কর্মসংস্থানেই সমৃদ্ধি

বাজেটে কী হয়, বাজেটের টাকা বারোভূতে খায়।’ বাজেট সম্পর্কে এমন মন্তব্য যেমন-তেমন ব্যক্তির নয়; একজন অতীত অর্থমন্ত্রীর। ভোক্তা বাজেট বলতে বোঝে এক অর্থবছরের সরকারি আয়-ব্যয়ের সম্ভাব্য হিসাব-নিকাশ। সে হিসাব-নিকাশের বিবরণ সংবলিত ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট আজ সংসদে পাস হবে। প্রস্তাবিত বাজেট সংসদের ভেতরে ও বাইরে নানাভাবে বিচার-বিশ্নেষণ হয়েছে। তাতে ভোক্তা মোটা দাগে বুঝেছে, বাজেট গতানুগতিক। অর্থাৎ অতীতের আর সব বাজেটের ধারাবাহিকতা মাত্র। কর, শুল্ক্ক, ভ্যাট ও মুনাফা আহরণ বৃদ্ধি দ্বারা সরকার আয় বাড়াবে। সে আয় রাজস্বসহ নানাবিধ উন্নয়ন খাতে ব্যয় হবে। সে ব্যয় চলতি অর্থবছরের তুলনায় ২২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হওয়ায় বাজেট ঘাটতি হবে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। ব্যাংক ঋণে এ ঘাটতির সিংহভাগ পূরণ হবে। অথচ চলতি অর্থবছরে ব্যাংকগুলোতে বিনিয়োগ/ঋণদানযোগ্য আমানতের পরিমাণ সর্বসাকল্যে মাত্র ৬৪ হাজার কোটি টাকা। তাই ঋণপ্রবাহ এখন সংকটে থাকায় ব্যক্তি খাত চরম বিনিয়োগ সংকটে আছে। ফলে ব্যক্তি খাতে প্রত্যাশিত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি অনিশ্চিত।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে দক্ষ ও সক্ষম জনসম্পদ বৃদ্ধি পায়। ফলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে আর্থিক প্রবৃদ্ধিও বৃদ্ধি পায়। এ বৃদ্ধি আবার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে। এভাবেই শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ ও আর্থিক প্রবৃদ্ধি চক্রাকারে বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে। তাতে একদিকে জাতি দক্ষ ও সু-স্বাস্থ্যসম্পন্ন জনসম্পদে সমৃদ্ধ হয়, অন্যদিকে এই সম্পদের প্রবৃদ্ধি নানামুখী উন্নয়ন ও অগ্রগতি অব্যাহত রাখে এবং নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। কিন্তু আমাদের উচ্চতর প্রবৃদ্ধির সঙ্গে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে সরকারি বিনিয়োগের এই তাত্ত্বিক ভিত্তি ভোক্তা খুঁজে পাচ্ছে না। বরং বিচার-বিশ্নেষণে দেখা যায়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে সরকারি বরাদ্দ বৃদ্ধি একদিকে ভোক্তার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য-ব্যয় বাড়ায় এবং মানহীন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ করে; অন্যদিকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো সেবা খাত বাণিজ্যে পরিণত করার ক্ষেত্র তৈরি করে এবং সে বাণিজ্য সম্প্রসারণে মুখ্য ভূমিকা রাখে। তাই জাতিকে দক্ষ ও সু-স্বাস্থ্যসম্পন্ন জনসম্পদে সমৃদ্ধ করা এবং নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে প্রস্তাবিত বাজেট কঠিন চ্যলেঞ্জের সম্মুখীন।

শ্রমবাজারে এখন স্বল্পশিক্ষিতদের তুলনায় উচ্চশিক্ষিতদের কর্মসংস্থান খুবই সীমিত। উচ্চ প্রবৃদ্ধি আমাদের শ্রমবাজারের গুণগত পরিবর্তন আনতে পারেনি। আবার বাজার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পণ্য ও সেবা উৎপাদন এবং সরবরাহে নানামুখী পরিবর্তন আসছে। এমন পরিবর্তনশীল, কর্মপরিবেশ-সম্পৃক্ত শ্রমবাজার উপযোগী শ্রমশক্তি উৎপাদনে আমরা সফল হইনি। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে সরকারি বিনিয়োগ কাজে আসেনি। রাজস্ব আহরণ এবং বাজেটে তার বিলি-বণ্টনে সে লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্ব পায়নি। উন্নয়ন নীতি ও কৌশল সে লক্ষ্যে গৃহীত না হওয়ায় বাজেট গতানুগতিক ধারাবাহিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির উপযোগীও হতে পারেনি। সুতরাং শ্রমবাজার উপযোগী শ্রমশক্তি উৎপাদনের লক্ষ্যে মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে সংস্কার কার্যক্রম গৃহীত হতে হবে এবং তাতে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি বিনিয়োগ অব্যাহত থাকতে হবে। সে লক্ষ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য উন্নয়ন নীতি ও কৌশল গৃহীত হতে হবে। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেট ভোক্তার সে প্রত্যাশা পূরণে অক্ষম।

প্রতি বছর প্রায় ২২ লাখ তরুণ (বয়স :১৫-২৯ বছর) শ্রমবাজারে আসছে। বর্তমানে এরাই দেশের মোট শ্রমশক্তির এক-তৃতীয়াংশ; ৪ কোটির ওপরে। আমাদের মোট জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই শ্রমশক্তি। এ শক্তিকে সম্পদে পরিণত করা আজ আমাদের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। এ শ্রমশক্তি কাজে সম্পৃক্ত হলে সে কাজে সম্পদ বৃদ্ধি হবে। সে বৃদ্ধি উচ্চতর প্রবৃদ্ধি দেবে। তাই জনবল উন্নয়ন সর্বোচ্চ মনোযোগ পাবে। অথচ তেমন মনোযোগ পায়নি। তবে মনোযোগ পায় সরকারি খাতে নিয়োজিত প্রায় ২০ লাখ শ্রমশক্তি। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি সমন্বয়ে তাদের বেতন ও ভাতাদি বৃদ্ধি হয়। সঙ্গে নানা সুযোগ-সুবিধা- আর্থিক ছাড়ে ফ্ল্যাট-প্লট, করমুক্ত ভাতা, স্বল্প সুদে গাড়ি-বাড়ি কেনার ঋণ, পেনশন, স্বামী-স্ত্রীর পেনশন একজনের অবর্তমানে অন্যজন উত্তরাধিকারী, প্রতিবন্ধী সন্তানও উত্তরাধিকারী ইত্যাদি। আবার অনেকেই ঘুষ-দুর্নীতিসহ নানা রকম অবৈধ আর্থিক সুবিধা নেন। এমন শ্রমশক্তি দেশের সম্পদ ও সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি তথা প্রবৃদ্ধি অর্জনে ইতিবাচক নয়।

সরকারি খাতের বাইরে মোট শ্রমশক্তির ৮৫ শতাংশেরই কাজের সংস্থান অপ্রাতিষ্ঠানিক। অর্থাৎ ব্যক্তি খাতভিত্তিক। এ খাতে সরকারি খাতের তুলনায় সুযোগ-সুবিধা নেই বললেই চলে। বেতন বৃদ্ধি ও পদোন্নতি অনিয়মিত এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনিশ্চিত। অনেক ক্ষেত্রেই কোনো বেতন কাঠামোও নেই। মূলত এই বিপুল পরিমাণ শ্রমশক্তির ওপরেই প্রবৃদ্ধি নির্ভরশীল। অথচ তারা সুযোগ-সুবিধা ও আয় বৈষম্যের ভয়ানক শিকার। সরকারি ও ব্যক্তি খাতে নিয়োজিত শ্রমশক্তির মধ্যে এমন বিদ্যমান বৈষম্য নিরসনের বিষয়টি একেবারেই সরকারের বিবেচনায় নেই। এমন বৈষম্য বজায় রেখে কোনো জাতির পক্ষে দক্ষ ও সু-স্বাস্থ্যসম্পন্ন জনসম্পদে সমৃদ্ধ হওয়া সম্ভব নয়। তেমন জনসম্পদ ব্যতীত টেকসই প্রবৃদ্ধিও অসম্ভব। সরকারি ও ব্যক্তি খাত মিলিয়ে সার্বিক কর্মকাণ্ডে অর্থপ্রবাহ এবং এর বৃদ্ধিতে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়। কিন্তু বাজেট কেবল সরকারি আয়-ব্যয় নিয়ে হয়। প্রবৃদ্ধি কেবল সরকারি ব্যয় ও বিনিয়োগে নির্ভরশীল নয়। তাই প্রবৃদ্ধির প্রশ্নে বাজেট সীমাবদ্ধতার শিকার।

ব্যক্তি খাত এখন বিনিয়োগ ও সুশাসন সংকটের শিকার। এ খাতে ঋণপ্রবাহ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও অর্জিত হয়নি। ব্যাংকই এ খাতের একমাত্র ঋণের উৎস। অথচ ব্যাংকগুলো আমানতই পাচ্ছে না। বেশি বেশি সুদ প্রস্তাবেও কাজ হয়নি। এ বছরে সব ক’টি ব্যাংকের বিনিয়োগযোগ্য আমানত সর্বসাকল্যে নেমে এসেছে ৬৪ হাজার কোটি টাকায়। অথচ এ আমানত গত বছরেও ছিল প্রায় দ্বিগুণ। আবার ঋণের টাকাও যথাসময়ে পরিশোধ হচ্ছে না। ফলে আদায় অনিশ্চিত ঋণের পরিমাণ এখন প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা। সেইসঙ্গে বিদেশে অর্থ পাচার তো আছেই। রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় এখন অনেক বেশি। তাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে। এক সময় রিজার্ভ দিয়ে ৮ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যেত। এখন তা ৪ মাসে নেমে এসেছে। বেকার যুবক কাজের প্রত্যাশায় নৌকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিচ্ছে। এসব অবস্থা মোকাবেলায় কেবল ঋণখেলাপিদের ছাড় দেওয়া ব্যতীত আর কিছুই করা হয়নি। তাতেও হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ব্যক্তি খাত উদ্যোক্তা সংঘবদ্ধ দুর্নীতির সহায়তায় এমন অবস্থা মোকাবেলা করছে। সংঘবদ্ধ দুর্নীতি ছাড়া ব্যবসায় টিকে থাকা যাচ্ছে না। সঠিক ও সুস্থভাবে কোনো ব্যবসা চালানো যায় না। শক্তিশালী লবিং ব্যতীত উদ্যোক্তার পক্ষে কোনো সুযোগ-সুবিধা পাওয়া সম্ভব নয়। তাই বিদ্যমান সুশাসন সংকটে ব্যক্তি খাত উদ্যোক্তাকে বিপথগামী হতে হয়। এমন সব ব্যক্তি খাতের পক্ষে যুগোপযোগী কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা এবং বেশি বেশি কর, শুল্ক্ক ও ভ্যাট দিয়ে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। তাই ভোক্তা দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন চায়। সে লক্ষ্যে বাজেটে বরাদ্দ চায়।

অনেকেই আক্ষেপ করে বলেছেন, কর-জিডিপি অনুপাত ভারতের ২০। এমনকি ভুটানের ৩০। অথচ বাংলাদেশের ৯। কেবল ফর্মাল করই নয়; ভোক্তারা ইমফর্মাল করও (করের টাকা আত্মসাৎ, ঘুষের বিনিময়ে ছাড় দেওয়া কর ও ওই ঘুষ, পণ্য বা সেবা সরবরাহে ঘুষ, দুর্নীতি এবং নানা চাঁদা ও কমিশন) দেয়। সেই ইমফর্মাল কর বিবেচনায় নেওয়া হলে কর-জিডিপি অনুপাতের দিক দিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়াত, তা বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ফর্মাল কর থেকে রাজস্ব আহরণ প্রবৃদ্ধি ১৭ শতাংশ। অর্থাৎ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এই প্রবৃদ্ধি ভোক্তাকে বাড়তি কত হাজার টাকা ইনফর্মাল কর দিতে বাধ্য করবে, তার হিসাব কেউ রাখে না। কে না জানে, মূল্যস্টম্ফীতি ও মুদ্রাস্টম্ফীতি ঘুষ, চাঁদা, কমিশন, এমনকি তছরুপের রেট বাড়ায়। এমন সব ইনফর্মাল কর থেকে ভোক্তার সুরক্ষা ব্যতীত কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধির কোনো নীতি/ কৌশল ন্যায্য ও যৌক্তিক হতে পারে না। সরকারকে তা বিশেষভাবে অনুধাবন করা দরকার।

দুর্নীতির ব্যাপারে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি, সারা সমাজ দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে- প্রধানমন্ত্রীর এমন অভিব্যক্তি, এমনকি ‘দুর্নীতিবাজদের খতম কর’ জনগণের জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর এমন নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও ভোক্তা তথা জনগণকে ফর্মাল করের পাশাপাশি ইনফর্মাল করও দিতে হয়। অর্থমন্ত্রীর লক্ষ্য ফর্মাল কর থেকে ৬ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ। ফর্মাল-ইনফর্মাল কর মিলিয়ে এখনই ভোক্তাদের কাছ থেকে কমবেশি এ পরিমাণ অর্থ আদায় হয়। ইনফর্মাল কর ফর্মাল করে রূপান্তর করা হলে অর্থমন্ত্রীর নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা এখনই অর্জিত হতে পারে। সে জন্য দরকার সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা প্রতিপালন করা। তা না করে কালো টাকা সাদা করা, এমপিওভুক্ত মানহীন শিক্ষার সম্প্রসারণ; রাষ্ট্রপতি-মন্ত্রী, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার দেশের পরিবর্তে বিদেশে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ, দক্ষ ও উপযুক্ত শ্রমশক্তি দেশে তৈরির পরিবর্তে আমদানি করার সুযোগ সৃষ্টি করা- এমন সব দৃষ্টান্ত কোনো জাতির দৈন্যদশারই বহিঃপ্রকাশ। অথচ আমাদের জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ শ্রমশক্তি। জনগণের অধিকাংশই শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা আজ বাজার থেকে ক্রয় করতে সক্ষম; অতীতে এমন অবস্থা ছিল না। আমাদের এ সক্ষমতা এনে দিতে পারে উন্নত দেশ বা জাতিতে পরিণত হওয়ার মর্যাদা।