কে হচ্ছেন বিশ্বের প্রথম ট্রিলিয়নেয়ার?

বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের সবারই নিট সম্পদের পরিমাণ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। ১৯১৬ সালে জন ডি রকফেলার প্রথম বিলিয়নেয়ারের স্বীকৃতি পান। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের সম্পদ বাড়লেও সেটি বিলিয়ন ডলারের সীমা পার হয়নি। তবে বয়স ও সম্পদ বাড়ার হার বিবেচনা করলে বর্তমানে বেশকিছু শীর্ষ ধনী রয়েছেন, ভবিষ্যতে যাদের সম্পদ ট্রিলিয়ন ডলারের মাইলফলক ছোঁয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

ট্রিলিয়ন ডলারের অংকটি অবশ্য বেশ বড়। ১ ট্রিলিয়ন ডলার ১ হাজার বিলিয়ন বা ১ লাখ কোটি ডলারের সমতুল্য, বর্তমানে যা মেক্সিকো কিংবা দক্ষিণ কোরিয়ার নমিনাল জিডিপির সমান। ১ ট্রিলিয়ন ডলার দিয়ে এক্সনমবিল ও ম্যাকডোনাল্ড’স কেনার পরও কোকা-কোলাকে কেনার মতো পর্যাপ্ত অর্থ থাকবে। বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ ধনী অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোসের সম্পদের পরিমাণ ১১২ বিলিয়ন ডলার। ফলে ট্রিলিয়ন ডলারের মাইলফলকে পৌঁছতে তাকে আরো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।

বিশ্বের প্রথম ট্রিলিয়নেয়ার কে হচ্ছেন—এ নিয়ে পশ্চিমা দুনিয়ার আর্থিক বিশ্লেষক, ফিন্যান্সিয়াল জার্নাল ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিনিয়তই বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করছে। ইনভেস্টোপিডিয়ার মতে, বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ধনীদের মধ্যে কেউই প্রথম ট্রিলিয়নেয়ার হতে পারবেন না। এর কারণ হিসেবে তারা বলছে, অন্যতম শীর্ষ ধনী কার্লোস স্লিম ও ওয়ারেন বাফেটের যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকলেও এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের বয়স। যদি কার্লোস স্লিম প্রতি বছর কর-পরবর্তী ২৫ শতাংশ হারে রিটার্ন পান, তাহলে ১ ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদ অর্জনে তার ১১ বছর সময় লাগবে। অবশ্য এদিক দিয়ে বিল গেটস স্লিমের চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন। তার বয়স বর্তমানে ৬৪ বছর। যদিও বর্তমানে সম্পদ অর্জনের তুলনায় দাতব্য কার্যক্রমে তার আগ্রহ বেশি। কিন্তু যদি বিল গেটস আরো বেশি সম্পদ অর্জনে মনোযোগী হন, তাহলে তাকে নতুন বিনিয়োগের খাত খুঁজে বের করতে হবে, কারণ মাইক্রোসফটের প্রবৃদ্ধি দিয়ে ট্রিলিয়ন ডলার অর্জন করাটা কঠিন হবে।

কথায় আছে, টাকায় টাকা আনে। বিত্তশালীদের কাছে প্রচুর আকর্ষণীয় বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে, যা সাধারণের নেই। ১০০ বিলিয়ন ডলারের সম্পদকে দ্বিগুণ করতে হলে আরেকটি ভিয়েতনাম খুঁজে পেতে হবে, যা সচরাচর দেখা যায় না। যখন বিনিয়োগকারীরা ওয়ারেট বাফেটের কাছ থেকে শোনেন যে, তাকে সম্ভাবনাময় বিনিয়োগের খাত খুঁজে পেতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে, তখন বুঝতে হবে তার কাছে কাজে লাগানোর মতো ন্যূনতম ১০০ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ রয়েছে।

অন্ট্রাপ্রেনিউর ডটকমের চোখে সম্ভাব্য ট্রিলিয়নেয়ার যারা
বিশ্বের ধনী কোম্পানি ও ব্যক্তিদের গত পাঁচ বছরের সম্পদের তথ্য পর্যালোচনা করে অন্ট্রাপ্রেনিউর ডটকম একটি তালিকা তৈরি করেছে, যেখানে দেখানো হয়েছে বর্তমান শীর্ষ ধনীদের সম্পদের প্রবৃদ্ধি গতি বজায় থাকলে কখন তারা ট্রিলিয়নেয়ার হতে পারবেন? এর মধ্য থেকে বিশ্বের ১১ জন ধনী ব্যক্তি কত বছর বয়সে ট্রিলিয়নেয়ার হতে পারবেন, সেটি ইনফোগ্রাফিকসে দেখানো হয়েছে।

সমস্যা হচ্ছে, সম্পদ অর্জনের পথে বর্তমানে অন্যতম বাধা সরকারের বিভিন্ন ধরনের নীতি ও বিধিবিধান। আঠারো শতকে যারা মনোপলি ও শোষণের মাধ্যমে অঢেল সম্পদ অর্জন করেছিলেন, বর্তমানে এ ধরনের কর্মকাণ্ড প্রায় পুরো পৃথিবীতেই অবৈধ। তার ওপর আগের তুলনায় করের পরিমাণ অনেক বেশি এবং এক্ষেত্রে সরকারগুলো আগের মতো কোনে ধরনের ফাঁকফোকর সেভাবে দিচ্ছে না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে সৃজনশীল ও উদ্যমী উদ্যোক্তারা এসব বাধাবিপত্তি অতিক্রম করতে পারবেন না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, অতি ধনী হওয়াটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কঠিন হয়ে গেছে।

আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, যথেষ্ট সম্পদ অর্জনের পর অনেকের মাঝেই আর আগের মতো সম্পদ অর্জনের ক্ষুধা কিংবা ঝুঁকি নেয়ার মানসিকতা থাকে না। অথচ তারাই কিন্তু যখন তাদের কাছে হারানোর মতো কিছু ছিল না, তখন বড় ধরনের ঝুঁকি নিয়ে অঢেল সম্পদ অর্জন করেছেন। জন পলসন, জর্জ সরোস ও জিম সিমন্সের কথাই ধরা যাক। তারাই যথেষ্ট সম্পদশালী এবং তারা তাদের বিনিয়োগের লেভারেজ নিয়ে সন্তুষ্ট। এ মানুষগুলো আগের মতো ঝুঁকি নেবেন, সেটা বিশ্বাস করা কঠিন। প্রশ্ন হচ্ছে, পলসন ও অন্যরা কি টেন টু ওয়ান লেভারেজ প্রয়োগ করবেন এবং ১ ট্রিলিয়ন সম্পদ অর্জনের দিকে ছুটবেন? হয়তো তাই। কিন্তু তারা যা সম্পদ অর্জন করেছেন সেটি তাদের কয়েক জেনারেশনের জন্য যথেষ্ট, তাহলে কেন তারা নিজেদের সম্পদকে ঝুঁকিপূর্ণ এবং প্রায় অসম্ভব জুয়ার পেছনে বিনিয়োগ করবেন।

কিন্তু তাই বলে কি এমন কেউ নেই, যারা ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদ অর্জনের দিকে যাবেন না। অবশ্য সরকারি নেতা ও স্বৈরশাসকদের এ তালিকা থেকে বাদ দেয়াই সংগত হবে, কারণ তাদের অর্জিত সম্পদ প্রচলিত ও গ্রহণযোগ্য মাধ্যমে আসেনি। জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকের সহপ্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গের বয়স মাত্র ৩৫ বছর এবং তার সম্পদের পরিমাণ ৭৭ বিলিয়ন ডলার। যদি জাকারবার্গের সম্পদ কর পরিশোধের পর প্রতি বছর ১০ শতাংশ হারে বাড়ে, তাহলে তার ৬৫তম জন্মদিনের আগেই তিনি ট্রিলিয়নেয়ার হয়ে যাবেন। কিন্তু এ পরিমাণ সম্পদ অর্জনের জন্য ফেসবুককে অবিশ্বাস্য রকমের বড় হতে হবে। বর্তমানে ফেসবুকে জাকারবার্গের যে পরিমাণ মালিকানা রয়েছে, তাতে ট্রিলিয়নেয়ার হওয়ার জন্য ফেসবুককে এক্সনমবিলের বর্তমান আকারের তুলনায় ১০ গুণ বড় হতে হবে।

ইনভেস্টোপিডিয়ার মতে, ট্রিলিয়নেয়ার হওয়ার জন্য আরেকজন সম্ভাবনাময় প্রার্থী হচ্ছেন ক্রেইগ ভেন্টার। সেলেরা জেনোমিকসের প্রতিষ্ঠাতা এবং সিনথেটিক লাইফ নিয়ে গবেষণার জন্য বিখ্যাত ভেন্টার একাধারে মেধাবী ও উচ্চাভিলাষী দুটোই। যদিও তিনি এখনই ক্যান্সারকে তার গবেষণার বিষয়বস্তু বানাননি, বরং তিনি সিনথেটিক বায়োলজিতেই (ক্লিন বায়োফুয়েল) তার গবেষণা সীমাবদ্ধ রেখেছেন। কিন্তু কল্পনা করে দেখুন, ক্যান্সারের নিরাময় খুঁজে পাওয়া গেলে তার মূল্য কী দাঁড়াবে? যুক্তরাষ্ট্রে ক্যান্সারের নিরাময়ের জন্য প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ ব্যয় হয় এবং এর সতিকারের নিরাময় মাল্টি ট্রিলিয়ন ডলারের সুযোগ তৈরি করবে। ক্লিন বায়োফুয়েল ভেন্টারকে ট্রিলিয়নেয়ারে পরিণত করবে না, কিন্তু ধারণাটিকে একেবারে বাতিলের খাতায়ও ফেলার সুযোগ নেই।

এদের বাইরে আর কেউ কি রয়েছেন, যাদের ট্রিলিয়ন ডলারের উচ্চাভিলাষী আসনে পৌঁছনোর সক্ষমতা রয়েছে। এক্ষেত্রে মুদ্রাস্ফীতি এটিকে সহজ করে দিতে পারে, কিন্তু তার পরও এটি অবিশ্বাস্য এবং পিলে চমকানোর মতো ব্যাপার। যেমন ধরুন, কেউই কিন্তু অনুমান করেনি যে বিল গেটস সফটওয়্যারের ব্যবসা করে বিলিয়নেয়ার হবেন কিংবা আল ম্যান ইনসুলিন পাম্পের জন্য বিলিয়নেয়ার হয়ে যাবেন। তার মানে হচ্ছে, বিশ্বের প্রথম ট্রিলিয়ন ডলার আইডিয়াটি কারো কল্পনা থেকেই আসবে এবং বর্তমানে এটিকে হাস্যকর বলেই মনে হবে।

ইনভেস্টোপিডিয়া, ব্লুমবার্গ ও অন্ট্রাপ্রেনিউর ডটকম অবলম্বনে

মেহেদী হাসান রাহাত