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা করে লাভ নেই, যা কোন দিন ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। আর ভবিষ্যতকালে কোন দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কায় দুশ্চিন্তায় মগ্ন থাকাও ক্ষতিকর। অতএব বান্দার দায়িত্ব ও কর্তব্য হল তার আজকের দিন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা এবং তার সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টা ঐ দিন তথা বর্তমান সময়কে ভাল করার কাজে ব্যয় করা। কারণ, এই দিকে মনোযোগ দিলেই তার কর্ম-কাণ্ডসমূহ পরিপূর্ণ ও পরিশুদ্ধ হবে এবং তার দ্বারা বান্দা দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়ে শান্তি লাভ করতে পারবে। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোন দো‘আ করতেন অথবা তাঁর উম্মতকে দো‘আ করতে বলতেন, তখন তিনি আল্লাহর সাহায্য ও অনুগ্রহ কামনার সাথে সাথে যা পাওয়ার জন্য দো‘আ করা হয়, তা অর্জনের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালানোর জন্য উৎসাহ প্রদান করতেন। আর যা দূর করার জন্য দো‘আ করা হত, তা থেকে দূরে সরে থাকতে উৎসাহ দিতেন। কারণ, দো‘আ আমলের মতই। সুতরাং বান্দা দীন ও দুনিয়ার ক্ষেত্রে তার উপকারী বিষয় নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করবে এবং তার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তার প্রতিপালকের নিকট প্রার্থনা করবে। আর এই ব্যাপারে তাঁর নিকট সাহায্য চাইবে। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
« الْمُؤْمِنُ الْقَوِىُّ خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنَ الْمُؤْمِنِ الضَّعِيفِ وَفِى كُلٍّ خَيْرٌ احْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ وَاسْتَعِنْ بِاللَّهِ وَلاَ تَعْجِزْ وَإِنْ أَصَابَكَ شَىْءٌ فَلاَ تَقُلْ لَوْ أَنِّى فَعَلْتُ كَانَ كَذَا وَكَذَا. وَلَكِنْ قُلْ قَدَرُ اللَّهِ وَمَا شَاءَ فَعَلَ فَإِنَّ لَوْ تَفْتَحُ عَمَلَ الشَّيْطَانِ ».
“দূর্বল মুমিনের চেয়ে শক্তিশালী মুমিন উত্তম এবং আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়। প্রত্যেক বস্তুর মধ্যেই কল্যাণ রয়েছে; যা তোমার জন্য উপকারী, তা তুমি কামনা কর এবং আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা কর। আর অক্ষমতা প্রকাশ করো না। কোন বস্তু অর্জন করার পর এ কথা বলো না যে, যদি আমি এরূপ এরূপ কাজ করতাম। বরং বল, আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত এবং তিনি যা ইচ্ছা তাই করেন; যদি তুমি শয়তানের কাজের উপর বিজয় লাভ করতে চাও।” —[মুসলিম, কদর, বাব-৮, হাদিস নং- ৬৯৪৫]
সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক অবস্থায় উপকারী কর্মের কামনা করতে আদেশ করেছেন। তিনি আরও নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহর সাহায্য চাইতে এবং দূর্বলতা ও অক্ষমতার নিকট আত্মসমর্পন না করতে, যা ক্ষতিকারক অলসতা। তিনি আরও আদেশ করেছেন অতীতকালের বাস্তবায়িত বিষয় এবং আল্লাহর ফয়সালা ও তার নির্ধারিত ভাগ্যকে মেনে নেয়ার জন্য।
আর তিনি সকল কর্ম-কাণ্ডকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন: এক প্রকার কাজ হল বান্দা তা পুরাপুরি বা অংশবিশেষ অর্জনের চেষ্টা-প্রচেষ্টায় অথবা তা প্রতিরোধ করতে বা কিছুটা লাঘব করতে সক্ষম। সুতরাং এই ক্ষেত্রে বান্দা তার চেষ্টা-প্রচেষ্টার শুরু করবে এবং মাবুদের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করবে। আরেক প্রকারের কাজ হল, এই ব্যাপারে তার ক্ষমতা নেই। সতরাং তার ব্যাপারে শান্ত ও সন্তুষ্ট থাকবে এবং তা মেনে নেবে। আর কোন সন্দেহ নেই যে, কোন বান্দা এই নীতি মেনে চললে, তা তার আনন্দ অনুভব করা ও দুশ্চিন্তা দূরের কারণ হবে।

৫. বেশি বেশি আল্লাহর যিকির: হৃদয়ের উদারতা ও মনের প্রশান্তির বড় উপায় হল বেশি বেশি আল্লাহর যিকির করা। কারণ, হৃদয়ের প্রশস্ততা ও মনের প্রশান্তি কায়েম করতে এবং তার দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনা দূর করতে যিকিরের আশ্চর্য ধরনের প্রভাব রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ أَلَا بِذِكۡرِ ٱللَّهِ تَطۡمَئِنُّ ٱلۡقُلُوبُ ﴾ [الرعد: 28]
“জেনে রাখ, আল্লাহর স্মরণেই চিত্ত প্রশান্ত হয়।” —[সূরা আর-রা‘দ: ২৮]
সুতরাং বান্দার স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের লক্ষ্য অর্জন ও তার প্রত্যাশিত সওয়াব ও প্রতিদান পেতে আল্লাহর যিকির বা স্মরণের বিরাট প্রভাব রয়েছে।
৬. আল্লাহর নিয়ামতের আলোচনা: অনুরূপভাবে (সৌভাগ্যময় জীবনের অন্যতম উপায় হল) আল্লাহর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সকল প্রকার নিয়ামতের আলোচনা করা। কারণ, তাঁর নিয়ামত সম্পর্কে জানা এবং তার আলোচনা দ্বারা তিনি বান্দার দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনা দূর করেন। আর তিনি বান্দাকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য উৎসাহিত করেন; যেহেতু বান্দা সর্বোচ্চ মরতবা ও মর্যাদার অধিকারী, যদিও সে অভাব-অনটন, অসুস্থতা প্রভৃতি প্রকারের বালা-মুসিবতে থাকে। কারণ, বান্দা যখন তার উপর আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামতের মুখোমুখি হয়, তখন তা গণনা বা হিসাব করা সম্ভব হবে না। আর তিনি সাধারণত বান্দা যেসব অপছন্দনীয় ও কষ্টকর কর্ম-কাণ্ডের শিকার হয়, তাও বর্ণনা করে দিয়েছেন; যে অপছন্দনীয় বস্তু বা বিষয়ের সাথে নিয়ামতের কোন সম্পর্ক নেই। বরং বিপদ-মুসিবত দ্বারা যখন আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাকে পরীক্ষা করেন; বান্দও সেই ব্যাপারে ধৈর্য, সন্তুষ্টি ও মেনে নেয়ার মত দায়িত্ব পালন করে, তখন বিপদের সেই চাপটি সহ্য করা সহজ হয়ে যায়। আর বান্দার সওয়াব ও প্রতিদানের আশা এবং ধৈর্য ও সন্তুষ্টির কর্তব্য পালন করার মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত করার দ্বারা সে তিক্ত বস্তুকে মিষ্টি বস্তু মনে করে। ফলে প্রতিদানের স্বাদ তাকে ধৈর্যের তিক্ততার কথা ভুলিয়ে দেয়।
চলবে………….

‘আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক’
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Twitter, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। “কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা” [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]
শেয়ার করুন


কীভাবে আপনি জান্নাত লাভ করবেন পর্ব 1
উসুফ ইবন মুহাম্মাদ আল ‘উয়াইয়েদ | অনুবাদ: ড. মোহাম্মাদ মানজুরে ইলাহী | সম্পাদনা: ড. আবু বকর মোহাম্মদ যাকারিয়া
ভূমিকা
সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি জান্নাতের ওয়াদা করেছেন এবং জাহান্নামের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন….. সুতরাং যে ব্যক্তি জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত হলো এবং জান্নাতে প্রবেশ করলো সে মহা সফলতা অর্জন করলো…। আবারো ঐ আল্লাহ পাকের প্রশংসা যিনি আমাদেরকে জান্নাতের পথে আহবান করছেন। আল্লাহ সুবহানাহু বলেন:
﴿ وَٱللَّهُ يَدۡعُوٓاْ إِلَى ٱلۡجَنَّةِ وَٱلۡمَغۡفِرَةِ بِإِذۡنِهِۦۖ﴾ [البقرة: من الآية 221] .
‘‘আল্লাহ তাঁর অনুমতিক্রমে জান্নাত ও মাগফিরাতের দিকে আহবান করছেন’’। [সূরা আল বাক্বারাহ: ২২১]
তিনি জান্নাতের বর্ণনা দিয়েছেন যে, জান্নাতে আছে সুমিষ্ট পানির নহর, দুধের ঝর্ণাধারা যার স্বাদের কোন পরিবর্তন নাই, শরাবের নহর যা পানকারীদের জন্য উপাদেয় এবং খাঁটি মধুর স্রোতস্বিনী। এর তলদেশ দিয়ে বিভিন্ন প্রকার নদী নালা প্রবাহিত। এখানে বাসনা অনুযায়ী, চোখজুড়ানো সকল চাহিদা পূর্ণ হবে। প্রত্যেক মু’মিন তার ঈমানদার সন্তানাদি, সৎকর্মশীল ব্যক্তি এবং শহীদগণের সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভে ধন্য হবে। আর সৎকর্মশীল ব্যক্তিবর্গ ও শহীদগণ কতই না উত্তম বন্ধু! বরং মু’মিন ব্যক্তি এর চেয়ে আরো উত্তম বস্তু লাভ করবে। আর তা হলো আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সাক্ষাৎ এবং তাঁর হাওযের পাশে অবস্থান। অধিকন্তু সেখানে সবচেয়ে উত্তম ও উৎকৃষ্ট নেয়ামত প্রাপ্তির যে ওয়াদা আল্লাহ করেছেন তা পূর্ণ হবে যখন মু’মিন ব্যক্তি তার প্রভুকে কোন পর্দা ছাড়াই সরাসরি দেখতে পাবে।
হ্যাঁ, এ হচ্ছে জান্নাত, যার প্রতিশ্রুতি দেয়ার কারণেই মানুষ তাদের রবের একত্ববাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। এ কারণেই তারা একমাত্র আল্লাহর ইবাদাত করে। এ জান্নাত লাভের আশায় মুসলিম ব্যক্তি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে বায়‘আত নিয়েছে।
এ জান্নাতই শেষ গন্তব্য বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু যার ইন্তেযার করছেন, যেদিন বেলালকে উত্তপ্ত বালুর উপর চিৎ করে শুইয়ে বুকের উপর পাথর চাপা দেয়া হয়েছিল এবং তিনি মুশরিকদের দেয়া এ কষ্টে ধৈর্য্যধারণ করেছিলেন ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাসজিদে আযান দেয়া অব্যাহত রেখেছিলেন।
এ জান্নাতই হচ্ছে সে বিশাল গনীমত আম্মার রাদিয়াল্লাহু আনহু যার জন্য অপেক্ষা করেছেন, যে দিন তাকে আগুন দিয়ে শাস্তি দেয়া হচ্ছিল, তার পিতা মাতাকে হত্যা করা হয়েছিল – যারা ছিলেন ইসলামের প্রথম শহীদ। এ জান্নাত পাওয়ার আশাই উমাইর ইবন হামামকে অহুদ যুদ্ধের দিন কয়েকটি খেজুর খাওয়া থেকে বিরত রেখেছিল; যেহেতু তিনি আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য পাগলপারা হয়ে উঠেছিলেন। আল্লাহও প্রতিদানে তাকে দ্রুত শাহাদাত নসীব করেছেন। এ জান্নাতের আশা-ভরসায় আল্লাহর ভয়ে প্রত্যেক আবেদের চোখ থেকে পানি ঝরে। প্রত্যেক মুজাহিদ আল্লাহর জন্য নিজের জান বিক্রি করে দেয়। প্রত্যেক আলেম স্বীয় ইলম অনুযায়ী আমল করে ও অন্যকে শিক্ষা দেয়। এ কারণেই ঈমানদার ব্যক্তি সালাত ও অন্যান্য ফরযসমূহ আদায় করে, আর মানুষ তার ঈমানের সাক্ষ্য দেয়। সে আল্লাহর আদেশ নিষেধ মেনে চলে। তার অন্তর দ্বীন, মাসজিদ এবং আল্লাহর প্রতিদানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়ে থাকে। তবে হ্যাঁ, এ জান্নাত পাওয়ার কতিপয় কারণ রয়েছে। আর প্রত্যেকে একটি উপায় অবলম্বন করবে যাতে সে জান্নাতের যে কোন একটি দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারে। সুতরাং কোন মু’মিন তার সালাতের কারণে জান্নাতে যাবে, কেউবা রোযা বা যাকাত বা হজ্জ কিংবা উত্তম চরিত্র, কেনাবেচা ও জিহাদের কারণে জান্নাতে যাবে। বরং আল্লাহর রহমাত ও অনুগ্রহ এত প্রশস্ত যে, কোন কোন বান্দাকে তিনি জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে জান্নাত দান করবেন শুধু এ কারণে যে, সে ব্যক্তি দুনিয়াতে রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দিয়ে মানুষকে কষ্টমুক্ত করেছে, তৃষ্ণার্ত পা্রণীকে পানি পান করিয়েছে এবং বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে।
সুতরাং জান্নাতে প্রবেশের উপায় যদি চয়ন করতে চান, তাহলে কুরআনের আয়াত ও হাদীসের সুললিত ও সুরভিত বাণী আপনার সমীপে পেশ করা হচ্ছে। সাধ্যানুযায়ী উপায় আপনি চয়ন করুন। হতে পারে এ কারণে আপনি একাধিক দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশের সুযোগ লাভ করতে পারবেন। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে এমন সুসংবাদ প্রদান করেছিলেন।
জান্নাত লাভের উপায়সমূহ
১. জান্নাতে প্রবেশের প্রথম উপায় হলো: শাহাদাত অর্থাৎ একথার সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া আর সত্য কোন ইলাহ নেই, যিনি একক, যার কোন শরীক নেই। আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। সুতরাং যে ব্যক্তি ইসলামের এ সাক্ষ্য প্রদান করবে, এর যাবতীয় আরকান পালন করবে, আর এক অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদাত করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
উবাদাহ ইবন সামেত রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করে বলেন:
«من شهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له وأن محمدا عبده ورسوله، وأن عيسى عبده ورسوله وكلمته ألقاها إلى مريم وروح منه ، والجنة حق والنار حق أدخله الله الجنة ما كان من العمل» (متفق عليه).
‘‘যে ব্যক্তি এ কথার সাক্ষ্য দিবে যে, ‘এক অদ্বিতীয় আল্লাহ ছাড়া আর কোন প্রকৃত ইলাহ নেই, তাঁর কোন শরীক নেই, আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল, ঈসা আলাইহিস সালাম তাঁর বান্দা ও রাসূল এবং আল্লাহর কালেমা যাকে তিনি মারিয়ামের নিকট প্রেরণ করেছেন এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে রূহ, আর জান্নাত সত্য, জাহান্নাম সত্য’। আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, তার আমল যাই হোক না কেন’’। [বুখারী ও মুসলিম]
আল্লাহ বলেন:
﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ قَالُواْ رَبُّنَا ٱللَّهُ ثُمَّ ٱسۡتَقَٰمُواْ فَلَا خَوۡفٌ عَلَيۡهِمۡ وَلَا هُمۡ يَحۡزَنُونَ ١٣ أُوْلَٰٓئِكَ أَصۡحَٰبُ ٱلۡجَنَّةِ خَٰلِدِينَ فِيهَا جَزَآءَۢ بِمَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١٤ َ﴾ [الأحقاف: 13-14]
‘‘নিশ্চয়ই যারা বলে, আমাদের রব আল্লাহ, অতঃপর এ কথার উপর সুদৃঢ় থাকে। তাদের কোন ভয় ভীতি নেই, তাদের কোন চিন্তা নেই। তারাই জান্নাতবাসী, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। এ জান্নাত তারা তাদের কৃত কর্মের ফল স্বরূপ লাভ করবে। [সূরা আল আহক্বাফ: ১৩-১৪]
আয়াতে উল্লেখিত الاستقامة শব্দটির অর্থ হল: আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করা। আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
«كل أمتي يدخلون الجنة إلا من أبى، فقالوا يا رسول الله ومن أبى؟ قال من أطاعني دخل الجنة ومن عصاني فقد أبى» (رواه البخاري).
‘‘জান্নাত পেতে আগ্রহী নয় এমন ব্যক্তি ছাড়া আমার সকল উম্মাতই জান্নাতে প্রবেশ করবে। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! কে এমন ব্যক্তি আছে যে জান্নাতে যেতে অস্বীকৃতি জানায়? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করবে সে জান্নাতে যাবে, আর যে আমার নাফরমানী করবে ও অবাধ্য হবে, সেই জান্নাতে যেতে অস্বীকার করে’’। [বুখারী ]
২. আল্লাহর সুন্দর সুন্দর নামসমূহ মুখস্থ করা এবং এ নামগুলো সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা জান্নাতে প্রবেশের একটি উপায়। আবু হুরায়রা রাদি আল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
«إن لله تسعة وتسعين اسما، مائة إلا واحدا، مَن أحصاها دخل الجنة».
‘‘আল্লাহর নিরানববইটি নাম আছে। যে ব্যক্তি এ নামগুলো গণনা করবে, সে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে’’। [বুখারী ও মুসলিম]
৩. আল কুরআনের অনুসারীগণ, যারা আল্লাহর আহল ও তাঁর খাস বান্দা, কুরআন তাদের জান্নাতে প্রবেশের উপায় হবে। আবদুল্লাহ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
«يقال لصاحب القرآن: اقرأ وارتق، ورتل كما كنت ترتل في الدنيا، فإن منزلتك عند آخر آية تقرأ بها» (رواه الترمذي وأبو داود وابن ماجة وصححه الألباني).
‘‘আলকুরআনের সঙ্গীকে বলা হবে: কুরআন পাঠ কর, আর মর্যাদার উচ্চশিখরে আরোহণ কর। আর তেলাওয়াত করতে থাক। যেমন দুনিয়াতে তেলাওয়াত করছিলে; কেননা তোমার মর্যাদা হলো কুরআনের শেষ আয়াত পর্যন্ত যা তুমি পাঠ করবে’’। [তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনে মাযাহ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে আরো প্রমাণিত রয়েছে যে, কতিপয় সূরা ও আয়াত জান্নাতে প্রবেশের মাধ্যম।
আবু উমামা থেকে বর্ণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
«من قرأ آية الكرسي في دبر كل صلاة مكتوبة لم يمنعه من دخول الجنة إلا أن يموت».
‘‘যে ব্যক্তি প্রতি ফরয সালাতের পর আয়াতুল কুরসী পাঠ করবে, মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সে জান্নাতবাসী হবে’’।[নাসায়ী, তাবারানী, ইবনে হিববান এটি বর্ণনা করেছেন ও আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন]
আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
«سورة من القرآن ما هي إلا ثلاثون آية خاصمت عن صاحبها حتى أدخلته الجنة وهي تبارك».
‘‘৩০ আয়াত বিশিষ্ট কুরআনের একটি সূরা, এর পাঠকের জন্য জান্নাতে না নেয়া পর্যন্ত সুপারিশ করতেই থাকবে। সূরাটি হল তাবারাকা’’ (তথা সূরা মূলক)। [তাবারানী এটি বর্ণনা করেছেন এবং আলবানী বিশুদ্ধ বলেছেন]
আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, এক ব্যক্তি মাসজিদে কোবায় আনসার সাহাবীদের ইমামতি করতেন। তিনি প্রতি রাকাতেই قل هو الله أحد সূরাটি পাঠ করতেন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন: তুমি কোন কারণে প্রতি রাকাতে এ সূরাটি পাঠ কর? উত্তরে সে সাহাবী বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি এ সূরাটি খুব পছন্দ করি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন, এ সূরাটি পছন্দ করার কারণেই তুমি জান্নাতে প্রবেশ করবে। [ইমাম বুখারী হাদীসটি সনদবিহীন বর্ণনা করেছেন। তিরমিযী ও আলবানী হাদীসটিকে উত্তম ও সহীহ বলেছেন]

৪. যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ইলম অর্জন করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথকে সহজ করে দেন।
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
«من سلك طريقا يلتمس فيه علما سهل الله له به طريقا إلى الجنة» (مسلم).
‘‘যে ব্যক্তি ইলম হাসিলের উদ্দেশ্যে রাস্তায় বের হয়, এর বিনিময়ে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সুগম করে দেন’’। [মুসলিম]
৫. আল্লাহ তা’লার যিক্র: আল্লাহর তাসবীহ (স্তুতি), তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) এবং তাকবীরের ফযীলত সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
«لقيتُ ليلة أسري بي إبراهيمَ، فقال يا محمد، أقرئ أمتك مني السلام وأخبرهم أن الجنة طيبة التربة، عذبة الماء، وأنها قيعان وأن غراسها سبحان الله والحمد لله ولا إله إلا الله والله أكبر».
‘‘মেরাজের রাতে ইবরাহীম আলাইহিস্ সালামের সাথে আমার সাক্ষাৎ হলে তিনি বললেন, হে মুহাম্মাদ! তোমার উম্মাতকে আমার সালাম বলো এবং তাদেরকে এ সংবাদ দাও যে, জান্নাতের মাটি সুন্দর, পানি মিষ্টি, আর জান্নাত সমতল এবং এর বৃক্ষরাজি সুবহানাল্লাহ, আলহামদুল্লিাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার’’।[তিরমিযী এটি রেওয়ায়েত করেছেন এবং আলবানী তাকে উত্তম বলেছেন]

৬. জান্নাতে প্রবেশের উপায়সমূহের মধ্যে আরো একটি হল প্রতি সালাতের পর আল্লাহর যিক্র পাঠ: আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, গরীব মুহাজিরগণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এসে বললেন. ধনী ও বিত্তবান লোকেরা তো আল্লাহর নিকট সুউচ্চ মর্যাদা এবং নানাবিধ নেয়ামত লাভে ধন্য হয়ে গেল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, কীভাবে? তারা জবাব দিলেন যে, আমরা যেমন সালাত আদায় করি তারাও সালাত আদায় করে। আমরা যেমন রোযা পালন করি তারাও রোযা পালন করে। কিন্তু তারা দান সদকা করে আমরা তা করতে পারি না। তারা গোলাম আযাদ করে আমরা তা করি না। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: আমি কি তোমাদেরকে এমন কিছু শিক্ষা দেব, যার দ্বারা তোমরা তোমাদের অগ্রবর্তীদের সমকক্ষ হবে, আর তোমাদের পরবর্তীদের চেয়ে অগ্রগামী হবে? আর তোমাদের চেয়ে উত্তম কেউ হবে না, সে ব্যক্তি ছাড়া যে তোমাদের মতই এ কাজগুলো করবে। তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদেরকে সে কাজ শিক্ষা দিন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সালাতের পর ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আল্লাহু আকবার, আর ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ পাঠ করবে’’। [মুসলিম]
৭. অনুরূপভাবে অযুর পর কালিমায়ে শাহাদাত পাঠও জান্নাতে যাওয়ার উপায়। উকবাহ ইবন আমের বলেন: আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমাদের কেউ সুন্দর করে অযু করার পর যদি বলে:
«أشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له وأن محمدا عبده ورسوله».
তার জন্য জান্নাতের ৮টি দরজাই উন্মুক্ত করে দেয়া হবে, সে যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা জান্নাতে প্রবেশ করবে। [মুসলিম]
৮. لا حول ولا قوة إلا بالله এ দো‘আ হল জান্নাতের ভান্ডার: আবু মুসা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: আমি কি তোমাকে জান্নাতের ভান্ডার সমূহের একটি ভান্ডার সম্পর্কে অবহিত করব? আমি বললাম: হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বলেন, বলো: لا حول ولا قوة إلا بالله অর্থ্যাৎ: ‘‘আল্লাহর আশ্রয় ও শক্তি ছাড়া আর কারো কোন ক্ষমতা নাই’’। [বুখারী, মুসলিম]
৯. আল্লাহর নিকট জান্নাত চেয়ে দো‘আ করলে জান্নাত তখন আমীন আমীন বলে সমর্থন করে।
আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যাক্তি ৩ বার আল্লাহর নিকট জান্নাত চায়, জান্নাত তখন বলে: হে আল্লাহ্! ঐ ব্যাক্তিকে জান্নাতে প্রবেশ করাও। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ৩ বার জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি চেয়ে দো‘আ করে, জাহান্নাম বলে: হে আল্লাহ্ ঐ ব্যক্তিকে দোযখের আগুন থেকে মুক্তি দাও। [তিরমিযি, নাসায়ী, ইবনু মাজাহ এটি বর্ণনা করেছেন, আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন]।
১০. আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাগফেরাত কামনার দো‘আকে সাইয়্যেদুল্ ইসস্তিগফার বা গুনাহ মাফ চাওয়ার প্রধান দো‘আ বলে অভিহিত করেছেন এবং জান্নাতে প্রবেশের কারণ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সুতরাং প্রিয় পাঠক! দো‘আটি মুখস্থ করুন এবং সকাল সন্ধ্যা পাঠ করুন।
শাদ্দাদ ইবন আওস রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ননা করেন তিনি বলেন, ইস্তেগফারের প্রধান দো‘আ হলো:
«اللهم أنت ربي لا إله إلا أنت خلقتني وأنا عبدك وأنا على عهدك ووعدك ما استطعت، أعوذ بك من شر ما صنعت، أبوء لك بنعمتك عليَّ وأبوء لك بذنبي فاغفر لي فإنه لا يغفر الذنوب إلا أنت».
‘‘হে আল্লাহ! তুমি আমার রব। তুমি ছাড়া আর কোন সত্য মা’বুদ নাই। তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ, আমি তোমার বান্দা। আমি তোমার ওয়াদা ও অঙ্গিকারের উপর সাধ্যানুযায়ী প্রতিষ্ঠিত। আমি অনিষ্টকর যা কিছু করেছি তা থেকে তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আমার উপর তোমার যে নেয়ামত আছে তার স্বীকৃতি দিচ্ছি। তোমার নিকট আমার গুনাহের স্বীকৃতি দিচ্ছি। সুতরাং তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও; কেননা তুমি ছাড়া আর কেউ গুনাহ ক্ষমা করতে পারে না’’।
যে ব্যক্তি বিশ্বাসের সাথে দিনে এ দো‘আ পাঠ করে, সন্ধ্যা হওয়ার পূর্বেই যদি তার মৃত্যু হয়, তাহলে সে জান্নাতবাসী হবে। আর যে ব্যক্তি বিশ্বাসের সাথে রাতে পাঠ করে এবং সকাল হওয়ার পূর্বেই মারা যায়, সে জান্নাতবাসী হয়’’। [বুখারী]
১১. সালাত হলো দ্বীনের খূঁটি। আল্লাহ আমাদের উপর দিন রাতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন। আল্লাহর নিকট প্রিয় ইবাদাত হলো তাঁর ফরয কাজসমূহ। যে ব্যক্তি আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী ফরয কাজসমূহ আদায় করে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। ওবাদা ইবন সামেত রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ বান্দাদের উপর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি সালাতসমূহের হকে কোন প্রকার কমতি ও তাচ্ছিল্য না করে সঠিকভাবে সেগুলো আদায় করে, তার জন্য আল্লাহর এ অঙ্গিকার যে, তিনি তাকে জান্নাত দান করবেন। আর যে এগুলোর ব্যাপারে কমতি ও তাচ্ছিল্য করে তা আদায় করবে, তার প্রতি আল্লাহর কোন অঙ্গিকার নেই। তিনি চাইলে তাকে শাস্তিও দিতে পারেন, আবার ক্ষমাও করতে পারেন’’। [হাদীসটি মোয়াত্তায়ে মালিক, মুসনাদে আহমাদ, সুনানে আবু দাউদ, নাসায়ী ও ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে। আর আলবানী একে সহীহ বলেছেন]।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজর ও আসরের দু’ ওয়াক্ত সালাতের পৃথক মর্যাদা দিয়ে এগুলোর নাম দিয়েছেন ‘বারাদাইন’ অর্থাৎ দু’টি শীতল ওয়াক্তের সালাত। আবু মূসা আশআ’রী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
«من صلى البردين دخل الجنة»
অর্থাৎ ‘‘যে ব্যক্তি শীতল ওয়াক্তের দুই সালাত (ফজর -আসর) আদায় করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’’।[বুখারী ও মুসলিম]
১২. কতিপয় সুন্নাত ও নিয়মিত সালাত আছে যেগুলো দ্বারা ফরয সালাতগুলোর কমতি পূরণ করা হয় এবং এগুলোর পুরস্কার স্বরূপ আল্লাহ আপনার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করেন। সুতরাং সেগুলো আদায়ের ব্যাপারে যত্নবান হোন, তাহলে আল্লাহ আপনাকে হেফাযত করবেন।
উম্মে হাবীবা রাদি আল্লাহ আনহা থেকে বর্ণিত যে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন: ‘‘যে মুসলিম ব্যক্তিই ফরযের অতিরিক্ত প্রতিদিন ১২ রাকাত সুন্নাত সালাত আল্লাহর জন্য আদায় করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের মধ্যে একটি ঘর নির্মাণ করবেন’’। [মুসলিম]
এ সুন্নাত সালাতগুলোর বর্ণনা এভাবে এসেছে: ‘‘যোহরের পূর্বে ৪ রাকাআত, পরে ২ রাকাআত, মাগরিবের পরে ২ রাকাআত, ইশার পর ২ রাকাআত এবং ফজরের পূর্বে ২ রাকাআত’’।
১৩. কোন ব্যক্তি যখন অযু করে, তখন তার জন্য ২ রাকাআত সালাত আদায় করা সুন্নাত। এ সালাত যখন সে নিষ্ঠার সাথে ও একাগ্রচিত্তে আল্লাহর উদ্দেশ্যে আদায় করে, তখন তার জন্য জান্নাত অপরিহার্য হয়ে যায়।
উকবাহ ইবন আমের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
«ما من أحد يتوضأ فيحسن الوضوء ويصلي ركعتين يقبل بقلبه ووجهه عليهما إلا وجبت له الجنة» (رواه مسلم).
‘‘ যে ব্যক্তিই সুন্দর করে অযু করে উপস্থিত মন নিয়ে ও একাগ্রচিত্তে দু’ রাকাআত সালাত আদায় করবে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে’’। [মুসলিম]
১৪. দ্বীন ইসলামের উত্তম দিকগুলোর মধ্যে রয়েছে: সালামের প্রসার করা, খাদ্য দান করা এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা। আর সত্যবাদীদের গুণাবলীর মধ্যে রয়েছে তারা হল রাতের নফল সালাত আদায়কারী। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
﴿ كَانُواْ قَلِيلٗا مِّنَ ٱلَّيۡلِ مَا يَهۡجَعُونَ ١٧ وَبِٱلۡأَسۡحَارِ هُمۡ يَسۡتَغۡفِرُونَ ١٨ َ﴾ [الذاريات: 17-18]
‘‘তারা রাতের কম অংশই নিদ্রায় মগ্ন থাকে। আর শেষ রাতে তারা আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে’’। [সূরা আযযারিয়াত: ১৭-১৮]
যারা উপরোক্ত কাজগুলো করবে, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। আবদুল্লাহ ইবন সালাম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«يا أيها الناس أفشوا السلام وأطعموا الطعام وصلوا الأرحام وصلوا بالليل والناس نيام تدخلوا الجنة بسلام».
‘‘ হে মানব সকল! সালামের প্রসার কর। খাদ্য দান কর। আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখ। লোকেরা ঘুমিয়ে গেলে রাতে নফল সালাত আদায় কর। তাহলে শান্তির সাথে জান্নাতে প্রবেশ করবে’’। [তিরমিযী, ইবনে মাজাহ ও আহমাদ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন]।
১৫. ফজরের সালাতসহ অন্যান্য সালাতের উদ্দেশ্যে মাসজিদে গমন করার কারণে আল্লাহ তা’লা আপনার জন্য জান্নাতে মেহমানদারীর ব্যবস্থা করবেন। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
«من غدا إلى المسجد أو راح أعد الله له في الجنة نزلا كلما غدا أو راح».
‘‘যে ব্যক্তি সকাল সন্ধ্যা মাসজিদে যায়, তার জন্য আল্লাহ সকাল বিকাল যখনই সে গমন করে জান্নাতের মধ্যে মেহমানদারীর ব্যবস্থা করেন’’। [বুখারী ও মুসলিম]
১৬. সালাতের কাতারে মুসল্লীদের মাঝে যে ফাঁক দেখা যায় তা আপনি পূরণ করলে আপনার জন্য জান্নাতে একটি ঘর তৈরী করা হয়। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
«من سد فرجة في صف رفعه الله بها درجة وبنى له بيتًا في الجنة».
‘‘যে ব্যক্তি সালাতের কাতারের ফাঁকা জায়গা পূরণ করলো, এর দরূন আল্লাহ তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেবেন এবং তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করবেন’’। [তাবারানী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং আলবানী একে সহীহ বলেছেন]।
১৭. আপনি যদি মাসজিদ নির্মাণ করেন অথবা মাসজিদ নির্মাণে সহযোগিতা করেন, তাহলে আল্লাহ আপনার জন্য জান্নাতের মধ্যে একটি ঘর নির্মাণ করবেন। উসমান ইবন আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন:
«من بنى مسجدا لله بنى الله له في الجنة مثله» (متفق عليه).
‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য মাসজিদ তৈরী করলো, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে অনুরূপ ঘর তৈরী করবেন’’। [বুখারী ও মুসলিম]
১৮. দিনরাতে পাঁচবার মুয়াযযিনের আযানের জবাব দেয়া জান্নাতে প্রবেশের আরো একটি কারণ। উমার ইবন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘‘মুয়াযযিন যখন আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার (২বার) বলে, তখন তার উত্তরে কেউ যদি অনুরূপ বলে; অতঃপর মুয়াযযিন (أشهد أن لا إله إلا الله) বললে সে তার মতো (أشهد أن لا إله إلا الله) বলে। মুয়াযযিন যখন (أشهد أن محمدا رسول الله)বলে, সেও তাই বলে। তারপর (حي على الصلاة) বললে সে (لا حول ولا قوة إلا بالله) বলে এবং (حي على الفلاح) বললেও সে (لا حول ولا قوة إلا بالله) বলে। তারপর মুয়াযযিন আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার বললে সেও আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার বলে। এরপর মুয়াযযিন যখন বলে (لا إله إلا الله) তখন সেও (لا إله إلا الله) আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে বললে জান্নাতে প্রবেশ করবে’’। [মুসলিম]
১৯. প্রিয় পাঠক! আপনি যদি আল্লাহর আদেশ পালন ও নিষেধের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে আল্লাহকে রব, ইসলামকে দ্বীন এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নবী হিসাবে মেনে নেন, তাহলে আপনার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হবে। আবু সাইদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘‘ হে আবু সাইদ! যে ব্যক্তি আল্লাহকে রব, ইসলামকে দ্বীন এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নবী হিসাবে গ্রহণ করবে, তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হবে’’। [মুসলিম]
২০. রোযাদারদের জন্য জান্নাতে একটি দরজা আছে যার নাম ‘রাইয়ান’, রোযাদার ছাড়া এ দরজা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। সাহল ইবন সা’দ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘‘জান্নাতের ভেতর ‘রাইয়ান’ নামে একটি দরজা আছে। কিয়ামতের দিন এখান দিয়ে রোযাদারগণ ঢুকবে। তারা ছাড়া আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশাধিকার পাবে না। বলা হবে: কোথায় রোযাদারগণ? তখন তারা সেখান দিয়ে ঢুকবে। তারা ছাড়া সেখান দিয়ে আর কেউ ঢুকবে না। তারা প্রবেশ করার পর তা বন্ধ করে দেয়া হবে। তারপর আর কেউ ঢুকতে পারবে না’’। [বুখারী ও মুসলিম]
২১. ইসলামের পঞ্চম রুকন হল আল্লাহর ঘরের হজ্জ করা। এ হজ্জের প্রতিদান হলো জান্নাত। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
«العمرة إلى العمرة كفارة لما بينهما، والحج المبرور ليس له جزاء إلا الجنة».
‘‘এক ওমরাহ থেকে আরেক ওমরাহ মধ্যবর্তী সকল গুনাহের জন্য কাফ্ফারা স্বরূপ। আর পূণ্যময় হজ্জের প্রতিদান জান্নাত ছাড়া আর কিছু নয়’’। [বুখারী ও মুসলিম]
২২. যার মাধ্যমে আল্লাহ তা’লা দ্বীন ইসলামকে বুলন্দ এবং সুউচ্চ করেছেন তা হলো আল্লাহর পথে জিহাদ। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহর বাণীকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে জিহাদ করে, তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যায়।
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘‘আল্লাহ ঐ ব্যক্তিকে জান্নাতে প্রবেশ করানোর দায়িত্ব নিয়েছেন যে ব্যক্তি শুধুমাত্র আল্লাহর পথে জিহাদ করা এবং তাঁর কথাকে সত্য বলে প্রমাণিত করার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হয়। অথবা তাকে জিহাদের সাওয়াব ও গণীমত লাভে ধন্য করে গাজী হিসাবে ঘরে ফিরিয়ে আনেন’’। [বুখারী ও মুসলিম]
২৩. আল্লাহ অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁর মুত্তাকী বান্দাদেরকে এ বলে আখ্যায়িত করেছেন যে, তারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে। হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে দান খয়রাত করে, এর দরূন তাকে জান্নাতে দেয়া হবে’’। [আহমাদ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন]
২৪. যে সকল মহান কাজ মানুষকে জান্নাতে প্রবেশ করায় তন্মধ্যে একটি হল: কোন ব্যক্তিকে অর্থ ঋণ দিয়ে তাকে তা স্বচ্ছলতার সাথে আদায় করার সুযোগ করে দেয়া। হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা করেছেন: ‘‘এক ব্যক্তি মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার পর জান্নাতে প্রবেশ করলো। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো: তুমি কি আমল করেছ? উত্তরে লোকটি বললো: আমি মানুষের সাথে কেনাবেচা করতাম। বিপদগ্রস্ত দরিদ্রদেরকে ঋণ পরিশোধের সময় দিতাম এবং কিছু টাকা পয়সা মাফ করে দিতাম। ফলে আল্লাহ তাকেও মাফ করে দিয়েছেন’’। [মুসলিম]
চলবে…………..

‘আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক’
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Twitter, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। “কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা” [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]
শেয়ার করুন


কীভাবে আপনি জান্নাত লাভ করবেন পর্ব – ২
যে সকল সহজ আমল জান্নাতে প্রবেশের কারণ ও উপায়, তন্মধ্যে রয়েছে:
১. রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক কিছু সরিয়ে দেয়া, জন্তু জানোয়ারের প্রতি করুণা করা, উত্তম চরিত্র, কথা ও কাজে সততা, ক্রোধ সংবরণ করা এবং রাগ না করা, রোগী দেখতে যাওয়া ও সেবা করা, মুসলিম ভাইদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করা, বেচাকেনার ক্ষেত্রে উদার হওয়া এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির মানদন্ডে কথা বলা।
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি:
«لقد رأيت رجلا يتقلب في الجنة في شجرة قطعها من ظهر الطريق كانت تؤذي الناس».
‘‘আমি একজন লোককে জান্নাতে এপাশ ওপাশ করতে দেখেছি রাস্তার উপর থেকে একটি গাছ কেটে ফেলার কারণে যার দরূন মানুষের চলাফেরায় কষ্ট হতো’’।[মুসলিম]
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা করেন:
«أن رجلا رأى كلبا يأكل الثرى من العطس، فأخذ الرجل خفه فجعل يغرف له به حتى أرواه، فشكر الله له فأدخله الجنة».
‘‘এক ব্যক্তি একটি কুকুরকে পিপাসায় মাটি চাটতে দেখে। অতঃপর লোকটি নিজের মোজার সাহায্যে কুকুরটিকে পানি পান করালো। ফলে আল্লাহ তাকে প্রতিদান দিলেন এবং জান্নাত দান করলেন’’। [বুখারী]
আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘‘আমি জান্নাতের আঙ্গিনায় এমন একটি ঘরের গ্যারান্টিদাতা, যে ঘরটি ঐ ব্যক্তির জন্য হবে, হকদার হওয়া সত্ত্বেও যে ঝগড়া করে না। অনুরূপভাবে আমি জান্নাতের মাঝে ঐ ঘরেরও গ্যারান্টিদাতা, যে ঘরটি ঐ ব্যক্তির জন্য, যে ঠাট্টা করেও মিথ্যা বলে না। তদুপরি জান্নাতের উপরিভাগের ঐ ঘরেরও আমি জামিনদার, যে ঘরটি হবে উত্তম চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তির জন্য’’। [আবু দাউদ এ হাদীস রেওয়ায়েত করেছেন এবং আলবানী একে সহীহ বলেছেন]
আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«إن الصدق يهدي إلى البر وإن البر يهدي إلى الجنة، وإن الرجل ليصدق حتى يكون صديقا، وإن الكذب يهدي إلى الفجور، وإن الفجور يهدي إلى النار، وإن الرجل ليكذب حتى يكتب عند الله كذابا».
‘‘নিঃসন্দেহে সততা পূণ্যের দিকে পথ দেখায়। আর পূণ্য জান্নাতের দিশা দেয়। একজন ব্যক্তি সত্য বলতে বলতে সত্যবাদী হয়ে যায়। পক্ষান্তরে মিথ্যা কথা খারাপ ও গুনাহের দিকে ঠেলে দেয়। আর গুনাহ ও পাপ দোযখের দিকে নিয়ে যায়। একজন ব্যক্তি মিথ্যা বলতে থাকে। এভাবে সে আল্লাহর নিকট মিথ্যাবাদী বলে লিখিত হয়ে যায়’’। [বুখারী ও মুসলিম]
আবুদ দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন:
«دُلَّنِي عَلَى عَمَلٍ يُدْخِلُنِي الْجَنَّةَ، قَالَ:”لا تَغْضَبْ، وَلَكَ الْجَنَّة»
‘‘আমাকে এমন একটি আমল শিক্ষা দিন যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ক্রোধান্বিত হয়ো না, তাহলে জান্নাতে যাবে।’’ [তাবারানী এ হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং আলবানী সহীহ বলেছেন]
সাওবান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
«مَنْ عَادَ مَرِيضًا لَمْ يَزَلْ فِى خُرْفَةِ الْجَنَّةِ حَتَّى يَرْجِعَ»
‘‘যে ব্যক্তি কোন রুগীকে দেখতে গেল, সে ফিরে না আসা পর্যন্ত জান্নাতের ফল কুড়ানো অবস্থায় থাকে’’। [মুসলিম]
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
«مَنْ عَادَ مَرِيضًا أَوْ زَارَ أَخًا فِي اللهِ ، نَادَى مُنَادٍ مِنَ السَّمَاءِ: طِبْتَ ، وَطَابَ مَمْشَاكَ ، وَتَبَوَّأْتَ مِنَ الْجَنَّةِ مَنْزِلاً»
‘‘যে ব্যক্তি কোন রুগীকে দেখতে গেল অথবা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোন ভাইকে দেখতে গেল, তখন একজন আহবানকারী তাকে ডেকে বলে: তোমার ও তোমার চলার পথ কল্যাণময় হোক, সুন্দর হোক। তুমি জান্নাতে তোমার বাসস্থান করে নিয়েছ’’। [ইবনে মাজাহ, তিরমিযী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং আলবানী অন্যান্য হাদীসের সমর্থনে একে সহীহ বলেছেন]
উসমান ইবন আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
«أدخل الله عز و جل الجنة رجلا كان سهلا مشتريا وبائعا وقاضيا ومقتضيا»
‘‘আল্লাহ তা’লা এমন এক ব্যক্তিকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যে বেচাকেনায়, বিচার ফয়সালা করায় এবং বিচার চাওয়ায় সরলতা অবলম্বন করেছে’’। [ইমাম আহমাদ ও নাসায়ী হাদীসটি রেওয়ায়েত করেছেন এবং আলবানী একে উত্তম বলেছেন। আর আহমাদ শাকির এর সনদকে সহীহ বলেছেন]
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘‘যে বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টির মানদন্ডে কথা বলে, এ ব্যাপারে কোন ভ্রূক্ষেপ করে না। একথার দরূন আল্লাহ তার মান-মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। অন্যদিকে যে ব্যক্তি আল্লাহর অসন্তুষ্টিমূলক কথা বলে অথচ এ ব্যাপারে ভ্রূক্ষেপও করে না, আল্লাহ তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করেন’’। [বুখারী]
২. জান্নাতের মধ্যে মুসলিম ব্যক্তির সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ও সুন্দর স্থান হলো যে ব্যক্তি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথী হবে। আর কন্যাদের সঠিক শিক্ষাদান ও লালন পালন করা এবং ইয়াতীমের দায়িত্ব গ্রহণ করা জান্নাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সান্নিধ্য পাওয়া ও তাঁর প্রতিবেশী হওয়ার সুনিশ্চিত কারণ।
আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
«من عال جاريتين حتى تبلغا جاء يوم القيامة أنا وهو، وضم أصابعه».
‘‘ যে ব্যক্তি দু’ কন্যাকে সাবালিকা হওয়া পর্যন্ত লালন পালন করে, কিয়ামতের দিন আমি ও সে একত্রে থাকব’’ , এই বলে তিনি তাঁর দু’ আঙ্গুলকে একত্র করে দেখালেন। [মুসলিম]
সহল ইবন সা’দ থেকে বর্ণিত যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
«أَنَا وَكَافِلُ الْيَتِيمِ فِي الْجَنَّةِ هَكَذَا وَأَشَارَ بِالسَّبَّابَةِ وَالْوُسْطَى وَفَرَّجَ بَيْنَهُمَا شَيْئًا»
‘‘আমি এবং ইয়াতিমের অভিভাবক জান্নাতে এভাবে থাকব’’। এ কথা বলে তিনি শাহাদাত ও মধ্যমা আঙ্গুল দু’টোকে একত্রে মিলিয়ে দু’টোর মাঝে একটু ফাঁক রাখলেন’’। [বুখারী]
৩. পিতামাতা উভয়ের প্রতি অথবা যে কোন একজনের প্রতি সদ্ব্যবহার করাও জান্নাতে যাওয়ার উপায়। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি:
«رَغِمَ أَنْفُ ثُمَّ رَغِمَ أَنْفُ ثُمَّ رَغِمَ أَنْفُ . قِيلَ مَنْ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ مَنْ أَدْرَكَ أَبَوَيْهِ عِنْدَ الْكِبَرِ أَحَدَهُمَا أَوْ كِلَيْهِمَا فَلَمْ يَدْخُلِ الْجَنَّةَ»
‘‘ঐ ব্যক্তির নাক ধুলো মলিন হোক (৩ বার) অর্থাৎ সে ধ্বংস হোক। প্রশ্ন করা হলো: হে আললাহর রাসূল! কোন ব্যক্তির? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জবাব দিলেন: ‘‘যে ব্যক্তি পিতামাতাকে অথবা তাদের যে কোন একজনকে বৃদ্ধ অবস্থায় পেল, তারপরও জান্নাতে যেতে পারলো না’’। [মুসলিম]
আবুদ দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি: ‘‘পিতা হলো জান্নাতের মাঝের দরজা। তুমি চাইলে এ দরজার হেফাযত করতে পার অথবা হারাতে পার’’। [তিরমিযী, ইবনে মাজাহ ও আহমাদ এটি বর্ণনা করেছেন এবং আলবানী একে সহীহ বলেছেন]
জনৈক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এসে যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে তার মা আছে কিনা জিজ্ঞাসা করলো। লোকটি বললো: জী, আমার মা আছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘‘তুমি সার্বক্ষণিক তার দেখাশুনা কর, কেননা তার পায়ের নিকটেই জান্নাত রয়েছে’’। [আহমাদ, নাসায়ী ও ইবনে মাজাহ এ হাদীস রেওয়ায়েত করেছেন এবং আলবানী একে উত্তম ও সহীহ বলেছেন]
৪. মানুষের সবচেয়ে বড় কাজ হল তার জিহবা ও লজ্জাস্থানের হেফাযত করা। সুতরাং যে ব্যক্তি এ দু’টো হেফাযতের দায়িত্ব নিবে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার জান্নাতের ব্যাপারে দায়িত্ব নিবেন। সহল ইবন সা’দ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
«من يضمن لي ما بين لحييه وما بين رجليه أضمن له الجنة».
‘‘যে ব্যক্তি তার দুই চোয়ালের মাঝের বস্তু (জিহবা) এবং দু’ পায়ের মধ্যখানের (লজ্জাস্থান) হেফাযতের গ্যারান্টি দিবে, আমি তার জান্নাতের ব্যাপারে গ্যারান্টি দেব’’। [বুখারী]
৫. মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহর পক্ষ থেকে সাক্ষীস্বরূপ। সুতরাং মানুষ যার পক্ষে ভাল সাক্ষ্য দেয়, সে জান্নাতে প্রবেশ করে।
আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: একদা একটি লাশের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় তার ভাল প্রশংসা করা হল। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: ‘‘ওয়াজিব হলো, ওয়াজিব হলো, ওয়াজিব হলো’’। অনুরূপভাবে আরো একটি লাশের পাশ দিয়ে অতিক্রম করা হল। এটি সম্পর্কে খারাপ বর্ণনা করা হলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন, ‘‘ওয়াজিব হলো’’ (৩ বার)। এরপর উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এর কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তরে বললেন: ‘‘তোমরা যার ভাল প্রশংসা কর, তার জন্য জান্নাত অপরিহার্য হয়ে যায়। আর তোমরা যার খারাপ বর্ণনা কর, তার জন্য জাহান্নাম অপরিহার্য হয়ে যায়। তোমরা পৃথিবীতে আল্লাহর সাক্ষী’’ (৩ বার বললেন)। [বুখারী ও মুসলিম]
৬. আল্লাহ তা’লা এরশাদ করেন:
﴿إِنَّمَا يُوَفَّى ٱلصَّٰبِرُونَ أَجۡرَهُم بِغَيۡرِ حِسَابٖ ١٠﴾ [الزمر:10]
‘‘নিশ্চয় সবরকারীগণকে বেহিসাবী প্রতিদান দেয়া হয়’’। [সূরা আযযুমার: ১০]
তাই সবর হলো আল্লাহর প্রতি বান্দার ঈমান এবং তাঁর নৈকট্যের আলামতসমূহের একটি আলামত। সুতরাং যে ব্যক্তি তার প্রিয়জন যথা: সন্তান, ভাই-বেরাদার ইত্যাদির মৃত্যুতে ধৈর্য্য ধারণ করে, সে জান্নাতী।
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
«يَقُولُ اللَّهُ تَعَالَى مَا لِعَبْدِي الْمُؤْمِنِ عِنْدِي جَزَاءٌ إِذَا قَبَضْتُ صَفِيَّهُ مِنْ أَهْلِ الدُّنْيَا ثُمَّ احْتَسَبَهُ إِلاَّ الْجَنَّة»
‘‘আল্লাহ তা’লা বলেন, আমার মু’মিন বান্দার নিকট থেকে যখন তার অতি প্রিয়জনের জান কবয করা হয়, আর সে আল্লাহর নিকট সাওয়াবের আশা করে ধৈর্য্যধারণ করে, তার প্রতিদান আমার নিকট জান্নাত ছাড়া আর কিছু নয়’’। [বুখারী]
আবু মূসা আশআরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘‘যখন কোন বান্দার সন্তান মারা যায়, তখন আল্লাহ তাঁর ফেরেস্তাদের জিজ্ঞাসা করেন: তোমরা কি আমার বান্দার সন্তানের জান কবজ করেছো? তারা বলেন, হ্যাঁ। আল্লাহ বলেন, তোমরা কি তার কলিজার টুকরার জান কবজ করেছো? তারা বলেন, হ্যাঁ। আল্লাহ আবার বলেন, আমার বান্দা কি বললো? ফেরেস্তারা জবাব দেন, সে আল্লাহর প্রশংসা করেছে এবং বলেছে: (إنا لله وإنا إليه راجعون) ‘নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহরই জন্য এবং আল্লাহর দিকেই আমাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে’। আল্লাহ তখন বলেন: তোমরা আমার বান্দার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ কর এবং এ ঘরটির নাম দাও ‘বায়তুল হামদ’ বা প্রশংসার ঘর’’। [তিরমিযী এ হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং আলবানী উত্তম বলেছেন]
৭. যে ব্যক্তি অন্ধ হয়েও ধৈর্য্যধারণ করে সে জান্নাতে যাবে। আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি: ‘‘আল্লাহ তা’লা বলেন, ‘আমার বান্দাকে তার দু’টি প্রিয় বস্তু (অর্থাৎ চোখ) কেড়ে নিয়ে পরীক্ষা করি। অতঃপর সে ধৈর্য্যধারণ করে। আমি এ দু’টোর পরিবর্তে তাকে জান্নাত দান করি’’। [বুখারী]
৮. যে মুসলিম নারী সৎ কাজে তার স্বামীর আনুগত্য করে এবং আল্লাহর হুকুম আহকাম পালন করে, সে জান্নাতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করবে।
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘‘যদি কোন মহিলা পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করে, রমযানের রোযা পালন করে, লজ্জাস্থানের হেফাযত করে এবং স্বামীর আনুগত্য করে, সে জান্নাতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করবে’’। [ইবনু হিববান এটি বর্ণনা করেছেন এবং আলবানী একে সহীহ বলেছেন]
৯. মুসলিম মহিলা প্রসবের সময় মারা গেলে তার সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার সাথে সাথে তার প্রসব বেদনা তাকে জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়।
রাশেদ ইবন হুবাইশ থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘‘আল্লাহর পথে নিহত ব্যক্তি শহীদ, প্লেগরোগে মারা যাওয়া ব্যক্তি শহীদ, ডুবে মরে যাওয়া ব্যক্তি শহীদ, পেটের পীড়ায় মারা যাওয়া ব্যক্তি শহীদ, আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া ব্যক্তি শহীদ, অসুস্থ অবস্থায় মৃত ব্যক্তি শহীদ এবং সন্তান প্রসবের পর নেফাস অবস্থায় মৃত মহিলা, তার সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার কারণে সে জান্নাতে চলে যায়’’। [আহমাদ হাদীসটি বর্ননা করেছেন, আলবানী একে উত্তম বলেছেন]
১০. যে ভিক্ষাবৃত্তি থেকে বিরত থাকলো আল্লাহর রাসূল তাকে জান্নাতে নেয়ার জামিন হলো। সাওবান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
«من تكفل لي أن لا يسأل الناس شيئا أتكفل له بالجنة».
‘‘যে ব্যক্তি মানুষের নিকট হাত না পাতার দায়িত্ব নিবে, আমি তাকে জান্নাতে নেয়ার দায়িত্ব নেব’’। [আহমাদ, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ ও আবু দাউদ হাদীসটি রেওয়ায়েত করেছেন এবং আলবানী একে সহীহ বলেছেন]
১১. যে ব্যক্তি নিজের সম্পত্তি রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয়, সেও জান্নাতী। আবদুল্লাহ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
«من قتل دون ماله مظلوما فله الجنة».
‘‘যে ব্যক্তি সম্পদ রক্ষার নিমিত্তে নিপীড়িত হয়ে মারা যায়, তার জন্য রয়েছে জান্নাত’’। [নাসায়ী এটি বর্ণনা করেছেন এবং আলবানী সহীহ বলেছেন]
১২. প্রিয় পাঠক! আপনার জন্য রয়েছে জান্নাত, যদি আপনি সালাম প্রচার করেন, অন্যকে খাদ্য দান করেন, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখেন এবং রাতের বেলা মানুষ ঘুমিয়ে গেলে সালাত আদায় করেন।
আবদুল্লাহ ইবন সালাম থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘‘হে মানব সকল! তোমরা সালামের প্রসার কর, খাদ্য প্রদান কর, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখ এবং মানুষ ঘুমিয়ে গেলে রাতের সালাত আদায় কর। তাহলে নিরাপদে জান্নাতে যেতে পারবে’’। [তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, আহমাদ ও হাকেম হাদীসটি রেওয়ায়েত করেছেন এবং আলবানী সহীহ বলেছেন]
শুরাইহ ইবন হানী তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন: ‘‘হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে এমন বিষয়ে অবহিত করুন যা আমার জান্নাতে যাওয়াকে নিশ্চিত করবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তরে বললেন:তুমি সর্বদা উত্তম কথা বলবে এবং খাদ্য দান করবে’’। [বুখারী আদাবুল মুফরাদে এবং হাকেম হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং আলবানী সহীহ বলেছেন]
১৩. যে ব্যক্তি অহংকার, ঋণ ও যুদ্ধে লব্ধ গণীমতের মালের খেয়ানত থেকে মুক্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে, সে জান্নাতে যাবে। সাওবান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি অহংকার, গণীমতের সম্পদে খেয়ানত করা এবং ঋণ থেকে মুক্ত অবস্থায় মারা গেল, সে জান্নাতে প্রবেশ করলো’’। [তিরমিযী, নাসায়ী ও ইবনে মাজাহ এটি রেওয়ায়েত করেছেন এবং আলবানী সহীহ বলেছেন]
১৪. আল্লাহর কিতাব ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতকে অবলম্বন করে যারা মুসলিম জামায়াতকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরে থাকবে, তারা জান্নাতের মধ্যবর্তী স্থানে প্রবেশ করবে। উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘‘তোমাদের জন্য ইসলামী জামায়াতকে আঁকড়ে ধরা অপরিহার্য। আর বিচ্ছিন্ন হওয়া থেকে বেঁচে থাক। কেননা একা একা থাকলে শয়তান তার সঙ্গী হয়। আর জামায়াতবদ্ধ দু’ ব্যক্তি থেকে শয়তান অনেক দূরে অবস্থান করে। যে ব্যক্তি জান্নাতের মধ্যবর্তী স্থান পাওয়ার আশা করে, সে যেন অবশ্যই ইসলামী জামায়াতকে আঁকড়ে ধরে’’। [তিরমিযী এ হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং আলবানী সহীহ বলেছেন]
১৫. ন্যায়পরায়ণ শাসক, কোমল হৃদয়ের অধিকারী দয়ালু ব্যক্তি এবং চরিত্রবান ও সুরুচিপূর্ণ পরিবার প্রধান জান্নাতবাসীদের অন্তর্গত। ইয়ায ইবন হিমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্ল¬াহু আলাইহি ওয়া সাল্ল¬াম বলেছেন: ‘‘তিনশ্রেণীর লোকেরা জান্নাতবাসী হবে। এক: ন্যায়পরায়ণ, দাতা ও আল্লাহর তাওফীকপ্রাপ্ত শাসক, দুই: দয়ালু ব্যক্তি যার অন্তর প্রতিটি আত্মীয় ও মুসলিমের জন্য কোমল, এবং তিন: সুরুচিপূর্ণ চরিত্রবান পরিবার প্রধান’’। [মুসলিম]
১৬. যে বিচারক ন্যায় ও ইনসাফের সাথে মানুষের বিচার ফয়সালা করে, সে জান্নাতী। বুরাইদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী সাল্লাল্ল¬াহু আলাইহি ওয়া সাল্ল¬াম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: ‘‘বিচারকগণ তিন প্রকার। দুই শ্রেণীর বিচারক হবে জাহান্নামী আর এক শ্রেণীর বিচারক হবে জান্নাতী। যে ব্যক্তি সত্য জেনে সে অনুযায়ী ফয়সালা করলো, সে জান্নাতী। অন্য দিকে যে ব্যক্তি না জেনে মূর্খতাবশতঃ ফয়সালা দেয়, সে জাহান্নামী। আর যে ব্যক্তি সত্য জানার পরও যুল্ম করলো, সে জাহান্নামী’’। [আবু দাউদ, তিরমিযী,নাসায়ী, ইবনে মাজাহ ও হাকেম হাদীসটি রেওয়ায়েত করেছেন এবং আলবানী সহীহ বলেছেন]
১৭. সত্তর হাজার লোক বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে, তারা হল যারা কারো নিকট ঝাড়ফুঁক চায়নি, পাখি দ্বারা ভাগ্য নির্ণয় করেনি এবং কারো নিকট বিশেষ চিকিৎসা চায়নি।
ইমরান ইবন হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, আল্লাহর রাসূল সাল্ল¬াল্ল¬¬াহু আলাইহি ওয়া সাল্ল¬¬াম বলেন: ‘‘আমার উম্মাতের মধ্যে ৭০ হাজার হিসাব ছাড়াই জান্নাতে প্রবেশ করবে। সাহাবাগণ জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! তারা কারা? নবী সাল্ল¬াল্ল¬¬াহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: তারা হলো যারা কারো নিকট ঝাড়ফুঁক চায়না, পাখির সাহায্যে ভাগ্য নির্ধারণ করে না, কারো নিকট বিশেষ চিকিৎসার জন্য যায় না। বস্তুতঃ তারা তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করে’’। [বোখারী ও মুসলিম]
লক্ষ্যণীয় যে, শরীয়তসম্মত ঝাড়ফুঁক এবং বিশেষ চিকিৎসা করা শরীয়তে নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ ভরসা করা উত্তম।
১৮. কতগুলো গুণ ও বৈশিষ্ট্য কোন মুসলিম ব্যক্তির মধ্যে অর্জিত হলে এগুলোর কারণে সে জান্নাতবাসীদের অন্তর্ভূক্ত হবে।
উবাদাহ ইবন সামিত রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘‘তোমরা তোমাদের নিজেদের মধ্যে ৬টি গুণ অর্জনের জামিন হও, আমি তোমাদের জন্য জান্নাতের জামিন হবো। এক: কথা বলার সময় সত্য বলবে, দুই: ওয়াদা করে তা পূরণ করবে, তিন: তোমাদের নিকট আমানাত রাখা হলে সে আমানাত আদায় করবে, চার: লজ্জাস্থানের হেফাযত করবে, পাঁচ: দৃষ্টিকে সংযত রাখবে, ছয়: তোমদের হাতকে অন্যায় করা থেকে বিরত রাখবে’’। [আহমাদ, ইবনু হিববান ও হাকিম হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং আলবানী সহীহ বলেছেন]
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘‘তোমাদের মধ্যে আজ কে রোযা রেখেছো? আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: তোমাদের মধ্যে আজ কে জানাযার অনুসরণ করেছো? আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমি। নবী সাল্লাল্ল¬¬াহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: তোমাদের কে আজ মিসকীনকে খাদ্য দান করেছো? আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুনরায় বললেন: তোমাদের মধ্যে কে আজ রুগীর সেবা করেছো? আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমি। অতঃপর রাসূল সাল্ল¬ল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লা¬ম বললেন: উপরোক্ত গুণাবলী যে ব্যক্তির মধ্যে একত্রিত হবে সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে’’। [বুখারী ও মুসলিম]
প্রিয় পাঠক! পরিশেষে আপনাকে তাওবার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। বস্তুতঃ গুনাহ থেকে তাওবাকারী নিষ্পাপ, যার কোন গুনাহ নেই। আল্লাহর নিকট খাঁটি তাওবাকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে। মহান আল্লাহ তা’লা বলেন:
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ تُوبُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِ تَوۡبَةٗ نَّصُوحًا عَسَىٰ رَبُّكُمۡ أَن يُكَفِّرَ عَنكُمۡ سَيِّ‍َٔاتِكُمۡ وَيُدۡخِلَكُمۡ جَنَّٰتٖ تَجۡرِي مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُ ﴾ [التحريم:8 ]
‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট নিষ্ঠাপূর্ণ খাঁটি তাওবা কর। আশা করা যায় তোমাদের প্রতিপালক তোমদের সকল ত্রুটি বিচ্যুতি মিটিয়ে দেবেন এবং তোমাদেরকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার তলদেশ দিয়ে নদী প্রবাহিত’’। [সূরা আত তাহরীম: ৮]
উপসংহার
পরিশেষে প্রিয় পাঠক! আপনি আপনার নিজের ভেতরে ঈমানে পরিপূর্ণ একটি মন আর আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাতের আকাংখায় ভরপুর একটি আত্মার অধিকারী। আপনার সুখ ও আনন্দ হলো – নেয়ামতপূর্ণ জান্নাতে আপনি নবী, সত্যবাদী শহীদ এবং সৎকর্মশীল ব্যক্তিগণের সঙ্গী হতে চান, যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন।
বস্তুতঃ জান্নাত প্রস্তুত ও নিকটবর্তী। দয়ালু ও করুণাময় আল্লাহই এর দিকে আহবান করছেন। আপনার প্রিয় নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জান্নাতের দরজায় দাঁড়িয়ে আপনাকে ডাকছেন – ‘হে মু’মিন! আস, জান্নাতবাসী হও’।
অতএব জান্নাত আপনার জন্য দুনিয়ার জীবনে, মৃত্যুর সময় এবং হিসাব-নিকাশের সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ। মহান আল্লাহ আপনাকে জান্নাতের ফল এবং এর অসংখ্য নেয়ামত দ্রুত অর্জনের জন্য আদেশ করছেন। আর আল্লাহ ওয়াদা ভঙ্গ করেন না।
মহান প্রতিপালক জান্নাতের অতি সুন্দর ও উত্তম বর্ণনা দিয়েছেন এবং একে মানুষের কল্পনাতীত বস্তু দিয়ে সুসজ্জিত করেছেন। যাতে আপনি সেখানে চিরস্থায়ী সুখ ও ভোগের সাথে জীবন যাপন করতে পারেন।
সুতরাং আপনি জান্নাতে প্রবেশের জন্য অগ্রসর হোন। আপনার প্রতি আল্লাহ তা’লার ভালবাসা ও খুশীর বহিঃপ্রকাশ এটাই। এসব কিছুই প্রতিফলিত হবে স্বল্প আমল করার মাধ্যমে, যে আমল করার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আপনাকে নির্দেশ দিয়েছেন। এ আমলগুলো করার পর আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত আপনার জন্য প্রশস্ত হবে। সুতরাং আসুন এবং এ দিকে অগ্রসর হোন। মহান আল্লাহর ঘোষণা:
﴿وَسَارِعُوٓاْ إِلَىٰ مَغۡفِرَةٖ مِّن رَّبِّكُمۡ وَجَنَّةٍ عَرۡضُهَا ٱلسَّمَٰوَٰتُ وَٱلۡأَرۡضُ أُعِدَّتۡ لِلۡمُتَّقِينَ ١٣٣ ﴾ [آل عمران :133]
‘‘তোমার রবের মাগফিরাত এবং ঐ জান্নাতের দিকে ধাবিত হও যার প্রশস্ততা আসমানসমূহ ও যমীনের সমান, যা মুত্তাকীদের জন্য তৈরী করা হয়েছে’’। [সূরা আল ইমরান: ১৩৩]
বন্ধুগণ! মুত্তাকীরাই হলো আল্লাহর অলী ও বন্ধু। তারাই দুনিয়া ও আখিরাতের সুসংবাদের হকদার। তাদের আমলই গ্রহণযোগ্য। তারাই জান্নাতে আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদাসম্পন্ন।
আর মুত্তাকীগণ এ তত্ত্বগুলো ভাল করেই জানে। কেননা তারা আল্লাহ তা’লার একত্ববাদে বিশ্বাসী। তাঁর সাথে কোন কিছুকে তারা শরীক করেনি। তারা আল্লাহ সুবহানাহু ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথার উপর অন্য কারো কথাকে প্রধান্য দেয় না। তারা সকল আমলকে কুরআন কারীম ও সহীহ হাদীস থেকে গ্রহণ করে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বাদ দিয়ে তারা কোন অলী, শায়খ কিংবা আলেম উলামার কথাকে গুরুত্ব দেয় না। অহী থেকে প্রাপ্ত কুরআন ও সুন্নাহই হলো সত্য – এটা গ্রহণ করাই তাদের স্বভাব। এছাড়া অন্য কিছুকে তারা মানে না।
মুত্তাকীগণ আল্লাহর মর্যাদার হকদার। কেননা তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিষ্ঠার সাথে সকল কাজ সম্পন্ন করে। এর দ্বারা মানুষের কোন প্রশংসা, স্তুতি ও কৃতজ্ঞতা পাওয়ার আশা তারা করে না। বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালীন মুক্তিই তাদের লক্ষ্য।
মুত্তাকীরাই জান্নাতী। কেননা তারা সরল সঠিক মনের অধিকারী। তাদের পাকস্থলীতে হালাল খাদ্য রয়েছে। তাছাড়াও তারা সর্বদা তাদের মাওলা ও মনিবের নিকট তাদের আমলগুলো কবুল হওয়ার জন্য কাতরভাবে দো‘আ করে।
মুত্তাকীগণই তাদের রবের জান্নাত, তাঁর সন্তুষ্টি, সম্মান ও মর্যাদা লাভে ধন্য হবে। তাদেরকেই ফেরেস্তাগণ জান্নাতের দিকে দলে দলে নিয়ে যাবে। ফেরেস্তাগণ তাদেরকে স্বাগতম জানাবে, সালাম বলবে। তাদের প্রতিপালক তাদের আনন্দ ও স্বচ্ছন্দের জন্য তাদের উদ্দেশ্যে সাক্ষাৎ দেবেন।
বন্ধুগণ! এ হলো জান্নাত। উপরোক্ত আমলগুলো হলো জান্নাতীদের আমল। সুতরাং উক্ত আমলগুলো করুন এবং জান্নাতের সুশংবাদ গ্রহণ করুন। আর নিরাশ হবেন না। কেননা আল্লাহর রহমত নেককারদের অতি নিকটে।
ওয়াস্ সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।

‘আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক’
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Twitter, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। “কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা” [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]
শেয়ার ক
আল-কুরআনের আলোকে মানুষের স্বরূপ বিশ্লেষণ – পর্ব ১
মহাগ্রন্থ আল-কুরআন মানব জাতির কল্যাণের আঁধার। মানুষের সঠিক পথের দিশা দিতে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত সর্বশেষ আসমানী গ্রন্থ হলো আল-কুরআন। এটি সুদীর্ঘ তেইশ বছর যাবৎ বিভিন্ন সময় ও পরিস্থিতির আবর্তে মানুষের কল্যাণ সাধনের নিমিত্তে গাইড বুক হিসেবে নাযিল হয়েছে। এতে মানব জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগের সমস্যা ও তার সমাধানের বর্ণনা বিবৃত হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন:
مَا فَرَّطْنَا فِي الْكِتَابِ مِنْ شَيْءٍ
কিতাব (কুরআনে) কোন কিছুই আমি বাদ দেইনি।’’ [1]
মানুষ আল্লাহ তা’আলার অসংখ্য সৃষ্টির মধ্যে এক অনন্য ও অসাধারণ সৃষ্টি। বুদ্ধিবৃত্তিক ও জীবকে দেয়া হয়েছে ভাল ও মন্দের মাঝে পার্থক্য সুচিত করার এক অসুপম ক্ষমতা। মানুষই একমাত্র সৃষ্টিজীব যাদের রয়েছে বিবেক ও বোধশক্তি। এ বিবেকই তাদের চালিকাশক্তি এবং আল্লাহ প্রদত্ত কল্যাণের অনুসন্ধানী। ফলে মানুষকে তিনি আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টি শ্রেষ্ঠ জীবরূপে ঘোষণা দিয়েছেন।[2]
এ পৃথিবীতে যা কিছু সৃষ্টি করা হয়েছে, তার সবই মানুষের কল্যাণের জন্য। মহান আল্লাহ আপন কৃপায় সেসব সৃষ্টিজীবকে মানুষের অনুগত ও বশ্য করে দিয়েছেন। যদিও তারা আকার-আকৃতিতে, শক্তি ও দেহাবয়বের দিক থেকে মানুষের চেয়ে অনেক বড়। এ মর্মে তিনি ইরশাদ করেন:
أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللهَ سَخَّرَ لَكُمْ مَا فِي الْأَرْضِ وَالْفُلْكَ
‘‘তুমি কি লক্ষ্য কর না যে, আল্লাহ তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন পৃথিবীতে যা কিছু আছে তৎসমূদয়কে।’’ [3]
মানুষের সৃষ্টি মূলে যে মহান আল্লাহর একক ইচ্ছার প্রতিফলন মাত্র, সেই মহান আল্লাহ দু’ধরনের উপাদান দিয়ে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন।[4]

প্রথমত: মাটি থেকে, অত:পর তাতে রূহ প্রবেশ করিয়েছেন যেমন: হযরত (আ.) এর সৃষ্টি। কুরআনে এসেছে:
الَّذِي أَحْسَنَ كُلَّ شَيْءٍ خَلَقَهُ وَبَدَأَ خَلْقَ الْإِنسَانِ مِنْ طِينٍ – ثُمَّ جَعَلَ نَسْلَهُ مِنْ سُلَالَةٍ مِنْ مَاءٍ مَهِينٍ
‘‘যিনি তার প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে সৃজন করেছেন উত্তমরূপে এবং কর্দম হতে মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন। অত:পর তিনি তার বংশ উৎপন্ন করেন তুচ্ছ তরল পদার্থের নির্যাস হতে। পরে তিনি তাকে করেছেন সুঠাম এবং তাতে ফুঁকিয়ে দিয়েছেন তাঁর রূহ হতে এবং তোমাদেরকে দিয়েছেন কর্ণ, চক্ষু ও অন্ত:করণ, তোমরা অতি সামান্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’’ [5]
অন্যত্র সরাসরি পৃথিবীতে মানব আদম(আ.) এর সৃষ্টি সম্পর্কে তিনি বলেন:
وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي خَالِقٌ بَشَرًا مِنْ صَلْصَالٍ مِنْ حَمَإٍ مَسْنُونٍ – فَإِذَا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ فِيهِ مِنْ رُوحِي فَقَعُوا لَهُ سَاجِدِينَ
‘‘স্মরণ কর, যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেস্তাদেরকে বললেন, আমি গন্ধযুক্ত কর্দমের শুস্ক ঠনঠনা মৃত্তিকা হতে মানুষ সৃষ্টি করেছি, যখন আমি তাকে সুমাঠ করব এবং তাতে আমার পক্ষ হতে রূহ সঞ্চার করব, তখন তোমরা তার প্রতি সিজদাবনত হইও।’’[6]
দ্বিতীয়ত: বীর্ষ থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে:
وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنسَانَ مِنْ سُلَالَةٍ مِنْ طِينٍ – ثُمَّ جَعَلْنَاهُ نُطْفَةً فِي قَرَارٍ مَكِينٍ – ثُمَّ خَلَقْنَا النُّطْفَةَ عَلَقَةً فَخَلَقْنَا الْعَلَقَةَ مُضْغَةً فَخَلَقْنَا الْمُضْغَةَ عِظَامًا فَكَسَوْنَا الْعِظَامَ لَحْمًا ثُمَّ أَنشَأْنَاهُ خَلْقًا آخَرَ فَتَبَارَكَ اللهُ أَحْسَنُ الْخَالِقِينَ
‘‘আমি তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি মৃত্তিকার উপাদান হতে, অত:পর আমি তাকে শুক্রবিন্দুরূপে স্থাপন করি ‘আলাক-এ, অত:পর ‘আলাককে পরিণত করি পিন্ডে এবং পিন্ডকে পরিণত করি অস্থি-পাঞ্জরে অত:পর অস্থি পাঞ্জরকে ঢেকে দেই গোশত দ্বারা; অবশেষে তাতে গড়ে তুলি অন্য এক সৃষ্টিরূপে। অতএব সর্বোত্তম স্রষ্টা আল্লাহ কত মহান।’’ [7]
অন্যত্র সৃষ্টি সম্পর্কে আরো বলা হয়েছে:
يَخْلُقُكُمْ فِي بُطُونِ أُمَّهَاتِكُمْ خَلْقًا مِنْ بَعْدِ خَلْقٍ فِي ظُلُمَاتٍ ثَلَاثٍ ذَلِكُمُ اللهُ رَبُّكُمْ لَهُ الْمُلْكُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ فَأَنَّى تُصْرَفُونَ
‘‘তিনি তোমাদেরকে তোমাদের মাতৃ-গর্ভের ত্রিবিধ অন্ধকারে পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি করেছেন। তিনিই আললাহ; তোমাদের প্রতিপালক; সর্বময় কর্তৃত্ব তারই; তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। তবে তোমরা মৃখ ফিরিয়ে কোথায় চলছ?’’ [8]
মূলত: মানুষকে একটি প্রাণ থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তারপর তা থেকে তার সঙ্গীর সৃষ্টি হয়েছে। অত:পর তাদের উভয়ের মাধ্যমে অসংখ্য নারী-পুরুষের বিস্তৃতি লাভ করেছে। মহান আল্লাহ সূরা নিসার শুরুতে ঘোষণা দিয়েছেন এভাবে:
يَاأَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمْ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً
‘‘হে মানব! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন ও যিনি তা হতে তার স্ত্রী সৃষ্টি করেন। যিনি তাদের দুইজন হতে বহু নব-নারী ছড়িয়ে দেন।’’ [9]
মানুষ সৃষ্টি করে মহনা আল্লাহ ক্লান্ত হননি বরং তাদের দিয়েছেন ভাল ও মন্দের মাঝে পার্থক্য করার ক্ষমতা, মুক্ত ও স্বাধীনভাবে জমীনে বিচরণের অধিকার, চিন্তার স্বাধীনতা প্রভৃতি। তিনি বলেন:
وَنَفْسٍ وَمَا سَوَّاهَا – فَأَلْهَمَهَا فُجُورَهَا وَتَقْوَاهَا – قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَا – وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسَّاهَا
‘‘শপথ মানুষের এবং তার, যিনি তাকে সুঠাম করিয়েছেন, অত:পর তাকে তার অসৎকর্ম এবং অসৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন। সে-ই সফলকাম হবে, যে নিজেকে পবিত্র করবে এবং সে-ই ব্যর্থ হবে যে নিজেকে কলুষাচ্ছন্ন করবে।’’ [10]
প্রকৃতপক্ষে মানুষের শ্রেষ্ঠ জীব হওয়ার মূলে যে বৈশিষ্ট্যটি খুবই গুরুত্বের দাবীদার তা হলো জ্ঞান। তিনি মানুষকে জ্ঞানের ভান্ডার দান করেছেন, শুধু তাই নয়, এ জ্ঞানের দ্বারাই মানুষ ফিরিশতাদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। এ মর্মে তিনি ইশরাদ করেন:
اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ- الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ – عَلَّمَ الْإِنسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ
‘‘পাঠ কর, আর তোমার প্রতিপালক মহামহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।’’ [11]
সূরা আল-বাকারাতে এসেছে:
وَعَلَّمَ آدَمَ الْأَسْمَاءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمْ عَلَى الْمَلَائِكَةِ فَقَالَ أَنْبِئُونِي بِأَسْمَاءِ هَؤُلَاء إِنْ كُنتُمْ صَادِقِينَ – قَالُوا سُبْحَانَكَ لَا عِلْمَ لَنَا إِلَّا مَا عَلَّمْتَنَا إِنَّكَ أَنْتَ الْعَلِيمُ الْحَكِيمُ
‘‘আর তিনি আদমকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন, তৎপর সে সমূদয় ফিরিশতাদের সামনে প্রকাশ করলেন এবং বললেন, ‘‘এই সমুদয়ের নাম আমাকে বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও। তারা বলল ‘আপনি মহান, পবিত্র। আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন, তাছাড়া আমাদেরতো কোন জ্ঞান নেই।’’ [12]
এতদ্ব্যতীত জ্ঞানের যেসব উপদান রয়েছে, তা সবই তিনি স্বীয় অনুগ্রহে মানুষকে দিয়েছেন। এ মর্মে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন:
وَجَعَلَ لَكُمْ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَالْأَفْئِدَةَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ
‘‘তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি এবং হৃদয়, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’’ [13]
কুরআনের অন্যত্র এসেছে:
أَلَمْ نَجْعَلْ لَهُ عَيْنَيْنِ – وَلِسَانًا وَشَفَتَيْنِ
‘‘আমি কি তার জন্য সৃষ্টি করি নাই দুই চক্ষু? আর জিহবা ও দুই ওষ্ঠ? [14]
এছাড়াও তিনি মানুষকে বয়ান বা কথা বলা শিখিয়েছেন। সূরা আর-রহমানে এসেছে:
الرَّحْمَنُ – عَلَّمَ الْقُرْآنَ- خَلَقَ الْإِنسَانَ- عَلَّمَهُ الْبَيَانَ
‘‘দয়াময় আল্লাহ তিনিই শিক্ষা দিয়েছে কুরআন, তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনিই তাকে শিখিয়েছেন ভাব প্রকাশ করতে।’’ [15]
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে নি‘আমত দ্বারা মানুষকে ভুষিত করা হয়েছে তা হলো যুগে যুগে প্রেরিত আসমানী গ্রন্থসমূহ। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী গ্রন্থের ধারণ করা সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন:
إِنَّا عَرَضْنَا الْأَمَانَةَ عَلَى السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَالْجِبَالِ فَأَبَيْنَ أَنْ يَحْمِلْنَهَا وَأَشْفَقْنَ مِنْهَا وَحَمَلَهَا الْإِنْسَانُ إِنَّهُ كَانَ ظَلُومًا جَهُولًا
‘‘আমি তো আসমান, যমীন ও পবর্তমালার প্রতি এই আমানত পেশ করেছিলাম, তারা তা বহন করতে অস্বীকার করল এবং তাতে শংকিত হলো, কিন্তু মানুষ তা বহন করল; সে তো অতিশয় জালিম, অতিশয় অজ্ঞ।’’ [16]
এসকল নি‘আমতের পিছনে উদ্দেশ্য ছিল কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন, তাঁর বিধি-বিধানের আনুগত্য করা, তাঁকে সিজদা করা প্রভৃতি। এসব অনুগ্রহের কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে স্বয়ং রাসূল (সা) সিজদায় অবনত হয়েছেন। সহীহ মুসলিম শরীফে এসেছে, তিনি বলেন:
مجد وجهى للذي خلقه وصوره وشق يحعه وبصره تبارك الله أحسن الخالقين
‘‘আমার চেহারা সিজদা করেছে ঐ সত্তার জন্য যিনি তা সৃষ্টি করেছেন, অবয়ব দিয়েছেন এবং দিয়েছেন তাকে শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি। আল্লাহ অতীব বরকতময়, সবচেয়ে উত্তম স্রষ্টা।’’ [17]
কিন্তু মানুষ অতিশয় অকৃতজ্ঞ। মহান আল্লাহ এসব অনুগ্রহের স্বীকৃতি দিতে চায় না এবং চেষ্টাও করে না। মহান আল্লাহ বলেন:
إِنَّ الْإِنسَانَ لَكَفُورٌ
‘‘মানুষ তো অতিমাত্রায় অকৃতজ্ঞ।’’ [18]
আল-কুরআন নানা ধরনের দীনি বিষয়ের বর্ণনার সাথে সাথে মানুষের বিভিন্ন প্রকারের স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য সর্ম্পকেও সংক্ষিপ্ত অথচ মূল্যবান চিত্র তুলে ধরেছে। যা সর্ব যুগের সর্বকালের সকল মানুষের মধ্যে বিদ্যমান। মানুষের এ স্বরূপগুলো স্থায়ী। কোন জাতি বা কোন গোত্রই এ সকল বৈশিষ্ট্যের বাইরে নয়।
পবিত্র কুরআনে যেসব মানুষের প্রশংসা করা হয়েছে, তেমনি নিন্দাও করা হয়েছে। তাকে একদিকে যেমন আসমান, জমিন ও ফিরিশতার চাইতেও মহীয়ান-গরীয়ান করা হয়েছে, অপরদিকে তেমনি তাকে চতুষ্পদ জন্তু, শয়তানের চেয়েও হীন ও নিকৃষ্টতর প্রাণীরূপে চিত্রিত করা হয়েছে। ফিরিশতার উপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করতে পারে এরাই, অথাপি এরা এত দুর্বল যে, নিকৃষ্টতম অবস্থানেও নেমে যেতে পারে। তাই কুরআনে তাদেরকে অত্যন্ত স্বৈরাচারী ও মুর্খরূপে চিত্রিত করা হয়েছে। এ মর্মে ইরশাদ হয়েছে:
وَلَقَدْ ذَرَأْنَا لِجَهَنَّمَ كَثِيرًا مِنْ الْجِنِّ وَالْإِنسِ لَهُمْ قُلُوبٌ لَا يَفْقَهُونَ بِهَا وَلَهُمْ أَعْيُنٌ لَا يُبْصِرُونَ بِهَا وَلَهُمْ آذَانٌ لَا يَسْمَعُونَ بِهَا أُوْلَئِكَ كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ أُوْلَئِكَ هُمْ الْغَافِلُونَ
‘‘আমি তো বহু জ্বিন ও মানবকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি, তাদের হৃদয় আছে কিন্তু তা দ্বারা তারা উপলব্ধি করে না, তাদের চক্ষু আছে তা দ্বারা তারা দেখে না এবং তদের কর্ণ আছে তা দ্বারা তারা শ্রবণ করে না, তারা পশুর ন্যায় বরং তারা অধিক বিভ্রান্ত, তারাই গাফিল।’’ [19]
কুরআনের অন্যত্র আরো বলা হয়েছে:
لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنسَانَ فِي أَحْسَنِ تَقْوِيم – ثُمَّ رَدَدْنَاهُ أَسْفَلَ سَافِلِينَ – إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ فَلَهُمْ أَجْرٌ غَيْرُ مَمْنُونٍ
‘‘আমি তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি সুন্দরতম গঠনে, অত:পর আমি তাদেরকে হীনতাগ্রস্থদের হীনতমে পরিণত করি। কিন্তু তাদেরকে নয় যারা মু’মিন ও সৎকর্ম করে, তাদের জন্য রয়েছে নিরবচ্ছিন্ন পুরস্কার।’’ [20]
অতএব উপরোক্ত আলোচনা থেখে প্রতীয়মান হয় যে, মানুষের স্বরূপ নির্ণয়ে পবিত্র কুরআন দু’ধরণের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছে। যেমন-
১. ভাল বৈশিষ্ট্য, ২. মন্দ বৈশিষ্ট্য।
এগুলোকে আমরা দুভাবে বিশ্লেষণ করতে পারি।
এক. ইতিবাচক দিক( যা কল্যাণকর ও অজর্নীয়), দুই. নেতিবাচক দিক (যা অকল্যাণকর ও বর্জনীয়)

১. ইতিবাচক দিক:

এক. মানুষ দুনিয়াতে আল্লাহর খলিফা
খলিফা শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো প্রতিনিধি, উত্তরাধিকারী।[21] মহান আল্লাহ তাঁর অসংখ্য সৃষ্টির মাঝে মানুষকে স্বীয় খলিফা মনোনীত করেছেন। যে তারা দুনিয়ার তাঁর দীন প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে তাঁর প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। এ মর্মে সৃষ্টির প্রারম্ভেই তিনি ফেরেশতাদের করে ঘোষণা দিয়েছেন:
وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً قَالُوا أَتَجْعَلُ فِيهَا مَنْ يُفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَاءَ وَنَحْنُ نُسَبِّحُ بِحَمْدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَ قَالَ إِنِّي أَعْلَمُ مَا لَا تَعْلَمُونَ
‘‘স্মরণ কর, যখন তোমার প্রতিপালক ফিরিশতাদের বললেন, ‘‘আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করতেছি; তারা বলল, আপনি কি সেখানে এমন কাউকেও সৃষ্টি করবেন যে অশান্তি ঘটানে ও রক্তপাত করবে? আমরাই তো আপনার সপ্রশংস স্ততিগান ও পবিত্রতা ঘোষনা করি। তিনি বললেন, আমি জানি যা তোমরা জান না।’’ [22]
তিনি (আল্লাহ) শুধু খলিফা হিসেবেই সৃষ্টি করেননি; বরং তাদেরকে পরীক্ষার জন্য একজনকে অন্যজনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন:
وَهُوَ الَّذِي جَعَلَكُمْ خَلَائِفَ الْأَرْضِ وَرَفَعَ بَعْضَكُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجَاتٍ لِيَبْلُوَكُمْ فِي مَا آتَاكُمْ إِنَّ رَبَّكَ سَرِيعُ الْعِقَابِ وَإِنَّهُ لَغَفُورٌ رَحِيمٌ
‘‘তিনিই তোমাদেরকে দুনিয়ার প্রতিনিধি করেছেন এবং যা তিনি তোমাদের দিয়েছেন সে সম্বন্ধে পরীক্ষার উদ্দেশ্যে তোমাদের কতজকে কতকের উপর মর্যাদায় উন্নীত করেছেন।’’ [23]
এছাড়াও খলিফা হিসেবে একজন মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য বিধৃত করতে গিয়ে তিনি তাঁর মনোনীত বান্দা দাউদ (আ.) কে লক্ষ্য করে বলেন:
‘‘হে দাউদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি, অতএব তুমি লোকদের মধ্যে সুবিচার কর এবং খেয়াল খুশির অনুসরণ করিও না, কেননা তা তোমাকে আল্লাহর পথ হতে বিচ্যুত করবে। [24]
এখানে প্রতিনিধি হিসেবে একজন রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব ও কর্তব্য কি তার দিকে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। কেননা মহান আল্লাহকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে প্রমাণিত করতে হলে তাঁর আইনকেই শুধু মানুষের মাঝে পরিচালিত করতে হবে অন্যথায় তা হবে ব্যক্তি পুজা বা প্রবৃত্তির অনুসরণ। আর দাউদ (আ.) এ ধরনেরই একজন শাসক ছিলেন।

দুই. সর্বশ্রেষ্ঠ নি‘আমত জ্ঞানের অধিকারী
মানুষ বোধশক্তি সম্পন্ন প্রাণী। মহান আল্লাহ মানুষকে এমন জ্ঞান দান করেছেন যার সাহায্যে ভাল ও মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণ প্রভৃতির মাঝে পার্থক্য সুচিত করা যায়। এ জ্ঞান দ্বারাই মানুষ ফিরিশতাদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত করেছে। অতএব জ্ঞানের ক্ষেত্রে মানুষ সকল প্রাণীর সেরা। পবিত্র কুরআনে এসেছে:
وَعَلَّمَ آدَمَ الْأَسْمَاءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمْ عَلَى الْمَلَائِكَةِ فَقَالَ أَنْبِئُونِي بِأَسْمَاءِ هَؤُلَاء إِنْ كُنتُمْ صَادِقِينَ- قَالُوا سُبْحَانَكَ لَا عِلْمَ لَنَا إِلَّا مَا عَلَّمْتَنَا إِنَّكَ أَنْتَ الْعَلِيمُ الْحَكِيمُ- قَالَ يَاآدَمُ أَنْبِئْهُمْ بِأَسْمَائِهِمْ فَلَمَّا أَنْبَأَهُمْ بِأَسْمَائِهِمْ قَالَ أَلَمْ أَقُلْ لَكُمْ إِنِّي أَعْلَمُ غَيْبَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَأَعْلَمُ مَا تُبْدُونَ وَمَا كُنتُمْ تَكْتُمُونَ
‘‘আর তিনি আদম কে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন তারপর ফিরিশতাদের সামনে সেগুলো প্রকাশ করলেন এবং বললেন ‘এগুলোর নাম আমাকে বলে দাও, ’ যদি তোমরা সত্যবাদী হও। তারা বলল, আপনি মহান পবিত্র। আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তাছাড়া আমাদের তো কোন জ্ঞান নেই। বস্ত্তত আপনি জ্ঞানমত ও প্রজ্ঞাময়। তিনি বললেন ‘‘হে আদম! তাদেরকে এসকল নাম বলে দাও’। সে তাদেরকে এ সবের নাম বলে দিল।’’ [25]
জ্ঞানে মাধ্যমেই মানুষ প্রভৃত কল্যাণের অধিকারী হয়েছে। এজন্যই পবিত্র কুরআনে বারবার জ্ঞান আহরণে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্য বলা হয়েছে-মহান আল্লাহ বলেন:
وَمَنْ يُؤْتَ الْحِكْمَةَ فَقَدْ أُوتِيَ خَيْرًا كَثِيرًا
যাকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, তার প্রভৃত কল্যাণ সাধিত হয়েছে। [26]
তিনি আরো বলেন:
وَهُوَ الَّذِي يَتَوَفَّاكُمْ بِاللَّيْلِ وَيَعْلَمُ مَا جَرَحْتُمْ بِالنَّهَارِ ثُمَّ يَبْعَثُكُمْ فِيهِ لِيُقْضَى أَجَلٌ مُسَمًّى ثُمَّ إِلَيْهِ مَرْجِعُكُمْ ثُمَّ يُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ
‘‘বল অন্ধ ও চক্ষুম্মান কি সমান? তোমরা কি অনুধাবন কর না?’’ [27]

পরবর্তী পর্বে আলোচনা চলবে, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের অর্থ বুঝে বেশি বেশি কুর’আন পড়ার তাওফিক দান করুন। আমীন!

________________________________________
[1] . সূরা আল-আন‘আম: ৩৮। অন্যত্র আরো ষ্পষ্ট করে বলা হয়েছে:
وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً وَبُشْرَى لِلْمُسْلِمِينَ
‘‘ আমি আত্মসম্পর্ণকারীদের জন্য প্রত্যেক বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যাস্বরূপ পথ নির্দেশ, দয়া ও সুসংবাদস্বরূপ তোমাদের প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করলাম। (সূরা আন-নাহল: ৮৯)
[2] . সূরা বনী ইসরাইল:৭০।
[3] . সুরা আল-হাজ্ব: ৬৫।
[4] . আব্দুর রহমান আননাহলাভী, উসূলুত তারিবিয়াতিল ইসলামিয়্যাহ ওয়া আসালিবুহা, দামেশক, দারুল ফিকর, ১৯৭৯ খ্রী. পৃ. ৩০।
[5] . সূরা আস-সাজদা: ৭-৮।
[6] . সূরা আল-হিজর: ২৮-২৯।
[7] . সূরা আল-মু‘মিনুন:১২-১৪।
[8] . সূরা আয-যুমার: ৬।
[9] . সূরা আন-নিসা: ১।
ইসলামি দা’ওয়াহ্র ৮০ টিরও বেশী উপায়! (এক্সক্লুসিভ পোস্ট)
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীনের জন্য যিনি তার দ্বীনের পথে মানুষকে আহ্বানকারীদের অশেষ মর্যাদার কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন বলেনঃ
“ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা কথায় কে উত্তম যে আল্লাহ্র দিকে মানুষকে আহ্বান করে, সৎকর্ম করে এবং বলেঃ আমি তো আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত।” (৪১:৩৩)
অতঃপর দরূদ ও সালাম অবতীর্ণ হোক প্রিয় নবী (সা) এর উপর যিনি আমাদের আদর্শ এবং যিনি বলেছেনঃ
“যে কেউ কোন ভাল কাজ করলে ভাল কাজে আহ্বানকারী ব্যক্তিও তার সমপরিমাণ পুণ্য লাভ করবে।”

মুসলিমরা জানে আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন তাদেরকে একমাত্র সত্য ধর্ম ইসলামকে তাদের জীবন বিধান হিসেবে দান করে তাদের সম্মানিত করেছেন এবং একই সাথে ইসলামকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব আরোপ করেছেন। আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন বলেনঃ
(কোরআন) তোমার ও তোমার সম্প্রদায়ের জন্যে তা সম্মানের বস্তু; তোমাদের অবশ্যই এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে।[৪৩:৪৪]

তারা এটাও জানে যে, যদি তারা তাদের ইসলাম প্রচারের এই দায়িত্বকে পালন করে এবং ইসলামকে দ্বীন হিসেবে মেনে চলার ক্ষেত্রে অন্যের হেদায়াতের কারণ হয় তাহলে তারা তাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে এমন প্রতিদান প্রাপ্ত হবে যা তারা কল্পনাও করতে পারেনা। এ বিষয়ে আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন বলেনঃ
“তুমি বলে দাওঃ আল্লাহ্র এই দান ও রহমতের (কোরআনের) প্রতি সকলেরই আনন্দিত হওয়া উচিৎ; এটা পার্থিব সম্পদ হতে বহুগুণ উত্তম যা তারা সঞ্চয় করেছে।” [১০:৫৮]
এবং প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা) বলেনঃ
“আল্লাহ্ যদি কাউকে হেদায়াত দিয়ে পথ দেখান তাহলে এই হেদায়াত পৃথিবীতে যা কিছু আছে তার চেয়েও বেশী মুল্যবান।”

এটা আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীনের এক সুস্পষ্ট অনুগ্রহ যে তিনি তাঁর দ্বীনকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার অগণিত পথ আমাদের সামনে উন্মোচিত করে দিয়েছেন। প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে ইসলাম প্রচারে অংশগ্রহণ করে তাদের স্রষ্টার কাছ থেকে পুরস্কার পাওয়ার সুযোগ নিতে পারেন। মানুষকে ইসলামের পথে দা’ওয়াহ্ দিতে হবে এমন পদ্ধতিতে যা মানুষের কাছে সবচেয়ে সুবিধাজনক এবং গ্রহণযোগ্য। পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী একজন দা’ঈকে তাঁর দা’ওয়াহ্র পদ্ধতিও বদলানো লাগবে। আর ঠিক এই কাজটাই করেছিলেন নবী নূহ্ (আ) এবং তাঁর পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণ।

একজন দা’ঈর দায়িত্ব হল মানুষকে ইসলামের পথে ডাকার সবরকম পন্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা। এতে করে দা’ওয়াহ্র কাজ করা তার জন্য অনেক সহজ হবে। একজন দা’ঈকে তার নিজ পরিবারের আপনজন থেকে শুরু করে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বাড়ীতে কাজের লোকসহ প্রতিটি মানুষকেই ইসলামের দা’ওয়াহ্ দিতে হবে। তাকে জানতে হবে কোথায়, কখন এবং কিভাবে ইসলামের দা’ওয়াহ্ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। এক্ষেত্রে তার গুরুত্বপূর্ণ স্থানের তালিকায় থাকবে মসজিদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, জেলখানা, পার্ক, সমুদ্র সৈকত, বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্র, হাজী ক্যাম্প, আবাসিক হোটেল, এয়ারপোর্ট, বাস টার্মিনাল, কমিউনিটি সেন্টার, শপিং সেন্টার, বাজার এলাকা, অফিস আদালত, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়া, খাবার হোটেল-রেস্তরা ইত্যাদি। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যেমনঃ পাসপোর্ট অফিস, পোস্ট অফিস, পর্যটন কেন্দ্র, বিভিন্ন তথ্য প্রদানকারী সংস্থা ইত্যাদিও তার ইসলামি দা’ওয়াহ্র ক্ষেত্র হতে পারে।

ইসলামের দা’ওয়াহ্র কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের মধ্যে পারস্পারিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে করে একে অন্যের কর্মদক্ষতা, অভিজ্ঞতা ইত্যাদিকে কাজে লাগিয়ে ইসলামি দা’ওয়াহ্র কাজে নিয়োজিত কর্মীরা আরো দক্ষ এবং সৃজনশীল হয়ে উঠবেন। ফলে দা’ওয়াহ্ কার্যক্রমকে আরো সফলভাবে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। পারস্পারিক উৎসাহ উদ্দীপনার মাধ্যমের ইসলামের সত্যবাণীকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার কাজ চালিয়ে যেতে হবে। মানুষকে দা’ওয়াহ্ দেয়ার ক্ষেত্রে একজন দা’ঈকে প্রয়োজনীয় সবরকম দা’ওয়াহ্ উপকরণকে কাজে লাগাতে হবে। এক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ইসলাম নিয়ে কাজ করতে আগ্রহীদের নিয়োগ দিয়ে হবে। তাদের সাথে যৌথ উদ্যোগে বিভিন্ন বই-পুস্তক, পত্র-পত্রিকা, লিফলেট, হ্যান্ডবিল ইত্যাদি প্রিন্ট করে সেগুলো বিতরণের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি ইসলামিক সিডি ও ভিসিডির কপি তৈরি করে সেগুলো বন্ধুমহলে এবং চারপাশের মানুষদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে।

অনেকেই বুঝে উঠতে পারেন না কিভাবে ইসলামিক দা’ওয়াহ্র কাজ শুরু করবেন। অনেকেই আবার অজ্ঞতার ওজুহাতে দেখিয়ে কিছু না করেই দিন পার করে যাচ্ছেন। নিচে আমরা ৮০ টিরও বেশী উপায় সম্বলিত একটি পরামর্শ তালিকা দিচ্ছি। পরামর্শগুলো কাজে লাগিয়ে আপনারা সহজেই ইসলামকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম হবেন ইনশাআল্লাহ্-

পরিবারে দা’ওয়াহঃ
১. পারিবারিক গ্রন্থাগারঃ পরিবারে সকল সদস্যদের বয়স বিবেচনা করে সে অনুযায়ী বাড়ীতে বিভিন্ন ইসলামিক বই-পুস্তক, পত্র-পত্রিকা এবং ইসলামিক বক্তাদের লেকচারের সিডি-ভিসিডির একটি সংগ্রহশালা গড়ে তুলুন। আপনার আত্মীয় স্বজনদের বলুন তারা আপনার বাসা থেকে সেগুলো নিয়ে বাসায় পড়তে।

২. ওয়াল পোস্টারঃ বাড়ীতে একটি নির্ধারিত স্থানকে নোটিশ বোর্ডের মত পোস্টার লাগানোর জন্য ব্যবহার করুন। গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক লেকচার, বিভিন্ন প্রোগ্রামের সময়সূচী ইত্যাদি পরিবারের সবাইকে মনে করিয়ে দেয়ার জন্য ওয়াল পোস্টারের স্থানটিকে ব্যবহার করুন।

৩. পারিবারিক শিক্ষার আসরঃ পরিবারের সবাই মিলে একসাথে বসে কেউ একজন কোন একটি বই থেকে সকলের উদ্দেশ্যে পড়ুন এবং বাকিরা শুনুন।যেমন কিতাবুত তাওহীদ। এক্ষেত্রে একসাথে বসে ইসলামিক লেকচার শুনতে পারেন অথবা কোরআনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আয়াত এবং গুরুত্বপূর্ণ হাদীসগুলোও মুখস্ত করতে পারেন।

৪. পারিবারিক প্রতিযোগিতাঃ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নানা রকম ইসলামিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করুন যা তাদেরকে ইসলাম মেনে চলার ক্ষেত্রে আরো বেশী অনুপ্রেরণা দেবে। পুরস্কার হিসাবে প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণদের নামসমূহ পারিবারিক সম্মাননা তালিকার শীর্ষে রাখা যেতে পারে। তালিকার শীর্ষে নিজের নাম থাকাটাই তাদের কাছে অনেক বড় পুরস্কার মনে হবে।

৫.পারিবারিক ম্যাগাজিনঃ বাড়ীতে একটি পারিবারিক ম্যাগাজিন প্রকাশের ব্যবস্থা করুন। এতে পরিবারের বিভিন্ন সদস্যরা ইসলাম বিষয়ক বিভিন্ন আর্টিকেল লিখবে। কুরআনের আলো ওয়েবসাইট থেকেও তারা ইসলাম বিষয়ক বিভিন্ন প্রবন্ধ বা ছবি সংগ্রহ করে এই ম্যাগাজিনে প্রকাশ করতে পারে।

৬. ইসলামিক সমাজ কল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণঃ সালাত আয়াদের জন্য মসজিদে যাবার সময়, ইসলামিক লেকচার শুনতে যাবার সময় অথবা কোন অসুস্থ কাউকে দেখতে যাবার সময় সাথে আপনার ভাই বা সন্তানদের নিয়ে যান। ইসলামি দাওয়াহ্র কাজে নিয়োজিত বিভিন্ন সংগঠনগুলোতেও তাদেরকে আপনার সাথে নিয়ে যান।

৭. অন্যদের সামনে ভাল কাজঃ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সামনেও কিছু ভাল কাজ করুন যাতে তারা আপনাকে দেখে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, তাদের সামনে সালাত আদায় করুন, কোরআন তেলাওয়াত করুন, গরীব দুঃখীদের দান সাদাকা করুন ইত্যাদি।

মসজিদে দা’ওয়াহঃ
৮. দেয়াল ম্যাগাজিনে অংশগ্রহণঃ অধিকাংশ মসজিদের পেছনের দিকের দেয়ালে নোটিশ বোর্ড থাকে যা বিভিন্ন ধরনের ঘোষণা, ইসলামিক পোস্টার ইত্যাদি লাগানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। এই নোটিশ বোর্ডে গুরুত্বপূর্ণ আর্টিকেল পোস্ট করতে পারেন অথবা মানুষকে ইসলাম সম্পর্কে সচেতন করে এমন তথ্যমূলক পোস্টার কিনে লাগাতে পারেন। কুরআনের আলো ওয়েবসাইট থেকেও আপনারা প্রবন্ধ প্রিন্ট, করে আপনার এলাকার মসজিদে লাগাতে পারেন।

৯. মসজিদের সুযোগ সুবিধা এবং অনুষ্ঠানের উন্নয়নঃ মসজিদে দা’ওয়াতের কার্যক্রম এবং অন্যান্য সুযোগসুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে মসজিদের পাঠাগার ও হিফয্‌খানার উন্নয়নের কাজে অংশগ্রহন করুন। দান বাক্সের মাধ্যমেও উক্ত কাজে সহায়তা করতে পারেন।

১০. ইসলামিক বই-পুস্তক এবং অডিও/ ভিডিও সিডি/ডিভিডি সরবরাহঃ বিভিন্ন ইসলামিক কল্যাণমূলক সংগঠন থেকে গুরুত্বপূর্ণ বই-পুস্তক, পত্র-পত্রিকা, ইসলামিক লেকচার, প্রামাণ্যচিত্রের অডিও/ভিডিও সিডি/ডিভিডি ইত্যাদি সংগ্রহ করে মসজিদের বিভিন্ন স্থানে রাখুন যাতে মুসল্লিদের দৃষ্টিগোচর হয়। যেমনঃ কোরআনের পাশাপাশি তার একাধিক অনুবাদসহ তাফসীর গ্রন্থগুলো মসজিদের সেলফে রাখা যেতে পারে।

১১. মসজিদে অনুষ্ঠিতব্য আলোচনা অনুষ্ঠান সম্পর্কে লোকজনকে জানানোঃ মসজিদে কখন কোন বিষয়ের উপর লেকচারের আয়োজন করা হয়েছে অথবা কোন সময় কোরআন শিক্ষার ক্লাস অনুষ্ঠিত হচ্ছে ইত্যাদি জানিয়ে মসজিদের নোটিশ বোর্ড কিংবা দরজায় বিজ্ঞাপন দিন।

১২. লেকচারের আয়োজন করাঃ আপনার পরিচিত বিশুদ্ধ ও পরিচ্ছন্ন আকীদার বক্তাদের লেকচার দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ করে মসজিদে নিয়ে আসুন। এক্ষেত্রে অন্যান্য দা’ওয়াহ্ সংস্থাগুলোর সাথে যোগাযোগ করে তাদের কাছ থেকে আথবা কুরআনের আলো ওয়েবসাইট থেকেও ভিডিও লেকচার সংগ্রহ করে, প্রোজেক্টরের মাধ্যমে লোকদের দেখানোর ব্যবস্থা করতে পারেন।

১৩. জুম’আর খুৎবা পর্যালোচনাঃ জুম’আর দিন ইমাম যে খুৎবা দেন তার বিষয়বস্তু নিয়ে লোকজনের সাথে পর্যালোচনা করুন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে খুৎবার প্রাসঙ্গিকতা বিচার করে তা বাস্তবায়নের জন্য লোকদের উৎসাহিত করুন।

১৪. মসজিদ কমিটিতে অংশগ্রহণঃ ইসলামিক দা’ওয়াহ্র পাশাপাশি অন্যান্য কল্যাণমূলক সামাজিক কর্মকাণ্ড নিয়ে কাজ করার জন্য মসজিদ কমিটির কর্মী হিসেবে অংশগ্রহন করুন।

১৫. ইমামের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলুনঃ আপনার মসজিদের ইমামের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলুন। আপনি তাকে Youtube অথবা আমাদের ওয়েবসাইটের বিভিন্ন লেকচার তাকে দেখাতে পারেন বা শোনাতে পারেন। Youtube এ khalifahklothing, shaykha, quraneralo – এই চ্যানেলগুলোতে অনেক ভালো ইংলিশ/বাংলা লেকচার পাবেন। এই লেকচার গুলো তাদের দেখাতে পারেন। তারা এই লেকচার গুলো নিয়ে জুম্মা তে খুৎবা দিতে পারবেন। (উপরের চ্যানেলগুলো দেখার জন্য নির্দিষ্ট চ্যানেলটির উপর ক্লিক করুন)

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দা’ওয়াহঃ
১৫. সকালের পিটি-প্যারেডঃ বিভিন্ন দা’ওয়াহ্ উপকরণ যেমনঃ ইসলামিক বই-পুস্তক, ম্যাগাজিন, লেকচারের অডিও/ ভিডিও সিডি ইত্যাদি প্রস্তুত রাখুন এবং সকালের পিটি প্যারেডে পরিস্থিতি বুঝে কাজে লাগান।

১৬. স্কুলের নোটিশ বোর্ডঃ এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটিজ এর পাশাপাশি বিভিন্ন ইসলামিক লেকচার, সভা-সেমিনার ইত্যাদির বিজ্ঞাপন দেয়ার জন্য আকর্ষণীয় সব পোস্টার তৈরি করে সেগুলো নোটিশ বোর্ডে লাগিয়ে দিতে পারেন।

১৭. নাট্য কর্মকাণ্ডঃ ইসলামিক ভাবধারা এবং ইসলামিক মূল্যবোধকে উজ্জীবিত করে এমন নাটক মঞ্চায়নের ব্যবস্থা করুন।

১৮. বক্তৃতা-ভাষণঃ স্কুলে ইসলামের বিশেষজ্ঞ বক্তাদের নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করুন। অনুষ্ঠানে ছাত্ররা যাতে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের উপর উন্মুক্ত প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশগ্রহণের সুযোগ পায় সেদিকে খেয়াল রাখুন। এতে করে ছাত্ররা তাদের করা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর গ্রহণযোগ্য উত্তর পেলে ইসলাম তাদের কাছে আরো গ্রহণযোগ্য ও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে।

১৯. বিভিন্ন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানঃ স্কুলের ছাত্র-শিক্ষক এবং কর্মচারীদের নিয়ে বিভিন্ন ইসলামিক এবং শিক্ষামূলক প্রতিযোগিতার আয়োজন করুন। বিজয়ীদের মাঝে ইসলামিক পুরস্কার বিতরণ করুন। প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানগুলোতে দা’ওয়াহ্র গুরুত্ব তুলে ধরে বিভিন্ন প্রবন্ধ উপস্থাপন করুন।

২০. ছাত্রদের স্বার্থরক্ষাঃ ছাত্রদের বিভিন্ন বিষয়ে উপদেশ, পরামর্শ, অভিযোগ ইত্যাদি সংগ্রহ করে সেগুলো স্কুল কর্তৃপক্ষের নিকট উপস্থাপন করুন। বিশেষ করে ইসলামের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে তাদের পূর্ণ সমর্থন ও সহায়তা দিন।

২১. ইসলামিক গ্রন্থাগারঃ স্কুলের সাধারন গ্রন্থাগারকে ইসলাম বিষয়ক বই-পুস্তকের একটি সমৃদ্ধ সংগ্রহশালা হিসেবে গড়ে তুলতে “ইসলামিক স্টাডিজ” বিভাগকে সহায়তা করুন। এখানে ইসলামিক সাহিত্যের পাশাপাশি রাসূল (সা) এর সাহাবীদের (রা) এবং ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণ মুসলিমদের জীবনচরিতগুলোও যাতে পাওয়া যায় সে ব্যবস্থা করুন।

২২. বিভিন্ন প্রচার-প্রদর্শনীঃ স্কুল কর্তৃপক্ষ আয়োজিত বিভিন্ন বইমেলা, ভিডিও প্রদর্শনী কিংবা বিভিন্ন মাদক বিরোধী প্রচারাভিযানে অংশগ্রহণ করুন।

২৩. ইসলামিক সপ্তাহ উদ্‌যাপনঃ স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করুন যেন তারা বছরে একটি দিন ইসলামিক সপ্তাহ হিসেবে উদ্‌যাপনের অনুমতি দেয়। এমন অনুষ্ঠানগুলোতে নানা রকম ইসলামিক প্রদর্শনীর আয়োজন থাকবে। ইসলাম সম্পর্কে মানুষের ভুল ধারনা দূর করে এমন স্লোগান খোচিত আকর্ষণীয় পোস্টার, ক্যালেন্ডার, আরবি ভাষা শিক্ষার সফটওয়্যার, কোরআনের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা সম্বলিত সফটওয়্যার, কোরআনের তেলাওয়াত, ইসলামিক লেকচার, প্রামান্যচিত্রের সিডি-ভিসিডি ইত্যাদি হবে প্রদর্শনীর প্রধান আকর্ষণ।

২৪. গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে দা’ওয়াহঃ ছুটিতে পড়াশোনার চাপ কম থাকলে সময়টা কাটাতে পারেন বন্ধুমহলে সামনে ইসলামকে তুলে ধরার মাধ্যমে। তাদের সাথে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করুন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে তাদের কি মত তা জেনে নিয়ে ইসলামে এসবের সমাধান কি তা তাদের সাথে শেয়ার করুন।

কর্মক্ষেত্রে দা’ওয়াহঃ
২৫. দা’ওয়াহ্ পোস্টারঃ ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের উপর আকর্ষণীয় ও নজরকাড়া পোস্টার তৈরি করে অফিসের নোটিশ বোর্ডে লাগিয়ে দিন। কোথাও কোন ইসলামিক অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকলে সেটাও বিজ্ঞাপন আকারে নোটিশ বোর্ডে লাগাতে পারেন।

২৬. নিজের বসার টেবিলঃ আপনার অফিসের টেবিলে সবসময় কিছু না কিছু দা’ওয়াহ্ উপকরণ রাখুন। যেমনঃ ইসলামিক পুস্তিকা, ম্যাগাজিন, কোরআনের উপদেশ সম্বলিত পেপার ওয়েট ইত্যাদি। এতে করে আপনার সহকর্মীরা থেকে শুরু করে আপনার ক্লায়েন্টসদের সকলের নজরে পড়বে ব্যাপারটি। ফলে তাদের সাথে মুখের কথা খরচ না করেই অনেকখানি দা’ওয়াহ্র কাজ হয়ে যাবে। আপনাকে দেখে তারাও দা’ওয়াহ্র কাজে উদ্বুদ্ধ হতে পারে।

২৭. ইসলামিক লেকচারের সিডি/ডিভিডি বিতরণঃ সহকর্মীদের চালচলন, কথাবার্তা, বয়স ইত্যাদি বিবেচনা করে তাদের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক লেকচারগুলো বিতরণ করুন। বিশেষ করে এমন
ধরনের লেকচার তাদের কে শুনতে বা দেখতে দিন যেগুলোর বিষয়বস্তু বা শিরোনাম অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং যেগুলো বস্তুবাদী মানব জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করে।

২৮. আমন্ত্রণ জানানঃ সহকর্মীদের আমন্ত্রণ করে ইসলামিক আলোচনা অনুষ্ঠান এবং সভা-সেমিনারে নিয়ে যান। তাদেরকে বিভিন্ন ইসলামিক দা’ওয়াহ্ সংগঠনগুলোতেও সাথে করে নিয়ে যান।

২৯. জামা’য়াতে সালাত আদায় করুনঃ সহকর্মীদের সাথে নিয়ে অফিসে একসাথে সালাত আদায় করুন অথবা তাদেরকে সাথে নিয়ে পাশের কোন মসজিদেও সালাত আদায়ের জন্য যেতে পারেন।

৩০. ইসলামিক আচার-অনুষ্ঠানঃ বিভিন্ন সভা সমাবেশের আয়োজন করুন এবং ইসলামের দা’ঈদেরকে অনুষ্ঠানগুলোতে আমন্ত্রণ করুন। অনুষ্ঠানে তাদের উপস্থিতি ও বক্তব্য দর্শক-শ্রোতাদের মাঝে ইসলামকে জানার ব্যাপারে আগ্রহ তৈরি করবে।

৩১. উন্মুক্ত আলোচলাঃ দুপুরের খাবার কিংবা চা বিরতির সময়টা খোশগল্পে না কাটিয়ে ইসলামিক আলোচনার উপলক্ষ হতে পারে।

৩২. ইসলামিক উদ্যোগঃ ইসলামিক দা’ওয়াহ্র সাথে যারা সক্রিয়ভাবে জড়িত তাদেরকে সাথে নিয়ে বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক উদ্যোগ হাতে নিয়ে সেগুলো বাস্তবায়ন করুন।

৩৩. ইসলামিক দৃষ্টান্তঃ কর্তব্যপালণ এবং কর্মসম্পাদনের ক্ষেত্রে শতভাগ আন্তরিক হউন। আপনার প্রতিটি কর্মই সাধ্যমত করার চেষ্টা করুন এবং অন্যদের চোখে প্রমাণ করুন আপনি যা করেছেন একজন ভাল মুসলিম বলেই তা করেছেন। আর এভাবেই তাদেরকে বোঝান ইসলাম কিভাবে মানুষকে সত্যকার অর্থে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গোড়ে তোলে।

দাওয়াহ্র কিছু সাধারন পন্থাঃ
৩৪. দা’ওয়াহ্ পোস্টারঃ অত্যন্ত দৃষ্টি-আকর্ষক এবং নান্দনিক সৌন্দর্যের বিভিন্ন দৃশ্যাবলী ব্যবহার করে পোস্টার তৈরি করুন। সামাজিক জীবনের বিভিন্ন বাস্তবিক মুহূর্তের চিত্র তুলে ধরে সেই পরিস্থিতিতে কিভাবে দা’ওয়াহ্ দেয়া যায় তা তুলে ধরুন। পোস্টারগুলোতে মানুষের চিন্তা উদ্রেককারী ইসলামিক স্লোগান লিখে দিন এবং সেগুলোকে শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে টাঙানোর ব্যবস্থা করুন।

৩৫. ইসলামিক শুভেচ্ছা কার্ডঃ বিভিন্ন শুভেচ্ছাবাণী সম্বলিত কার্ড ছাপিয়ে সেগুলো বিতরণ করতে পারেন। গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক দিন কিংবা অনুষ্ঠানের তারিখ দিয়ে কার্ড ছাপিয়ে সেগুলোও বিতরণ করা যেতে পারে। কার্ডগুলোতে মনোরম অক্ষরে ইসলামে নিষিদ্ধ বিষয় যেমনঃ সুদ, ঘুষ, পরচর্চা, প্রতারণা ইত্যাদির কুফল উল্লেখ করুন।

৩৬. দা’ওয়াহ্ এ্যালবামঃ পরকাল সম্পর্কে মানুষের মনে ভীতি সঞ্চারকারী এবং তাদের মনে বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারে এমন সব ছবি সংগ্রহে রাখুন। ছবিগুলো আপনাদের দা’ওয়াহ্ সংগঠনের দর্শনার্থীদের জন্য ব্যবহার করুন অথবা উপহার হিসেবে সেগুলো তাদেরকে দিতেও পারেন।

৩৭. বিয়ের কার্ডঃ বিয়ের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের ইসলামিক দা’ওয়াহ্ পৌঁছে দেয়ার জন্য ইসলামিক দা’ওয়াহ্র প্রচারপত্রের উল্টো পিঠ বিয়ের কার্ড হিসেবে ব্যবহার করুন। উদাহরণস্বরূপ, যে এলাকার লোকজন বিয়ের অনুষ্ঠানে অনৈসলামিক কার্যকলাপে লিপ্ত হয় সে এলাকার লোকজনদের দা’ওয়াহ্ দেয়ার জন্য “ইসলামে বিয়ে অনুষ্ঠানের ‘আদাব” শীর্ষক পুস্তিকা বিয়ের কার্ড হিসেবে ব্যবহার করুন।

৩৮. টাইপিং এবং রিভিশনঃ হয়ত কোন কাউকে ইসলামের দা’ওয়াহ্ দিতে চাচ্ছেন কিন্তু সরাসরি কিছু বললে কাজ হবে না। সেক্ষেত্রে যা করতে পারেন তা হল, তাকে দিয়ে ইসলামিক কোন আর্টিকেল লেখান বা লেখা আর্টিকেল তাকে প্রুফ রিডিং এর জন্য দিন। এমনি এমনি হয়ত পড়ত না কিন্তু অনুরোধ করে কাজটি করতে বললে করবে এবং এক্ষেত্রে দুই কাজই হবে। লিখতে গিয়ে বা প্রুফ রিডিং করতে গিয়ে সে মনোযোগ দিয়ে পড়বে এবং ইসলামের দাওয়াহ্র কাজও হবে।

৩৯. মোবাইলের মাধ্যমে দাওয়াহঃ আপনার মোবাইল এবং ই-মেইল কন্ট্যাক্ট লিস্টের সকলকে গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক দিন ও অনুষ্ঠানের কথা জানিয়ে এবং মনে করিয়ে দিয়ে মেসেজ পাঠান। ইসলামে দা’ওয়াহ্র গুরুত্ব উল্লেখ করে সংক্ষিপ্ত আর্টিকেল লিখে তাদের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিন। আমাদের ওয়েবসাইটের সব আর্টিকেল ইমেইল করে পাঠাতে পারেন।

৪০. ইন্টারনেট দা’ওয়াহঃ বিভিন্ন জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগের সাইট যেমনঃ Facebook, Twitter, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে ইসলামি প্রবন্ধ, বই, অডিও/ভিডিও লেকচার শেয়ার করুন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। । ইন্টারনেটে এমন অসংখ্য চ্যাট রুম/ব্লগ আছে যেগুলোতে ইসলামের কুৎসা রটনা করা হচ্ছে, ইসলামের নামে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এমন চ্যাট রুম/ ওয়েবসাইট গুলোতে আলোচনায় অংশ নিন এবং তাদের মিথ্যাচারকে খণ্ডন করুন।

৪১. গণমাধ্যমে দা’ওয়াহঃ রেডিও এবং টেলিভিশনের জন্য ইসলামিক অনুষ্ঠান নির্মাণ করে সেগুলো সম্প্রচারের ব্যবস্থা করুন। অনুষ্ঠানগুলো সম্প্রচারের আগেই সেগুলোর প্রচার সময় এবং চ্যানেলের নাম উল্লেখ করে ব্যপক প্রচারণা চালান। এক্ষেত্রে পূর্বোল্লিখিত পদ্ধতিতে পোস্টারের মাধ্যমে তা করতে পারেন। ফেইসবুকের সাইডবারেও আকর্ষণীয় ইমেজ ব্যবহার করে বিজ্ঞাপন দিতে পারেন। স্থানীয় সংবাদপত্রেও ইসলাম বিষয়ক আর্টিকেল লিখে পাঠান।

৪২. স্টিকারের মাধ্যমে দা’ওয়াহঃ সালাত আদায় করা, পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করা, দুস্থদের সহায়তা করা ইত্যাদি বিষয়গুলো মানুষকে মনে করিয়ে দেয় এমন মেসেজ লিখে স্টিকার আকারে সেগুলো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানসহ পাবলিক যানবাহন যেমনঃ বাস, ট্রেন ইত্যাদিতে লাগানোর ব্যবস্থা করুন। স্টিকারে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দো’য়া যেমনঃ বাড়ীর বাইরে যাওয়ার দো’য়া, বাড়ীতে প্রবেশের দো’য়া, টয়লেটে প্রবেশের দো’য়া ইত্যাদি লিখে মানুষের মাঝে বিতরণ করুন যাতে তারা সেগুলো বাড়ীর যথাস্থানে লাগিয়ে রাখতে পারে। আবাসিক হোটেলের মালিকদের অনুমতি নিয়ে হোটেলের রুমগুলোতে সালাতের জন্য কিব্‌লা উল্লেখ করে আকর্ষণীয় স্টিকার লাগাতে পারেন।

৪৩. সালাত এবং সাওমের (রোজা) সময়সূচী প্রচারঃ সালাতের সময়সূচী এবং রমজান মাসে ইফতারের সময়সূচী ছাপিয়ে সেগুলোকে শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে লাগানোর ব্যবস্থা করুন। এতে করে মুসল্লীদের এবং যারা রোজা রাখেন তাদের অনেক উপকার হবে। এতে করে সালাতের ব্যাপারে অন্যান্যদেরও স্মরণ করিয়ে দেয়া যাবে।

৪৪. দিনপঞ্জি এবং কর্মসূচীঃ গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক দিন এবং কর্মসূচীর তারিখ ইত্যাদি উল্লেখ করে আকর্ষণীয় দিনপঞ্জি ছাপিয়ে তা প্রকাশের ব্যবস্থা করুন।

৪৫. কলিং কার্ডঃ বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানীর সাথে যোগাযোগ করে ব্যালেন্স রিচার্জ কার্ডের উপরে দা’ওয়াহ্ মেসেজ লিখে সেগুলো দোকানে দোকানে সরবরাহ করার ব্যবস্থা করুন।এতে করে ব্যালেন্স রিচার্জ কার্ডের মাধ্যমেও কাস্টোমারদের কাছে ইসলামের দা’ওয়াহ্ পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে।

৪৬. পোস্ট কার্ডঃ প্রাকৃতিক মনোরম দৃশ্য ব্যবহার করে আকর্ষণীয় পোস্ট কার্ড ডিজাইন করুন। পোস্ট কার্ডের উল্টো পিঠে ইসলামিক দা’ওয়াহ্ সম্পর্কিত মেসেজ লিখে সেগুলো ছাপানোর ব্যবস্থা করুন। উদাহরণস্বরূপ, কোন খেজুর বাগানের মনোরম দৃশ্যকে ব্যাকগ্রাউন্ড করে তার উপর কোরআনে বর্ণিত “পানি চক্র” সম্পর্কিত আয়াতের উদ্ধৃতি দিতে পারেন।

৪৭. দা’ওয়াহ্ ব্রিফকেইসঃ বিশেষ ধরনের একাধিক পকেট বিশিষ্ট ব্রিফকেইস কিনে তা কর্মীদের মধ্যে বিতরণ করুন। একাধিক পকেটওয়ালা এমন ব্রিফকেইস বিভিন্ন ধরনের লিফলেট, পুস্তিকা, গুরুত্বপূর্ণ লেকচারের অডিও-ভিডিও সিডি/ডিভিডি ইত্যাদি বহনের জন্য অত্যন্ত সহায়ক হবে।

৪৮. পত্রিকার চাঁদাঃ উপহার হিসেবে কাউকে ইসলামিক কোন পত্রিকার চাঁদা পরিমাণ টাকা পাঠিয়ে দিতে পারেন অথবা পত্রিকার চাঁদা পরিমাণ টাকা কোন দা’ওয়াহ্ সংগঠনকে পাঠিয়ে দিতে পারেন ফলে তারাই পত্রিকাটি গ্রাহকের কাছে উপহার হিসেবে পাঠিয়ে দেবে।

৪৯. পঠিত বই-পুস্তক এবং পত্র-পত্রিকা সংগ্রহঃ পড়া হয়ে গেছে এমন বই-পুস্তক এবং পত্র-পত্রিকা সংগ্রহের একটি উদ্যোগ হাতে নিন। সেগুলো সংগ্রহ করে এমন সব এলাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করুন যেখানকার লোকেরা সেগুলো এখনও পড়ার সুযোগ পাইনি।

৫০. পুস্তিকা-প্রচারপত্রঃ গুরুত্বপূর্ণ বই বা লেকচারে ভিডিও সিডি/ডিভিডি থেকে নির্বাচিত অংশ ছাপিয়ে পুস্তিকা বা প্রচারপত্র আকারে প্রকাশ করুন। বিভিন্ন উপলক্ষে এমনটি করা যেতে পারে। যেমনঃ হজ্ব মৌসুমে, লম্বা ছুটির ভেতরে, প্রবাসী শ্রমিকদের উপলক্ষে, বিয়ের অনুষ্ঠান উপলক্ষে, রমজান মাস কিংবা ঈদ উপলক্ষে।

৫১. বিভিন্ন বিলের রশিদঃ সাধারন ব্যবহার্য বিল যেমনঃ টেলিফোন বিল, পানির বিল, বিদ্যুৎ বিল ইত্যাদি বিলের রশিদের উল্টো পীঠে সংক্ষিপ্ত দা’ওয়াহ্ বিষয়ক বিবৃতি এবং কোরআনের উপদেশবাণী লিখে তা গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দিন।

৫২. ইসলামিক স্লোগানঃ মানুষের নজর কাড়ে এমন সব আকর্ষণীয় স্লোগান বা বক্তব্য আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যপকভাবে ব্যবহৃত জিনিসপত্র যেমনঃ ক্যালেন্ডার, শপিংব্যাগ, গাড়ির সানস্ক্রীন ইত্যাদিতে লিখা যেতে পারে। এক্ষেত্রে অবশ্যই শপিংব্যাগ বা গাড়ীর সানস্ক্রীন এর প্রস্তুতকারক কোম্পানির অনুমতি নিতে হবে।

৫৩. খোলা চিঠিঃ বিভিন্ন বয়সের মানুষকে পাঠক হিসেবে কল্পনা করে চিঠি লিখুন। মনে করুন, আপনার চিঠির পাঠক হতে পারে মসজিদের পাশের বাড়ীর কেউ অথবা সেই মসজিদের ইমাম, কিংবা একজন পাবলিক স্পিকার, একজন ডাক্তার, একজন শিক্ষক, একজন ছাত্র, একজন প্রকাশক, একজন বাবা, একজন মা, একজন স্বামী, একজন স্ত্রী, একজন চাকুরিদাতা, একজন ব্যবসায়ী, একজন ভোক্তা/ক্রেতা, একজন নিরাপত্তা প্রহরী, একজন কারাবন্দী কয়েদী অথবা একজন মুসাফির। আপনার পাঠককে উদ্দেশ্য করে তার অনুভূতিতে নাড়া দেয় এমন ভাষায় তাকে ইসলামের পথে ডাকুন।

৫৪. সাধারন প্রতিযোগিতাঃ বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক সাধারন জ্ঞানের প্রতিযোগিতা আয়োজন করুন। এক্ষেত্রে প্রতিযোগীদের বয়সের কথা মাথায় রেখে বয়সের সাথে মানানসই বিভিন্ন ইসলামিক পুরস্কার দেয়ার ব্যবস্থা করুন। পুরুস্কার হিসেবে বিজয়ীদের মধ্যে ইসলামিক বই, লেকচারের সিডি-ভিসিডির সিডি/ডিভিডি ইত্যাদি বিতরণ করুন।

৫৫. সাধারন প্রকাশনাঃ আগে হয়ত ইসলাম মেনে চলত না অথবা বিপথে চলে গিয়েছিল পরে আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন হেদায়াত দান করেছেন এমন মানুষদের গল্প বা তাদের স্বীকারোক্তিমূলক কথাকে গল্প আকারে প্রকাশের ব্যবস্থা করুন। এধরনের প্রকাশনায় নিয়মিত বিভাগ হিসেবে আরো যা থাকতে পারে তা হল কবিতা, নাটক, ছোট গল্প, ভাষাতাত্ত্বিক আলোচনা, বিখ্যাত লোকদের জীবনী, আন্তর্জাতিক রাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপট, আধুনিক ব্যবসা-বাণিজ্য এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানসহ বিজ্ঞানের বিভিন্ন অবদান ও আবিস্কারের উপর প্রবন্ধ। প্রকাশনায় এসকল বিভাগ রাখার উদ্দেশ্য হল সেসব পাঠকদের ধরে রাখা যারা হয়ত পুরোপুরি ইসলামিক পত্রিকা পড়তে আগ্রহী নন।

৫৬. বিভিন্ন দা’ওয়াহ্ উপকরণ বিতরণঃ ইসালামের দা’ওয়াহ্ পৌঁছে দেয়ার কাজে নিয়োজিত সংগঠনগুলো নিয়ম করে সপ্তাহের নির্ধারিত দিনে বাড়ীতে বাড়ীতে গিয়ে দা’ওয়াহ্ বিষয়ক পুস্তিকা, ক্রোড়পত্র, লেকচারের সিডি-ভিসিডি ইত্যাদি পৌঁছে দিতে পারে। এমন কাজ স্কুলগুলোতেও করা যেতে পারে।

৫৭. প্রোডাকশন কোম্পানীঃ বড় ধরনের অনুষ্ঠানগুলোর আয়োজন করে থাকে এমন কমিউনিটি সেন্টার বা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে গিয়ে তাদের সাথে যোগাযোগ করুন। তাদের সহযোগিতায় উপস্থিত অতিথিদের মাঝে দা’ওয়াহ্ উপকরণ যেমনঃ দা’ওয়াহ্ পুস্তিকা, বিখ্যাত বক্তাদের আকর্ষণীয় লেকচারের সিডি-ভিসিডি ইত্যাদি বিতরণের ব্যবস্থা করুন।

৫৮. দা’ওয়াহ্র কাজে ব্যবহারের জন্য গাড়ীঃ দা’ওয়াহ্র কাজে ব্যবহারের জন্য হালকা দামের খোলা জীপ গাড়ী কিনতে পারেন। গাড়ীতে দা’ওয়াহ্ বিষয়ক এবং উৎসাহমূলক শব্দগুচ্ছ বা বাক্য লিখে দিন। জনসমাগম বেশী হয় এমন জায়গায় গাড়ী পার্ক করে লোকজনের মাঝে পূর্বোল্লিখিত দা’ওয়াহ্ উপকরণ যেমনঃ দা’ওয়াহ্ পুস্তিকা, বিখ্যাত বক্তাদের আকর্ষণীয় লেকচারের সিডি-ভিসিডি ইত্যাদি বিতরণ করুন।

৫৯. বিশালাকৃতির বিল বোর্ডঃ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ন বিজ্ঞাপন বা বিল বোর্ড টাঙিয়ে সেগুলোতে দা’ওয়াহ্ মেসেজ এবং ইসলামিক অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দেয়ার ব্যবস্থা করুন। বিশালাকৃতির বিল বোর্ডগুলো সহজেই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হবে। আজকাল রাস্তার মোড়ে মোড়ে বিভিন্ন প্রসাধনী পণ্যের কুরুচিপূর্ণ বিজ্ঞাপনের জায়গায় ইসলামিক বিল বোর্ড দেখা গেলে তা লোকজনের মাঝে বৈপ্লবিক সাড়া জাগাবে।

৬০. ক্রীড়ানুষ্ঠানের আয়োজনঃ দা’ওয়াহ্ সংগঠনগুলো কিশোর এবং যুবকদের অংশগ্রহণে বিভিন্ন শারীয়াহ্ সম্মত খেলাধুলার আয়োজন করতে পারে। এমন অনুষ্ঠানগুলোতে বিজয়ীদেরসহ দর্শকদের মাঝে দা’ওয়াহ্ সংশ্লিষ্ট উপকরণ পুরস্কার হিসেবে বিতরণ করা যেতে পারে।

৬১. বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানঃ ইসলামের জন্য কাজ করতে আগ্রহী এমন ডাক্তারদের দিয়ে কোন সমমনা প্রাইভেট ক্লিনিকের অধিনে সাধারন মানুষদের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করুন। এক্ষেত্রে বিশেষ ধরনের মানুষদের সুবিধা দেয়া যেতে পারে। যেমনঃ নতুন মুসলিম হয়েছে অথবা যারা ইসলাম গ্রহনে আগ্রহী ইত্যাদি।

৬২. মহিলাদের জন্য কোর্সের আয়োজনঃ মহিলাদের উদ্দেশ্যে এমন সব কল্যাণধর্মী কোর্সের আয়োজন করুন যে ব্যাপারে তারা স্বভাবতই তারা আগ্রহ বোধ করে। যেমনঃ রান্না-বান্না, গারাস্থ্য অর্থনীতি, সন্তান প্রতিপালন, দাম্পত্য জীবন, গৃহ ব্যবস্থাপনা, গৃহকর্ম ও গৃহকর্মী, দাম্পত্য প্রস্তুতি, স্তন্যদান, শিশুদের রোগবালাই, গৃহ নিরাপত্তা, প্রাথমিক চিকিৎসা ইত্যাদি। এইসব কোর্সের পাঠ্যসূচীর বই-পুস্তকের ভিতর দা’ওয়াহ্ বিষয়ক মেসেজ সন্নিবেশ করুন।

৬৩. সাহায্য মেলাঃ তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্য নিয়ে “চ্যারিটি ফেয়ার”, “চ্যারিটি ফীস্ট” ইত্যাদি নামে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করুন। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা ইসলামিক দা’ওয়াহ্ কার্যক্রমকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে তাদের সাধ্যমত আর্থিক অনুদান দেয়ার চেষ্টা করবে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত বক্তারা নারী বিষয়ক ইসলামিক বিষয়ের উপর আলোকপাত করতে পারেন।

৬৪. সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানঃ ইসলামিক স্কলার, দা’ঈ, দা’ওয়াহ্ সংগঠন, ইসলামিক পত্রিকা, ইসলামিক ওয়েবসাইট, ইসলামিক সিডি-ভিসিডির দোকান ইত্যাদি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের নিজ নিজ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ সম্মাননা পদক প্রদান উপলক্ষে সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করুন। অনুষ্ঠানে ইসলামে দা’ওয়াহ্র গুরুত্ব তুলে ধরে উপস্থিত সাধারনের জন্য বক্তব্যের ব্যবস্থা রাখুন। এতে করে সাধারন মানুষ দা’ওয়াহ্র গুরুত্ব সম্পর্কে অবগত হবে।

৬৫. দা’ওয়াহ্ নির্দেশিকাঃ দেশে বেড়াতে আসা বিদেশী পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে দা’ওয়াহ্ গাইড বা ট্যুরিষ্ট গাইড প্রকাশ করুন। এই গাইডে যেসব বিষয় স্থান পেতে পারে তা হল বিভিন্ন জায়গার ইসলামিক সংগঠন বা দা’ওয়াহ্ সংগঠনের ঠিকানা, ইসলামিক গ্রন্থাগার, স্টুডিও, বিখ্যাত মসজিদ, ইসলামিক স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকেশন, বর্তমানে অনুষ্ঠিতব্য দা’ওয়াহ্ কনফারেন্স এর সময়সূচী, স্থানীয় ইসলামিক বিশেষজ্ঞদের ঠিকানা ইত্যাদি।

৬৬. ইসলামিক প্রদর্শনীঃ সংস্কৃতি ও পর্যটন বিভাগের সহায়তায় বড় বড় ইসলামিক বুকস্টল এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনকে নিয়ে ইসলামিক প্রদর্শনীর আয়োজন করুন। এমন প্রদর্শনীতে ইসলামিক দা’ওয়াহ্ কার্যক্রমের সাথে সমমনা স্কুল-কলেজ এবং বিভিন্ন কোম্পানির স্টল থাকবে যেখানে তারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর এমন কিছু তুলে ধরবে যা ইসলামিক দা’ওয়াহ্র প্রচার-প্রসারে সহায়ক ভুমিকা পালন করবে।

৬৭. দা’ওয়াহ্ ওয়েবসাইটঃ দা’ওয়াহ্ কার্যক্রম চালানোর জন্য সব রকম চাহিদা মেটাতে পারে এমন দা’ওয়াহ্ ওয়েবসাইট নির্মাণ করুন। এই ধরনের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সবরকম দা’ওয়াহ্ উপকরণ সরবরাহ করা হবে। ফলে ওয়েবসাইটগুলো ইসলামিক বিশেষজ্ঞ বোর্ড এর ন্যায় ভুমিকা পালন করবে। এখানে দা’ওয়াহ্ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আলোচনাও স্থান পাবে। দা’ওয়াহ্ বিষয়ক প্রশ্নোত্তর সেকশনও থাকবে।

৬৮. ইফ্‌তার পার্টি আয়োজনঃ দা’ওয়াহ্ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে রমজান মাসে ইফ্‌তার পার্টির আয়োজন করুন এবং অন্যান্যদের ইফ্‌তার পার্টিতে অংশগ্রহণ করুন। ইফ্‌তার অনুষ্ঠানে সাওম বা রোজার অসাধারণ উপকারিতা এবং আত্মিক পরিশুদ্ধির জন্য এর তাৎপর্য তুলে ধরে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিন। অথবা সপ্তাহের যে কোন দুটি দিনকে নির্ধারণ করে ঐ দিনগুলোতে অন্যান্য যারা দা’ওয়াহ্র কাজ করছে তাদের সাথে মিলিত হয়ে পারস্পারিক মতবিনিময়ের অয়োজন করুন। এ কাজটি সারা বছর ধরেই চালিয়ে যান।

৬৯. হজ্ব এবং ‘উমরাঃ হজ্ব অথবা উমরা করতে যাচ্ছেন এমন মানুষদের এবং বিশেষ করে নতুন মুসলিমদের হজ্ব সফর সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ে যথা সম্ভব সহায়তা করুন। ইসলামের দা’ওয়াহ্র কাজে
তাদের স্পৃহাকে উজ্জীবিত রাখার উদ্দেশ্যে হজ্বের পূর্বে, হজ্ব পালনের সময় এবং হজ্ব পরবর্তী কি ধরনের ভুমিকা তাদের হওয়া উচিৎ তা তুলে ধরে হজ্ব গমনেচ্ছু ব্যক্তিদের নিয়ে কর্মশালার আয়োজন করুন।

৭০. যাতায়াত যানবাহনঃ অনেকেই দূরবর্তী কোন ইসলামিক অনুষ্ঠান, অথবা কোন দা’ওয়াহ্ অফিসের কোন কোর্সে যোগদানের জন্য যেতে চান কিন্তু যাতায়াত সুবিধা না থাকায় যেতে পারেন না। এক্ষেত্রে আপনি ইসলামের স্বার্থে নিজের গাড়ীতে করে এবং একটু সময় খরচ করে এমন লোকজনকে তাদের গন্তব্যে পৌঁছে দিন।

৭১. দা’ওয়াহ্ বিপণীঃ বিভিন্ন জায়গায় দা’ওয়াহ্ বিপণী স্থাপন করুন। এই বিপণীগুলো বিভিন্ন দা’ওয়াহ্ উপকরণ সংগ্রহের কাজ করবে। পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগে কেউ দা’ওয়াহ্ উপকরণ হিসেবে ইসলামিক বই-পুস্তক, সিডি-ভিসিডি’র কপি ইত্যাদি দিতে চাইলে সেগুলো গ্রহন করবে। সংগৃহীত দা’ওয়াহ্ উপকরণগুলো নামমাত্র দামে মসজিদ-মাদ্রসা এবং স্কুল-কলেজগুলোতে সরবরাহ করতে হবে।

৭২. দা’ওয়াহ্ কার্যালয়ঃ স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন দা’ওয়াহ্ কার্যালয় স্থাপন করুন। অন্যান্যদেরও কার্যালয়গুলোতে নিয়ে যান। কার্যালয়গুলোর বিভিন্ন প্রোগ্রামে শরিক হউন। যারা সেখানে ইসলামের দা’ওয়াহ্র কাজে নিয়োজিত আছেন তাদের সহায়তা করুন, উৎসাহ দিন।

৭৩. মানুষের জন্য দো’য়া করুনঃ মানুষকে ইসলামের পথে ডাকার অংশ হিসেবে তাদের জন্য বিভিন্ন সময়ে দো’য়া করুন। যেমনঃ হয়ত কাউকে কোন হারাম কাজে লিপ্ত হতে দেখলে তাকে বলুন, “আল্লাহ্ আপনাকে জাহান্নামের আগুন থেকে হেফাজত করুন।” অথবা কেউ কোন ভাল কাজ করলে তার জন্য বলুন, আল্লাহ্র কাছে দো’য়া করি তিনি যেন আমাদের সবাইকে জান্নাতে তাঁর রাসূলের (সা) কাছাকাছি রাখেন।” অথবা কোন ছাত্রের জন্য দো’য়া করলে বলুন, “আল্লাহ্ আপনাকে ইহকাল এবং পরকালের উভয় পরীক্ষায় সাফল্য দান করুন।”

৭৪. ব্যক্তিগত সাক্ষাৎঃ সালাত আদায়ের ব্যপারে উদাসীন বা একবারেই সালাত আদায় করে না এমন লোকদের সাথে সরাসরি দেখা করুন। আযানের সময় হয়ে এসেছে এমন সময় তাদের সাথে দেখা করুন যাতে করে তাদেরকে সাথে নিয়ে মসজিদে যেতে পারেন।

৭৫. ইসলাম গ্রহণের ঘোষণাঃ সদ্য ইসলাম গ্রহণকারী মুসলিমদের জুম’আর মসজিদে নিয়ে আসুন। সালাত শেষে তাদের মুখ থেকেই শুনুন কিভাবে বা কেন তারা ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিল। ইসলামের কোন কোন দিক তাদেরকে বেশী আকর্ষণ করেছে। তাদের কাছ থেকে শোনার পর উপস্থিত মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে দা’ওয়াহ্র বিভিন্ন উপায় তুলে ধরে কিছু বলুন যা তাদের কাজে আসবে। ইসলাম গ্রহণকারী ব্যক্তি কোন মহিলা হলে তাকে কোন গার্লস স্কুল বা কোন মহিলা সংস্থায় নিয়ে যান এবং সেখানে তার ম্নুখ থেকে ইসলাম গ্রহণের কাহিনী শুনুন । এতে অন্যরাও অনুপ্রাণিত হবে।

৭৬. সাধারণ যানবাহনঃ আকর্ষণীয় এবং প্রাসঙ্গিক পোস্টার, স্টিকার, অডিও সিডি/ডিভিডি ইত্যাদি ছাপিয়ে এবং তৈরি করে বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট যানবাহনের মালিক সমিতির কাছে সরবরাহ করুন। এগুলো তারা তাদের বাস, প্রাইভেট কার, মোটর বা ট্যাক্সি ক্যাব ইত্যাদিতে ব্যবহার করবে। মাঝে মাঝে ইসলামিক দা’ওয়াহ্র কাজে সহযোগিতার জন্য তাদের সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করুন।

৭৭. দা’ওয়াহ্ বুথঃ শহরের বড় বড় শপিং মল, সুপার মার্কেট এলাকা, নিউমার্কেট এলাকা ইত্যাদি যে স্থানগুলোতে প্রচুর জনসমাগম হয় এমন স্থানগুলোতে দা’ওয়াহ্ বুথ স্থাপন করুন। এই দা’ওয়াহ্ বুথ বা দা’ওয়াহ্ স্টলগুলোর টেবিলে দা’ওয়াহ্ বিষয়ক ক্লিপ্স দেখানোর জন্য রাখতে হবে বড় পর্দার টেলিভিশন। সাথে থাকবে নজরকাড়া প্রচ্ছদের সব দা’ওয়াহ্ সংশ্লিষ্ট ইসলামিক বই-পুস্তক, দা’ওয়াহ্ পত্রিকা, অডিও ক্যাসেট, ভিডিও, সিডি, ভিসিডি ইত্যাদির অনন্য সমাহার যা উপস্থিত দর্শনার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হবে।

৭৮. টেলিফোন দা’ওয়াহঃ আপনার মোবাইল বা টেলিফোনের ওয়েলকাম টিউন হিসেবে বিভিন্ন দা’ওয়াহ্ মেসেজ ব্যবহার করুন। কোন কলার আপনাকে কল করলে তিনি তা শুনতে পাবেন। ফোনকলটি রিসিভ না করা পর্যন্ত কলার মেসেজটি শুনতে থাকবেন। ওয়েলকাম টিউনটি হতে পারে, “সম্মানিত কলার, আপনি আজকে সালাত আদায় করেছেন তো? কারণ সালাতই হল একজন কাফির ও মুসলিমের মধ্যে পার্থক্যকারী বিষয়।” এছাড়া মোবাইল এবং টেলিফোনের মাধ্যমে দাওয়াহ্ সেন্টার থেকে লোকজন বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর জেনে নিতে পারেন।

৭৯. আরবি ভাষা শিক্ষা কোর্সঃ আরবি ভাষা শিক্ষা কোর্স চালু করুন। এই কোর্সগুলো কথোপকথনমূলক (কনভারসেশনাল) আরবি ভাষা এবং আরবি ব্যকরনের উপর গুরুত্ব দিতে পারে। এক্ষেত্রে আরবি ব্যকরনের জ্ঞান কোরআন বুঝে পড়তে সাহায্য করবে। সরাসরি কোর্সের বদলে ধারণকৃত ক্লাস লেকচার প্রোজেক্টরে দেখানোর মাধ্যমেও আরবি ভাষা শেখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কাজটি নিজের বাড়ী কিংবা কর্মক্ষেত্রে যেখানে সুবিধা করা যেতে পারে।

৮০. ইসলামিক কোর্সঃ তাওহীদ, শির্ক, বিদ্‌য়া’হ্, হালাল-হারাম, ইসলামে ব্যবসা-বাণিজ্য, ইসলামে দাম্পত্য জীবন, ইসলামে নারী অধিকার, বিয়ে অনুষ্ঠানের ‘আদব ইত্যাদিসহ আকীদাহ্গত বিভিন্ন বিষয়ের উপর ইসলামিক কোর্সের আয়োজন করুন। কোর্সগুলো স্থানীয় মসজিদ বা দা’ওয়াহ্ সংগঠনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। এছাড়া যারা ইসলামের দা’ঈ হিসেবে কাজ করতে চাই তাদের জন্য দা’ওয়াহ্ ট্রেনিং কোর্সের আয়োজন করুন।

৮১. দা’ওয়াহ্ দিবসঃ উন্মুক্ত দা’ওয়াহ্ দিবসের আয়োজন করুন এবং এতে বিভিন্ন শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা রাখুন। অনুষ্ঠানে নারী-পুরুষ, দেশী-বিদেশী সকলশ্রেণীর মানুষদের জন্য সুব্যবস্থা রাখুন। দা’ওয়াহ্ দিবস অনুষ্ঠানের একমাস আগে থেকেই স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসাসহ সকল জায়গায় মৌখিক ঘোষণা এবং পোস্টারের মাধ্যমে প্রচারনা চালিয়ে তা সকলকে জানিয়ে দিন যাতে করে দা’ওয়াহ্ দিবসের আয়োজন মানুষের মুখে মুখে প্রচার লাভ করে।

পরিশেষে, আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীনের কাছে আমরা এই দো’য়া করি তিনি যেন আমাদের প্রত্যেককে তাঁর দ্বীনের দা’ঈ হিসেবে কবুল করে নেন এবং তাঁর জান্নাতে আমাদেরকে সেই সমস্ত সৎকর্মশীলদের পাশে স্থান দেন যারা তাঁর দ্বীনকে সঠিকভাবে পালন করে গেছেন।
English Version
আল্লাহর পথে দাওয়াত – পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪

অনুগ্রহ করে আপনার আইডিয়া শেয়ার করুন আমাদের সাথে, কমেন্ট সেকশনে।

‘আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক’
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Twitter, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। “কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা” [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]
পর্ব ১ – একজন ঈমানদার দা‘ঈর বর্জিত গুণাবলি
ভূমিকা
মহান রাব্বুল আলামীন এই সুন্দর পৃথিবী সৃষ্টি করে তাকে সুশোভিত করেছেন, সৃষ্টি করেছেন অরণ্য, গাছপালা-তরুলতা, সাগর-নদী, আকাশ-বাতাস, চন্দ্র-সূর্য ও বিভিন্ন প্রকার প্রাণীকূল। আর এই সৃষ্ট জগতে মানুষকে পাঠিয়েছেন আশরাফুল মাখলুকাত রূপে। স্রষ্টার এই সুন্দর সৃষ্টি পরিচালিত হচ্ছে সুশৃঙ্খল নিয়ম-নীতি মেনেই। মানুষ তার পরম সত্তাকে জানার জন্য সর্বদাই আকুল। এ দুর্নিবার জানার আগ্রহ মানুষকে এক নৈর্ব্যক্তিক প্রষ্টার ধারনায় পৌঁছে দেয়। এ নৈর্ব্যক্তিক মহা সত্তা বা স্রষ্টা নৈর্ব্যক্তিক থেকে মানুষের হৃদয়ের আবেদন পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছ। তাই মানুষ যুগ যুগ ধরে নিজের অন্তরে সেই পরম সত্তাকে খুজে বের করে তার সাথে আত্মীক সম্পর্ক গড়তে চেয়েছে। আর এ সত্তাকে জানতে ও চিনতে হলে তাকে অবশ্যই একজন পবিত্র আত্মার মানুষ হতে হবে। আর পবিত্র আত্মার অধিকারী হতে হলে তাকে অবশ্যই আদর্শিক ও চারিত্রিক গুণে গুণান্বিত হওয়া আবশ্যক। একজন মু’মিনকে দেখে অপর একজন বিধর্মী ঈমান গ্রহণ করে এবং তারই জীবনে তা বাস্তবায়নের কারণে মানুষ হয়ে উঠে আল্লাহ্ মুখী ও তাকওয়াবান। যা আমরা রাসূলুল্লাহ্ সা.-এর যুগে এবং তৎপরবর্র্তী যুগে লক্ষ্য করলে দেখতে পাই। তাই তাকে অবশ্যই কতিপয় গুণাবলী বা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে হবে যা দ্বারা মানুষ তার দিকে আকৃষ্ট হয়ে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে নিজেকে দোযখের কঠিন আযাব থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হবে।
মানবচরিত্রের দু’টি ধারা। একটি মানবচরিত্র ধ্বংসকারী অসৎ স্বভাবসমূহ ও মানবচরিত্র ধ্বংসের হাত থেকে পরিত্রাণকারী মহৎ গুণাবলী। এ দু’টি পদ্ধতির মধ্যে মানবচরিত্র ধ্বংসকারী অসৎ স্বভাবসমূহ থেকে বিরত থেকে মানবচরিত্র ধ্বংসের হাত থেকে পরিত্রাণকারী মহৎ গুণাবলী পালন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমেই একমাত্র মানবচরিত্রকে উন্নতির স্বর্ণশিখরে পৌঁছতে সক্ষম হয়। পাশাপাশি এমন কিছু গুণাবলি রয়েছে যেগুলো বর্জন করা মু’মিনের উপর আবশ্য। আলোচ্য প্রবন্ধে এ প্রসঙ্গেই ধারাবাহিক ভাবে আলোচনা করা হবে।
১. অহংকার
অহংকার পরিচিতি
অহংকার শব্দটির আরবী প্রতিশব্দ হলো : (আল-কিবর)الكِبْر। যার আভিধানিক অর্থ, বড়ত্ব, বড়াই, অহংকার ইত্যাদি। আল্লামা ইব্ন মানযুর রহ. বলেন : (আল-কিবর) الكِبْر শব্দের আভিধানিক অর্থ বড়ত্ব, অহংকার ও দাম্ভিক, অহমিকা ইত্যাদি।১
অহংকারের পারিভাষিক সংজ্ঞা প্রদানে হাদীসে রাসূল সা. বলেন :
عن عبد الله بن مسعود، عن النبي صلى الله عليه و سلم قال: لا يْدخُلُ الجَنةََّ مَنْ كَانَ فِي قَلْبهِِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ كبِرٍ قَالَ رَجُلٌ: إِنَّ الرَّجُلَ يُحبُِّ أَنْ يَكُونَ ثَوْبُهُ حسَنًا، وَنْعُلُه حَسَنَةً. قَالَ: إِنَّ الله جَميِلٌ يُحبُ الجَمَالَ، الْكبِر بَطَرُ الحَقِّ، وَغَمْطُ الناَّسِ.
আব্দুল্লাহ ইব্ন মাসুদ রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন : যার অন্তরে একটি অণু পরিমাণ অহংকার থাকে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। রাসূল সা. এ কথা বললে, এক লোক দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেসা করল : কোন কোন লোক এমন আছে, সে সুন্দর কাপড় পরিধান করতে পছন্দ করে, সুন্দর জুতা পরিধান করতে পছন্দ করে, এসবকে কি অহংকার বলা হবে? রাসূল সা. উত্তরে বললেন : আল্লাহ্ তা‘আলা নিজেই সুন্দর, তিনি সুন্দরকে পছন্দ করেন। (সুন্দর কাপড় পরিধান করা অহংকার নয়) অহংকার হল, সত্যকে গোপন করা এবং মানুষকে নিকৃষ্ট জানা।২ উল্লেখ্য যে, রাসূল সা. এ হাদীসে অহংকারের সংজ্ঞা দু’টি অংশে তুলে ধরেন।
এক. প্রকৃত সত্যকে অস্বীকার করা। হককে কবুল না করে তার প্রতি অবজ্ঞা করা এবং সত্য কবুল করা থেকে বিরত থাকা। বর্তমান আমাদের সমাজে অধিকাংশ মানুষকে দেখা যায়, যখন তাদের নিকট এমন কোন লোক হকের দাওয়াত নিয়ে আসে, যে বয়স বা সম্মানের দিক দিয়ে তার থেকে ছোট, তখন সে তার কথার প্রতি কোন প্রকার গুরুত্ব দেয় না। আর তা যদি তাদের মতামত অথবা তারা যা নির্ধারণ ও যার উপর তারা আমল করছে, তার পরিপন্থী হয়, তখন তারা তা অস্বীকার ও প্রত্যাখান করে। আর অধিকাংশ মানুষের স্বভাব হল, যে লোকটি তাদের নিকট দাওয়াত নিয়ে আসবে, তাকে ছোট মনে করবে এবং তার বিরোধিতায় অটল ও অবিচল থাকবে, যদিও কল্যাণ নিহিত থাকে সত্য ও হকের আনুগত্যের মধ্যে এবং তারা যে অন্যায়ের উপর অটুট রয়েছে। তাতে তাদের ক্ষতি ছাড়া কোনই কল্যাণ না থাকে। আমাদের সমাজে এ ধরণের লোকের অভাব নেই। বিশেষ করে ছোট পরিসরে এ ধরণের ঘটনা অহরহ ঘটতে থাকে। যেমন : পরিবার, স্কুল, মাদ্রাসায়, অফিস আদালত ও বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে এ ধরণের ঘটনা নিত্যদিন ঘটে থাকে।
অহংকারীরা যে বিষয়টির আশংকা করে অপরের থেকে সত্যকে গ্রহণ করে না, তাহলো, সে যদি অপর ব্যক্তি থেকে প্রমাণিত সত্যকে গ্রহণ করে, তাকে মানুষ সম্মান দেবে না, মানুষ অপর লোকটিকে সম্মান দেবে তখন সম্মান অপরের হাতে চলে যাবে এবং সে মানুষের সামনে বড় ও সম্মানী লোক হিসেবে বিবেচিত হবে, অহংকারীকে কেউ সম্মান করবে না। এ কারণেই সে কাউকে মেনে নিতে পারে না, সে মনে করে সত্যকে গ্রহণ করলে তার সম্মান নিয়ে টানাটানি হবে এবং মানুষ তার প্রতি আর আকৃষ্ট হবে না। মানুষ সে লোকটিকেই বড় মনে করবে এবং তাকেই মানবে। আর বাধ্য হয়ে অহংকারীকও অপরের অনুসারী হতে হবে। কিন্তু এ অহংকারী লোকটি যদি বুঝতে পারত, তার জন্য সত্যিকার ইজ্জত ও সম্মান হল, হকের অনুসরণ ও আনুগত্য করার মধ্যে, বাতিলের মধ্যে ডুবে থাকতে নয়ত, তা ছিল তার জন্য অধিক কল্যাণকর ও প্রশংসনীয়।
উমর ইব্নুল খাত্তাব রা. আবূ মূসা আল-আশআরী রা.-এর নিকট লিখেন, তুমি গত কাল যে ফায়সালা দিয়েছিলে, তার মধ্যে তুমি চিন্তা ফিকির করে যখন সঠিক ও সত্য তার বিপরীতে পাও, তাহলে তা থেকে ফিরে আসতে যেন তোমার নফস তোমাকে বাধা না দেয়। কারণ, সত্য চিরন্তন, সত্যের পথে ফিরে আসা বাতিলের মধ্যে সময় নষ্ট করার চেয়ে অনেক উত্তম।৩
আব্দুর রহমান ইবনে মাহদী রহ. বলেন : একদা আমরা একটি জানাযায় উপস্থিত হলাম, তাতে কাজী উবায়দুল্লাহ ইব্নুল হাসান রহ. হাজির হল। আমি তাকে একটি বিষয়ে জিজ্ঞেসা করলে, সে ভুল উত্তর দেয়, আমি তাকে বললাম : আল্লাহ্ আপনাকে সংশোধন করে দিক, এ মাসআলার সঠিক উত্তর এভাবে …। তিনি কিছু সময় মাথা নিচু করে চুপ করে বসে থাকলেন, তারপর মাথা উঠিয়ে বললেন : আমি আমার কথা থেকে ফিরে আসলাম, আমি লজ্জিত। সত্য গ্রহণ করে লেজ হওয়া আমার নিকট মিথ্যার মধ্যে থেকে মাথা হওয়ার চেয়ে অধিক উত্তম।৪
দুই. মানুষকে নিকৃষ্ট জানা। মনে রাখতে হবে যে, যারা মানুষকে খারাপ জানে, তাদের কর্মের পরিণতি হল, মানুষ তাদের খারাপ জানবে। এ ধরণের লোকেরা মানুষের সুনামকে ক্ষুন্ন এবং তাদের যোগ্যতাকে ম্লান করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। সে অন্যদের উপর তার নিজের বড়ত্ব ও উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার লক্ষ্যে, মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন ও ছোট করে। মানুষের সম্মানহানি ঘটানোর উদ্দেশ্যে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করে ও অপবাদ রটায়। অহংকারীরা কখনোই মানুষের চোখে ভাল হতে পারে না, মানুষ তাদের ভালো চোখে দেখে না। অহংকারী তার নিজের কর্ম ও গুণ দিয়ে কখনোই উচ্চ মর্যাদা বা সম্মান লাভ করতে সক্ষম হয় না। তাই সে নিজে সম্মান লাভ করতে না পেরে নিজের মর্যাদা ঠিক রাখার জন্য অন্যদের কৃতিত্বকে নষ্ট করে এবং তাদের মান-মর্যাদা খাট করে দেখে।
আবূ ওহাব আল-মারওয়ারজি রহ. বলেন : আমি আব্দুল্লাহ্ ইব্ন মুবারককে জিজ্ঞেসা করলাম : কিবর কী? উত্তরে তিনি বললেন : মানুষকে অবজ্ঞা করা। তারপর আমি তাকে উজব সম্পর্কে জিজ্ঞেসা করলাম : উজব কী? উত্তরে তিনি বললেন : তুমি মনে করলে যে, তোমার নিকট এমন কিছু আছে, যা অন্যদের মধ্যে নেই। তিনি বললেন : নামাজিদের মধ্যে উজব বা আত্মতৃপ্তির চেয়ে খারাপ আর কোন মারাত্মক ত্রুটি আমি দেখতে পাই না।৫
অহংকারের শ্রেণীবিভাগ ও স্তরসমূহ
প্রকাশ থাকে যে, অহংকার দুই প্রকার। এক. কিবরে জাহির (প্রকাশ্য অহংকার) দুই. কিবরে বাতিন (অপ্রকাশ্য অহংকার)
এক. প্রকাশ্য অহংকার : প্রকাশ অহংকার দ্বারা বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও কাজের মাধ্যমে যে কিবর বা অহংকার প্রকাশ পায় তাকে কিবরে জাহির বা প্রকাশ্য অহংকার বলে।
দুই. অপ্রকাশ্য অহংকার : নিজেকে অপরের চেয়ে মর্যাদায় বড় ধারণা করাতে অন্তরে যে এক সন্তুষ্টির হালত আসে উক্ত হালতকে কিবরে বাতিন বা অপ্রকাশ্য অহংকার বলে। উল্লেখ্য যে, কিবরে জাহির ছোটদের সামনে করা জায়িয কিন্তু বড়দের সামনে করা নাজায়িয।
অহংকারের স্তর
প্রকাশ থাকে যে, অহংকারের স্তর তিনটি। যথা :
এক. আল্লাহর সাথে : যেমন-নমরূদ, ফির‘আউন ও ইবলীসের তাকাব্বুরী।
দুই. রাসূল সা. এর সাথে : যেমন-কুফ্ফারে কুরাইশরা বলেছিল তারা ইয়াতীম মুহাম্মদের কাছে মাথা নত করতে পারবে না। তাদের সর্দারদেরকে কেন রাসূল করা হলো না?
তিন. রাসূল ব্যতীত অন্যান্য লোকদের সাথে। যেটি আমাদের সমাজে প্রচলিত।
অহংকারের কারণসমূহ
একজন অহংকারী মনে করে সে তার সাথী সঙ্গীদের চেয়ে জাতিগত ও সত্তাগতভাবেই বড় এবং সে অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র, তার সাথে কারো কোন তুলনা হয় না। ফলে সে কাউকেই কোন প্রকার তোয়াক্কা করে না, কাউকে মূল্যায়ন করতে চায় না এবং কারো আনুগত্য করার মানসিকতা তার মধ্যে থাকে না। যার কারণে সে সমাজে এমনভাবে চলা ফেরা করে মনে হয় তার মত এত বড় আর কেউ নেই। এ অহংকারের কতগুলো কারণ নিম্নরূপ :
এক. কারো প্রতি আনুগত্য প্রকাশ না করা
অহংকার প্রবেশের অন্যতম কারণ হলো কারোর প্রতি নমনীয় না হওয়া বা আনুগত্য না করার স্পৃহা। সে চিন্তা করে আমি কেন মানুষের কথা শুনবো। মানুষ আমার কথা শুনবে। আমিই মানুষকে উপদেশ দিব। এভাবেই তার দিন অতিবাহিত হতে থাকে। আর অহংকারের স্পৃহা বাড়তে থাকে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন :
كَلَّا إِنَّ الْإِنْسَانَ لَيَطْغَى . أَنْ رَآهُ اسْتَغْنَى . إِنَّ إِلَى رَبِّكَ الرُّجْعَى .
“কখনও নয়, নিশ্চয়ই মানুষ সীমালঙ্ঘন করে থাকে। কেননা সে নিজেকে মনে করে স্বয়ংসম্পূর্ণ। নিশ্চয়ই তোমার রবের দিকেই প্রত্যাবর্তন।৬
আল্লামা বাগাভী রহ. বলেন : মানুষ তখনই সীমালঙ্ঘন এবং তার প্রভুর বিরুদ্ধাচারণ করে, যখন সে দেখতে পায়, সে নিজেই স্বয়ংসম্পন্ন। আর কারো প্রতি নত হওয়া বা কারো আনুগত্য করার কোন প্রয়োজন নেই।৭
দুই. প্রভাব বিস্তার করার অভিলাস
একজন অহংকারী সে মনে করে, সমাজে তার প্রাধান্য বিস্তার, সবার নিকট প্রসিদ্ধি লাভ ও নেতৃত্ব দেয়ার কোন বিকল্প নেই। তাকে এ লক্ষ্যে সফল হতেই হবে কিন্তু যদি সমাজ তার কর্তৃত্ব বা প্রাধান্য মেনে না নেয়, তখন সে চিন্তা করে, তাকে যে কোন উপায়ে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে। চাই তা বড়াই করে হোক অথবা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে হোক। তখন সে যা ইচ্ছা তাই করে এবং সমাজে হট্রোগল শুরু করে।
তিন. দোষ-গুণ গোপন করা
একজন অহংকারী ইচ্ছা করলে তার দোষগুণগুলো বিনয়, নম্রতা, মানুষের সাথে বন্ধুত্ব ও চুপ-চাপ থাকার মাধ্যমে গোপন রাখতে পারত, কিন্তু তা না করে অহংকার করার কারণে তার সব গোমর ফাঁক হয়ে যায়। এ ছাড়াও মানুষ যা পছন্দ করে না, তা নিয়ে দু:খ প্রকাশ করা, কোন বিষয়ে চ্যালেঞ্জ করা হতে দূরে থাকা এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য মিথ্যা দাবি করা হতে বিরত থাকার মাধ্যমে সে তার যাবতীয় দুর্বলতা ও গোপন বিষয়গুলো ধামা চাপা দিতে পারত কিন্তু সে তা না করে অহংকার করাতে তার অবস্থা আরও প্রতিকূলে গেল এবং ফলাফল তার বিপক্ষে চলে গেল। তার বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে তার যাবতীয় অপকর্ম মানুষ জানতে পারল।
চার. অপরকে সম্মান করতে না জানা
মানুষ শ্রেষ্ঠ হওয়ার মানদণ্ড কী এবং মানুষকে কীসের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করতে হবে, তা আমাদের অবশ্যই জানা থাকতে হবে। অহংকারের অন্যতম কারণ হলো : মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড নিধারণে ত্র“টি করা। একজন মানুষের শ্রেষ্ঠ হওয়ার মানদণ্ড কি তা আমাদের অনেকেরই অজানা। রাসূল সা. তাঁর সাহাবীদের একটি সুস্পষ্ট ও বাস্তব দৃষ্টান্ত দিয়ে বুঝিয়ে দেন যে, একজন মানুষকে কিসের ভিত্তিতে মূল্যায়ন ও অগ্রাধিকার দেয়া হবে এবং তাকে কিসের ভিত্তিতে অবমূল্যায়ন ও পিছনে ফেলে রাখা হবে। মানুষের মর্যাদা তার পোশাকে নয়, বরং মানুষের মর্যাদা তার অন্তর্নিহীত সততা, স্বচ্ছতা ও আল্লাহ্ ভীতির উপর নির্ভর করে। যার মধ্যে যতটুকু আল্লাহ্ ভীতি থাকবে, সে তত বেশি সৎ ও উত্তম লোক হিসেবে বিবেচিত হবে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ্ সা. বলেন :
عن سهل بن سعد الساعدي قال : مَرَّ رجل على رسول الله صلى الله عليه و سلم فقال مَا تَقُولُونَ فِي هَذَا قالوا حِرٌّي إن خطب أَنْ ينكح وَإن شفع أن يُشَفَّعَ، وإن قال أَنْ يْسَتَمعَ، قال ثم سكت، فَمَرّ رجل من فقراء المسلمين، فقال مَاتَقُولُونَ فِي هَذَا قالواحِرٌّي إنْ خطب أن لا ينكح و َإِنْ شفع أَنْ لَا يُشَفَّعَ، وإن قال أَنْ لَا يْسَتَمعَ، فقال رسول الله صلى الله عليه و سلم هَذَا خَيٌر مِنْ مِلِْء الْأرَْضِ مِثْلَ هَذَا.
সাহাল ইব্ন সাদ রা. হতে বর্ণিত; তিনি বলেন : একদিন রাসূল সা. এর সামনে দিয়ে একব্যক্তি অতিক্রম করে যাচ্ছিল, রাসূল সা. সমবেত লোকদের জিজ্ঞেসা করলেন, তোমরা এ লোকটি সম্পর্কে কী বল? তারা উত্তরে বলল : লোকটি যদি কাউকে বিবাহের প্রস্তাব দেয় তাহলে তার ডাকে সাড়া দেয়া হয়, যদি কারো বিষয়ে সুপারিশ করে, তাহলে তার সুপারিশ গ্রহণ করা হয়, আর যদি কোন কথা বলে, তার কথা শোনা হয়। তাদের কথা শুনে রাসূল সা. চুপ করে থাকেন। একটু পর অপর একজন দরিদ্র মুসলিম রাস্তা দিয়ে অতিক্রম করে যাচ্ছিল। রাসূল সা. তাকে দেখে বললেন : তোমরা এ লোকটি সম্পর্কে কী বল? তারা বলল : যদি সে প্রস্তাব দেয়, তাহলে তার প্রস্তাবে সাড়া দেয়া হয় না, কোন সুপারিশ করলে তা গ্রহণ করা হয় না, আর যদি সে কোন কথা বলে তার কথায় কোন কান দেয়া হয় না। তখন রাসূল সা. বললেন : এ লোকটি যমিনে ভরপুর যত কিছু আছে তার সবকিছুর চেয়ে উত্তম।৮
পাঁচ. আল্লাহকে ভুলে যাওয়া
কিবর বা অহংকারের অন্যতম কারণ হলো, একজন মানুষকে আল্লাহ্ তা‘আলা যে সব নিয়ামত দান করেছেন, সে সব নিয়ামতকে ঐ লোকের সাথে তুলনা করা যাকে আল্লাহ্ তা‘আলা কোন হিকমতের কারণে ঐ সব নিয়ামতসমূহ দেয়নি। তখন সে মনে করে, আমি তো ঐ সব নিয়ামতসমূহ লাভের যোগ্য ও উপযুক্ত ব্যক্তি, তাই আল্লাহ্ আমাকে আমার যোগ্যতার দিক বিবেচনা করেই নিয়ামতসমূহ দান করেছেন। ফলে সে নিজেকে সব সময় বড় করে দেখে এবং অন্যদের ছোট করে দেখে ও নিকৃষ্ট মনে করে। অন্যদেরকে সে মনে করে তারা নিয়ামত লাভের উপযুক্ত নয়, তাদের যদি যোগ্যতা থাকতো তাহলে আল্লাহ্ তাদের অবশ্যই নিয়ামতরাজী দান করতেন।
অহংকারের নিদর্শনসমূহ
অহংকারের অনেক আলামত রয়েছে। তন্মধ্যে কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
ক. আল্লাহর হুকুম বিনা প্রতিবাদে মানতে মনে চায় না।
খ. ধম বিরোধী কাজ করতে অন্তরে ভয় না হওয়া।
গ. নায়েবে রাসূলদের অনুসরণ করতে মনে না চাওয়া।
ঘ. হক ফতোয়া মানতে অন্তরে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়া।
ঙ. মুসলমানদের দেয়া হাদিয়া কবুল না করাও অহংকারের আলামত হিসেবে গণ্য।
চ. নিজেকে ছোট ধারণায় না আনাও অহংকারের আলামতের শামিল।
ছ. ক্ষুদ্র কাজ করতে লজ্জাবোধ করা।
জ. গরীব লোকদেরকে নিকটে বসতে না দেয়া।
ঝ. কাউকে সালাম না দেয়া। উল্লেখ্য যে, সালাম না দেয়া যদিও তাকাব্বুরীর লক্ষণ কিন্তু ধর্ম বিরোধী কাফিরদের বেলায় তা প্রযোজ্য নয়।
ঞ. কেউ উপদেশ দিলে সেদিকে মনোযোগ সহকারে না শুনা।
ট. অপরের সাথে দেখা-সাক্ষাত না করা।
ঠ. সাধারণ লোকদেরকে ইতর জীবের মত মনে করা।
ড. অন্যকে অবজ্ঞার চোখে দেখা।৯
বর্তমান যামানায় সামান্য কিছু লেখা পড়া করলেই সাংসারিক কাজ নিজের হাতে করাটাকে লজ্জাবোধ মনে করে। এটি একমাত্র অহংকারের চিহৃ ছাড়া আর কিছুই নয়। কতক পীর (ইলমে তাসাওউফ ও কিতাবী শর্তবিহীন নাকেছ পীর) এবং কতক আলিমগণের মধ্যে এই প্রকার অহংকার খুব প্রবল আকারে দেখা যায়। অথচ রাসূল সা. নিজের সাংসারিক কাজ এমনকি স্ত্রীদের সাথে রান্নার কাজেও সহযোগিতা করতেন বলে বহু সহীহ হাদীসে প্রমাণিত।
এছাড়া তিনি নিজে উট ও ছাগলকে খাদ্য ও পানি খাওয়াতেন, দুধ দোহন করেছেন, বাজার হতে সদায় ক্রয় করে আনতেন, ঘরে ঝাড়– দিতেন, মেহমানকে নিজ হাতে খাদিম দিয়ে খাওয়াতেন, নিজের হাতে নিজের কাপড় ধৌত করতেন। এভাবে অনেক সাংসারিক কাজ রাসূল সা. নিজ হাতেই সম্পাদন করতেন যা আমাদের জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়।
পূর্ববর্তী নবীদের সময়কার অহংকারী
আলোচ্য নিবন্ধে যে সব অহংকারীকে তার অহংকার হকের অনুকরণ ও অনুসরণ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে তাদের দৃষ্টান্ত সম্পর্কে আলোচনা করা হবে:
এক. ইবলিস
অভিশপ্ত ইবলিসের কুফরী করা ও আল্লাহর আদেশের অবাধ্য হওয়ার একমাত্র কারণ তার অহংকার। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা মহাগ্রন্থ আল-কুর’আনে ঘোষণা করেন :
إِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي خَالِقٌ بَشَرًا مِنْ طِينٍ . فَإِذَا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ فِيهِ مِنْ رُوحِي فَقَعُوا لَهُ سَاجِدِينَ . فَسَجَدَ الْمَلَائِكَةُ كُلُّهُمْ أَجْمَعُونَ . إِلَّا إِبْلِيسَ اسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ . قَالَ يَا إِبْلِيسُ مَا مَنَعَكَ أَنْ تَسْجُدَ لِمَا خَلَقْتُ بِيَدَيَّ أَسْتَكْبَرْتَ أَمْ كُنْتَ مِنَ الْعَالِينَ . قَالَ أَنَا خَيْرٌ مِنْهُ خَلَقْتَنِي مِنْ نَارٍ وَخَلَقْتَهُ مِنْ طِينٍ . قَالَ فَاخْرُجْ مِنْهَا فَإِنَّكَ رَجِيمٌ . وَإِنَّ عَلَيْكَ لَعْنَتِي إِلَى يَوْمِ الدِّينِ . قَالَ رَبِّ فَأَنْظِرْنِي إِلَى يَوْمِ يُبْعَثُونَ . قَالَ فَإِنَّكَ مِنَ الْمُنْظَرِينَ . إِلَى يَوْمِ الْوَقْتِ الْمَعْلُومِ . قَالَ فَبِعِزَّتِكَ لَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ . إِلَّا عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِينَ . قَالَ فَالْحَقُّ وَالْحَقَّ أَقُولُ . لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنْكَ وَمِمَّنْ تَبِعَكَ مِنْهُمْ أَجْمَعِينَ . قُلْ مَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ مِنْ أَجْرٍ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُتَكَلِّفِينَ . إِنْ هُوَ إِلَّا ذِكْرٌ لِلْعَالَمِينَ.
“স্মরণ কর, যখন তোমার রব ফেরেশতাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন : আমি মাটি হতে মানুষ সৃষ্টি করব। যখন আমি তাকে সুষম করব এবং তার মধ্যে আমার রূহ সঞ্চার করব, তখন তোমরা তার উদ্দেশ্যে সিজদাবনত হয়ে যাও’। ফলে ফেরেশতাগণ সকলেই সিজদাবনত হল। ইবলীস ছাড়া, সে অহংকার করল এবং কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ল। আল্লাহ বললেন, ‘হে ইবলীস! আমার দু’হাতে আমি যাকে সৃষ্টি করেছি তার প্রতি সিজদাবনত হতে কিসে তোমাকে বাধা দিল? তুমি কি অহংকার করলে, না তুমি অধিকতর উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন?’ সে বলল : ‘আমি তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন অগ্নি থেকে আর তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে।’ তিনি বললেন, ‘তুমি এখান থেকে বের হয়ে যাও। কেননা নিশ্চয় তুমি বিতাড়িত। আর নিশ্চয় বিচার দিবস পর্যন্ত তোমার প্রতি আমার লা‘নত বলবৎ থাকবে। সে বলল : ‘হে আমার রব, আমাকে সে দিন পর্যন্ত অবকাশ দিন যেদিন তারা পুনরুত্থিত হবে।’ তিনি বললেন, আচ্ছা তুমি অবকাশপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হলে-‘নির্ধারিত সময় উপস্থিত হওয়ার দিন পর্যন্ত।’ সে বলল : ‘আপনার ইজ্জতের কসম! আমি তাদের সকলকেই বিপথগামী করে ছাড়ব।’ তাদের মধ্য থেকে আপনার একনিষ্ঠ বান্দারা ছাড়া। আল্লাহ বললেন : এটি সত্য আর সত্য-ই আমি বলি’ তোমাকে দিয়ে এবং তাদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করত তাদের দিয়ে নিশ্চয় আমি জাহান্নাম পূর্ণ করব। বল, ‘এর বিনিময়ে আমি তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চাই না আর আমি ভানকারীদের অন্তর্ভুক্ত নই। সৃষ্টিকুলের জন্য এ তো উপদেশ ছাড়া আর কিছু নয়।”১০
দুই. ফির‘আউন ও তার সম্প্রদায়ের লোক
অনুরূপভাবে ফির‘আউনের কুফরী করার কারণ ছিল, তার অহংকার। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন :
وَقَالَ فِرْعَوْنُ يَا أَيُّهَا الْمَلَأُ مَا عَلِمْتُ لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرِي فَأَوْقِدْ لِي يَا هَامَانُ عَلَى الطِّينِ فَاجْعَلْ لِي صَرْحًا لَعَلِّي أَطَّلِعُ إِلَى إِلَهِ مُوسَى وَإِنِّي لَأَظُنُّهُ مِنَ الْكَاذِبِينَ . وَاسْتَكْبَرَ هُوَ وَجُنُودُهُ فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَظَنُّوا أَنَّهُمْ إِلَيْنَا لَا يُرْجَعُونَ . فَأَخَذْنَاهُ وَجُنُودَهُ فَنَبَذْنَاهُمْ فِي الْيَمِّ فَانْظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الظَّالِمِينَ . وَجَعَلْنَاهُمْ أَئِمَّةً يَدْعُونَ إِلَى النَّارِ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ لَا يُنْصَرُونَ . وَأَتْبَعْنَاهُمْ فِي هَذِهِ الدُّنْيَا لَعْنَةً وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ هُمْ مِنَ الْمَقْبُوحِينَ.
আর ফির‘আউন বলল : ‘হে পারিষদবর্গ, আমি ছাড়া তোমাদের কোন ইলাহ আছে বলে আমি জানি না। অতএব হে হামান! আমার জন্য তুমি ইট পোড়াও, তারপর আমার জন্য একটি প্রাসাদ তৈরী কর। যাতে আমি মূসার ইলাহকে দেখতে পাই। আর নিশ্চয় আমি মনে করি সে মিথ্যাবাদীদের অন্তর্ভুক্ত’। আর ফির‘আউন ও তার সেনাবাহিনী অন্যায়ভাবে যমীনে অহংকার করেছিল এবং তারা মনে করেছিল যে, তাদেরকে আমার নিকট ফিরিয়ে আনা হবে না। অতঃপর আমি তাকে ও তার সেনাবাহিনীকে পাকড়াও করলাম, তারপর তাদেরকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করলাম। অতএব, দেখ যালিমদের পরিণাম কিরূপ হয়েছিল? আর আমি তাদেরকে নেতা বানিয়েছিলাম, তারা জাহান্নামের দিকে আহ্বান করত এবং কিয়ামতের দিন তাদেরকে সাহায্য করা হবে না। এ যমীনে আমি তাদের পিছনে অভিসম্পাত লাগিয়ে দিয়েছি আর কিয়ামতের দিন তারা হবে ঘৃণিতদের অন্তর্ভুক্ত।১১
তিন. সালেহ আ.-এর কওম সামূদ গোত্র
সামূদ গোত্রের কুফরীর কারণও একই। অর্থাৎ তাদের অহংকার। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন :
قَالَ الْمَلَأُ الَّذِينَ اسْتَكْبَرُوا مِنْ قَوْمِهِ لِلَّذِينَ اسْتُضْعِفُوا لِمَنْ آمَنَ مِنْهُمْ أَتَعْلَمُونَ أَنَّ صَالِحًا مُرْسَلٌ مِنْ رَبِّهِ قَالُوا إِنَّا بِمَا أُرْسِلَ بِهِ مُؤْمِنُونَ . قَالَ الَّذِينَ اسْتَكْبَرُوا إِنَّا بِالَّذِي آمَنْتُمْ بِهِ كَافِرُونَ . فَعَقَرُوا النَّاقَةَ وَعَتَوْا عَنْ أَمْرِ رَبِّهِمْ وَقَالُوا يَا صَالِحُ ائْتِنَا بِمَا تَعِدُنَا إِنْ كُنْتَ مِنَ الْمُرْسَلِينَ . فَأَخَذَتْهُمُ الرَّجْفَةُ فَأَصْبَحُوا فِي دَارِهِمْ جَاثِمِينَ.
“তার কওমের অহংকারী নেতৃবৃন্দ তাদের সেই মু’মিনদেরকে বলল যাদেরকে দুর্বল মনে করা হত, ‘তোমরা কি জান যে, সালিহ তার রবের পক্ষ থেকে প্রেরিত’? তারা বলল : ‘নিশ্চয় সে যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছে, আমরা তাতে বিশ্বাসী’। যারা অহংকার করেছিল তারা বলল : ‘নিশ্চয় তোমরা যার প্রতি ঈমান এনেছ, আমরা তার প্রতি অস্বীকারকারী’। অতঃপর তারা উষ্ট্রীকে যবেহ করল এবং তাদের রবের আদেশ অমান্য করল। আর তারা বলল : ‘হে সালিহ! তুমি আমাদেরকে যে ওয়াদা দিয়েছ, তা আমাদের কাছে নিয়ে এসো, যদি তুমি রাসূলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাক’। ফলে তাদেরকে ভূমিকম্প পাকড়াও করল, তাই সকালে তারা তাদের গৃহে উপুড় হয়ে মরে রইল।”১২
চার. হুদ আ.-এর কাওম আদ সম্প্রদায়
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন :
فَأَمَّا عَادٌ فَاسْتَكْبَرُوا فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَقَالُوا مَنْ أَشَدُّ مِنَّا قُوَّةً أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّ اللَّهَ الَّذِي خَلَقَهُمْ هُوَ أَشَدُّ مِنْهُمْ قُوَّةً وَكَانُوا بِآيَاتِنَا يَجْحَدُونَ . فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ رِيحًا صَرْصَرًا فِي أَيَّامٍ نَحِسَاتٍ لِنُذِيقَهُمْ عَذَابَ الْخِزْيِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَلَعَذَابُ الْآخِرَةِ أَخْزَى وَهُمْ لَا يُنْصَرُونَ . وَأَمَّا ثَمُودُ فَهَدَيْنَاهُمْ فَاسْتَحَبُّوا الْعَمَى عَلَى الْهُدَى فَأَخَذَتْهُمْ صَاعِقَةُ الْعَذَابِ الْهُونِ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ . وَنَجَّيْنَا الَّذِينَ آمَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُونَ .
“আর ‘আদ সম্প্রদায়, তারা যমীনে অযথা অহংকার করত এবং বলত, ‘আমাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী কে আছে’? তবে কি তারা লক্ষ্য করেনি যে, নিশ্চয় আল্লাহ যিনি তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী? আর তারা আমার আয়াতগুলোকে অস্বীকার করত। তারপর আমি তাদের উপর অশুভ দিনগুলোতে ঝঞ্ঝাবায়ু পাঠালাম যাতে তাদেরকে দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনাদায়ক আযাব আস্বাদন করাতে পারি। আর আখিরাতের আযাব তো অধিকতর লাঞ্ছনাদায়ক এবং তাদেরকে সাহায্য করা হবে না। আর সামূদ সম্প্রদায়, আমি তাদেরকে সঠিক পথের নির্দেশনা দিয়েছিলাম; কিন্তু তারা সঠিক পথে চলার পরিবর্তে অন্ধ পথে চলাই পছন্দ করেছিল। ফলে তাদের অর্জনের কারণেই লাঞ্ছনাদায়ক আযাবের বজ্রাঘাত তাদেরকে পাকড়াও করল। আর আমি তাদেরকে রক্ষা করলাম যারা ঈমান এনেছিল এবং তাকওয়া অবলম্বন করত।”১৩
পাঁচ. শু‘আইব আ.-এর কওম মাদায়েনবাসী
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বলেন :
قَالَ الْمَلَأُ الَّذِينَ اسْتَكْبَرُوا مِنْ قَوْمِهِ لَنُخْرِجَنَّكَ يَا شُعَيْبُ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَكَ مِنْ قَرْيَتِنَا أَوْ لَتَعُودُنَّ فِي مِلَّتِنَا قَالَ أَوَلَوْ كُنَّا كَارِهِينَ . قَدِ افْتَرَيْنَا عَلَى اللَّهِ كَذِبًا إِنْ عُدْنَا فِي مِلَّتِكُمْ بَعْدَ إِذْ نَجَّانَا اللَّهُ مِنْهَا وَمَا يَكُونُ لَنَا أَنْ نَعُودَ فِيهَا إِلَّا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّنَا وَسِعَ رَبُّنَا كُلَّ شَيْءٍ عِلْمًا عَلَى اللَّهِ تَوَكَّلْنَا رَبَّنَا افْتَحْ بَيْنَنَا وَبَيْنَ قَوْمِنَا بِالْحَقِّ وَأَنْتَ خَيْرُ الْفَاتِحِينَ . وَقَالَ الْمَلَأُ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ قَوْمِهِ لَئِنِ اتَّبَعْتُمْ شُعَيْبًا إِنَّكُمْ إِذًا لَخَاسِرُونَ . فَأَخَذَتْهُمُ الرَّجْفَةُ فَأَصْبَحُوا فِي دَارِهِمْ جَاثِمِينَ . الَّذِينَ كَذَّبُوا شُعَيْبًا كَأَنْ لَمْ يَغْنَوْا فِيهَا الَّذِينَ كَذَّبُوا شُعَيْبًا كَانُوا هُمُ الْخَاسِرِينَ.
“তার কওম থেকে যে নেতৃবৃন্দ অহংকার করেছিল তারা বলল : ‘হে শু‘আইব, আমরা তোমাকে ও তোমার সাথে যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে অবশ্যই আমাদের জনপদ থেকে বের করে দেব অথবা তোমরা আমাদের ধর্মে ফিরে আসবে।’ সে বলল : ‘যদিও আমরা অপছন্দ করি তবুও?’ আমরা তো আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করলাম যদি আমরা তোমাদের ধর্মে ফিরে যাইÑ সেই ধর্ম থেকে আল্লাহ আমাদেরকে নাজাত দেয়ার পর। আর আমাদের জন্য উচিত হবে না তাতে ফিরে যাওয়া। তবে আমাদের রব আল্লাহ চাইলে (সেটা ভিন্ন কথা)। আমাদের রব জ্ঞান দ্বারা সব কিছু পরিব্যাপ্ত করে আছেন। আল্লাহরই উপর আমরা তাওয়াক্কুল করি। হে আমাদের রব! আমাদের ও আমাদের কওমের মধ্যে যথার্থ ফায়সালা করে দিন। আর আপনি শ্রেষ্ঠ ফয়সালাকারী। আর তার কওম থেকে যে নেতৃবৃন্দ কুফরী করেছিল তারা বলল : ‘যদি তোমরা শু‘আইবকে অনুসরণ কর তাহলে নিশ্চয় তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ অতঃপর ভূমিকম্প তাদের পাকড়াও করল। তারপর তারা তাদের গৃহে উপুড় হয়ে মরে রইল। যারা শু‘আইবকে মিথ্যাবাদী বলেছিল, মনে হয় যেন তারা সেখানে বসবাসই করেনি। যারা শু‘আইবকে মিথ্যাবাদী বলেছিল তারাই ছিল ক্ষতিগ্রস্ত।”১৪
ছয়. নূহ আ.-এর সম্প্রদায়
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন :
قَالَ رَبِّ إِنِّي دَعَوْتُ قَوْمِي لَيْلًا وَنَهَارًا . فَلَمْ يَزِدْهُمْ دُعَائِي إِلَّا فِرَارًا . وَإِنِّي كُلَّمَا دَعَوْتُهُمْ لِتَغْفِرَ لَهُمْ جَعَلُوا أَصَابِعَهُمْ فِي آذَانِهِمْ وَاسْتَغْشَوْا ثِيَابَهُمْ وَأَصَرُّوا وَاسْتَكْبَرُوا اسْتِكْبَارًا . ثُمَّ إِنِّي دَعَوْتُهُمْ جِهَارًا . ثُمَّ إِنِّي أَعْلَنْتُ لَهُمْ وَأَسْرَرْتُ لَهُمْ إِسْرَارًا . فَقُلْتُ اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ إِنَّهُ كَانَ غَفَّارًا.
“সে বলল : ‘হে আমার রব! আমি তো আমার কওমকে রাত-দিন আহবান করেছি। ‘অতঃপর আমার আহ্বান কেবল তাদের পলায়নই বাড়িয়ে দিয়েছে’। ‘আর যখনই আমি তাদেরকে আহ্বান করেছি ‘যেন আপনি তাদেরকে ক্ষমা করেন’, তারা নিজদের কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিয়েছে, নিজদেরকে পোশাকে আবৃত করেছে, (অবাধ্যতায়) অনড় থেকেছে এবং দম্ভভরে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছে’। ‘তারপর আমি তাদেরকে প্রকাশ্যে আহ্বান করেছি’। অতঃপর তাদেরকে আমি প্রকাশ্যে এবং অতি গোপনেও আহ্বান করেছি। আর বলেছি, ‘তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও; নিশ্চয় তিনি পরম ক্ষমাশীল’।”১৫
পরবর্তীতে তাদের শাস্তি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
مِمَّا خَطِيئَاتِهِمْ أُغْرِقُوا فَأُدْخِلُوا نَارًا فَلَمْ يَجِدُوا لَهُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَنْصَارًا . وَقَالَ نُوحٌ رَبِّ لَا تَذَرْ عَلَى الْأَرْضِ مِنَ الْكَافِرِينَ دَيَّارًا . إِنَّكَ إِنْ تَذَرْهُمْ يُضِلُّوا عِبَادَكَ وَلَا يَلِدُوا إِلَّا فَاجِرًا كَفَّارً.
“তাদের পাপের কারণে তাদেরকে ডুবিয়ে দেয়া হল অতঃপর আগুনে প্রবেশ করানো হল; তারা নিজদের সাহায্যকারী হিসেবে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে পায়নি। আর নূহ বলল : ‘হে আমার রব! যমীনের উপর কোন কাফিরকে অবশিষ্ট রাখবেন না’। ‘আপনি যদি তাদেরকে অবশিষ্ট রাখেন তবে তারা আপনার বান্দাদেরকে পথভ্রষ্ট করবে এবং দুরাচারী ও কাফির ছাড়া অন্য কারো জন্ম দেবে না’।”১৬
সাত. বনী ইসরাঈল
এ প্রসেঙ্গ আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন :
وَلَقَدْ آتَيْنَا مُوسَى الْكِتَابَ وَقَفَّيْنَا مِنْ بَعْدِهِ بِالرُّسُلِ وَآتَيْنَا عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ الْبَيِّنَاتِ وَأَيَّدْنَاهُ بِرُوحِ الْقُدُسِ أَفَكُلَّمَا جَاءَكُمْ رَسُولٌ بِمَا لَا تَهْوَى أَنْفُسُكُمُ اسْتَكْبَرْتُمْ فَفَرِيقًا كَذَّبْتُمْ وَفَرِيقًا تَقْتُلُونَ . وَقَالُوا قُلُوبُنَا غُلْفٌ بَلْ لَعَنَهُمُ اللَّهُ بِكُفْرِهِمْ فَقَلِيلًا مَا يُؤْمِنُونَ . وَلَمَّا جَاءَهُمْ كِتَابٌ مِنْ عِنْدِ اللَّهِ مُصَدِّقٌ لِمَا مَعَهُمْ وَكَانُوا مِنْ قَبْلُ يَسْتَفْتِحُونَ عَلَى الَّذِينَ كَفَرُوا فَلَمَّا جَاءَهُمْ مَا عَرَفُوا كَفَرُوا بِهِ فَلَعْنَةُ اللَّهِ عَلَى الْكَافِرِينَ . بِئْسَمَا اشْتَرَوْا بِهِ أَنْفُسَهُمْ أَنْ يَكْفُرُوا بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ بَغْيًا أَنْ يُنَزِّلَ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ عَلَى مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ فَبَاءُوا بِغَضَبٍ عَلَى غَضَبٍ وَلِلْكَافِرِينَ عَذَابٌ مُهِينٌ .
“যার বিনিময়ে তারা নিজদেরকে বিক্রয় করেছে তা কত জঘন্য (তা এই) যে, আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তা তারা অস্বীকার করেছে এই জিদের বশবর্তী হয়ে যে, আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা তার উপর তাঁর অনুগ্রহ নাযিল করেছেন। সুতরাং তারা ক্রোধের উপর ক্রোধের অধিকারী হল। আর কাফিরদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর আযাব। আর তারা বলল : আমাদের অন্তরসমূহ আচ্ছাদিত; বরং তাদের কুফরীর কারণে আল্লাহ্ তাদেরকে লা‘নত করেছেন। অতঃপর তারা খুব কমই ঈমান আনে। আর যখন তাদের কাছে, তাদের সাথে যা আছে, আল্লাহ্র পক্ষ থেকে তার সত্যায়নকারী কিতাব এলো, আর তারা (এর মাধ্যমে) পূর্বে কাফিরদের উপর বিজয় কামনা করত। সুতরাং যখন তাদের নিকট এলো যা তারা চিনত, তখন তারা তা অস্বীকার করল। অতএব কাফিরদের উপর আল্লাহ্র লা‘নত। আর আমি নিশ্চয় মূসাকে কিতাব দিয়েছি এবং তার পরে একের পর এক রাসূল প্রেরণ করেছি এবং মারইয়াম পুত্র ঈসাকে দিয়েছি সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ। আর তাকে শক্তিশালী করেছি ‘পবিত্র আত্মা’র মাধ্যমে। তবে কি তোমাদের নিকট যখনই কোন রাসূল এমন কিছু নিয়ে এসেছে, যা তোমাদের মনঃপূত নয়, তখন তোমরা অহংকার করেছ, অতঃপর (নবীদের) একদলকে তোমরা মিথ্যাবাদী বলেছ আর একদলকে হত্যা করেছ।”১৭
এমনিভাবে মহান আল্লাহ্ অহংকারীদের অহংকার ভেঙ্গে চুরে দাবিয়ে দেন।
অহংকারের শাস্তি
নিজেকে আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করা, অন্যদেরকে নিজের তুলনায় ছোট ও অধম মনে করে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা, আল্লাহর আদেশের বিরুদ্ধে ঔদ্ধ্যত প্রকাশ করে তার প্রতি অবাধ্য হওয়া ও আদেশ অমান্য করা সবই অহংকারের লক্ষণ ও অহংকারের মধ্যে গণ্য। আল কুরআনে বহু জায়গায় অহংকারের নিন্দা ও অহংকারীর প্রতি ধিক্কার ঘোষিত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
وَقَالَ مُوسَى إِنِّي عُذْتُ بِرَبِّي وَرَبِّكُمْ مِنْ كُلِّ مُتَكَبِّرٍ لَا يُؤْمِنُ بِيَوْمِ الْحِسَابِ.
“মূসা বললো : আমি আমার ও তোমাদের প্রতিপালকের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি এমন প্রত্যেক অহংকারী থেকে, যে হিসাবের দিনের প্রতি বিশ্বাস রাখে না।”১৮
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা অন্য এক আয়াতে বলেন :
إنه لا يحب المستكبرين.
“নিশ্চয় আল্লাহ অহংকারীদেরকে পছন্দ করেন না।”১৯
এ দ্বারা বুঝা গেল, আল্লাহর প্রতি তার ঈমান থাকলেও তাতে কোন লাভ হবে না। ইবলিসের ন্যায় সে কাফের বলে গণ্য হবে। লুকমান আ. তার ছেলেকে উপদেশ দিতে যেয়ে যে কথা বলেছিলেন তা আল্লাহ্ তা‘আলা এত বেশি পছন্দ করেছিলেন যে, আল্লাহ্ তা কুর’আনে উল্লেখ করে দিয়েছেন। হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “অহংকার আমার পোশাক। এই পোশাক যে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চেষ্টা করে, তাকে আমি জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো।”২০
রাসূল (সা.) আরো বলেন : যে ব্যক্তি অহংকারের সাথে চলাফেরা করে এবং নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে, সে যখন আল্লাহ তা‘আলার সাথে সাক্ষাত করবে, তখন তাঁকে তার ওপর রাগান্বিত দেখবে।”২১
অপর একটি হাদীসে এসেছে,আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : রাসূল (সা.) বলেছেন : আল্লাহ তা‘আলা তিন শ্রেণীর লোকের সাথে ক্বিয়ামতের দিন কথা বলবেন না। (১) বয়ঃপ্রাপ্ত যেনাকার (২) মিথ্যুক শাসক (৩) অহংকারী দরিদ্র।২২
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন : রাসূল (সা.) বলেছেন : ‘যে অহংকার বশত পায়ের নিচে লুঙ্গি ঝুলিয়ে রাখে ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তার প্রতি দৃষ্টি দিবেন না’।২৩
এ হাদীস থেকে বুঝা যায় যে, যারা অহংকার করে টাখনুর নিচে কাপড় ঝুলিয়ে পরবে আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন তাদের দিকে দৃষ্টি দিবেন না। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে মুসলিম পুরুষরা লুঙ্গি, পাজামা, প্যান্ট গোড়ালীর নিচে ঝুলিয়ে পরে। এটা যেন এখন একটা ফ্যাশান। অথচ এর পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। এ বিষয়ে কোন মানুষ চিন্তা করে না। এর মধ্যে কোন ভদ্রতা ও শালীনতা নেই। বরং এর পরিণাম হচ্ছে জাহান্নাম। তাই এ বিষয়ে প্রত্যেক মুসলিম পুরুষকে সজাগ ও সচেতন হওয়া জরূরী। জান্নাত পিয়াসী মুসলিম পুরুষকে টাখনুর উপরে কাপড় পরিধান করতে হবে। অন্যথা পরকালে তাদেরকে জাহান্নামে যেতে হবে।
মনে রাখতে হবে যে, জ্ঞান ও বিদ্যার শ্রেষ্ঠত্ব এবং পদমর্যাদার উচ্চতা নিয়ে বড়াই করা খুবই নিকৃষ্ট ধরনের অহংকার। যে ব্যক্তি আখিরাতের উদ্দেশ্যে বিদ্যা বিশেষত ইসলামী জ্ঞান অর্জন করে, সে অহংকারী হতে পারে না। সে সবসময় নিজের মনের ওপর পাহারা বসিয়ে রাখে এবং কড়া নজর রাখে। এ ব্যাপারে শৈথিল্য দেখা দিলেই মনে অহংকার আসবে এবং সঠিক পথ থেকে তাকে বিচ্যুত করে ফেলবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন : যে অহংকার করে তাকে আমি আমার আয়াতসমূহ থেকে ফিরিয়ে রাখবো। অর্থাৎ অহংকার মানুষের হেদায়েতের পথ বন্ধ করে দেয়। আর যে ব্যক্তি অহংকার করা ও মুসলমানদেরকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার উদ্দেশ্যে জ্ঞানার্জন করে এবং জ্ঞানার্জনের পর তাদেরকে বোকা ভাবে, সে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ধরনের অহংকারে লিপ্ত হয়।
অহংকার থেকে বাঁচার উপায়
একটি কথা মনে রাখতে হবে, কিবর তথা অহংকার এমন একটি কবীরা গুণাহ যা মানুষকে ধ্বংস করে দেয় এবং একজন মানুষের দুনিয়া ও আখিরাতকে নষ্ট করে দেয়। এ কারণেই একজন মানুষের জন্য অহংকার থেকে দূরে থাকা বা তার জীবন থেকে তা দুর করা অকাট্যভাবে ফরয। আর এ কথ সত্য যার মধ্যে অহংকার থাকে সে শুধু আশা করলে বা ইচ্ছা করলেই অহংকারকে দূর করতে বা অহংকার হতে বিরত থাকতে পারে না। তাকে অবশ্যই এ মারাত্মক ব্যাধির চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। অহংকারের চিকিৎসা নিম্নরূপ :
এক. অন্তর থেকে দূরিভূত করা
প্রথমে অহংকারী নিজেকে চিনতে হবে, তারপর তাকে তার প্রভুকে চিনতে হবে। একজন মানুষ যখন নিজেকে ভালোভাবে চিনতে পারবে এবং আল্লাহ্ তা‘আলার মহত্ব ও বড়ত্বকে সঠিকভাবে বুঝতে পারবে তখন তার মধ্যে বিনয় ও নম্রতা ছাড়া আর কিছুই থাকতে পারে না, অহংকার তার থেকে এমনিতেই দূর হয়ে যাবে। আল্লাহ্ তা‘আলাকে যখন ভালোভাবে চিনবে তখন সে অবশ্যই জানতে পারবে বড়ত্ব ও মহত্ব একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো জন্য প্রযোজ্য নয়। আর এভাবে সে তার মন থেকে অহংকার মুছে ফেলতে পারবে।
দুই. অহংকারের উৎসসমূহ থেকে বিরত থাকা
এানুষ যে সব বস্তু নিয়ে অহংকার করে তাতে চিন্তা ফিকির করা এবং মেনে নেয়া যে তার জন্য এসব বস্তু নিয়ে অহংকার করা উচিত নয়। কেউ যদি তার বংশ মর্যাদা নিয়ে অহংকার করে, তখন তাকে বুঝতে হবে যে, এটি একটি মূর্খতা বৈ কিছুই নয়। কারণ সে তো তার নিজের ভিতরের কোন যোগ্যতা নিয়ে অহংকার করছে না। সে অহংকার করছে অন্যদের যোগ্যতা নিয়ে। যা একেবারেই বিবেক ও বুদ্ধিহীন কাজ।
তিন. আল্লাহর নিকট সাহায্য যাওয়া
দো‘আ ও আল্লাহর নিকট সাহায্য চাওয়া হল, অহংকার থেকে বাঁচার জন্য সব চেয়ে উপকারী ও কার্যকর ঔষধ। কারণ, আল্লাহ্ তা‘আলা যাদের হিফাযত করেন, তারাই অহংকার থেকে বাঁচতে পারে। আর আল্লাহর সাহায্য ছাড়া বাঁচার কোন উপায় নেই। এ কারণে রাসূল সা. উম্মতদের দো‘আ শিখিয়ে দেন এবং তিনি নিজেও সালাতে বেশি বেশি করে আল্লাহর নিকট দো‘আ মুনাজাত করেন। এ প্রসঙ্গে হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে : যুবাইর ইব্ন মুতইম রা. হতে বর্ণিত, তিনি রাসূল সা. কে একবার সালাত আদায় করতে দেখেন, তখন তিনি রাসূল সা.কে সালাতে এ কথাগুলো বলতে শোনেন :
الله أَكْبر كَبِيًرا الله أَكبر كَبِيًرا الله أَكبر كَبِيًرا وَالحَمْدُ لله كَثيِراً وَالحَمْدُ لله كَثِيراً وَالحَمْدُ لله كَثِيراً وَسبحَانَ الله بُكْرَةً وََأِصيلًا ثَلَاًثا، أَعُوذُ باِلله مِنْ الشَّيطْاَنِ الرجيم مِنْ نَفْخِهِ وَنَفْثِهِ وَهمْزِه
“আল্লাহ তা‘আলা সব কিছু হতে বড়, আল্লাহ্ তা‘আলা সবকিছু হতে বড়, আল্লাহ্ তা‘আলা সবকিছু হতে বড়। আর সর্বাধিক প্রশংসা কেবলই আল্লাহরই, আর সর্বাধিক প্রশংসা কেবলই আল্লাহরই, আর সর্বাধিক প্রশংসা কেবলই আল্লাহরই। আর আমি বিতাড়িত শয়তান হতে তোমার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি, আমি আরও আশ্রয় চাচ্ছি তার অহংকার থেকে তার প্ররোচনা থেকে ও ষড়যন্ত্র থেকে।”২৪
চার. আত্মপরিচয় সম্পর্কে অবগত হওয়া
যে ব্যক্তির মধ্যে অহংকার আসে তার চিন্তা করে দেখা উচিত যে, অহংকার কোন্ কারণে এসেছে, এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, অহংকার দূর করতে হলে নিজেকে এবং প্রভুকে চিনতে হবে। মানুষকে এক ফোটা তুচ্ছ পানি দ্বারা পয়দা করা হইয়াছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন :
هَلْ أَتَى عَلَى الْإِنْسَانِ حِينٌ مِنَ الدَّهْرِ لَمْ يَكُنْ شَيْئًا مَذْكُورًا . إِنَّا خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ مِنْ نُطْفَةٍ أَمْشَاجٍ نَبْتَلِيهِ فَجَعَلْنَاهُ سَمِيعًا بَصِيرًا.
“মানুষের উপর এমন এক সময় কি আসেনি? যখন সে উল্লেখযোগ্য কোন জিনিসই ছিল না। নিশ্চয়ই আমি মানুষকে পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে সংমিশ্রিত ধাতু দ্বারা সৃষ্টি করেছি। অুঃপর আমি তাকে শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টি শক্তির অধিকারী করেছি।”২৫
পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪| পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭| পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০
________________________________________
১. ইবনে মানযুর, লিসানুর আরব, (বৈরূত : দারুল ফিকর, তা.বি.), খ. ৫০, পৃ. ১২৫
২. মুসলিম, আস-সহীহ, পৃ. ৯১
৩. দার কুতনী, খ. ৪, পৃ. ২০৬
৪. তারিখে বাগদাদ, খ. ১০, পৃ. ৩০৭
৫. সিয়ার আলাম আন নুবালা, খ. ৭, পৃ. ৪০৭
৬. সূরা আল-আলাক, আয়াত : ৬-৮
৭. আল্লামা বাগাভী, তাফসীরু মাআলিমুত তানযীল, খ. ৮, পৃ. ৪৯৭
৮. বুখারী, আস-সহীহ, হাদীস নং-৫০৯৬
৯. ইসলাহে নাফস, পৃ. ১২
১০. সূরা সাদ, আয়াত : ৭১-৮৭
১১. সূরা আল-কাসাস, আয়াত : ৩৮-৪২
১২. সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত : ৭৫-৭৮
১৩. সূরা ফুসসিলাত, আয়ত : ১৫-১৬
১৪. সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত : ৮৮-৯২
১৫. সূরা নূহ, আয়াত : ৫-১০
১৬. সূরা নূহ, আয়াত : ২৫-২৮
১৭. সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত : ৮৭-৯০
১৮. সূরা আল মু’মিন
১৯. সূরা আন্-নাহল, আয়াত : ২৩
২০. সহীহ মুসলিম
২১. তাবারানী
২২. মুসলিম, মিশকাত, হাদীস নং-৫১০৯
২৩. বুখারী, হাদীস নং-৫৩৪২
২৪. আবূ দাউদ, আস-সুনান, খ. ৪, পৃ. ৪২৭, হাদীস নং-৪৯০৫।
২৫. সূরা আদ-দাহর, আয়াত : ১-২

‘আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক’
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Twitter, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। “কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা” [সহীহ্ মুসলিম:
প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য যা জানা একান্ত কর্তব্য – ২
ইসলাম বিনষ্টকারী বস্তু সমূহ
ইসলামকে বিনষ্ট করে এমন বস্তু দশটি :
• এক : আল্লাহর ইবাদাতে কাউকে শরিক বা অংশীদার করা। আল্লাহ বলেন:

“নিশ্চয়ই আল্লাহ ইবাদাতে তার সাথে কাউকে শরিক বা অংশীদার মানাকে ক্ষমা করবেন না, এছাড়া যা কিছু আছে তা যাকে ইচ্ছা করেন ক্ষমা করবেন”। [সূরা আন্-নিসা: ১১৬]
আরও বলেন :
“নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করে তার উপর আল্লাহ তা‘আলা জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন, তার আবাস হবে জাহান্নামে, আর অত্যাচারী (শির্ককারী)-দের কোন সাহায্যকারী নেই”। [সূরা আল-মায়েদা: ৭২]
আর এই শির্ক হিসেবে গণ্য হবে কবর অথবা মূর্তির জন্য কোন কিছু জবেহ করা।
• দুই : যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার মধ্যে কোনো মাধ্যম নির্ধারণ করে তাদের কাছে কিছু চাইবে ও তাদের সুপারিশ প্রার্থনা করবে এবং তাদের উপর ভরসা করবে, সে ব্যক্তি উম্মতের সর্বসম্মত মতে কাফের হয়ে যাবে।
• তিন : যে কেউ মুশরিকদের (যারা আল্লাহর ইবাদতে এবং তার সৃষ্টিগত সার্বভৌমত্বে অন্য কাউকে অংশীদার মনে করে তাদেরকে) কাফের বলবে না বা তাদের কাফের হওয়া সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করবে অথবা তাদের দীনকে সঠিক মনে করবে, সে উম্মতের ঐক্যমত্যে কাফের বলে বিবেচিত হবে।
• চার : যে ব্যক্তি মনে করবে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রদর্শিত পথের চেয়ে অন্য কারো প্রদর্শিত পথ বেশি পূর্ণাঙ্গ, অথবা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাসন-প্রণালীর চেয়ে অন্য কারো শাসন প্রণালী বেশি ভাল; যেমন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বিচার-পদ্ধতির উপর তাগুতি-শক্তির (আল্লাহদ্রোহী শক্তির) বিচার-ব্যবস্থাকে প্রাধান্য দেয় তাহলে সে কাফেরদের মধ্যে গণ্য হবে।
• পাঁচ : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে আদর্শ নিয়ে এসেছেন এর সামান্য কিছুও যদি কেউ অপছন্দ করে তবে সে কাফের হয়ে যাবে, যদিও সে (অপছন্দ করার পাশাপাশি) তার উপর আমল করে থাকে।
• ছয় : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বর্ণিত দীনের (জীবন বিধানের) সামান্যতম কিছু নিয়ে যদি কেউ ঠাট্টা করে বা দীনের কোন পুণ্য বা শাস্তি নিয়ে ‘ইয়ার্কি’ করে তবে সেও কাফের হয়ে যাবে। তার প্রমাণ: আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

“বলুন: তোমরা কি আল্লাহ ও তাঁর আয়াত (শরয়ি বা প্রাকৃতিক নিদর্শনাবলি) এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে ঠাট্টা করছ? তোমরা কোনো প্রকার ওজর পেশ করো না, কারণ তোমরা ঈমান আনার পরে কাফের হয়ে গিয়েছ”। [সূরা আত্-তাওবা: ৬৫, ৬৬]
• সাত : যাদু, বান, টোনা এর দ্বারা সম্পর্ক বিচ্যুতি ঘটানো বা সম্পর্ক স্থাপন করানো— যদি কেউ এগুলো করে বা করতে রাজি হয় তবে সে কাফের হয়ে যাবে।
এর প্রমাণ কোরআনের বাণী :
“তারা দু’জন (হারুত মারুত) কাউকে তা (যাদু) শিক্ষা দেওয়ার পূর্বে অবশ্যই বলে যে, আমরা তো কেবল ফিতনা বা পরীক্ষা স্বরূপ। সুতরাং তোমরা কুফরই করো না”। [সূরা আল-বাকারা: ১০২]
• আট : মুশরিকদের (যারা আল্লাহর ইবাদতে বা সার্বভৌমত্বে কাউকে অংশীদার বানায় তাদের)-কে মুসলমানদের উপর সাহায্য-সহযোগিতা করা।
এর দলিল আল্লাহর বাণী:
“তোমাদের থেকে যারা তাদের (মুশরিকদের)-কে মুরুব্বি বা বন্ধু মনে করবে তারা তাদের দলের অন্তর্ভুক্ত হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা অত্যাচারী কোন জাতিকে সঠিক পথের দিশা দেন না বা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছান না”। [সূরা আল-মায়েদা: ৫১]
• নয় : যে এ-কথা বিশ্বাস করবে যে, যেমনিভাবে খিজির আলাইহিস্সালাম এর জন্য মুসা আলাইহিস্সালাম এর শরিয়তের বাইরে থাকা সম্ভব হয়েছিল তেমনিভাবে কারো কারো জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রবর্তিত শরীয়ত থেকে বাইরে থাকা সম্ভব, সেও কাফের বলে গণ্য হবে।
• দশ: আল্লাহর দীন থেকে বিমুখ হওয়া, দীন শিখতে বা দীনের আদেশ নিষেধ অনুসারে কাজ করার ব্যাপারে গুরুত্বহীন থাকে।
এর দলিল আল্লাহর বাণী:
“তার চেয়ে কে বেশী অত্যাচারী যাকে আল্লাহর আয়াতসমূহ স্মরণ করিয়ে দেওয়ার পর সে তা এড়িয়ে গেল, নিশ্চয়ই আমি পাপিষ্ঠদের থেকে প্রতিশোধ নেব ”। [সূরা আস্-সাজদাহ: ২২]
এ-সমস্ত ঈমান বিনষ্টকারী বস্তু, ঠাট্টা করেই বলুক আর মন থেকে বলুক অথবা ভয়ে ভীত হয়েই বলুক, যেকোনো লোক এ-সমস্ত কাজের কোনো একটি করলে কাফের বলে বিবেচিত হবে। তবে যাকে জোর করে এ রকম কোন কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছে তার হুকুম আলাদা।
এ সবগুলোই অত্যন্ত বিপজ্জনক ও অত্যধিক হারে সংগঠিত হয়ে থাকে। সুতরাং মুসলিম মাত্রই এগুলো থেকে সাবধানতা অবলম্বন করা ও এগুলো থেকে বেঁচে থাকা বাঞ্ছনীয়।
আমরা আল্লাহর কাছে তার আযাব-গজবে পড়া ও তাঁর কঠিন শাস্তিতে নিপতিত হওয়া থেকে আশ্রয় চাচ্ছি।
তাওহীদ বা একত্ববাদ এর তিন অংশ
• এক: তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহ: “সৃষ্টি জগতের সৃষ্টিতে, নিয়ন্ত্রণে, লালন পালনে, রিজিক প্রদানে, জীবিত করণে, মৃত্যু প্রদানে, সার্বভৌমত্বে, আইন প্রদানে আল্লাহকেই এককভাবে মেনে নেয়া।” এ প্রকার তাওহীদ বা একত্ববাদকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সময়কার কাফেরগণ স্বীকার করে নিয়েছিল, কিন্তু শুধু এ গুলোতে ঈমান থাকার পরেও তারা ইসলামে প্রবেশ করতে পারে নি, বরং এগুলোর স্বীকৃতি থাকার পরও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, এবং তাদের জানমালকে হালাল বা বৈধ করে দিয়েছিলেন। এই প্রকারের তাওহীদ বা একত্ববাদ বলতে বুঝায় আল্লাহর কার্যসমূহে আল্লাহকেই একক কার্য সম্পাদনকারী হিসাবে মেনে নেয়া। তাওহীদ এর এ অংশ মক্কার কাফিরগণও যে স্বীকার করত তার প্রমাণ কোরআনের বাণী:

“বলুন: আসমান ও জমিনের কে তোমাদেরকে রিজিক বা খাদ্য যোগান দেয়? অথবা কে তোমাদের শ্রবণেন্দ্রিয় ও দৃষ্টিশক্তির সার্বভৌমত্বের অধিকারী? আর কে মৃত থেকে জীবিতকে বের করে? ও জীবিতকে মৃত থেকে বের করে? এবং কে কার্যাদির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম নিয়ন্ত্রণ করে থাকে? তারা অবশ্যই বলবে: আল্লাহ। সুতরাং বলুন: তোমরা কি তাকে ভয় পাও না ? ” [সূরা ইউনুস: ৩১]
কোরআনের আরও বহু আয়াতে এ কথার প্রমাণ রয়েছে।
• দুই: তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ: অর্থাৎ “সর্বপ্রকার ইবাদত শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য সম্পাদন করা। আর ইবাদতের প্রকার সমূহের মধ্যে রয়েছে : (১) দোয়া (২) সাহায্য চাওয়া (৩) আশ্রয় চাওয়া (৪) বিপদমুক্তি প্রার্থনা করা (৫) জবেহ করা (৬) মান্নত করা (৭) আশা করা (৮) ভয় করা (১০) ভালবাসা (১১) আগ্রহ ও (১২) প্রত্যাবর্তন করা, ইত্যাদি।” তাওহীদের এ অংশেই যত বিভেদ পূর্বকাল থেকে শুরু করে বর্তমানেও চলছে। এই অংশের অর্থ হলো, বান্দার ইবাদত কার্যাদিতে এককভাবে আল্লাহকেই নির্দিষ্ট করা। যেমন: দোয়া মান্নত, পশু জবেহ, আশা, ভরসা, ভীতি, আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাবর্তন ইত্যাদিতে তাঁকেই উদ্দেশ্য করা।
আর এ সবগুলোই যে আল্লাহর ইবাদত তার দলিল পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে।
• তিন: তাওহীদুয্যাত ওয়াল আসমা ওয়াস সিফাত: “আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস এবং তার নাম ও গুণাবলীসমূহে তাকে একক স্বত্বাধিকারী মনে করা।”
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
“বলুন: তিনি আল্লাহ একক স্বত্বা, আল্লাহ অমুখাপেক্ষী, তিনি জন্ম দেন নি, আবার তাঁকেও কেউ জন্ম দেয় নি, আর কেহ তাঁর সমকক্ষ হতে পারে না”। [সূরা আল-ইখলাস]
তিনি আরও বলেন:
“আর সুন্দর যাবতীয় নামগুলো আল্লাহরই, সুতরাং তোমরা তাকে সেগুলো দ্বারা আহবান করো, আর যারা তার নামসমূহকে বিকৃত করে তোমরা তাদের ছেড়ে দাও, অচিরেই তাদেরকে তাদের কার্যাদির পরিণাম-ফল দেয়া হবে”। [সূরা আল-আ‘রাফ: ১৮০]
তিনি আরও বলেন:
“তাঁর মত কোন কিছু নেই, তিনি সর্ব শ্রোতা দর্শক।” [সূরা আশ-শুরা: ১১]
তাওহীদের বিপরীত হলো শির্ক
(একত্ববাদের বিপরীতে অংশীদারিত্ব)
শির্ক তিন প্রকার : ১। বড় শির্ক, ২। ছোট শির্ক, ৩। গোপন শির্ক।
১। বড় শির্ক :
যা আল্লাহ কক্ষনো ক্ষমা করবেন না। এ শির্ক এর সাথে অনুষ্ঠিত কোন সৎকাজ আল্লাহ তা‘আলা কবুল করেন না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সাথে শির্ক করাকে ক্ষমা করবেন না, তবে শির্ক ব্যতীত (শির্কের চেয়ে নিচু পর্যায়ের) যত গুনাহ আছে তা তিনি যাকে ইচ্ছা করেন ক্ষমা করে দেবেন। আর যে আল্লাহর সাথে শির্ক করলো সে পথভ্রষ্টতায় অনেকদূর এগিয়ে গেল (বেশী বিপথগামী হলো)।” [সূরা আন্-নিসা: ১১৬]
তিনি আরও বলেন:
“অথচ মসীহ (ঈসা আলাইহিস্সালাম) বলেছেন: হে ইস্রায়েলের বংশধরগণ! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, যিনি আমার প্রভু, তোমাদের প্রভু, নিশ্চয়ই যদি কেউ আল্লাহর সাথে শরিক করে পরিণামে আল্লাহ তার উপর জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন, তার আস্তানা হবে জাহান্নাম, আর অত্যাচারীদের কোন সাহায্যকারী নেই”। [সূরা আল-মায়েদা: ৭২]
তিনি আরও বলেন:
“আর আমি তারা যা আমল করেছে সেগুলোর দিকে ধাবিত হয়ে সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় রূপান্তরিত করে দিয়েছি”। [সূরা আল-ফুরকান: ২৩]
আরও বলেন:
“আপনি যদি শির্ক করেন তবে অবশ্যই আপনার আমলকে নষ্ট করে দেব এবং নিশ্চয়ই আপনি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবেন।” [সূরা আয্-যুমার: ৬৫]
আরও বলেন:
“যদি তারা শির্ক করে তবে অবশ্যই তারা যা আমল করেছে তা নষ্ট হয়ে যাবে।” [সূরা আল-আন‘আম ১৮৮]
বড় শির্ক এর প্রকারাদি
বড় শির্ক চার প্রকার :
• এক: দোয়ায় শির্ক করা : এর দলিল আল্লাহর বাণী :

“অতঃপর যখন তারা নৌকায় চড়ে তখন দীনকে নিষ্ঠা সহকারে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করে তাঁকে ডাকতে থাকে কিন্তু যখন তিনি তাদেরকে ডাঙ্গায় নিয়ে পরিত্রাণ দেন তখনই তারা তার সাথে শির্ক (অংশীদার) করে।” [সূরা আল আনকাবুত: ৬৫]
• দুই: নিয়্যাত ও সংকল্পে শির্ক করা : এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী :

“যারা পার্থিব জীবন ও তার চাকচিক্য পেতে চায় আমি তাদেরকে তাদের কার্যাদির প্রতিফল তাতেই (পার্থিব জীবনেই) পরিপূর্ণভাবে দিয়ে দেব, তাদের এতে কম দেয়া হবেনা, তাদের জন্য পরকালে জাহান্নাম ছাড়া আর কিছুই থাকবে না, তারা দুনিয়ায় যা করেছে তা নষ্ট হয়ে গেছে, আর যে সমস্ত (নেক) কার্যাদি তারা করেছে তা বাতিল হয়ে যাবে।” [সূরা হুদ: ১৫, ১৬]
• তিন: আদেশ, নিষেধ প্রতিপালন বা বশ্যতায় শির্ক করা : এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী:

“তারা আল্লাহ ছাড়া তাদের ‘আরবাব’ তথা আলেম, ‘আহবার’ তথা আবেদদের (পীর-দরবেশদের)-কে তাদের জন্য হালাল হারাম-কারী বানিয়ে নিয়েছে এবং মরিয়ম পুত্র মসিহ্-কেও, অথচ তাদেরকে শুধু এক মা’বুদ এর ইবাদত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, তিনি ব্যতীত আর কোন হক মা’বুদ নেই। তার সাথে যাদের শরিক করছে তাদের থেকে তিনি কতইনা পবিত্র!” [সূরা আত্তাওবাঃ ৩১]
“আরবাব” শব্দের তাফসীর বা ব্যাখ্যা হলো আলেমদেরকে পাপ কাজে অনুসরণ করা, এর অর্থ তাদেরকে ডাকা নয়; কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রখ্যাত সাহাবী ‘আদি ইব্ন হাতিম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর প্রশ্নের উত্তরে এ প্রকার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। কারণ তিনি যখন বললেন : আমরা তাদের ইবাদত (উপাসনা) করি না, উত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন : “তাদের উপাসনা হলো পাপ কাজে তাদের আদেশ নিষেধ মান্য করা।”
• চার: ভালবাসায় শির্ক করা: এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী :

“আর মানুষের মাঝে এমনও আছে যারা আল্লাহ ছাড়া তার অনেক সমকক্ষ (সমপর্যায়ের ভালবাসা পাওয়ার অধিকারী, ভালবাসার পাত্র) নির্ধারণ করে সেগুলোকে আল্লাহর ন্যায় ভালবাসে, অথচ যারা ইমানদার তারা আল্লাহকে সর্বাধিক ভালবাসে।” [সূরা আল-বাকারাহ: ১৬৫]
২। ছোট শির্ক:
আর তা হলো (সামান্য) লোক দেখানোর নিয়তে নেক কাজ করা।
এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী :
“সুতরাং যে আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের আশা রাখে সে যেন নেক কাজ করে এবং তাঁর প্রভুর ইবাদতের সাথে অন্য কাউকে শরিক না করে।” [সূরা আল-কাহ্ফ: ১১০]
৩। গোপন (সূক্ষ্ম) শির্ক:
এর প্রমাণ হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী :
“এ [মুসলিম] জাতির মধ্যে শির্ক অন্ধকার রাত্রিতে কালো পাথরের উপর কালো পিপড়ার বেয়ে উঠার মতই সূক্ষ্ম বা গোপন।”
শির্ক থেকে বাঁচার দোয়া:
নিম্নের দোয়া (অর্থ বুঝে বিশ্বাস-সহকারে) পাঠ করলে শির্ক গুনাহের কাফ্‌ফারা হয়ে থাকে।
اللَّهُمَّ إنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ أَنْ أُشْرِكَ بِكَ شَيْئاً وَأَنَا أَعْلَمُ، وَأَسْتَغْفِرُكَ مِنَ الذَّنْبِ الَّذِيْ لا أَعْلَمُ
অর্থাৎ :

“হে আল্লাহ আমি জেনে-শুনে তোমার সাথে কোন কিছুকে শরিক করা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি, আর আমার অজ্ঞাত গুনাহরাজি থেকে আমি ক্ষমা চাচ্ছি।”
কুফরির প্রকারভেদ
কুফরি দু’ প্রকার :
এক:
যা করলে ইসলাম থেকে বের হয়ে যায়।
নিম্নলিখিত পাঁচটি কারণে এ প্রকার কুফরি হয়ে থাকে:
• ১। মিথ্যা প্রতিপন্ন করার কারণে কুফরি : এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী:

“আর তার চেয়ে কে বেশি অত্যাচারী যে আল্লাহর উপর মিথ্যার সম্বন্ধ আরোপ করেছে, অথবা তার কাছে হক (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বা আল্লাহ ছাড়া সঠিক কোন উপাস্য নেই এ কালেমা) আসার পর তা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে, জাহান্নাম কি কাফেরদেরই বাসস্থান নয়?” [সূরা আল আনকাবুত: ৬৮]
• ২। সত্য জেনেও অহংকার ও অস্বীকার করার কারণে কুফরি : এর প্রমাণ আল্লাহ তা‘আলার বাণী :

“আর স্মরণ করুন যখন আপনার প্রভু আদমকে সিজদা করার জন্য ফেরেশ্তাদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তখন ইবলিস ব্যতীত সবাই সিজদা করেছিল, সে অস্বীকার করেছিল, এবং অহংকার বোধে গর্ব করেছিল আর কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।” [সূরা আল বাকারা: ৩৪]
• ৩। সন্দেহ করার দ্বারা কুফরি করা- আর তা হলো অসার ধারণার বশবর্তী হয়ে কুফরি করা : এর প্রমাণ কোরআনের বাণী :

“আর সে তার বাগানে প্রবেশ করল এমতাবস্থায় যে সে তার আত্মার উপর অত্যাচার করছে, এ-কথা বলে যে, আমি মনে করি না যে, এটা (বাগান) কখনো ধ্বংস হয়ে যাবে এবং কোনোদিন কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে বলেও মনে করি না। আর যদি তা হয়েও যায় এবং আমাকে আমার প্রভুর কাছে ফিরে নেয়াও হয় তথাপি আমি তার কাছে ফিরে এর (বাগানের) চেয়ে আরও ভালো (বাগান) পেয়ে যাব। তার সাথী তাকে বলল: তুমি কি সেই স্বত্বার সাথে কুফরি করছ যিনি তোমাকে প্রথমে মাটি ও পরে বীর্য থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং এরপর পূর্ণ মানুষরূপে তোমাকে অবয়ব দান করেছেন? কিন্তু আমি (বলছি) সেই আল্লাহই আমার রব ও পালনকর্তা, তার সাথে কাউকে শরিক করি না।” [সূরা আল-কাহফ: ৩৫-৩৮]
• ৪। এড়িয়ে যাওয়ার (বিমুখ হওয়ার) কারণে কুফরি : এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী :

“আর যারা কুফরি করেছে তারা যে সমস্ত বস্তুর ভয় তাদেরকে দেখান হয়েছে সেগুলো থেকে বিমুখ হয়েছে (এড়িয়ে গেছে)।” [সূরা আল-আহকাফ: ৩]
• ৫। মুনাফেকি করার কারণে কুফরি : এর প্রমাণ আল্লাহর পবিত্র কালামে এসেছে :

“এটা এ জন্য যে, তারা ঈমান এনেছে অতঃপর কুফরি করেছে; ফলে তাদের অন্তরের উপর সিল মেরে দেয়া হয়েছে সুতরাং তারা বুঝছে না, বুঝবেনা।” [সূরা আল মুনাফিকুন: ৩]
দুই : দ্বিতীয় প্রকার কুফরি
আর তা হলো ছোট কুফরি, যা করলে গুনাহ হলেও ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবেনা, আর তা’ হলো আল্লাহর নেয়ামত এর সাথে কুফরি করা।
এর প্রমাণ : কোরআনের বাণী :
“আল্লাহ্ তা‘আলা উদাহরণ দিচ্ছেন কোন নিরাপদ, শান্ত-স্থির জনপদের— যার জীবিকা চতুর্দিক থেকে অনায়াসে আসছিল, তখন তারা আল্লাহর নেয়ামতের সাথে কুফরি করলো, ফলে আল্লাহ তা‘আলা সে জনপদকে তাদের কার্যাদির শাস্তি স্বরূপ ক্ষুধা ও ভয়ে নিপতিত রাখল”। [সূরা আন্-নাহ্ল: ১১২]
মুনাফেকির প্রকারভেদ
মুনাফেকি দু প্রকার :
• ১। বিশ্বাসগত মুনাফেকি।
• ২। আমলগত (কার্যগত) মুনাফেকি।
এক : বিশ্বাসগত মুনাফেকি
এ-প্রকার মুনাফেকি ছয় প্রকার, এর যে কোন একটা কারো মধ্যে পাওয়া গেলে সে জাহান্নামের সর্বশেষ স্তরে নিক্ষিপ্ত হবে।
• ১। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা।
• ২। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন তার সামান্যতম অংশকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা।
• ৩। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে ঘৃণা বা অপছন্দ করা।
• ৪। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন তার সামান্যতম অংশকে ঘৃণা বা অপছন্দ করা।
• ৫। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দীনের অবনতিতে খুশী হওয়া।
• ৬। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দীনের জয়ে অসন্তুষ্ট হওয়া।
দুই : কার্যগত মুনাফেকি
এ ধরণের মুনাফেকি পাঁচ ভাবে হয়ে থাকে: এর প্রমাণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “মুনাফিকের নিদর্শন হলো তিনটি:
o ১। কথা বললে মিথ্যা বলা।
o ২। ওয়াদা করলে ভঙ্গ করা।
o ৩। আমানত রাখলে খিয়ানত করা।
অপর বর্ণনায় এসেছে :
• ৪। ঝগড়া করলে অকথ্য গালি দেয়া।
• ৫। চুক্তিতে উপনীত হলে তার বিপরীত কাজ করা।”
তাগুত এর অর্থ এবং এর প্রধান প্রধান অংশ
এ-কথা জানা প্রয়োজন যে, আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতির উপর সর্ব প্রথম যা ফরজ করেছেন তা হচ্ছে তাগুতের সাথে কুফরি এবং আল্লাহর উপর ঈমান।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
“আর নিশ্চয়ই আমি প্রত্যেক জাতির কাছে রাসূল পাঠিয়েছি এ কথা বলে যে, তোমরা শুধু আল্লাহর উপাসনা কর এবং তাগুতকে পরিত্যাগ কর।” [সূরা আন্-নাহল: ৩৬]
তাগুতের সাথে কুফরির ধরণ হলো : আল্লাহ ছাড়া অন্য সবকিছুর উপাসনা (ইবাদত) বাতিল বলে বিশ্বাস করা, তা ত্যাগ করা, ঘৃণা ও অপছন্দ করা, এবং যারা তা করবে তাদের অস্বীকার করা, তাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করা।
আর আল্লাহর উপর ঈমানের অর্থ হলো : আল্লাহ তা‘আলাই কেবলমাত্র হক উপাস্য ইলাহ, অন্য কেউ নয়— এ-কথা বিশ্বাস করা, আর সবরকম ইবাদতকে নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট করা যাতে এর কোন অংশ অন্য কোন উপাস্যের জন্য নির্দিষ্ট না হয়; আর মুখলিস বা নিষ্ঠাবানদের ভালবাসা, তাদের মাঝে আনুগত্যের সম্পর্ক স্থাপন করা, মুশরিকদের ঘৃণা ও অপছন্দ করা, তাদের শত্রুতা করা।
আর এটাই ইবরাহীম আলাইহিস্‌সালাম এর প্রতিষ্ঠিত দীন বা মিল্লাত, যে ব্যক্তি তার থেকে বিমুখ হবে সে নিজ আত্মাকে বোকা বানাবে, আর এটাই হলো সে আদর্শ (أسوة) বা (Model) যার কথা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বাণীতে বলেছেন :
“অবশ্যই তোমাদের জন্য রয়েছে ইবরাহীম ও তার সাথীদের মাঝে সুন্দর আদর্শ, যখন তারা তাদের জাতিকে বলেছিল: আমরা তোমাদের এবং আল্লাহ ছাড়া তোমাদের অপরাপর উপাস্য দেবতাদের থেকে সম্পূর্ণ সম্পর্কমুক্ত, আমরা তোমাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলাম, আর আমাদের ও তোমাদের মাঝে চিরদিনের জন্য শত্রুতা ও ঘৃণার সম্পর্ক প্রকাশ হয়ে পড়ল, যে পর্যন্ত তোমরা শুধু এক আল্লাহর উপর ঈমান স্থাপন না করছ।” [সূরা আল-মুমতাহিনাঃ ৪]
তাগুত:
শব্দটি ব্যাপক, এর দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত যা কিছুর ইবাদত বা উপাসনা করা হয়, এবং উপাস্য সে উপাসনায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করে এমন সবকিছুকে অন্তর্ভুক্ত করে, চাই কি তা দেবতা, বা নেতা, বা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুসরণের বাইরে অন্য কারো অনুসরণই হোক, ঐসবগুলোকেই তাগুত বলা হবে।
আর এ তাগুত -এর সংখ্যা অত্যধিক; তবে প্রধান-প্রধান তাগুত হলো পাঁচটি :
• এক: শয়তান : যে আল্লাহর ইবাদত থেকে মানুষকে অন্য কিছুর ইবাদতের দিকে আহবান করে।
এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী : “হে আদম-সন্তান, আমি কি তোমাদের থেকে শয়তানের ইবাদত না করার অঙ্গিকার নিই নি? নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।” [সূরা ইয়াসিন: ৬০]
• দুই: আল্লাহর আইন (হুকুম) পরিবর্তনকারী অত্যাচারী শাসক : এর প্রমাণ আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

“আপনি কি তাদের দেখেন নি যারা মনে করে আপনার কাছে এবং আপনার পূর্ববর্তীদের কাছে যা অবতীর্ণ হয়েছে তার উপর ঈমান এনেছে, তারা তাগুতকে বিচারক হিসাবে পেতে আকাঙ্ক্ষা করে অথচ তাদেরকে এর (তাগুতের) সাথে কুফরির নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। আর শয়তান তাদেরকে সহজ সরল পথ থেকে অনেক দুর নিয়ে যেতে চায়।” [সূরা আন্নিসাঃ ৬০]
• তিন : আল্লাহ কর্তৃক অবতীর্ণ (আইনের) হুকুমের বিপরীত হুকুম প্রদানকারী :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “আর যারা আল্লাহর অবতীর্ণ আইন অনুসারে বিচার করে না তারা কাফের।” [সূরা আল মায়েদা: ৪৪]
• চার : আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন গায়েবের খবর রাখার দাবিদার :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
“তিনি গায়েবের জ্ঞানে জ্ঞানী, সুতরাং তার অদৃশ্য জ্ঞানকে কারও জন্য প্রকাশ করেন না, তবে যে রাসূল এর ব্যাপারে তিনি সন্তুষ্ট তিনি তাকে তার সম্মুখ ও পশ্চাৎ থেকে হিফাজত করেন।” [সূরা আল-জিন: ২৬, ২৭]
অন্য আয়াতে বলেন :
“আর তার কাছেই সমস্ত অদৃষ্ট বস্তুর চাবিকাঠি, এগুলো তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না, তিনি জানেন যা ডাঙ্গায় আছে আর যা সমুদ্রে আছে। যে কোন (গাছের) পাতাই পতিত হয় তিনি তা জানেন, জমিনের অন্ধকারের কোন শস্য বা কোন শুষ্ক বা আর্দ্র বস্তু সবই এক প্রকাশ্য গ্রন্থে সন্নিবেশিত আছে।” [সূরা আল-আন‘আম: ৫৯]
• পাঁচ : আল্লাহ ছাড়া যার ইবাদত করা হয় এবং সে এই ইবাদতে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
“আর তাদের থেকে যে বলবে- আল্লাহ ব্যতীত আমি উপাস্য, তাকে আমি জাহান্নাম দ্বারা পরিণাম ফল প্রদান করব, এভাবেই আমি অত্যাচারীদের পরিণাম ফল প্রদান করে থাকি”। [সূরা আল-আন্বিয়াঃ ২৯]
মনে রাখা দরকার কোন মানুষ তাগুতের উপর কুফরি ছাড়া ইমানদার হতে পারেনা, আল্লাহ বলেন :
“সুতরাং যে তাগুতের সাথে কুফরি করে এবং আল্লাহর উপর ঈমান আনে সে এমন মজবুত রজ্জুকে ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে যার কোন বিভক্তি বা চিড় নেই, আর আল্লাহ সর্ব শ্রোতা ও সর্ব জ্ঞানী।” [সূরা আল-বাকারা: ২৫৬]
এ আয়াতের পূর্বাংশে আল্লাহ বলেছেন যে, “বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন পথ, ভ্রষ্ট-পথ থেকে স্পষ্ট হয়েছে”। ‘বিচার-বুদ্ধি সম্পন্ন পথ’ বলতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দীনকে, আর ‘ভ্রান্ত-পথ’ বলতে আবু জাহলের দীন, আর এর পরবর্তী আয়াতের ‘মজবুত রশি বা রজ্জু’ দ্বারা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (বা আল্লাহ ছাড়া হক কোন উপাস্য নেই) এ সাক্ষ্য প্রদানকে বুঝিয়েছেন।
‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এ কলেমা কিছু জিনিসকে নিষেধ করে, এবং কিছু বস্তুকে সাব্যস্ত করে, সকল প্রকার ইবাদতকে আল্লাহর ছাড়া অন্যের জন্য হওয়া নিষেধ করে। শুধুমাত্র লা-শরীক আল্লাহর জন্য সকল প্রকার ইবাদতকে নির্দিষ্ট করে।
“আল্লাহর জন্যই সমস্ত শোকর, যার নেয়ামত ও অনুগ্রহেই যাবতীয় ভাল কাজ সম্পন্ন হয়ে থাকে।”
সমাপ্ত
প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য যা জানা একান্ত কর্তব্য-১
যে চৌদ্দটি আমলে রিজিক বাড়ে
মুসলিম মাত্রেই বিশ্বাস করেন যে তার আয় ও উপার্জন, জীবন ও মৃত্যু, এবং সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য ইত্যাদি র্নিধারণ হয়ে যায় যখন তিনি মায়ের উদরে থাকেন। আর এসব তিনি লাভ করেন তার জন্য বরাদ্দ উপায়-উপকরণগুলোর মাধ্যমে। তাই আমাদের কর্তব্য হলো হাত গুটিয়ে বসে না থেকে এর জন্য র্নিধারিত উপায়-উপকরণ সংগ্রহে চেষ্টা করা। যেমন চাষাবাদ, ব্যবসায়-বাণিজ্য, শিল্প-চারু, চাকরি-বাকরি বা অন্য কিছু। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿هُوَ ٱلَّذِي جَعَلَ لَكُمُ ٱلۡأَرۡضَ ذَلُولٗا فَٱمۡشُواْ فِي مَنَاكِبِهَا وَكُلُواْ مِن رِّزۡقِهِۦۖ وَإِلَيۡهِ ٱلنُّشُورُ ١٥﴾ [الملك: ١٥]
‘তিনিই তো তোমাদের জন্য যমীনকে সুগম করে দিয়েছেন, কাজেই তোমরা এর পথে প্রান্তরে বিচরণ কর এবং তাঁর রিযক থেকে তোমরা আহার কর। আর তাঁর নিকটই পুনরুত্থান।’ {সূরা আল-মুলক, আয়াত : ১৫}

আজ আমরা রিজিক বৃদ্ধির উপায়সমূহের মধ্যে কুরআন ও হাদীস রোমন্থিত ১৪টি আমলের কথা আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

প্রথম আমল : তাকওয়া ও তাওয়াক্কুল অবলম্বন করা
আল্লাহর ভয় তথা তাকওয়া অবলম্বন করা, তাঁর নির্দেশাবলি পালন ও নিষিদ্ধ বিষয়গুলো বর্জন করা। পাশাপাশি আল্লাহর ওপর অটল আস্থা রাখা, তাওয়াক্কুল করা এবং রিজিক তালাশে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করা। কারণ, যে আল্লাহর ওপর ভরসা করে তিনিই তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যান। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
﴿ وَمَن يَتَّقِ ٱللَّهَ يَجۡعَل لَّهُۥ مَخۡرَجٗا ٢ وَيَرۡزُقۡهُ مِنۡ حَيۡثُ لَا يَحۡتَسِبُۚ وَمَن يَتَوَكَّلۡ عَلَى ٱللَّهِ فَهُوَ حَسۡبُهُۥٓۚ إِنَّ ٱللَّهَ بَٰلِغُ أَمۡرِهِۦۚ قَدۡ جَعَلَ ٱللَّهُ لِكُلِّ شَيۡءٖ قَدۡرٗا ٣ ﴾ [الطلاق : ٢، ٣]
‘আর যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরী করে দেন। এবং তিনি তাকে এমন উৎস থেকে রিযক দিবেন যা সে কল্পনাও করতে পারবে না। আর যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তাঁর উদ্দেশ্য পূর্ণ করবেনই। নিশ্চয় আল্লাহ প্রত্যেক জিনিসের জন্য একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন।’ {সূরা আত-তালাক, আয়াত : ২-৩}

অর্থাৎ যে আল্লাহকে ভয় করবে এবং আনুগত্য দেখাবে, আল্লাহ তার সকল সংকট দূর করে দেবেন এবং তার কল্পনাতীত স্থান থেকে রিজিকের সংস্থান করে দেবেন। আর যে কেউ তার উদ্দেশ্য হাসিলে একমাত্র আল্লাহর শরণাপন্ন হয় তিনিই তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যান। বলাবাহুল্য এই তাকওয়ার পরিচয় মেলে হালাল উপার্জনে চেষ্টা এবং সন্দেহযুক্ত কামাই বর্জনের মধ্য দিয়ে।

দ্বিতীয় আমল : তাওবা ও ইস্তেগফার করা
অধিক পরিমাণে ইস্তেগফার এবং বেশি বেশি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেও রিজিক বাড়ে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর অন্যতম নবী ও রাসূল নূহ আলাইহিস সালামের ঘটনা তুলে ধরে ইরশাদ করেন,
﴿ فَقُلۡتُ ٱسۡتَغۡفِرُواْ رَبَّكُمۡ إِنَّهُۥ كَانَ غَفَّارٗا ١٠ يُرۡسِلِ ٱلسَّمَآءَ عَلَيۡكُم مِّدۡرَارٗا ١١ وَيُمۡدِدۡكُم بِأَمۡوَٰلٖ وَبَنِينَ وَيَجۡعَل لَّكُمۡ جَنَّٰتٖ وَيَجۡعَل لَّكُمۡ أَنۡهَٰرٗا ١٢ ﴾ [نوح: ١٠، ١٢]
‘আর বলেছি, ‘তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও; নিশ্চয় তিনি পরম ক্ষমাশীল’। (তাঁর কাছে ক্ষমা চাইলে) ‘তিনি তোমাদের উপর মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন, ‘আর তোমাদেরকে ধন-সম্পদ ও সন্তান- সন্ততি দিয়ে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের জন্য বাগ-বাগিচা দেবেন আর দেবেন নদী-নালা’।{সূরা নূহ, আয়াত : ১০-১২}

হাদীসে বিষয়টি আরেকটু খোলাসা করে বলা হয়েছে, আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« مَنْ لَزِمَ الاِسْتِغْفَارَ جَعَلَ اللَّهُ لَهُ مِنْ كُلِّ ضِيقٍ مَخْرَجًا وَمِنْ كُلِّ هَمٍّ فَرَجًا وَرَزَقَهُ مِنْ حَيْثُ لاَ يَحْتَسِبُ ».
‘যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তেগফার করবে আল্লাহ তার সব সংকট থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেবেন, সব দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের সংস্থান করে দেবেন।’ [আবূ দাঊদ : ১৫২০; ইবন মাজা : ৩৮১৯; তাবরানী : ৬২৯১][1]

অন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« مَنْ أَكْثَرَ الِاسْتِغْفَارَ جَعَلَ اللَّهُ لَهُ مِنْ كُلِّ هَمٍّ فَرَجًا وَمِنْ كُلِّ ضِيقٍ مَخْرَجًا وَرَزَقَهُ مِنْ حَيْثُ لاَ يَحْتَسِبُ».
‘যে ব্যক্তি বেশি বেশি ইস্তেগফার করবে আল্লাহ তার সব সংকট থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেবেন, সব দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন।’ [বাইহাকী : ৬৩৬; হাকেম, মুস্তাদরাক : ৭৬৭৭ সহীহ সূত্রে বর্ণিত।]

তৃতীয় আমল : আত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা
আত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং তাদের হক আদায়ের মাধ্যমেও রিজিক বাড়ে। যেমন : আনাস ইবন মালেক রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি তিনি ইরশাদ করেন,
« مَنْ سَرَّهُ أَنْ يُبْسَطَ لَهُ فِي رِزْقِهِ أَوْ يُنْسَأَ لَهُ فِي أَثَرِهِ فَلْيَصِلْ رَحِمَهُ».
‘যে ব্যক্তি কামনা করে তার রিজিক প্রশস্ত করে দেওয়া হোক এবং তার আয়ু দীর্ঘ করা হোক সে যেন তার আত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখে।’ [বুখারী : ৫৯৮৫; মুসলিম : ৪৬৩৯]

চতৃর্থ আমল : নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর দরূদ পড়া
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি দরূদ পাঠেও রিজিকে প্রশস্ততা আসে। যেমনটি অনুমিত হয় নিম্নোক্ত হাদীস থেকে। তোফায়েল ইবন উবাই ইবন কা‘ব রাদিআল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন,
قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنِّى أُكْثِرُ الصَّلاَةَ عَلَيْكَ فَكَمْ أَجْعَلُ لَكَ مِنْ صَلاَتِى فَقَالَ « مَا شِئْتَ ». قَالَ قُلْتُ الرُّبُعَ. قَالَ « مَا شِئْتَ فَإِنْ زِدْتَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكَ ». قُلْتُ النِّصْفَ. قَالَ « مَا شِئْتَ فَإِنْ زِدْتَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكَ ». قَالَ قُلْتُ فَالثُّلُثَيْنِ. قَالَ « مَا شِئْتَ فَإِنْ زِدْتَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكَ ». قُلْتُ أَجْعَلُ لَكَ صَلاَتِى كُلَّهَا. قَالَ « إِذًا تُكْفَى هَمَّكَ وَيُغْفَرُ لَكَ ذَنْبُكَ ». قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ.
আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমি আপনার প্রতি অধিকহারে দরূদ পড়তে চাই, অতএব আমার দু‘আর মধ্যে আপনার দরূদের জন্য কতটুকু অংশ রাখব? তিনি বললেন, তুমি যতটুকু চাও। কা‘ব বলেন, আমি বললাম, এক চতুর্থাংশ। তিনি বললেন, তুমি যতটুকু চাও। তবে যদি তুমি বেশি পড় তা তোমার জন্য উত্তম হবে। আমি বললাম, অর্ধেক? তিনি বললেন, তুমি যতটুকু চাও। তবে তুমি যদি বেশি পড় তা তোমার জন্য উত্তম হবে। কা‘ব বলেন, আমি বললাম, তাহলে দুই তৃতীয়াংশ? তিনি বললেন, তুমি যতটুকু চাও। তবে তুমি যদি বেশি পড় তা তোমার জন্য উত্তম হবে। আমি বললাম, আমার দু‘আর পুরোটা জুড়েই শুধু আপনার দরূদ রাখব। তিনি বললেন, তাহলে তা তোমার ঝামেলা ও প্রয়োজনের জন্য যথেষ্ট হবে এবং তোমার গুনাহ ক্ষমা করা হবে। [তিরমিযী : ২৬৪৫; হাকেম, মুস্তাদরাক : ৭৬৭৭ (আবূ ঈসা বলেন, হাদীসটি ‘হাসান’ সহীহ।)]

পঞ্চম আমল : আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করা
আল্লাহর রাস্তায় কেউ ব্যয় বা দান করলে তা বিফলে যায় না। সে সম্পদ ফুরায়ও না। বরং তা বাড়ে বৈ কি। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
﴿ قُلۡ إِنَّ رَبِّي يَبۡسُطُ ٱلرِّزۡقَ لِمَن يَشَآءُ مِنۡ عِبَادِهِۦ وَيَقۡدِرُ لَهُۥۚ وَمَآ أَنفَقۡتُم مِّن شَيۡءٖ فَهُوَ يُخۡلِفُهُۥۖ وَهُوَ خَيۡرُ ٱلرَّٰزِقِينَ ٣٩ ﴾ [سبا: ٣٩]
‘বল, ‘নিশ্চয় আমার রব তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার জন্য ইচ্ছা রিযক প্রশস্ত করেন এবং সঙ্কুচিত করেন। আর তোমরা যা কিছু আল্লাহর জন্য ব্যয় কর তিনি তার বিনিময় দেবেন এবং তিনিই উত্তম রিযকদাতা।’ {সূরা আস-সাবা’, আয়াত : ৩৯}

ষষ্ঠ আমল : বারবার হজ-উমরা করা
হজ ও উমরা পাপ মোচনের পাশাপাশি হজকারী ও উমরাকারীর অভাব-অনটন দূর করে এবং তার সম্পদ বাড়িয়ে দেয়। আবদুল্লাহ ইব্ন মাসঊদ রাদিআল্লাহু আনহুমা কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« تَابِعُوا بَيْنَ الْحَجِّ وَالْعُمْرَةِ فَإِنَّهُمَا يَنْفِيَانِ الْفَقْرَ وَالذُّنُوبَ كَمَا يَنْفِى الْكِيرُ خَبَثَ الْحَدِيدِ وَالذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَلَيْسَ لِلْحَجَّةِ الْمَبْرُورَةِ ثَوَابٌ إِلاَّ الْجَنَّةُ ».
‘তোমরা হজ ও উমরা পরপর করতে থাক, কেননা তা অভাব ও গুনাহ দূর করে দেয়, যেমন দূর করে দেয় কামারের হাপর লোহা, সোনা ও রুপার ময়লাকে।’ [তিরমিযী : ৮১৫; নাসাঈ : ২৬৩১]

সপ্তম আমল : দুর্বলের প্রতি সদয় হওয়া বা সদাচার করা
মুস‘আব ইবন সা‘দ রাদিআল্লাহু আনহু যুদ্ধজয়ের পর মনে মনে কল্পনা করলেন, তিনি বোধ হয় তাঁর বীরত্ব ও শৌর্য-বীর্য হেতু অন্যদের চেয়ে নিজেকে বেশি মর্যাদাবান। সেই প্রেক্ষিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
« هَلْ تُنْصَرُونَ وَتُرْزَقُونَ إِلاَّ بِضُعَفَائِكُمْ » .
‘তোমাদের মধ্যে থাকা দুর্বলদের কারণে কেবল তোমাদের সাহায্য করা হয় এবং রিজিক প্রদান করা হয়।’ [বুখারী : ২৮৯৬]

অষ্টম আমল : ইবাদতের জন্য ঝঞ্ঝাটমুক্ত হওয়া
আল্লাহর ইবাদতের জন্য ঝামেলামুক্ত হলে এর মাধ্যমেও অভাব দূর হয় এবং প্রাচুর্য লাভ হয়। যেমনটি বর্ণিত হয়েছে আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু কর্তৃক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« إِنَّ اللَّهَ تَعَالَى يَقُولُ يَا ابْنَ آدَمَ تَفَرَّغْ لِعِبَادَتِى أَمْلأْ صَدْرَكَ غِنًى وَأَسُدَّ فَقْرَكَ وَإِلاَّ تَفْعَلْ مَلأْتُ يَدَيْكَ شُغْلاً وَلَمْ أَسُدَّ فَقْرَكَ ».
‘আল্লাহ তা‘আলা বলেন, হে আদম সন্তান, আমার ইবাদতের জন্য তুমি ঝামেলামুক্ত হও, আমি তোমার অন্তরকে প্রাচুর্য দিয়ে ভরে দেব এবং তোমার দারিদ্র ঘুচিয়ে দেব। আর যদি তা না কর, তবে তোমার হাত ব্যস্ততায় ভরে দেব এবং তোমার অভাব দূর করব না।’ [তিরমিযী : ২৬৫৪; মুসনাদ আহমদ : ৮৬৮১; ইবন মাজা : ৪১০৭]

নবম আমল : আল্লাহর রাস্তায় হিজরত করা
আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্তে হিজরত তথা স্বদেশ ত্যাগ করলে এর মাধ্যমেও রিজিকে প্রশস্ততা ঘটে। যেমনটি অনুধাবিত হয় নিচের আয়াত থেকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ ۞وَمَن يُهَاجِرۡ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ يَجِدۡ فِي ٱلۡأَرۡضِ مُرَٰغَمٗا كَثِيرٗا وَسَعَةٗۚ وَمَن يَخۡرُجۡ مِنۢ بَيۡتِهِۦ مُهَاجِرًا إِلَى ٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ ثُمَّ يُدۡرِكۡهُ ٱلۡمَوۡتُ فَقَدۡ وَقَعَ أَجۡرُهُۥ عَلَى ٱللَّهِۗ وَكَانَ ٱللَّهُ غَفُورٗا رَّحِيمٗا ١٠٠ ﴾ [النساء : ١٠٠]
‘আর যে আল্লাহর রাস্তায় হিজরত করবে, সে যমীনে বহু আশ্রয়ের জায়গা ও সচ্ছলতা পাবে। আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উদ্দেশ্যে মুহাজির হয়ে নিজ ঘর থেকে বের হয় তারপর তাকে মৃত্যু পেয়ে বসে, তাহলে তার প্রতিদান আল্লাহর উপর অবধারিত হয়। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ {সূরা আন-নিসা, আয়াত : ১০০}

আয়াতের ব্যাখ্যা আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস প্রমুখ সাহাবী রাদিআল্লাহু আনহুদ বলেন, স্বচ্ছলতা অর্থ রিজিকে প্রশস্ততা।

দশম আমল : আল্লাহর পথে জিহাদ
একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের জিহাদেও সম্পদের ব্যপ্তি ঘটে। গনীমত বা যুদ্ধলব্ধ সম্পদের মাধ্যমে সংসারে প্রাচুর্য আসে। যেমন ইবন উমর রাদিআল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« وَجُعِلَ رِزْقِي تَحْتَ ظِلِّ رُمْحِي ».
‘আর আমার রিজিক রাখা হয়েছে আমার বর্শার ছায়াতলে।’ [মুসনাদ আহমদ : ৫৬৬৭; বাইহাকী : ১১৫৪; শু‘আবুল ঈমান : ১৯৭৮৩]

একাদশ আমল : আল্লাহর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা
সাধারণভাবে আল্লাহ যে রিজিক ও নিয়ামতরাজি দান করেছেন তার জন্য আল্লাহর শুকরিয়া করা এবং তাঁর স্তুতি গাওয়া। কারণ, শুকরিয়ার ফলে নেয়ামত বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
﴿ وَإِذۡ تَأَذَّنَ رَبُّكُمۡ لَئِن شَكَرۡتُمۡ لَأَزِيدَنَّكُمۡۖ وَلَئِن كَفَرۡتُمۡ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٞ ٧ ﴾ [ابراهيم: ٧]
‘আর যখন তোমাদের রব ঘোষণা দিলেন, ‘যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় কর, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের বাড়িয়ে দেব, আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, নিশ্চয় আমার আযাব বড় কঠিন।’ {সূরা ইবরাহীম, আয়াত : ০৭}

আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা শুকরিয়ার বদৌলতে নেয়ামত বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। আর বলাবাহুল্য আল্লাহর বাড়ানোর কোনো সীমা-পরিসীমা নাই।

দ্বাদশ আমল : বিয়ে করা
আজকাল মানুষের দুনিয়ার প্রাচুর্য ও বিলাসের প্রতি আসক্তি এত বেশি বেড়েছে, তারা প্রচুর অর্থ নেই এ যুক্তিতে প্রয়োজন সত্ত্বেও বিয়ে বিলম্বিত করার পক্ষে রায় দেন। তাদের কাছে আশ্চর্য লাগতে পারে এ কথা যে বিয়ের মাধ্যমেও মানুষের সংসারে প্রাচুর্য আসে। কারণ, সংসারে নতুন যে কেউ যুক্ত হয়, সে তো তার জন্য বরাদ্দ রিজিক নিয়েই আসে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
﴿ وَأَنكِحُواْ ٱلۡأَيَٰمَىٰ مِنكُمۡ وَٱلصَّٰلِحِينَ مِنۡ عِبَادِكُمۡ وَإِمَآئِكُمۡۚ إِن يَكُونُواْ فُقَرَآءَ يُغۡنِهِمُ ٱللَّهُ مِن فَضۡلِهِۦۗ وَٱللَّهُ وَٰسِعٌ عَلِيمٞ ٣٢ ﴾ [النور : ٣٢]
‘আর তোমরা তোমাদের মধ্যকার অবিবাহিত নারী-পুরুষ ও সৎকর্মশীল দাস দাসীদের বিবাহ দাও। তারা অভাবী হলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময় ও মহাজ্ঞানী।’ {সূরা আন-নূর, আয়াত : ৩২}

উমর ইবন খাত্তাব রাদিআল্লাহু আনহুমা বলতেন, ওই ব্যক্তির ব্যাপার বিস্ময়কর যে বিয়ের মধ্যে প্রাচুর্য খোঁজে না। কারণ স্বয়ং আল্লাহ বলেছেন, ‘তারা অভাবী হলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দেবেন।’

ত্রয়োদশ আমল : অভাবের সময় আল্লাহমুখী হওয়া এবং তার কাছে দু‘আ করা
রিজিক অর্জনে এবং অভাব দূরীকরণে প্রয়োজন আল্লাহর কাছে দু‘আ করা। কারণ, তিনি প্রার্থনা কবুল করেন। আর আল্লাহ তা‘আলাই রিজিকদাতা এবং তিনি অসীম ক্ষমতাবান। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَقَالَ رَبُّكُمُ ٱدۡعُونِيٓ أَسۡتَجِبۡ لَكُمۡۚ ﴾ [غافر: ٦٠]
‘আর তোমাদের রব বলেছেন, ‘তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের জন্য সাড়া দেব।’ {সূরা আল-মু‘মিন, আয়াত : ৬০}

এ আয়াতে আল্লাহ দু‘আ করার নির্দেশ দিয়েছেন আর তিনি তা কবুলের জিম্মাদারি নিয়েছেন। যাবৎ না তা কবুলে পথে কোনো অন্তরায় না হয়। যেমন ওয়াজিব তরক করা, হারাম কাজে জড়ানো, হারাম আহার গ্রহণ বা হারাপ পরিচ্ছদ পরা ইত্যাদি এবং কবুলকে খানিক বিলম্বিতকরণ। আল্লাহর কাছে দু‘আয় বলা যেতে পারে,
‘হে রিজিকদাতা আমাকে রিজিক দান করুন, আপনি সর্বোত্তম রিজিকদাতা। হে আল্লাহ আমি আপনার কাছে পবিত্র সুপ্রশস্ত রিজিক চাই। হে ওই সত্তা, দানের ঢল সত্ত্বেও যার ভাণ্ডারে কমতি হয় না। হে আল্লাহ, আমাকে আপনি আপনার হালাল দিয়ে আপনার হারাম থেকে যথেষ্ট করে দিন আর আপনার দয়া দিয়ে আপনি ছাড়া অন্যদের থেকে যথেষ্ট হয়ে যান। হে আল্লাহ আপনি আমাকে যে রিজিক দিয়েছেন তা দিয়েই সন্তুষ্ট বানিয়ে দিন। আর যা আমাকে দিয়েছেন তাতে বরকত দিন।’

অভাবকালে মানুষের কাছে হাত না পেতে আল্লাহর শরণাপন্ন হলে এবং তাঁর কাছেই প্রাচুর্য চাইলে অবশ্যই তার অভাব মোচন হবে এবং রিজিক বাড়ানো হবে। আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাদিআল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« مَنْ نَزَلَتْ بِهِ فَاقَةٌ فَأَنْزَلَهَا بِالنَّاسِ لَمْ تُسَدَّ فَاقَتُهُ وَمَنْ نَزَلَتْ بِهِ فَاقَةٌ فَأَنْزَلَهَا بِاللَّهِ فَيُوشِكُ اللَّهُ لَهُ بِرِزْقٍ عَاجِلٍ أَوْ آجِلٍ ».
‘যে ব্যক্তি অভাবে পতিত হয়, অতপর তা সে মানুষের কাছে সোপর্দ করে (অভাব দূরিকরণে মানুষের ওপর নির্ভরশীল হয়), তার অভাব মোচন করা হয় না। পক্ষান্তরে যে অভাবে পতিত হয়ে এর প্রতিকারে আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল হয় তবে অনিতবিলম্বে আল্লাহ তাকে তরিৎ বা ধীর রিজিক দেবেন। [তিরমিযী : ২৮৯৬; মুসনাদ আহমদ : ৪২১৮]

চতুর্দশ আমল : গুনাহ ত্যাগ করা, আল্লাহর দীনের ওপর সদা অটল থাকা এবং নেকীর কাজ করে যাওয়া।
গুনাহ ত্যাগ করা, আল্লাহর দীনের ওপর অটল থাকা এবং নেকীর কাজ করা- এসবের মাধ্যমেও রিজিকের রাস্তা প্রশস্ত হয় যেমন পূর্বোক্ত আয়াতগুলো থেকে অনুমান করা যায়।
তবে সর্বোপরি আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা দুনিয়াতে চিরদিন থাকার জন্য আসি নি। তাই দুনিয়াকে প্রাধান্য না দিয়ে উচিত হবে আখিরাতকে অগ্রাধিকার ও প্রাধান্য দেয়া। আমাদের এদেন অবস্থা দেখে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ بَلۡ تُؤۡثِرُونَ ٱلۡحَيَوٰةَ ٱلدُّنۡيَا ١٦ وَٱلۡأٓخِرَةُ خَيۡرٞ وَأَبۡقَىٰٓ ١٧ ﴾ [الاعلى: ١٦، ١٧]
‘বরং তোমরা দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দিচ্ছ। অথচ আখিরাত সর্বোত্তম ও স্থায়ী।’{সূরা আল-আ‘লা, আয়াত : ১৬-১৭}

আর পরকালের মুক্তি ও চিরশান্তিই যার প্রধান লক্ষ্য তার উচিত হবে রিজিকের জন্য হাহাকার না করে অল্পে তুষ্ট হতে চেষ্টা করা। যেমন : হাদীসে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবন আ‘স রাদিআল্লাহু আনহুম থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« قَدْ أَفْلَحَ مَنْ أَسْلَمَ وَرُزِقَ كَفَافًا وَقَنَّعَهُ اللَّهُ بِمَا آتَاهُ ».
‘ওই ব্যক্তি প্রকৃত সফল যে ইসলাম গ্রহণ করেছে আর তাকে জীবন ধারণে (অভাবও নয়; বিলাসও নয়) পর্যাপ্ত পরিমাণ রিজিক দেয়া হয়েছে এবং আল্লাহ তাকে যা দিয়েছেন তাতে তুষ্টও করেছেন। [মুসলিম : ২৪৭৩; তিরমিযী : ২৩৪৮; আহমদ : ৬৫৭২]

পরিশেষে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদের এসব উপায়-উপকরণ যোগাড় করে রিজিক তথা হালাল উপার্জনে উদ্যোগী ও সফল হবার তাওফীক দান করেন। তিনি যেন আপনাদের রিজিক ও উপার্জনে প্রশস্ততা দান করেন। আমীন।

________________________________________
[1]. (শায়খ উসাইমীন বলেন, সনদগত দিক থেকে হাদীসটি দুর্বল কিন্তু এর মর্ম ও বক্তব্য সহীহ বা সঠিক। কুরআনের আয়াত ও হাদীসে এই বক্তব্যের সমর্থন বিদ্যমান। এই হাদীস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার পর শায়খ বিন বায বলেন, সর্বোপরি হাদীসটি তারগীব ও তারহীব তথা মানুষকে আখিরাতের আগ্রহ বা ভয় দেখানোর ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য। কারণ, এ ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহে একাধিক বক্তব্য পাওয়া যায়। [ফাতাওয়া নূর আলাদ-দারবি (হাদীসের ব্যাখ্যা ও তার হুকুম।]
ওয়েব সম্পাদনাঃ মোঃ মাহমুদ -ই- গাফফার