জলবায়ু পরিবর্তনের বাংলাদশর সাফাল

জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর ও বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশ ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছে। আর্থিক সীমাবদ্ধতার পরও নিজস্ব অর্থায়নে ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করে গোটা বিশ্বে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। বিশ্বের কোনো দেশের নিজস্ব তহবিলে এ ধরনের ফান্ড গঠনের কোনো নজির নেই। এ পর্যন্ত এই ট্রাস্ট ফান্ডকে সরকারি তহবিল থেকে বরাদ্দ দেয়া ৩ হাজার কোটি টাকায় গ্রহণ করা হয়েছে ৩৬৮টি প্রকল্প। পাশাপাশি বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটিও বিশ্বে প্রথম। প্রণয়ন করা হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট আইনসহ প্রয়োজনীয় বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা। আর এসব কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেয়া হয়েছে জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কার চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় তার সুদূরপ্রসারী কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতিস্বরূপ পলিসি লিডারশিপ ক্যাটাগরিতে তাকে এ পুরস্কার দেয়া হচ্ছে। আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে তার হাতে এ পুরস্কার তুলে দেবেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের দিক থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে জলমগ্নতা ও লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ, অনিয়মিত ও অতি বৃষ্টিপাত, বন্যা, নদীতীরের ভাঙন, খরা, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, ভূমিধস এবং কৃষি উৎপাদনের ওপর নেতিবাচক প্রভাবের মতো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। এ অবস্থায় টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের হুমকি। গত কয়েক বছরে ঘটে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস সিডর, আইলা ও মোহসিনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ জলবায়ুর পরিবর্তনেরই প্রভাব।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার দায়িত্ব নিয়েই জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় ২০০৯-১০ অর্থবছরে নিজস্ব অর্থায়নে গঠন করা হয় জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড। শুধু তাই নয়, ফান্ড সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য প্রণয়ন করা হয় জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট আইন-২০১০। গঠন করা হয় জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক ট্রাস্টি বোর্ডও। নিজস্ব অর্থায়নে এ ফান্ড গঠন করা বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে নতুন করে পরিচিত করে তোলে। গত ৬ অর্থবছরে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডে ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। এ ফান্ডের অর্থায়নে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলসহ সারা দেশে গ্রহণ করা হয়েছে ৩৬৮টি প্রকল্প। এর মধ্যে বেসরকারি সংস্থার ৬৩টি প্রকল্পও রয়েছে। জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবেলায় অভিযোজন কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থায়নে বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ রেজিলিয়েন্স ফান্ড (বিসিসিআরএফ) গঠন করা হয়েছে। এ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ান এইড, ডেনমার্ক, ডিএফআইডি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড ও ইউএসএআইডি এ ফান্ডে সর্বমোট ১৮ দশমিক ৯৫ কোটি মার্কিন ডলার অনুদান দিয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অগ্রণী ভূমিকা পালনের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের সভাপতি, ইন্টারন্যাশনাল ক্লিন ডেভেলপমেন্ট মেকানিজমের বোর্ড সদস্য, গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের সদস্য, এডাপটেশন ফান্ড বোর্ড সদস্য এবং এডাপটেশন কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ পুরস্কার দেয়া প্রসঙ্গে জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির নির্বাহী পরিচালক অচিম স্টেইনারের বরাত দিয়ে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনকে দেশে জাতীয় অগ্রাধিকার ইস্যু এবং একই সঙ্গে এ বিষয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণে জোরালো ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার নেতৃত্ব এবং দূরদৃষ্টি প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছেন। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ কয়েক দিনের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এবং ডিসেম্বরে প্যারিসে জলবায়ু সম্মেলনের অংশ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে কর্মসূচি গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। জলবায়ু অভিযোজন কর্মসূচির অগ্রগামী বাস্তবায়নকারী এবং অভিযোজন নীতির সপক্ষের একজন বলিষ্ঠ প্রবক্তা হিসেবে শেখ হাসিনা অন্যদের জন্য অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত। আরও বলা হয় বিশ্বের অন্যতম স্বল্পোন্নত দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েও শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বিনিয়োগ সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জনের ক্ষেত্রে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ। প্রতিবেশগতভাবে ভঙ্গুর বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তার সরকারের সামগ্রিক পদক্ষেপের স্বীকৃতি দিতে এ পুরস্কারের জন্য তাকে মনোনীত করা হয়েছে। এছাড়া বলা হয়, বেশ কয়েকটি উদ্ভাবনমূলক নীতিগত পদক্ষেপ এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা বাংলাদেশ তার উন্নয়নের মূল প্রতিপাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে। জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন কার্যক্রম থেকে শুরু করে বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন ইত্যাদি কার্যক্রম গ্রহণের ফলে বাংলাদেশের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁঁকি এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় অনেক বেশি প্রস্তুত।
জানতে চাইলে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বৃহস্পতিবার নিজ দফতরে এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, পরিবেশ সংরক্ষণ এখন বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোর মধ্যে অন্যতম। পৃথিবীর বিপর্যয় রোধে সারা বিশ্ব এখন সোচ্চার। পৃথিবীকে সুন্দর ও বাসযোগ্য রাখতে বিশ্বের কিছু ভালো মানুষ উদ্যোগ নিচ্ছেন, যার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্যতম। তার ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও নির্দেশনায় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আর্থিক সীমাবদ্ধতার পরও নিজস্ব অর্থায়নে গঠন করা হয়েছে ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড, যা বিশ্বের কোনো দেশ গঠন করেনি। এজন্য বিশ্বের অনেকে তাকে ধরিত্রী কন্যা বলে আখ্যা দিয়েছেন। জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাকে দেয়া হয়েছে চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ।
পুরস্কার সাইটেশনে বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান ২০০৯-এর উল্লেখ করে বলা হয়, বাংলাদেশ বিশ্বের প্রথম উন্নয়নশীল দেশ যেখানে এ ধরনের সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ প্রথম দেশ হিসেবে নিজস্ব তহবিল দ্বারা ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছে। ২০০৯ থেকে ২০১২ পর্যন্ত এ তহবিলে ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সরকার বর্তমানে বার্ষিক বাজেটের ৬-৭% (যা প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের সমান) জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন কার্যক্রমের জন্য বরাদ্দ করছে। এর ২৫% আসছে আন্তর্জাতিক সাহায্য দাতাদের কাছ থেকে। একটি ক্লাইমেট চেঞ্জ ফিসক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক তৈরির কাজ চলছে, যাতে জলবায়ু তহবিলের চাহিদা এবং সরবরাহ সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়। জলবায়ু পরিবর্তন কোনো অতিরিক্ত চাহিদা হিসেবে নয় বরং সরকারের উন্নয়ন সম্ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে এই প্রথমবার বিষয়টিকে স্থান দেয়া হয়েছে।
সাইটেশনে আরও বলা হয়, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০১১ সালে বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন করা হয়। এই সংশোধনীতে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে রাষ্ট্রকে সাংবিধানিক নির্দেশনা দেয়া হয়ছে। সংবিধানে জলাভূমি এবং বন্যপ্রাণী রক্ষাকে প্রাধিকার দিয়ে শেখ হাসিনার সরকার গৃহীত বন নীতিমালা আবহাওয়ার বেশকিছু চরমভাবাপন্ন অবস্থার প্রতিকার হিসেবে কাজ করছে। পাশাপাশি দেশে বনাঞ্চলের পরিমাণ প্রায় ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। জলবাযু পরিবর্তন সংক্রান্ত অভিযোজনে বস্তুগত এবং আর্থিক বিনিয়োগ ছাড়াও সরকার ক্রমবর্ধমান অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ মোকাবেলায় জনগণকে প্রস্তুতি গ্রহণে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এগুলোর মধ্যে বন্যাজনিত কারণে পানিবাহিত রোগ নিরাময়ে স্বাস্থ্যসেবা, আগাম সতর্কীকরণে কমিউনিটি দল গঠন এবং পরিবেশবান্ধব কৃষি প্রযুক্তিতে উৎসাহ প্রদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রসঙ্গত, পলিসি, বিজ্ঞান, ব্যবসা এবং সুশীল সমাজ এই ৪টি ক্যাটাগরিতে চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ পুরস্কার দিয়ে থাকে জাতিসংঘ। এ পর্যন্ত ৬৭ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

জলবায়ু পরিবর্তন কারন ও ভবিষ্যৎ ভাবনা।

জলবায়ু পরিবর্তন কারন ও ভবিষ্যৎ ভাবনা।
————————————————————————-

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে উদ্ভুত জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে যেসব দেশ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ বলে ধারণা করা হয় বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। বিশ্বের বড় বড় জিসিএম ( General Circulation Model বা Global Climate Model) গুলো আগামী শতকে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ার কারণে সমুদ্র সমতলের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীর কোন কোন স্থানগুলো সমুদ্রতলে বিলীন হয়ে যাবে তার একটা ধারণা দিচ্ছে যার মধ্যে বাংলাদেশও অন্তর্ভুক্ত। তবে যেকথা সত্য তা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত যেকোন ভবিষ্যৎবাণীই অমেঘ সত্য নয়, বরং বিজ্ঞাণ ও প্রযুক্তিকে ভিত্তি করে সেটা একটা সম্ভাবনা মাত্র। আরো ভাল করে বলতে গেলে জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যপট আসলে ভবিষ্যতের জলবায়ুর বাস্তব রূপায়ণ নয় বরং তা বর্তমানের প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যতে গ্রীন হাউস গ্যাস নির্গমন বা জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যান্ন নিয়ামক একটি নির্দীষ্ট হারে বাড়লে তার কি কি প্রভাব জলবায়ুর উপর পড়বে সেই জাতীয় একটি ধারণা মাত্র।
বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে নদীপ্রবাহের কিরূপ সম্পর্ক তা নিয়ে আগের একটি লেখায় কিছু সহজ ব্যাখ্যা দিয়েছিলাম।খুব সহজে বললে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাধারণ প্রভাব নিম্নরূপঃ

বিপুল জলরাশির তাপমাত্রার ফলে প্রসারণ ( ছোটবেলায় পড়েছি সবাই যে তাপমাত্রা বাড়লে আয়তন বাড়ে) আর সেই সাথে মেরু অঞ্চলের বরফের একটা বিশেষ অংশ গলে গিয়ে সমুদ্র সমতলের উচ্চতা বৃদ্ধি।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে অধিক পানি স্বতঃবাষ্পীভুত হবে ফলে বৃষ্টিপাত বাড়বে ফলশ্রুতিতে বর্ষা মৌসুমে নদীতে প্রবাহ বাড়বে।
যেহেতু অধিক হারে পানি স্বতঃবাষ্পীভুত হবে তাই শুষ্ক মৌসুমে মাটিতে পানির পরিমান কমে যাবে এবং খরা দেখা দিবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই সব কিছু মিলিয়ে বাংলাদেশ ডুববে নাকি ডুববে না? সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে আইপিসিসির রিপোর্ট অনুযায়ী আগামী শতকের শেষে ( ২১০০ সালে ) সমুদ্র সমতলের উচ্চতা ০.৬ মিটার বাড়বে আর মৌসুমী বৃষ্টিপাত ২৬% বাড়বে সুতরাং বাংলাদেশের মত একটি ব-দ্বীপের পক্ষে এই উপাত্তের ভিত্তিতে বেঁচে থাকা খুব কষ্টকর।

এই যখন প্রেক্ষাপট ঠিক সেই সময় গত ২৩ এপ্রিল ২০১০ দেশের সংবাদ মাধ্যমের (প্রথম আলো , ডেইলী ষ্টার) বরাতে আমরা একটি আশার বাণী শুনতে পেলাম,

বাংলাদেশের ডুবে যাবার সম্ভাবনা নেই বরং নতুন কিছু এলাকা বাড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
কয়েকদিনের মধ্যে সেই আশা বিস্ফোরিত হলো সাংবাদিকের কলামে, ব্লগারের হাত ধরে ব্লগে, চায়ের টেবিলে কিংবা ড্রয়িং রুমের আড্ডা থেকে ফেইসবুকের পাতায় পাতায়। বলতে দ্বিধা নেই পানিসম্পদ প্রকৌশল নিয়ে দুপাতা পড়া থাকায় বোধহয় মিডিয়ার সংবাদে খুব বেশি আশান্বিত হতে পারিনি। চেষ্টা ছিল যে প্রতিষ্ঠানটি গবেষণাটি করেছে তাদের মূল রিপোর্টটি হাতে পাবার। সেটি অবশ্য হাতে মিলল তবে বিস্তারিত রিপোর্ট নয় বরং তার একটি সংক্ষেপিত রূপ। ইতিমধ্যে অবশ্য ঐ গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের প্রতিক্রিয়ায় তাদের ব্যাখ্যা প্রদান করে ২৬ এপ্রিল ২০১০ এ ( প্রথম আলো ) যার মূল বক্তব্য ছিল,

‘বাংলাদেশ ডুববে না শিরোনামটি আমরা যা বলিনি এবং গবেষণা থেকে পাইনি এমন একটি বার্তা দিতে পারে।’
একথা অমেঘ সত্যি যে রিপোর্টে যা ছিল তাকে সংবাদপত্র ভুল ভাবে উপস্থাপন করেছে কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে উক্ত প্রতিষ্ঠানটির গবেষণায় এমন কি ছিল যা কিনা দেশের প্রধান সংবাদ মাধ্যমের কাছে ঢাক ঢোল পিটিয়ে প্রকাশ করতে হবে? সেই প্রশ্নের উত্তর পাবার আগে চলুন ঐ রিপোর্টের ছোট খাট একটি ব্যবচ্ছেদ করা যাক। চেষ্টা করেছি সহজভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত জিনিসগুলোকে সাধারণ পাঠকের উপযোগী করে তুলতে তার পরেও কোন কিছু বুঝতে না পারলে লেখক হিসেবে মন্তব্যে তা ব্যখ্যা করার আশ্বাস দিয়ে রাখছি শুরুতেই।

কি আছে সিইজিআইএস এর রিপোর্টেঃ

‘‌Brief note on the findings of Field Based Research on the Impact of Climate Change on Bangladesh Rivers’ শিরোনামে সিইজিআইএস এর ঐ রিপোর্টে মূলত করেকটি জিনিস তুলে ধরা হয়েছে,

১০০ বছর পরে অর্থাৎ ২১০০ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উদ্ভুত মৌসুমী বৃষ্টিপাত ২৬ ভাগ বেড়ে যাওয়া আর সমুদ্র সমতল ০.৬ মিটার উপরে উঠার সাথে বাংলাদেশের নদীগুলোর অভিযোজন।
বর্ধিত মৌসুমী বৃষ্টিপাতের ফলে নদীর বর্ষাকালীন পানি প্রবাহ সমানুপাতে বেড়ে যাওয়া এবং তার ফলে নদীর গভীরতা ও প্রস্থ পরিবর্তিত হওয়া।
বর্ধিত প্রবাহের কারনে নদীর পাড় ভাঙ্গার পরিমান ও তলদেশ থেকে মাটি সরে যাবার ( Scour) পরিমান নির্নয় করা।
সর্বোপরি বর্ধিত পানি প্রবাহের সাথে বর্ধিত পলি প্রবাহ উপরের প্রক্রিয়াগুলোর উপর কতটুকু ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে তা বের করা।
পুরো রিপোর্টিতে মূলত অতীতে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক প্রকাশনায় প্রকাশিত বেশ কিছু গবেষণা কাজের ব্যবহারিক প্রয়োগ দেখানো হয়েছে। যে বিষয়টি বার বার এসেছে তা হচ্ছে অভিযোজন। রিপোর্টের উপসংহারে যাবার পূর্বে তাই অভিযোজন বিষয়টা একটু ব্যাখা করা প্রয়োজন।

ধরে নেয়া যাক মেঘনা নদীর প্রবাহ যা আছে তাই থাকল কিন্তু হঠাৎ করে বঙ্গোপসাগরের পানির উচ্চতা ১ মিটার বেড়ে গেল। এই বর্ধিত সমুদ্রতলের ফলে নদীর পানি সাগরে যেতে বাধাপ্রাপ্ত হবে, ফলে তার বেগ কমে যাবে। পানি প্রবাহের বেগ কমে গেলে এর সাথে আসা পলি নিচে পড়ে যাবে ফলে নদীর তলদেশ উচু হবে। নদীর তলদেশে উঁচু হলে নদীর পানির উপরিতলও উঁচু হবে।

এবারে একটু জটিলে যাই। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মেঘনা নদীর বর্ষাকালীন প্রবাহ আগের মত থাকবেনা, বাড়বে, আর সেই সাথে বেড়ে যাবে পলির পরিমান। বর্ধিত পানি প্রবাহ নদীর গভীরতাকে বাড়াবে আর অন্যদিকে সমুদ্রতলের বৃদ্ধি ও বর্ধিত পলি মিলে নদীর গভীরতাকে কমাতে চেষ্টা করবে। এই প্রক্রিয়াগুলো মিলে যদি নদীর পানির উচ্চতা বেড়ে যায় তাহলে নতুন এলাকা ডুবে যাবে আর যদি না বেড়ে যায় তাহলে নতুন এলাকা ডুববেনা। ধরে নেই নদীর পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে, এখন নদীর পাড়ের উচ্চতাও যদি বাড়িয়ে দেই তাহলে বেড়ে যাওয়া নদীর পানি কিন্তু আটকে থাকবে, বাইরে যেতে পারবেনা।

ঠিক এই সম্ভাবনাগুলিই বিশ্লেষণ করা হয়েছে ঐ রিপোর্টে, কারন জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে বর্ধিত বৃষ্টিপাত অববাহিকা থেকে অধিক পলিকে নদীতে নিয়ে আসবে, সেই পলি বর্ষাতে উপচে পড়বে নদীর পাড়ে। সুতরাং সিইজিআইএস এর গবেষণায় ধরে নেয়া হয়েছে সবকিছু মিলিয়ে নদীর তলদেশ যতটুকু উপরে উঠবে নদীর পাড় ঠিক ততটুকুই উপরে উঠবে ফলে বর্ধিত পানি নদী থেকে বাইরে আসবেনা এবং বাংলাদেশের ডুবে যাবার সম্ভাবনা কম এর ফলে। এই যে বর্ধিত সমুদ্র সমতল আর পানি ও পলি প্রবাহের নিজেদের মধ্যে মধ্যস্থতা একেই বলা যায় ‘অভিযোজন’ যা নিচের উপসংহারে বার বার চলে এসেছে।

এবারে সিইজিআইএস এর গবেষণার উপসংহার দেখা যাক,

বাংলাদেশের নদীসমুহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বর্ধিত সমুদ্র সমতলের উচ্চতা আর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত পানি ও পলিপ্রবাহের সাথে দ্রুত অভিযোজিত হবে।
দীর্ঘমেয়াদী বর্ধিত পানি প্রবাহের ফলে নদী তার প্রস্থ ও গভীরতা পরিবর্তন করবে বা অভিযোজিত হবে সুতরাং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিপুল এলাকা ডুবে যাবার সম্ভাবনা যে আশঙ্কা এখন করা হচ্ছে তা ততটা আশঙ্কাজনক হবেনা।
আগামী ১০০ বছরে সমুদ্রসমতলের উচ্চতা বৃদ্ধি যদি ৬০ থেকে ১০০ সেন্টিমিটারের মধ্যে থাকে তাহলে মেঘনা মোহনায় এই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত সমুদ্রতলের সাথে নদীর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত পানি ও পলির অভিযোজন দ্রুত হবে।
ইতিপূর্বে বিভিন্ন গবেষণায় জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে বর্ধিত জোয়ারের ফলে লবনাক্ততা বৃদ্ধির যে আশঙ্কা করা হয়েছে তা কম হবে।
সিইজিআইএস এর রিপোর্টের দূর্বল দিকগুলোঃ

আমার বিচারে এই গবেষণার দূর্বল দিকগুলো নিম্নরূপঃ

যেকোন বৈজ্ঞানিক গবেষণাই বেশ কিছু ধারনার উপরে ভিত্তি করে শুরু করতে হয় যাকে আমরা Assumption বলে থাকি। আমার বিচারে এই গবেষণার সবচেয়ে দূর্বল দিক হচ্ছে নদীর তলদেশ যতটকু বাড়বে নদীর পাড় ঠিক ততটুকু বাড়বে এই এসাম্পশনটা।
এই গবেষণায় শুধু বর্ষা মৌসুমে বর্ধিত পানির ফলে লবনাক্ততা বাড়বেনা বলে নিয়ে উপসংহার টানা হয়েছে, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শুষ্ক মৌসুমে নদীর প্রবাহ আগের থেকে কমবে, ফলে তখন অধিক লবনাক্ত পানি উপকূলীয় নদীগুলোর ভেতরে মোহনায় ঢুকবে। এই বিষয়গুলি বিবেচনায় নিয়ে আসা উচিৎ।
যেকোন জলবায়ু পরিবর্তনের গবেষনাতেই যেসব গানিতিক মডেল ব্যবহার করা হয় সেগুলোকে একটি বেইজ পিরিয়ড ( অধিকাংশ ক্ষেত্রে ১৯৬১-১৯৯০) সালের প্রাপ্ত উপাত্ত দিয়ে সিদ্ধ করে নিতে হয়। অর্থাৎ আগেই জানা উপাত্ত দিয়ে পরীক্ষা করে নেয়া যে ঐ গানিতিক সুত্র সঠিক ফলাফল দিচ্ছে কিনা। আমি এই রিপোর্টে সেরকম কোন সিদ্ধকরণের নমুনা পাইনি।
বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও মিডিয়াঃ

একজন গবেষক হিসেবে আমি সিইজিআইএস এই গবেষনার সাধুবাদ জানাই এই জন্য যে বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিবর্তিত নদী প্রবাহের সাথে পলি কতটা গুরুত্ত্বপূর্ণ সেই বিষয়টি তারা সামনে নিয়ে এসেছে। বিশেষত বাংলাদেশের মত পললভূমির ক্ষেত্রে এই বিষয়টি অতীব গুরুত্ত্বপূর্ন। কিন্তু তাদের গবেষনার এই রিপোর্ট আসলে একটি প্রাথমিক অনুসন্ধান, ভাল করে বললে এই বিষয়টি নিয়ে যে গবেষণা প্রয়োজন তা অনুধাবনের একটি নির্নায়ক। সুতরাং কোন মতেই তা আশা বা নিরাশা কোনটারই দাবী রাখেনা। সেই বিচারে এই গবেষণার ফলাফল নিয়ে জাতীয় গনমাধ্যমে বিশাল প্রচারের কোন যৌক্তিকতা অন্ততপক্ষে আমার বোধগম্য নয়। সংবাদিকরা প্রযুক্তিবিদ বা গবেষক নয়, তাদের দায়িত্ত্ব গবেষকদের গবেষনা লব্ধ ফলাফলের সারমর্ম মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া। সুতরাং দেশের প্রধান দুটি সংবাদপত্রে ‘বাংলাদেশ ডুববেনা’ বা ‘বাংলাদেশ নতুন ভূমি পাচ্ছে’ জাতীয় সংবাদ, আর তা দেখে পনের কোটি মানুষের আশায় বুক বাধা, এবং পরে গবেষণা সংস্থার ব্যাখ্যায় পুনরায় নিরাশ হওয়া, এই কোন কিছুই হতোনা যদিনা পরিপূর্ন গবেষণা শেষ করে তার ফলাফল মিডিয়ায় প্রকাশ করা হতো।

আরো যে জিনিসটি আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে শেষ হয়ে যাওয়া ২০০৯ কোপেনহেগেন সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোকে আগামী সময়গুলোতে তারা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে কি কি পদক্ষেপ নিবে সেই বিষয়ে নির্দীষ্ট প্রকল্প জাতিসংঘের কাছে পেশ করতে বলা হয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সুনির্দীষ্ট গবেষণা না শেষ করে তার যাত্রাপথে বা মাঝপথেই মিডিয়ায় ঢাক ঢোল পিটিয়ে বাংলাদেশে ডুববেনা, আমাদের কিছু হবেনা জাতীয় খবর প্রকাশ করাটা কতটা কূটনৈতিকভাবে সিদ্ধ সেই প্রশ্নও রয়ে যায়।

সূত্র: ইন্টারনেট
1 Like

জলবায়ু পরিবর্তন, জলবায়ু অভিবাসী ও মানবাধিকার

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন মানবসভ্যতার জন্য আজ সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাবের ফলে ঝুঁকির মুখে পড়বে মানুষের বিবিধ মৌলিক অধিকার ও নিরাপত্তা। এসব অধিকার ও নিরাপত্তার মধ্যে মানুষের জীবন ও সম্পদ, খাদ্য, নিরাপদ পানি, স্বাস্থ্য, বসতি, ভূমি, জীবন-জীবিকার উত্স, কর্মসংস্থান এবং তাদের উন্নয়নের অধিকারও রয়েছে।
জাতিসংঘসহ নানা আন্তর্জাতিক সংস্থা জলবায়ু পরিবর্তন ও জলবায়ু উদ্বাস্তু সমস্যাকে উন্নয়ন, দারিদ্র্য নিরসন ও খাদ্যনিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত করে দেখছে। কেননা, জলবায়ুসংক্রান্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে লাখ লাখ লোক তাদের বসতভিটা ছেড়ে শহরের বস্তিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হবে। তারা বঞ্চিত হবে তাদের মৌলিক মানবাধিকার, যথা—খাদ্য ও পানি, উন্নয়নের অধিকার এবং তাদের নিজস্ব সমাজ ও সংস্কৃতিতে বসবাসের অধিকার থেকে।
জলবায়ু পরিবর্তন প্রায় সব প্রতিবেশ, সমাজ ও অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কিন্তু এই ক্ষতিকর প্রভাব তাদের ভৌগোলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক অবস্থা, উন্নয়নের ইতিহাস ও সরকারের সক্ষমতা তথা শাসনপদ্ধতি ও ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত ও জলবায়ুসংশ্লিষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সবচেয়ে বেশি বিপদাপন্ন করে তুলবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পৌনঃপুনিক বৃদ্ধিসহ দীর্ঘস্থায়ী বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততার প্রবেশ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও খরা অন্যতম। বিশ্বসম্প্রদায় যদি এখনই জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করে, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তন বৈশ্বিক দারিদ্র্য ও মানুষের খাদ্য, পানি, স্বাস্থ্য, জ্বালানি, আশ্রয় ও সামাজিক নিরাপত্তার সমস্যাকে তীব্রতর করবে। আঞ্চলিক বৈষম্য তীব্রতর ও মৌলিক মানবাধিকারগুলো লঙ্ঘিত হবে।
এসবের ফলে নিকট-ভবিষ্যতে ২০ কোটিরও বেশি মানুষ বাস্তুভিটাচ্যুত হতে পারে। ফলে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু শরণার্থীর (climate refugee) সংখ্যা বাড়বে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলো, নিম্ন ব-দ্বীপ অঞ্চল এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোয় জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা বেশি বাড়বে। তা গ্রাম থেকে শহরে, এমনকি দেশ থেকে দেশে (বিপদাপন্ন দেশ থেকে অন্য দেশে) মানুষের স্থানান্তর বৃদ্ধি করবে। এই অভ্যন্তরীণ ও বহির্দেশীয় স্থানান্তরিত জনগোষ্ঠী পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে তৈরি করবে নতুন নতুন সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা।
ইতিমধ্যে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার লাখ লাখ দরিদ্র মানুষ শহরের বস্তিতে কর্মসংস্থান, প্রয়োজনীয় আয়, খাদ্য, পানি, বাসস্থান, এমনকি দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় মৌলিক সব সুবিধা ছাড়াই বাস করছে। জলবায়ুসংক্রান্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে লাখ লাখ মানুষ তাদের বসতভিটা ছেড়ে শহরের বস্তিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হবে। ফলে বাস্তুচ্যুত এসব মানুষের মৌলিক মানবাধিকারগুলো তথা খাদ্য ও পানি, উন্নয়নের অধিকার এবং তাদের নিজস্ব সমাজ ও সংস্কৃতিতে বসবাসের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
দুর্যোগ ও ক্রমবর্ধমান সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা
১৫ নভেম্বর ২০০৭ সালের প্রচণ্ড শক্তিশালী ও ধ্বংসাত্মক সাইক্লোন ‘সিডর’ বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে। এতে ১০ হাজারেরও অধিক মানুষের মৃত্যু ঘটে এবং তিন কোটিরও অধিক উপকূলীয় মানুষের জীবন ও জীবিকার ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়। পরবর্তী ধ্বংসাত্মক ঘূর্ণিঝড় ‘নার্গিস’ বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হলেও বাংলাদেশে আঘাত হানেনি, কিন্তু মিয়ানমারের উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। এর তাণ্ডবে মিয়ানমারের উপকূলীয় এলাকার এক লাখেরও অধিক মানুষ মারা যায় এবং লাখ লাখ আহত হয়। অতিসম্প্রতি (মে ২৫, ২০০৯) ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’ বাংলাদেশ ও ভারতের উপকূলে আঘাত হানে। তিন শতাধিক লোক এতে মৃত্যুবরণ করে এবং হাজার হাজার লোক তাদের বাস্তুভিটাচ্যুত হয়। উপকূলীয় জেলাগুলোর বহু মানুষ কয়েক সপ্তাহ ধরে আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে এবং খাদ্য ও নিরাপদ পানীয় জলের সীমাহীন সংকট ও দুর্ভোগের শিকার হয়। হাজার হাজার মানুষ চরম দারিদ্র্যে নিপতিত হয়। ডায়রিয়াজনিত রোগ বহু এলাকায় ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে।
জলবায়ু পরিবর্তন-সংশ্লিষ্ট সব দুর্যোগের প্রাথমিক ও চূড়ান্ত শিকার উন্নয়নশীল দেশগুলোর দরিদ্র জনগোষ্ঠী। কেননা, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ-ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় সক্ষমতা তাদের নেই বা যা আছে তা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই সামান্য। বর্তমান বিশ্বে ১০০ কোটিরও বেশি লোক চরম খাদ্য-অনিরাপত্তা ও সীমাহীন অপুষ্টিতে ভুগছে। তাদের প্রায় ৯৫ শতাংশ উন্নয়নশীল দেশগুলোর। খাদ্যপ্রাপ্তির অসম সুযোগ ও অধিকারই এর পেছনের মূল কারণ। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত দুর্যোগও খাদ্য-অনিরাপত্তার সমস্যাকে ক্রমশ বাড়িয়ে তুলছে।
জলবায়ু শরণার্থী
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় জলবায়ু পরিবর্তনসংশ্লিষ্ট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা, মাত্রা ও অভিঘাত বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্ভাব্য সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি নিম্নাঞ্চল ও উপকূলীয় দেশগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। লাখ লাখ লোক তাদের বসতভিটা ছেড়ে অন্যত্র সরে যেতে বাধ্য হবে, কর্মসংস্থান ও জীবন-জীবিকা থেকে বঞ্চিত হবে। লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বিশ্বব্যাপী বহু মানুষ সীমাহীন দারিদ্র্যের সংকটে নিপতিত হবে।
বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাগুলোয় ইতিমধ্যে উচ্চমাত্রার সামুদ্রিক জোয়ারে তীরবর্তী ব্যাপক এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের ৪৫ সেন্টিমিটার উচ্চতা বৃদ্ধি উপকূলীয় প্রতিবেশগুলোর কেবল ব্যাপক ক্ষতি সাধনই করবে না, কৃষি ও খাদ্য-উত্পাদনকেও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং উপকূলীয় ২০টি জেলার প্রায় সাড়ে তিন কোটি লোককে তাদের বাস্তুভিটা থেকে অন্যত্র স্থানান্তরে বাধ্য করতে পারে।
বাংলাদেশ ইতিমধ্যে জনসংখ্যার ভারে জর্জরিত একটি দেশ। জলবায়ু শরণার্থীরা নতুন করে দেশে গৃহায়ণ ও আবাসন সমস্যার সৃষ্টি করবে এবং দেশের সীমাবদ্ধ সম্পদের (ভূমি, পানি, মত্স্য, বন) ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি করবে এবং সৃষ্টি করবে সংকট ও বিবাদ।
জরুরি করণীয়সমূহ
ধনী দেশের অসম উন্নয়ন ও ভোগের ফলে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, যা পৃথিবীব্যাপী বৈষম্য সৃষ্টি করছে। বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীর ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতও অসমভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর দরিদ্র জনগোষ্ঠীই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
জলবায়ুর পরিবর্তন প্রশমন, দারিদ্র্য নিরসন, টেকসই উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা এবং অর্জিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সমবণ্টন এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি, যার জন্য প্রয়োজন পারস্পরিক সমঝোতাভিত্তিক ও সমন্বিত উদ্যোগ। এটা নিশ্চিত করতে দরিদ্র ও বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীর অধিকারগুলো রক্ষা করতে হবে; জরুরি ও তাত্ক্ষণিকভাবে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন অবশ্যই কমাতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের সামনে মূল করণীয় হচ্ছে:
১. জলবায়ুর পরিবর্তন রোধে ২০১২ সাল-পরবর্তী প্রতিশ্রুতি পূরণের অংশ হিসেবে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর বৃহত্তর অংশগ্রহণে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন নিরসনের কৌশল এবং এ লক্ষ্যে কার্যকর ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করতে হবে।
২. অপেক্ষাকৃত উষ্ণ জলবায়ু ও পরিবর্তিত অবস্থায় কীভাবে টিকে থাকা যায়, বা কার্যকর অভিযোজন করা যায়, এর কৌশল উদ্ভাবন করতে হবে। কেননা এ অবস্থা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
৩. স্বল্পমাত্রার কার্বন নির্গমনে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা এবং ধনী দেশগুলোর জনগণের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনা, যারা তাদের ভোগবিলাসী জীবনযাপনের মাধ্যমে পৃথিবীর পরিবেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে।
এ ছাড়া হুমকির সম্মুখীন বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার ও নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলো জরুরি ভিত্তিতে মোকাবিলার জন্য নিম্নোক্ত কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন:
১. বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীকে খাদ্য, আশ্রয়, নিরাপদ পানি ও স্বাস্থ্যসেবা সহযোগিতা প্রদান করা;
২. বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর (অভ্যন্তরীণ ও বহির্দেশীয়) জন্য পরিকল্পিত অভিবাসনের ব্যবস্থা করা;
৩. জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট শরণার্থীদের প্রধান প্রধান কার্বন নির্গমনকারী দেশগুলোয় বসবাস করার অধিকার দেওয়া এবং তাদের এ অভিবাসীদের দায়িত্ব নেওয়া;
৪. উপরিউক্ত সব অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এবং ক্রমবর্ধমান জলবায়ু-শরণার্থী সৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর নতুন নীতিকাঠামো তৈরি করা;
৫. বিশেষ করে, ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলো, নিম্ন প্লাবনভূমির দেশগুলো এবং উপকূলীয় সব এলাকা এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে বিশেষ মনোযোগ ও সহযোগিতা প্রাপ্তির দাবি রাখে;
৬. উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অবশ্যই যথাযথ কৌশল ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করা, যাতে ক্রমবর্ধমান জলবায়ু-শরণার্থীদের অধিকারগুলো রক্ষা ও বাস্তবায়ন করা যায়;
৭. নিকট-ভবিষ্যতে অতি দ্রুত জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে স্থানান্তরিত জলবায়ু-শরণার্থীদের মৌলিক অধিকারগুলো রক্ষায় একটি আলাদা প্রটোকল তৈরি করা;
৮. বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমিয়ে আনা এবং তাদের মৌলিক অধিকারগুলো রক্ষার স্বার্থে জলবায়ুর পরিবর্তন বন্ধ করা, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অভিযোজন, অর্থায়ন ও প্রযুক্তির হস্তান্তরের জন্য কার্যকর কর্মসূচি গ্রহণ করা।
 ড. আতিক রহমান, নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ (বিসিএএস), ঢাকা।

টেকসই উন্নয়ন এবং অতি-দারিদ্র্য নিরসনের চ্যালেঞ্জ

এম ডিজি পূরণে বাংলাদেশের সাফল্যের কথা সর্বজনবিদিত। এর উত্তরসূরি এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বাংলাদেশ অঙ্গীকারাবদ্ধ। এসডিজি এখন বিশ্ব এজেন্ডা। সতেরোটি লক্ষ্য পূরণে জাতিসংঘের নেতৃত্বে পুরো বিশ্ব আজ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। সকলেই বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে। দেশটি এমডিজির মতো এসডিজি পূরণেও কি একই ধরনের সাফল্য দেখাতে পারবে?

এ কথা ঠিক, এসডিজি পূরণে চ্যালেঞ্জটা অনেক কঠিন। দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নিবারণ, সকলের জন্য সুশিক্ষা, নারী-পুরুষের সুযোগের সমতা, নারীর ক্ষমতায়ন, পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থাপনা, সবার জন্য টেকসই জ্বালানি, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই প্রবৃদ্ধি, সবার জন্য উত্পাদনশীল ও গ্রহণযোগ্য কর্মসংস্থান, টেকসই অবকাঠামো ও শিল্পায়ন, বৈষম্য দূরীকরণ, বাসযোগ্য টেকসই নগরায়ন, টেকসই উত্পাদন ও ভোগ ব্যবস্থা, জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, সামুদ্রিক সম্পদ সংরক্ষণ ও টেসকই উন্নয়ন, বনভূমি সংরক্ষণ ও টেকসই উন্নয়ন, শান্তিপূর্ণ অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বিনির্মাণ এবং টেকসই উন্নয়নের জন্যে বিশ্বব্যাপী অংশীদারিত্বের আবহ জোরদার করার মতো বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জসমূহ ২০৩০ সাল নাগাদ মোকাবিলার অঙ্গীকারপত্রে স্বাক্ষর করেছেন বিশ্ব নেতৃবৃন্দ। এসডিজি চুক্তির পর পরই প্যারিসে জলবায়ু চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন তারা। এসডিজির প্রাণভোমরা এই প্যারিস চুক্তি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেক দেন-দরবার শেষে এই চুক্তিতে সই করেছিল। নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই বিশ্ব চুক্তি থেকে সরে আসার কথা বললেও মনে হয় তার দেশের এবং বিশ্বের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের চাপে তিনি শেষ পর্যন্ত প্যারিস চুক্তি নিয়ে আর বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করবেন না। অবশ্য, অস্থিরমতি এই প্রেসিডেন্ট আখেরে কী করবেন তা বলা মুশকিল।

তিনি যাই করুন, সারা বিশ্বের নেতৃবৃন্দ এই চুক্তির সফল বাস্তবায়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ। বাংলাদেশ, জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার এক অভাগা দেশ। আমাদের তাই এই চুক্তি বাস্তবায়নে সদাই তত্পর থাকতে হবে। একই সঙ্গে বিশ্ববাসীকেও আমাদের দুঃখ দুর্দশার কথা বলে যেতে হবে। তাদের প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে নৈতিক চাপ অব্যাহত রাখতে হবে।

টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যগুলো পূরণে আমাদের তাই সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অর্থনীতিকে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও সমন্বয় করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সুখের কথা, বাংলাদেশ সরকার এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য খুবই আন্তরিক। আমাদের সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রাসমূহ এসডিজির আলোকেই নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই এই পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অর্থই হবে এসডিজি বাস্তবায়নের ভিত্তিভূমিকে মজবুত করা। তাছাড়া, এরই মধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অফিসে একটি এসডিজি বাস্তবায়ন সমন্বয় সেল স্থাপন করা হয়েছে। প্রত্যেক মন্ত্রণালয়কে এসডিজির লক্ষ্য অনুযায়ী অনুরূপ বাস্তবায়ন সেল গঠন করতে বলা হয়েছে। ফলাফল নির্ভর এসব উদ্যোগের সঙ্গে ব্যক্তিখাত, এনজিও ও সামাজিক সংগঠনকেও যুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসডিজি বাস্তাবায়নে সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তিখাতকে অর্থায়নে বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। ব্যক্তিখাত ও সরকারি খাত মিলে পিপিপি নির্ভর অর্থায়নের ব্যবস্থাও করতে হবে। আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ থেকেও এ জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন সহযোগিতা পাওয়ার কথা রয়েছে। এতসব উদ্যোগের সমন্বয় নিশ্চিত করে লক্ষ্য ধরে ধরে বাস্তবায়ন কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব শেষ পর্যন্ত আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বেকেই দিতে হবে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এসডিজি এজেন্ডাকে খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। বিশ্ব মঞ্চে তার সরব উপস্থিতি আমরা সকলেই দেখতে পাচ্ছি।

তবে বাংলাদেশের জন্য টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যটি হচ্ছে প্রথমটি। বিশেষ করে ২০৩০ সালের মধ্যে অতি-দারিদ্র্য পুরোপুরি নিরসন এবং সার্বিক দারিদ্র্য অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্যটি পূরণ করা খুবই চ্যালেঞ্জিং হতে বাধ্য। বর্তমানে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার ২২ শতাংশের মতো। এই হারকে ২০৩০ সাল নাগাদ ১১ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। বর্তমানে অতি-দারিদ্র্যের হার ১২ শতাংশের মতো। তাকে পুরোপুরি নিরসন করতে হবে। প্রায় দুই কোটির মতো অতি-দরিদ্র মানুষকে দারিদ্র্যমুক্ত করা চাট্টিখানি কথা নয়। এমনকি উন্নত দেশেও বিরাট সংখ্যক মানুষ অতি-দারিদ্র্য রেখার নিচে বাস করেন। তাদের সামাজিক সুরক্ষা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়। বাংলাদেশের পক্ষে এই বিপুল সংখ্যক অতি-দরিদ্র মানুষকে সামাজিক সুরক্ষা দিয়ে পুরোপুরি দারিদ্র্যমুক্ত রাখা খুব একটা সহজ হবে না।

তবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার মতো শক্তি ও সামর্থ্য একমাত্র বাংলাদেশেরই রয়েছে। দারিদ্র্য নিরসনে বাংলাদেশের ব্যাপক সাফল্যের কথা সকলেরই জানা। বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গরিব-হিতৈষী নীতিকৌশলের ফলে এ দেশের গরিব-দুঃখী মানুষ তাদের বঞ্চনা ও দুরবস্থা থেকে কীভাবে উঠে এসেছে—সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। ছিয়ানব্বইয়ে প্রথমবার ক্ষমতায় এসেই তিনি বয়স্কভাতা ও বিধবা ভাতা প্রদানের সামাজিক সুরক্ষা নীতি চালু করেন। এর পরের বার ক্ষমতাসীন হয়ে তিনি এর ভিত্তি ও ব্যাপ্তি দুই’ই বাড়িয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকে কাজের অভিজ্ঞতা থেকেই আমি বলতে পারি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষেই এসডিজি’র এই প্রধান লক্ষ্য পূরণ খুবই সম্ভব। দীর্ঘদিন এ দেশের প্রধানমন্ত্রী থাকার কারণে যে অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতা তিনি অর্জন করেছেন সেসবের আলোকেই তিনি অতি দারিদ্র্য নিরসনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার সক্ষমতা রাখেন।

তাছাড়া, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামোতেও গরিব-সহায়ক বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্যাপক আধুনিকায়ন ও যন্ত্রায়নের কারণে ভূমির ব্যবহারেও পরিবর্তন এসেছে। বর্গাচাষের ধরনেও পরিবর্তন এসেছে। এখন বেশিরভাগ জমিই ‘ফিক্সড রেন্ট’ বা চুক্তিতে ভাগ চাষ হয়। ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষিরা এতে উপকৃত হচ্ছেন। ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষিরা এখন প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের সুবিধাও পাচ্ছেন। শ্রম বাজারেও এসেছে পরিবর্তন। দৈনিক মজুরির বদলে চুক্তিভিত্তিক শ্রম বিক্রির পরিমাণ বেড়েছে। এ সবই হচ্ছে কৃষি খাতের ব্যাপক আধুনিকায়ন ও বিনিয়োগের কারণে। বর্তমান সরকারের কৃষি-বান্ধব নীতির কারণেই যে গ্রামীণ অতি-দারিদ্র্যের হার ব্যাপক হারে কমেছে সে কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তার পাশাপাশি গ্রাম থেকে প্রায় অর্ধ-কোটি নারী শ্রমিক রপ্তানিমুখী শিল্পে নিয়োজিত রয়েছেন। এরাও নিয়মিত গ্রামে টাকা পাঠাচ্ছেন। সে টাকায় আত্মীয়-স্বজন জমি ইজারা নিচ্ছেন। তার মানে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানগুলোরও পরিবর্তন এনে তাকে অনেকটাই অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে পেরেছে। এর ফলে অতি-দরিদ্র মানুষের আয় রোজগারের সুযোগ বেড়েছে। তাছাড়া, এই সরকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি ও অর্থায়ন কৌশলের কারণে বৈষম্য সেভাবে বাড়েনি। গ্রাম পর্যায়ে বরং তা কমেছে। আর সে কারণে অতি-দারিদ্র্যের হার দ্রুততার সঙ্গে কমেছে। আর প্রবৃদ্ধির হার ভালো থাকার কারণে সকলেরই আয় রোজগার বেড়েছে। তারও সুবিধা গরিব মানুষের ভাগ্যে বেশ খানিকটা জুটেছে। যদি ৭% শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখা যায় তাহলে ২০৩০ সাল নাগাদ বড়জোর ৩ শতাংশ মানুষ অতি-দরিদ্র থাকবে। এরা আবার প্রতিবন্ধী, স্বামী-পরিত্যক্ত ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো কাঠামোগত সমস্যার শিকার হবার কারণে অতি-দারিদ্র্যর ঐ ফাঁদ থেকে এদের জন্য বের হতে কষ্টকর হবে। এই পরিমাণ অতি-দরিদ্র মানুষকে উন্নত দেশেও সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার অধীনে প্রতিপালন করতে হয়। আমাদেরও হয়তো তাই করতে হবে। সেজন্য সামাজিক সুরক্ষা নীতির ব্যাপক আধুনিকায়নের প্রয়োজন রয়েছে। সরকার এরই মধ্যে এদিকে নজর দিয়েছেন।

এছাড়া, শুধু অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির কৌশলের ওপর নির্ভরশীল না থেকে যে সব গরিব-হিতৈষী প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপমূলক (যেমন চর উন্নয়ন প্রকল্প, অসহায় নারীর সুনির্দিষ্ট কর্মসংস্থান প্রকল্প, এনজিওদের ‘সৌহার্দ্য’, ‘টাপ (TUP)’ প্রকল্প এবং ‘নদী ও জীবন’ প্রকল্প, নগরের অংশীদারমূলক দারিদ্র্য নিরসন প্রকল্প, ‘সিঁড়ি’ প্রকল্প ইত্যাদি) অভিজ্ঞতার আলোকে নতুন করে সরকারি-বেসরকারি প্রকল্প হাতে নিয়ে অতি-দারিদ্র্যের হার আরো দ্রুত কমিয়ে ফেলা সম্ভব। একেকটি পরিবারের জন্য বড়জোর ৫০০ ডলার বা চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার টাকার অর্থ স্থানান্তর ও কিছু সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করলেই অতি-দরিদ্র মানুষগুলোকে তীব্র দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব। আর এই অর্থ খরচের সক্ষমতা আমাদের রয়েছে। প্রয়োজন উদ্যোগের। বিশেষ করে, যেসব অঞ্চল মূল ভূ-খণ্ড থেকে বহু দূরে (হাওর, চর, উপকূল) এবং জলবায়ু পরিবর্তনের আঘাতে জর্জরিত সেদিকে আগে নজর দিতে হবে। সময়মতো স্বাস্থ্যসেবার অভাবেও অনেকেই দারিদ্র্যের গর্তে পড়ে যান। তাই কমিউনিটি হাসপাতলগুলোকে আরো আধুুনিক ও সক্ষম করে তোলা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।

আমরা বিশ্বায়নের এই পরিবর্তনশীল সময়েও ম্যাক্রো-অর্থনীতির বিস্ময়কর অগ্রগতি ও স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছি। রপ্তানি আয়, রেমিটেন্স আয় বাড়ন্ত ছিল বলে দেশের ম্যাক্রো-অর্থনীতি এতোটা ভলো ছিল। এ দুটো জায়গায় এখন খানিকটা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এখনই সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দূরদর্শী নীতি হস্তক্ষেপ করে বহু কষ্টে অর্জিত ম্যাক্রো-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে। পাশাপাশি কৃষির আধুনিকায়ন ও বহুমুখীকরণের কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে হবে।

সরকার নিঃসন্দেহে নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকবে। কিন্তু পাশাপাশি ব্যক্তিখাত, এনজিও, সামাজিক সংগঠনগুলোকেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। আমাদের পোড়খাওয়া মানুষগুলোর ভাগ্যোন্নয়নে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সরকার যেসব সুদূরপ্রসারী অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নকৌশল ও অর্থায়ন নীতি গ্রহণ করেছে তার ফলে সাধারণ মানুষ ও নেতৃত্বের মাঝে একটি সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক সমঝোতা তৈরি হয়েছে। এই পরিবেশে কোনো মানুষ না খেয়ে মারা যাবে—তা আর সম্ভব নয়। প্রযুক্তির কল্যাণে নিমিষেই খবর চলে যাচ্ছে পুরো সমাজে।

এমন পরিস্থিতি একদিনেই সৃষ্টি হয়নি। বাঙালি সমাজের অন্তর্নিহিত স্বাদেশিক অনুভূতি, একে-অপরের দুঃখে সামিল হওয়া, একাত্তরের মতো অতি সাধারণের মাঝে থেকে তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে সহায়ক হবার ঐতিহ্য আমাদের দীর্ঘদিনের। সেই ১৯০৭ সালের ১৮ জুন চট্টগ্রাম সফরে এসেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাকে দেওয়া সংবর্ধনার জবাবে সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘প্রাচীন বা মধ্যপন্থি এবং নবীন বা উগ্রপন্থি কোনো দলই দেশের প্রকৃত কাজ করছেন না, কেননা দেশের অতি সাধারণ মানুষদের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসে তাদের নিয়ে কাজ কোনো পক্ষই করছেন না, অথচ এটাই এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ।’ (দ্র: শিমুল বড়ুয়া, রবীন্দ্র জীবনে ও সাহিত্যে চট্টগ্রাম, অমিতাভ প্রকাশন, ২০১৬, পৃ. ২৫)। রবীন্দ্রনাথ নিজে শিলাইদহ, পতিসর, শান্তিনিকেতনে এই অতি-সাধারণের মাঝে কাজ করেছেন বলেই এই উপলব্ধি তার হয়েছিল। আরেক শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এই অতি-সাধারণ ঘেঁষা এক দূরদর্শী নেতা। চুয়ান্নর নির্বাচনী প্রচারণার সময় তিনি এক গরিব বৃদ্ধার ঘরে গিয়েছিলেন। তিনি তাকে এক গ্লাস দুধ খেতে দিলেন। আর চার আনা পয়সা। তার নির্বাচনের খরচের জন্য। বঙ্গবন্ধু তাকে ঐ পয়সাসহ আরো কিছু টাকা দেবার অনেক চেষ্টা করেও দিতে পারলেন না। শুধু মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। দু’চোখে পানি নিয়ে বঙ্গবন্ধু বের হয়ে এলেন তার ঘর থেকে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ (পৃ. ২৫৫-২৫৬) তাই তিনি লিখেছেন, “সেই দিনই আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, ‘মানুষরে ধোঁকা আমি দিতে পারব না।’” ধোঁকা তিনি দেননি। দিয়েছেন নিজের প্রাণ। আর দিয়েছেন এই মুক্ত বাংলাদেশ। তিনিও রবীন্দ্রনাথের মতোই অতি-সাধারণের মুক্তির কথা সর্বক্ষণ বলতেন। সেই মতো কাজও করতেন। ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে (পৃ. ১৫৩) ১৯৬৬ সনের ৮ জুলাই তারিখে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘চুপ করে শুয়ে চিন্তা করতে লাগলাম গ্রামের কথা, বস্তির কথা। … অভাবের তাড়নায়, দুঃখের জ্বালায় আদম সন্তান গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছে শহরের দিকে। অনেকক্ষণ শুয়ে শুয়ে ছোটবেলার কত কাহিনিই না মনে পড়ল। কারণ আমি তো গ্রামেরই ছেলে। গ্রামকে আমি ভালোবাসি।’ গ্রামের ঐ দুঃখী মানুষের কথা তিনি কোনোদিন ভোলেননি। বরং নিরন্তর চেষ্টা করেছেন কী করে তাদের দুঃখ দূর করা যায়। এই দুই শ্রেষ্ঠ বাঙালির অভিপ্রায় অনুযায়ী আমরা আমাদের এই প্রিয় স্বদেশ থেকে নিশ্চয় অতি-দারিদ্র্যের অভিশাপ নির্মূল করতে পারব। আমাদের রয়েছে যোগ্য নেতৃত্ব, অসংখ্য সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন। রয়েছে তরুণ্যে ভরা প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং দারিদ্র্য নিরসনের বিপুল অভিজ্ঞতা। এসবের সমন্বয় ঘটিয়ে নিশ্চয় আমরা অতি-দারিদ্র্য নিরসনের এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হব। পুরো জাতির মনে এই আশাবাদ সঞ্চারিত হোক।

n লেখক :বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক

জীবন-সায়াহ্নে পরিবারের দায়িত্ব অনেক

জীবন-সায়াহ্নে পরিবারের দায়িত্ব অনেক
১৯ জুলাই, ২০১৭ ইং
শতাব্দী জুবায়ের

জরা বার্ধক্য মানুষের জীবনে এক চরম সত্য । শৈশবের সোনালি দিন, তারুণ্য আর যৌবনের রোদেলা দুপুর পাড়ি দিয়ে, মাঝ বয়সে ব্যস্ত বিকেলটাও অস্তমিত হয়; একসময় তখনই জীবন সায়াহ্নের গোধূলি বেলা হয়ে আসে বার্ধক্য।

বয়সটা যখন প্রবীণের কাতারে চলে যায় তখন মস্তিষ্কটা ছোট হয়ে আসে। ফলে স্মৃতিশক্তি কমে যায়, আবেগ-অনুভূতি, বিচার-বুদ্ধি, বিবেচনা শক্তি, চিন্তা ক্ষমতা, কাজ করার ক্ষমতা ইত্যাদির পরিবর্তন ঘটে। আসলে একজন মানুষ যখন জীবন সায়াহ্নে চলে যায় তখন তার মধ্যে কিছু কিছু জিনিস দানা বাঁধে। যেমন শারীরিক অসামর্থ্য, অসহায়ত্ব, অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা ইত্যাদি। এগুলো থেকে মানসিক যন্ত্রণা শুরু হয় এবং নিজেকে পরিবারের বোঝা ভাবতে শুরু করেন। অনেক সময় এমন আচরণ করে বসেন যে যা শিশুকেও হার মানায়। তিনি যাতে নিজেকে পরিবারের বোঝা না ভাবেন এই দিকে দৃষ্টি দিতে হবে পরিবারকেই। আজকে যাঁরা জীবন সায়াহ্নে তাঁরা পরিবার, সমাজ, দেশের জন্য অনেক কিছুই করেছেন। ভুলে গেলে চলবে না যে আমাদের সবাইকে একদিন এই অবস্থায় যেতে হবে।

কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেললে স্বাভাবিকভাবেই পরিবারের অন্যদের ওপরই নির্ভর করে চলতে হয়। অনেক পরিবারেই দেখা যায় তাদের নানা দাবি বা কথাবার্তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়। আর তখন তিনি অসম্মানিত বোধ করেন। যা একটি পরিবার তথা সমাজের জন্য খুবই নেতিবাচক একটা দিক। জীবন সায়াহ্নে এসে তাঁরা শিশুর মতো হয়ে যান। শিশু যেমন কথা বলা শুরুর সময় সারা দিন বকবক করতে থাকে তেমনি তাঁরাও এই রকম করতে থাকেন। এই সময় আমাদের বিরক্ত হওয়া যাবে না। তাঁদের সঙ্গ দিতে হবে।

লক্ষ লক্ষ বেকারের কর্মসংস্থানের কী হইবে?

১৯ জুলাই, ২০১৭ ইং
দেশে বর্তমানে পূর্ণকালীন কর্মবঞ্চিত নারী-পুরুষের সংখ্যা ৭১ লক্ষের অধিক। ইহার মধ্যে ১৭ লক্ষ ৫৯ হাজার টিউশনি কিংবা এই ধরনের খণ্ডকালীন কাজ করিয়া থাকে। তবে কাজের সুযোগ না থাকায় বা ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে অবশিষ্ট বিশাল জনসমষ্টিই বর্তমানে কোনো কাজের সহিত জড়িত নহে। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর সর্বশেষ প্রকাশিত ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৫-১৬-এর প্রতিবেদন হইতে এই তথ্য জানা যায়। অন্যদিকে বিবিএসের গত বত্সরের প্রতিবেদনে দেশে মোট জনসংখ্যার চার দশমিক তিন শতাংশ বেকার থাকিবার কথা বলা হয়। এই বত্সর তাহা চার দশমিক দুই ভাগে নামিয়া আসিয়াছে। ইহাতে আমাদের সন্তুষ্ট হইবার কথা। তবে বাস্তব পরিস্থিতি বলে ভিন্ন কথা। সামান্য কয়েকটা পদের জন্য এখনো দেশে হাজার হাজার—এমনকি লক্ষাধিক আবেদনপত্রও জমা পড়ে। কেননা, প্রতি বত্সর দেশে সরকারি-বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় হইতে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী পাস করিয়া বাহির হয়, কিন্তু তাহাদের অধিকাংশেরই কাঙ্ক্ষিত কর্মসংস্থানের সুযোগ হয় না। উপরন্তু কর্মবাজারে চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় সরকারি-বেসরকারি উভয় চাকরিতেই আজ দুর্নীতি ও অনিয়ম বৃদ্ধি পাইয়াছে আশঙ্কাজনকভাবে।

জানা যায়, বাংলাদেশের শ্রমবাজারে প্রতি বত্সর প্রায় ২৭ লক্ষ মানুষ ঢুকিয়া থাকে। তাহাদের মধ্যে সরকারি বা বেসরকারি খাতে এক লক্ষ ৮৬ হাজার মানুষকে কাজ দেওয়া সম্ভব হয়। বাকিরা বলা যায় বেকারত্বের খাতাতেই নাম লিখায়। বিষয়টি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। কারণ বাংলাদেশকে বলা হয় অমিত সম্ভাবনার দেশ। ইতোমধ্যে আমরা নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হইয়াছি। উপরন্তু শ্রমের দাম কম হইবার কারণে এবং ১৬ কোটি মানুষের বিশাল একটি বাজার থাকায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরও এই দেশ সম্পর্কে আগ্রহের অভাব নাই। তবে গ্যাস-বিদ্যুত্সহ অবকাঠামোগত নানা সমস্যার কারণে তাহারা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রায়শই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগিয়া থাকে। প্রযুক্তিগত পশ্চাত্পদতা ও নানান প্রতিবন্ধকতার কারণে দেশি বিনিয়োগকারীরাও শিল্পে প্রয়োজনীয় গতি সঞ্চার করিতে ব্যর্থ হইতেছেন। সব মিলাইয়া ক্রমশই দেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র সংকুচিত হইতেছে বলা যায়।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন বলি, আর দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে নিয়ে যাওয়ার কথাই বলি—ইহা এই বিশাল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে কর্মহীন রাখিয়া বাস্তবায়ন করা আদৌ সম্ভব নহে। তাহা ছাড়া দেশকে মধ্যম আয়ের দেশের সারিতে উন্নীত করিতে কেবল আশাবাদ ও উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা থাকিলেই চলিবে না, ইহাকে বাস্তবসম্মত ও কর্মসৃজনযোগ্যও করিতে হইবে। ইহার জন্য বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থাকে কর্মমুখী করাও জরুরি। কেননা, মোটা দাগে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা যুবশক্তির অন্তর্নিহিত মেধা বা শক্তির বিকাশ ঘটাইয়া তাহাদেরকে বর্তমান বাজার অনুযায়ী দক্ষ করিয়া তুলিতে সক্ষম নহে। উপরন্তু সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে মোট অনুমোদিত পদের বিপরীতে যেই কয়েক লক্ষ পদ শূন্য আছে, তাহা সর্বাগ্রে পূরণ করিবার দাবিও অন্যায্য নহে। দেশ উন্নতি লাভ করিতেছে বিধায় প্রয়োজনে সেইসব পদের সংখ্যা বাড়ানোও অযৌক্তিক হইবে না। অন্যদিকে বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থান বাড়াইতে জ্বালানি ও অবকাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা দূর করার পাশাপাশি শিল্পোন্নয়নসহ সার্বিকভাবে বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশের উন্নতি সাধনও প্রয়োজন। সর্বোপরি, বহির্বিশ্বে শ্রমশক্তি রপ্তানির ব্যাপারে আরো পরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক।

জঙ্গিবাদের বিস্তার কমাতে তরুণদের ৩ পরামর্শ

নির্দিষ্ট কোনো একটি নয়, দেশে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে তিনটি পদক্ষেপ দেখতে চায় তরুণেরা। এগুলো হলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান, সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো ও বেকারত্ব কমিয়ে আনা। এ তিনটি বিষয়ে জোর দিলে জঙ্গিবাদ অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব বলেই তারা মনে করছে।

জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে করণীয় নিয়ে তরুণদের মতামত জানতে চাওয়া হয়েছিল জরিপে। এতে অংশ নিয়ে এই তিনটি বিষয়কে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কথাই বলা হয়।

ঢাকার হোলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর গত এক বছরে সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা ও সামাজিক প্রতিরোধে বড় কোনো ঘটনা আর ঘটেনি। তবে এ সময় দেশের বিভিন্ন জায়গায় একের পর এক জঙ্গি আস্তানা উদ্ধার হয়েছে, পুলিশের অভিযানে মারা পড়েছে কমপক্ষে ৭০ জঙ্গি। এত কিছুর পরও জঙ্গি হামলা নিয়ে মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা পুরোপুরি দূর হয়নি।

এ রকম এক অবস্থায় জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে এককভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর পদক্ষেপের বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পেয়েছে জরিপে। ২৬ শতাংশ তরুণ এ বিষয়ের পক্ষে মতামত দিয়েছে। শহরের চেয়ে গ্রামের তরুণেরা এর পক্ষে বেশি। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জঙ্গিবাদ ঠেকানোর পক্ষে বলেছে ২৫ শতাংশ তরুণ। এ বিষয়ে ছেলে-মেয়ে, শহর-গ্রামের তরুণদের অবস্থান প্রায় একই রকম। আর দারিদ্র্য কমিয়ে আনায় জোর দিয়েছে ২২ শতাংশ তরুণ।

তবে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কাউন্টার টেররিজম কমিটি বলছে, শুধু দমন-পীড়নের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ বন্ধ হবে না। জঙ্গিবাদ উসকে দেয় এমন কর্মকাণ্ড থেকে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে বিরত থাকতে হবে। পাশাপাশি সংবাদমাধ্যম, সুশীল সমাজ, ধর্মীয় ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক সংগঠনকে একযোগে কাজ করতে হবে।

এ তিনটি বিষয় ছাড়া জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে আরও কিছু বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ এসেছে তরুণদের কাছ থেকে। উত্তরদাতা ১০ শতাংশ তরুণের মতে, সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের বাড়তি যত্ন ও খেয়াল জঙ্গিবাদের ভুল পথে যাওয়াকে আটকাতে পারে। কোরআন ও হাদিসের আলোকে সঠিক শিক্ষা দেওয়া এবং জঙ্গিবাদের মদদদাতাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছে ১৫ শতাংশ তরুণ। এ ছাড়া দারিদ্র্য কমানো, ধর্মের অপব্যবহার রোধ ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার মতো বিষয়ে গুরুত্ব আরোপের কথা বলেছে আরও ১৬ শতাংশ তরুণ। তাদের মতে, ঠিকভাবে এ কাজগুলো করা গেলে তা জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। উত্তরদাতা ৭ শতাংশ তরুণ বলেছে, জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে আসলে কী করা উচিত, এ সম্পর্কে তাদের স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই।

জরিপের আগের পর্বের বিষয় ছিল পরিবার। সেখানে জরিপে অংশ নিয়ে ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ তরুণই বলেছে যে পরিবার ও বাবা-মায়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে না পারাটাই তাদের জন্য সবচেয়ে চিন্তার বিষয়। ছেলে বা মেয়ে—সবার জন্য এটি একটি বড় সমস্যা বলেই তরুণেরা উল্লেখ করেছে। এ থেকে বলা যায়, প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজন তরুণই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা বোধ করে। পারিবারিক বন্ধন আলগা হওয়ায় বাড়ছে বাবা-মায়ের সঙ্গে দূরত্ব। এই পর্বের জরিপে তরুণেরা আরও বলেছে, তারা জীবনের লক্ষ্য নিয়ে নিশ্চিত নয়। আবার লক্ষ্য ঠিক করতে পরিবার থেকে প্রয়োজনীয় পথের নির্দেশও পাচ্ছে না। গুলশানের ঘটনার পর জঙ্গি হিসেবে ধরা পড়া তরুণদের জবানবন্দি বিশ্লেষণ করেও দেখা যাচ্ছে তারা প্রায় সবাই ছিল পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। এরপরই তারা যুক্ত হয় জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে। বিশেষ করে শিক্ষিত ও অবস্থাপন্ন পরিবারের সন্তানদের জঙ্গি হওয়ার ক্ষেত্রে এমনটি বেশি দেখা গেছে।

বিশেষজ্ঞ মতামত তরুণদের কাছে সঠিক আদর্শ তুলে ধরতে হবে

বাংলাদেশ এখন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, যেখানে উগ্রপন্থা বা জঙ্গিবাদ নতুন করে একটি উদ্বেগ ও ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত বছর গুলশানে জঙ্গি হামলা এ ক্ষেত্রে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তবে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, ওই ঘটনার পর আমরা পুরো দেশে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার মনোভাব লক্ষ্য করেছি। এর ফলে গত এক বছরে কোনো ধরনের জঙ্গি হামলার ঘটনা আমরা দেখিনি। যদিও জঙ্গিবাদের হুমকি এখনো অনেকটাই ব্যাপক।

জঙ্গিবাদকে সম্পূর্ণভাবে মোকাবিলা করতে গেলে তরুণ সমাজের মধ্যে সচেতনতা আনাটা সবচেয়ে জরুরি। কেননা, তারাই উগ্রবাদীদের লক্ষ্য থাকে। আমাদের তরুণ সমাজের মধ্যে দেশ নিয়ে, সমাজ নিয়ে, সমাজব্যবস্থা নিয়ে একধরনের হতাশা ও আশাহীনতা কাজ করছে—এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এর পেছনে বেকারত্ব, সুযোগের অভাব, উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর চাকরি না পাওয়া, সঠিক কর্মসংস্থান না পাওয়ার হতাশা ইত্যাদি কারণ রয়েছে। আবার দুর্নীতি, অনিয়ম, ন্যায়বিচারের অভাব, সুশাসনের অভাব ইত্যাদিও তরুণ সমাজকে দারুণভাবে পীড়া দেয়। ফলে তাদের মধ্যে হতাশার জন্ম নেয়। জঙ্গিরা এসব বিষয় কাজে লাগিয়ে কিছুসংখ্যক তরুণকে তাদের দিকে আকৃষ্ট করে।

তরুণদের মধ্যে হতাশা বা আশাহীনতা যাতে জন্ম না নেয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। তরুণদের মধ্যে যে কর্মক্ষমতা, উদ্ভাবনী শক্তি ও নতুন চিন্তা রয়েছে, তা কীভাবে দেশের জন্য কাজে লাগানো যায়, সে বিষয়ে আমাদের ভাবতে হবে। তাদের শিক্ষাজীবন শেষে যথোপযুক্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে আমাদের লক্ষ রাখতে হবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, শুধু একটি গোষ্ঠী বা কিছুসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তরুণেরা জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট হচ্ছে না; সমাজের বিভিন্ন স্তর ও অংশ থেকেও কিছু মানুষ এ পথে যাচ্ছে। তাই আমাদের দেখতে হবে, কীভাবে ধর্মের অপব্যাখ্যা বা ভ্রান্ত আদর্শ তৈরি করে তরুণদের জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট করা হচ্ছে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে জঙ্গিবাদ বা উগ্রবাদের বিরুদ্ধে আমাদের যে লড়াই তা আদর্শিক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চলমান তৎপরতা এখানে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। তবে এর পাশাপাশি কিছু কৌশলগত পরিকল্পনা নেওয়ারও প্রয়োজন আছে। জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদকে সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে গেলে সামাজিক প্রতিরোধ ও সামাজিক সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠ্যক্রমের মধ্যে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধী বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। জঙ্গিবাদীদের ভ্রান্ত আদর্শের বিরুদ্ধে সঠিক আদর্শ তুলে ধরতে হবে। এখনকার উগ্রবাদের বিস্তারে ইন্টারনেট বড় ভূমিকা পালন করছে। তাই জঙ্গিগোষ্ঠী যেভাবে ইন্টারনেটকে কাজে লাগাচ্ছে, একইভাবে তাদের আদর্শ প্রতিরোধেও ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হবে। সঠিক ও ইতিবাচক মূল্যবোধ তুলে ধরতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভুয়া সংবাদ প্রতিরোধ করা এবং তা নিয়ে প্রশ্ন করার সচেতনতা তৈরি করতে হবে। সমাজকে জঙ্গিবাদের ক্যানসারমুক্ত করা আমাদের সমগ্র সমাজব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি সুন্দর ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য জঙ্গিবাদকে সম্পূর্ণ নির্মূল করা দরকার। এর জন্য সরকার ও সুশীল সমাজকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও গবেষক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ

অলসতা কাটান

কখনো কখনো ভীষণ অলসতা আমাদের মধ্যে দানা বাঁধে। ফলে কাজের ক্ষেত্রে প্রচুর চাপ হয়। যে কোনো কাজে আত্মতৃপ্তি বা সেলফ স্যাটিসফ্যাকশন আমাদের অনেকের কাছেই একটা বড় ব্যাপার। কিন্তু আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেলফ মোটিভেটেড হয়েও অনেক সময়ই জীবনের কাজের ছন্দকে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে বিলম্বিত করে ফেলি। নিউ ইয়ার রেজিলিউশন নিই, ভাবি এই বছর আর আলসেমি করে ‘টাইম ওয়েস্ট’ করব না, কিন্তু কে শোনে কার কথা। সেই আবার আজ করি কাল করি করে করে প্রায় একই অবস্থা। এই অলসতার হাত থেকে যে কীভাবে বেরোবো, ভাবতে ভাবতেই সময় কেটে যায়। এসব নিয়েই লিখেছেন- শামীম ফরহাদ

দেরির কারণ : এটি ব্যক্তিবিশেষে বিভিন্ন রকম হতে পারা। যেমনÑ হাতে পাওয়া অ্যাসাইনমেন্টটাই হয়তো আমার পছন্দের নয়। আমার একার পক্ষে পুরো অ্যাসাইনমেন্টটা করে ওঠা সম্ভব নয়। আমি হয়তো সত্যিই আমার সিনিয়র বা সাবঅর্ডিনেটদের থেকে কোনো সহযোগিতা পাচ্ছি না। আমি মাত্রাতিরিক্ত ‘পারফেকশনিস্ট’ বলে অ্যাসাইনমেন্টটাকে যথাসম্ভব ভালোভাবে তৈরি করার চেষ্টা করছি। আমি নিজেই নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে যথেষ্ট কনফিডেন্ট ছিলাম না, তাই একটু ইমপালসিভ হয়েই দায়িত্বটা নিয়ে ফেলে এখন পস্তাচ্ছি।

যে কোনো নতুন বা অজানা-অচেনা কাজে হাত দিতে প্রাথমিকভাবে একটা ভয় কাজ করা। আমার মধ্যে অতিরিক্ত একটা দেখানেপনা থেকেই আমি এই কমপিটিশনের বাজারে শো অব করেই চলেছি যে, আমি অন্যদের চেয়ে কত বেশি পরিশ্রম করে থাকি। কিন্তু সমস্যা হলো, বিভিন্ন ক্ষেত্রে কারণ বিভিন্ন হলেও নিট রেজাল্ট কিন্তু সেই একই আর তা হলো ‘বিলম্বিত লয়…’

বেরোনোর রাস্তা : এ ক্ষেত্রে সব থেকে জরুরি হলো অন্যকে দোষারোপ না করে নিজেকে প্রশ্ন করা। যাকে আমরা বলি অন্তরদর্শন। খুঁজে বের করা যে, ঠিক কোন কোন কারণের জন্য আমার এই আলসেমিজনিত বিলম্ব। নিজের ভুল স্বীকার করাটাও একটা মহৎ গুণের মধ্যেই পড়ে। আর এটি অভ্যাস করে নিজেকে শোধরানোর সুযোগ দিতে পারলে আখেরে নিজেরই সেলফ এস্টিম বাড়বে।

স্টেপ বাই স্টেপ : কোনো বড় কাজ যেমন ধরুন অফিসের কোনো প্রেজেন্টেশন থাকলে সেটা ধাপে ধাপে করে ফেলার চেষ্টা করুন। অনেক বড় কাজ ভাবলে কুঁড়েমি আসবেই। তার চেয়ে ভালো আপনি সেগুলোকে ছোট ছোট খ-ে বিভক্ত করে নিন। এতে ভীষণ দ্রুত কাজ এগোবে। সবচেয়ে বড় কথা, এক একটি ধাপ সফলতার সঙ্গে অতিক্রম করলে নিজেকে অনুপ্রাণিত করা অনেক সহজ হয়ে পড়বে। যে কোনো অ্যাসাইনমেন্টকে ছোট ছোট পর্ব বা এপিসোডে ভাগ করে নিয়ে প্রত্যেকটি ভাগের জন্য একটি নির্দিষ্ট টাইম অ্যালট করা। এতে অনেক কারেকশনের সময়ও যেমন পাওয়া যায়, তেমন সময়ও পাওয়া যায়।

নড়েচড়ে বসুন : সারাদিন শুয়ে-বসে কাটালে কুঁড়েমি বাসা বাঁধতে বাধ্য। বিশেষত ঠা-া ঠা-া দিনে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাতে কে না চায়। কিন্তু কখন কোন কাজ এসে যাবে সেটা তো আপনি জানেন না। ফলে কাজ না থাকলেও ছুটির আমেজে মজে যাওয়া মোটেই উচিত নয়। ছুটিতেও নিজেকে সচল রাখুন। প্রতিদিনের মতো সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে জগিং করুন। তার পর ব্রেকফাস্ট নিজের হাতে তৈরি করুন। ঘর গোছান। সন্তানের সঙ্গে সময় কাটান। কিংবা অফিসের পেন্ডিং কাজ সারুন। এতে অলসতা বাসাই বাঁধতে পারবে না। ফলে কোনো কাজ এলে চটজলদি বেরিয়ে পড়তে পারবেন।

লক্ষ্য স্থির রাখুন : আপনার কুঁড়েমির কারণ কিন্তু প্রচুর কাজ হতেই পারে। আপনি জানেন যে, আপনার হাতে অনেক কাজ। কোনটা আগে সারবেন কোনটা পরে সে বিষয়ে আপনি সম্পূর্ণ ঘেঁটে রয়েছেন। এ ক্ষেত্রে অলসতা কিন্তু অজুহাত। নিজেকে নিজেই ধোঁকা দিচ্ছেন। বরং বুঝুন কাজ না সারলে আরও কাজ জমবে। ফলে চাপ ক্রমাগত বাড়তে থাকবে। এ ক্ষেত্রে যে কোনো একটা দিয়ে শুরু করুন এবং পরপর কাজ সেরে ফেলুন। যখন যে কাজ করবেন সেদিকে মন দিন। এর পর কী কাজ আছে সেটা ভাববেন না। এতে অনেক সুবিধা হবে।

ব্যালেন্সিং এসপেক্ট টেকনিক : অ্যাসাইনমেন্টের কাজ শুরু করার আগে তার একটি সম্ভাব্য তালিকা তৈরি করা, যাতে বোঝা যায়, যে কাজটিতে হাত দিয়ে চলেছি তার নানা ‘পজিটিভ অ্যান্ড নেগেটিভ অ্যাসপেক্ট’গুলো কী কী হতে পারে। সেই লিস্ট অনুযায়ী এগোলে ভুলভ্রান্তি কম হয় আর ‘সাকসেস রেট’ও বাড়ে।

গ্রুপ টেকনিক : বিশেষভাবে পারদর্শী বা সমমনস্ক মানুষদের মধ্যে কাজটা ভাগ করে নেওয়া। এ ক্ষেত্রে কাজের রেজাল্টের গুণগত তারতম্যের সঙ্গে একটা অ্যাডজাস্টমেন্টের প্রশ্ন জড়িয়ে থাকে তাই সঠিক দক্ষ রিসোর্স খুঁজে বের করাটাও একটা ইমার্জেন্সি ডিসিশন মেকিং হয়ে ধরে।

টেক অব ব্রেক : তবে ক্রমাগত কাজ করতে থাকলেও কিন্তু আলসেমি আসে। তাই কিছু কাজ সারার পর একটা ব্রেক নিন। কলিগদের সঙ্গে একটু আড্ডা দিন। ক্যাফেটেরিয়ায় গিয়ে চা ও স্ন্যাক্স খেয়ে নিন। তার পর আবার কাজ শুরু করুন। মাঝেমধ্যে একটু ব্রেকও জরুরি।

পুরস্কার : অলসতা কাটিয়ে কাজ করার আরেকটা ভালো উপায় হলো নিজেকে পুরস্কার দেওয়া। কে কী ভাবে না ভেবে নিজেকেই নিজে রিওয়ার্ড দেওয়ার সিস্টেম চালু করা। এ ক্ষেত্রে মোটিভেশন ধরে রাখার ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে নির্বাচন করা যে রিওয়ার্ড ‘এপিসোডিক’ হবে না ‘এন্ড বেসড’ হবে। আর ইনসেনটিভ বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও যার যা ভালো লাগে তাই সিলেক্ট করা যেতে পারে। একটা কাজ শেষ হলে রাতে ডিনারে পছন্দের পিতজা অর্ডার করব, আরেকটা হলে সঙ্গে সঙ্গে প্রিয় চকোলেট খাব এমনটা ভেবে কাজ করলে কিন্তু আলসেমি তো আসবেই না। বরং কাজ তরতরিয়ে এগোবে। অনেক সময়ই আলসেমি করে আমরা ঠিক সময়ে ঠিক কাজটা করে উঠতে পারি না। সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করারও আলাদা মূল্য আছে। তাই শুধু ভালো কাজ নয়, সময়মতো ভালো কাজ করা প্রয়োজন।

জঙ্গিবাদ বাড়ছে দারিদ্র্যে ও ধর্মের ভুল ব্যাখ্যায়

দেশের তরুণদের ভাবনা জানতে প্রথম আলোর উদ্যোগে ওআরজি-কোয়েস্ট গত মার্চে সারা দেশে জরিপ করেছে। এতে দেশের সার্বিক পরিস্থিতির পাশাপাশি জঙ্গিবাদ, পারিবারিক মূল্যবোধ, অবসরে কী করে, সে বিষয়েও তরুণদের মতামত জানতে চাওয়া হয়

দেশে জঙ্গিবাদের উত্থানকে আর্থসামাজিক বিভিন্ন সমস্যার প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখছে দেশের তরুণ প্রজন্ম। জরিপে অংশ নেওয়া ৭৮ শতাংশের মতে, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা এবং অপব্যবহার করেও তরুণদের একটি অংশকে জঙ্গিবাদে আনা হচ্ছে। আবার বেকারত্ব ও দারিদ্র্য তরুণদের জঙ্গিবাদের পথে টেনে নিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে বলেও মনে করে ৭২ শতাংশ তরুণ।

এ ছাড়া ৪৯ শতাংশ তরুণের ধারণা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, সামাজিক ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতি ও অশিক্ষার মতো বিষয়গুলো জঙ্গিবাদ উসকে দিতে প্রভাবকের ভূমিকা রাখছে।

জরিপে তরুণদের কাছে জঙ্গিবাদের উত্থানের কারণ জানতে চাওয়া হয়েছিল। মোটা দাগে তরুণদের জবাবকে তিনটি বিষয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেমন অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক। বেকারত্ব ও দারিদ্র্যকে তরুণেরা জঙ্গিবাদ বৃদ্ধির অর্থনৈতিক কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। ধর্মের অপব্যবহার ও ভুল ব্যাখ্যা, ইসলাম ধর্মের সমালোচনা, মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে দেখা হয়েছে জঙ্গিবাদের ধর্মীয় দিক হিসেবে। আর মূল্যবোধের অবক্ষয়, সামাজিক ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতি ও অশিক্ষাকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে সামাজিক দিক থেকে।

গত নব্বইয়ের দশক থেকেই দেশে জঙ্গিবাদের প্রসার দেখা যাচ্ছিল। তবে গত বছরের ১ জুলাই গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার ঘটনার পর থেকে তা নতুন মাত্রা লাভ করেছে। এর আগে দরিদ্র ও কম শিক্ষিতদের মধ্যে জঙ্গিবাদের প্রসার দেো গেলেও এখন শিক্ষিত এবং অবস্থাপন্ন ঘরের তরুণেরা এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এসব জঙ্গিগোষ্ঠীর কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ধর্মকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা দিয়ে তরুণদের একটি অংশকে বিভ্রান্ত করে উগ্রপন্থায় আনা হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে জরিপে তরুণদের কাছেই জানতে চাওয়া হয়েছিল জঙ্গিবাদের প্রসার নিয়ে তাদের ভাবনা।

বেকারত্ব ও দারিদ্র্য বড় কারণ

এক-তৃতীয়াংশ তরুণ জানিয়েছে, কাজ করার সামর্থ্য থাকার পরও বেকার জীবনযাপনের হতাশা থেকে অনেকে জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছে। বেকারত্বের কারণে যে জঙ্গিবাদ সবচেয়ে বেশি বাড়ছে, এ বিষয়ে শহর, গ্রাম, ছেলেমেয়ে—সব শ্রেণির তরুণ একমত।

জরিপের তথ্য বলছে, রংপুর ও সিলেট বিভাগের তরুণেরা বেকারত্বকে জঙ্গিবাদের সবচেয়ে বড় কারণ মনে করে। রংপুর বিভাগের ৫৬ শতাংশ ও সিলেট বিভাগের ৪৮ শতাংশ তরুণ বিষয়টিকে জঙ্গিবাদ প্রসারের মূল কারণ মনে করে। এমনটি ভাবার প্রবণতা খুলনা ও বরিশাল বিভাগের তরুণদের মধ্যে বেশ কম, যথাক্রমে ১৩ ও ৭ শতাংশ।

নানা দিক থেকে বেকারত্বকে তরুণেরা দুশ্চিন্তার কারণ বলে মনে করলেও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশে বেকারের সংখ্যা এখন প্রায় ২৬ লাখ। তবে যাঁরা সপ্তাহে এক ঘণ্টাও কাজ করার সুযোগ পান না, তাঁদের বেকার হিসেবে ধরা হয়। এর বাইরে দেশে আরও ৮৬ লাখ মানুষ আছেন, যারা পরিবারে কাজ করেন কিন্তু কোনো মজুরি পান না। বিবিএসের জরিপই এখন বলছে, দেশে কাজের সুযোগ কম তৈরি হচ্ছে। এসব কারণে বেকারত্বের বিষয়টি জরিপে বারবার উঠে এসেছে।

বেকারত্বের পর জঙ্গিবাদ বৃদ্ধির বড় কারণ হিসেবে দারিদ্র্যকে উল্লেখ করেছে তরুণেরা। ২৮ শতাংশ তরুণের মতে, বেকারত্ব ও দারিদ্র্য পরস্পর সম্পর্কিত। বেকার থাকার কারণে অনেক তরুণ দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না, এর ফলে তাদের একটি অংশ জঙ্গিবাদের মতো ভুল পথে চলে যাচ্ছে। বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের কারণে তৈরি হওয়া হতাশা থেকেও অনেকে জঙ্গিবাদে চলে যাচ্ছে বলে মনে করে ৬ শতাংশ তরুণ।

দারিদ্র্যকে জঙ্গিবাদ প্রসারের সবচেয়ে বড় কারণ মনে করে চট্টগ্রাম বিভাগের তরুণেরা (৩৯ শতাংশ)। খুলনা, রংপুর, বরিশাল ও ময়মনসিংহ বিভাগে এমন মতামত দিয়েছে ২০ থেকে ২৪ শতাংশ তরুণ। আবার শহরের চেয়ে গ্রামের তরুণেরা জঙ্গিবাদ বিস্তারে দারিদ্র্যকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। শহরের ২৩ শতাংশ তরুণ দারিদ্র্যকে জঙ্গিবাদ প্রসারের মূল কারণ মনে করে, গ্রামে এমনটি মনে করে ৩০ শতাংশ। লিঙ্গভেদে মেয়েদের চেয়ে ছেলেরা দারিদ্র্যকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত বলেন, অর্থনৈতিক বৈষম্য যখন সমাজে বাড়তে থাকে, তখন এটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে তরুণদের। বেকার তরুণ তো বটেই, যিনি এখন একটি চাকরি করেন তিনিও এই বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য হতাশ তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি করছে।

ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা ও অপব্যবহার

জরিপে ৫৮ শতাংশ তরুণ বলেছে, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা ও অপব্যবহারের কারণে জঙ্গিবাদ বাড়ছে। এর মধ্যে ৩৩ শতাংশ ধর্মের অপব্যবহারের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়েছে আর ২৫ শতাংশ জোর দিয়েছে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যার বিষয়টিকে। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারকেও তরুণদের একটি অংশ জঙ্গিবাদ বৃদ্ধির কারণ মনে করে। তাদের মতে, ইসলাম ধর্ম নিয়ে দেশে ও দেশের বাইরে অনেক সমালোচনা আছে, যেগুলো সঠিক নয়। এসব নেতিবাচক প্রচারণার জবাব দিতে গিয়ে অনেক তরুণ জঙ্গিবাদের মতো চরমপন্থায় আকৃষ্ট হয়। মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার কারণেও একটি অংশ জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছে বলে কিছু তরুণ (৪ দশিমক ৬ শতাংশ) মতামত দিয়েছে।

চট্টগ্রাম বিভাগের তরুণেরা ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা ও অপব্যবহারকে জঙ্গিবাদ প্রসারের প্রধান কারণ মনে করে। চট্টগ্রামে ৩৯ থেকে ৪৮ শতাংশ তরুণ বিষয়টিকে বড় সমস্যা মনে করে। তবে রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, ময়মনসিংহের তরুণেরা ধর্মের ভুল ব্যবহারকে তত বড় সমস্যা মনে করে না। এই তিন বিভাগের ২৩ থেকে ১৯ শতাংশ তরুণ ধর্মকে জঙ্গিবাদ বৃদ্ধির কারণ মনে করে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রিয়াজ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে পরিবার, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি সব ক্ষেত্রে তরুণদের অংশগ্রহণের সুযোগ ও সম্ভাবনা সীমিত হয়ে আসছে। এতে করে তরুণদের মধ্যে নিরাপত্তার অভাব অনুভূত হচ্ছে। বর্তমান রাজনীতি ও অর্থনীতি তরুণদের সামনে কোনো আদর্শ তৈরি করছে না। এসব সমস্যা যতই অস্বীকার করা হবে, ততই এগুলো বাড়তে থাকবে। কারণ বিচ্ছিন্ন মানুষই উগ্রপন্থা গ্রহণ করে।

সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও অশিক্ষা

অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় কারণের পাশাপাশি তরুণদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে জঙ্গিবাদ বাড়ছে কি না। উত্তরে ১৮ শতাংশ তরুণ বলেছে, সামাজিক মূল্যবোধের ধারাবাহিক অবক্ষয় ও অশিক্ষা বা ভুল শিক্ষার কারণে জঙ্গিবাদ বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে গ্রাম ও শহরের তরুণদের মত একই রকম। মূল্যবোধের অবক্ষয়ের পাশাপাশি সামাজিক ন্যায়বিচারের অভাবের কারণে জঙ্গিবাদ বাড়ছে এমনটি মনে করে ১২ শতাংশ তরুণ।

সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও অশিক্ষাকে জঙ্গিবাদের উত্থানের প্রধান কারণ মনে করে ১৮ থেকে ১৯ শতাংশ তরুণ। এ ক্ষেত্রে গ্রাম ও শহরের তরুণদের মতামত একই রকম। সামাজিক ন্যায়বিচারের অভাবের কারণে জঙ্গিবাদ বাড়ছে এমনটি মনে করে ১২ শতাংশ তরুণ। মেয়েদের চেয়ে ছেলেরা শিক্ষার অভাবকে জঙ্গিবাদ বৃদ্ধির বেশি গুরুত্বপূর্ণ কারণ মনে করে।

বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞদের ‘জার্নাল ফর ডির‍্যাডিক্যালাইজেশন’ নামে একটি অনলাইন প্রকাশনা রয়েছে। তাতে কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবার পিএইচডি গবেষক আজিজুর রহমানের ‘বাংলাদেশে ইসলামি জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের ধরন এবং কার্যক্রম’ শীর্ষক একটি গবেষণাধর্মী লেখা রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, দারিদ্র্য, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য, রাজনৈতিক দোষারোপের সংস্কৃতি, অস্ত্রের সহজলভ্যতার কারণে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বাড়ছে। গবেষণাধর্মী এই লেখায় বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে গবেষণায় গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, এনজিও, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করে একটি সমন্বিত কর্মকৌশল বাস্তবায়নের পরামর্শ এবং তরুণদের আকর্ষণে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো যে মতবাদ ও কর্মকৌশল ব্যবহার করে, সেগুলো চ্যালেঞ্জ করে বিপরীত মতবাদ প্রকাশে গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে।

অর্থনৈতিক কারণ

বেকারত্ব ৩৭.৩%

দারিদ্র্য ২৭.৮

হতাশা ৬.৪

ধর্মীয় কারণ

ভুল ব্যবহার ৩২.৮%

অপব্যাখ্যা ২৫

সমালোচনা ৮.৭

সামাজিক কারণ

মূল্যবোধের অবক্ষয় ১৭.৬%

ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতি ১২.৪

অশিক্ষা ১৯.২