নির্ধারিত সময়ে সালাত আদায়ের গুরুত্ব

“নিশ্চয়ই সালাত মু’মিনদের জন্য উল্লিখিত সময়ে ফরয।” [সূরা আন-নিসা : ১০৩]

এ সম্পর্কে ইমাম আল-বুখারী (রহ.) বলেন :

“উল্লিখিত সময় হলো নির্ধারিত (সময়)। তিনি সালাতের জন্য সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন।”

আবু আম্‌র আশ-শাইবানী থেকে বর্ণিত : এই ঘরের মালিক (আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদের ঘরের দিকে ইশারা করে) বলেছেন : আমি রাসূলকে (সা) জিজ্ঞাসা করেছিলাম : কোন ‘আমলটি আল্লাহ্‌র নিকট সর্বাধিক প্রিয়?’ তিনি (সা) উত্তরে বলেছিলেন : “যথা সময়ে সালাত (আদায় করা)।” তারপর তিনি জানতে চাইলেন : তারপর কী?’ তিনি (সা) বলেন : “বাবা-মায়ের সাথে ন্যায়নিষ্ঠ আচরণ করা।” তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তারপর কী?’ তিনি (সা) বললেন : “আল্লাহ্‌র রাস্তায় জিহাদ করা।” এসব বলার পর তিনি (আব্দুল্লাহ) বলেন : আমি আরও জানতে চাইলে তিনি (সা) আমাকে আরও বলতেন। [বুখারী, খণ্ড : ৮, অধ্যায় : ৭৩, হাদীস : ১]

এই হাদীসে রাসূল (সা) সুস্পষ্ট করেছেন যে, নির্ধারিত সময়কে সালাত আদায় করা আল্লাহ্‌র কাছে সর্বাধিক প্রিয় ‘আমল। এই ‘আমলটিকে তিনি (সা) বাবা-মায়ের সাথে সদ্ব্যবহার করা এবং আল্লাহ্‌র রাস্তায় জিহাদ করার ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন। এর প্রমাণ হলো হাদীসে ‘তারপর কী?’ ক্রমবাচক পদবাচ্যের ব্যবহার। এই শব্দগুচ্ছটি গুরুত্বের ক্রম বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয় এবং আরবি ভাষাভাষীদের কাছে বিষয়টি সুপরিচিত।

আল-হাফিয ইবনু হাজার তার ‘আল-ফাত্‌হ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন : “ইবনু বাযীযা বলেছেন : এক্ষেত্রে যা লক্ষণীয় তা হলো, সকল দৈহিক প্রচেষ্টার মধ্য থেকে জিহাদকে সর্বাগ্রে স্থান দেওয়া, কারণ এতে আত্মত্যাগের বিষয়টি জড়িত। তবে ধৈর্য ধারনের বিষয়টি এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। কারণ ফরজ সালাতগুলোকে রক্ষা করা, সেগুলোকে সঠিক সময়ে আদায় করা এবং নিজের মা-বাবার সাথে উত্তম আচরণ করার বিষয়টি ধৈর্যের সাথে সংশ্লিষ্ট যা একটি সার্বক্ষণিক বিষয়। সত্যবাদীরা (সদীকূন) ব্যতীত অন্যকেউ আল্লাহ্‌র আদেশ পালনের ক্ষেত্রে সার্বক্ষণিকভাবে ধৈর্যশীল থাকতে পারে না। আর আল্লাহ্‌ সকল বিষয়ে সর্বজ্ঞ।”

বিষয়টি সুস্পষ্ট করার জন্য আমি এখানে একটি দৃষ্টান্ত পেশ করতে চাই :
ধরুন, এক ব্যবসায়ী তার ব্যবসা-বাণিজ্য এবং লেনদেন নিয়ে সারাদিন মশগুল থাকেন। শয়তানের প্ররোচনায় এই লোক প্রায়ই জামা‘আতে সালাতের তাকবীরাতুল ইহ্‌রাম (সালাতের প্রথম তাকবীর) অথবা সালাতের অংশবিশেষ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এমতাবস্থায় আপনি সেই লোকের কাছে আল্লাহ্‌র রাস্তায় জিহাদের মর্যাদা এবং সাহাবাদের বীরত্বগাঁথা সম্পর্কিত কুরআন এবং হাদীসের দলীল নিয়ে হাজির হলেন। তার মনে জান্নাত লাভের আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করে দিলেন। ফলে পৃথিবীর প্রতি তার বিতৃষ্ণা জন্ম নিল। আপনার সতর্কবাণী শোনার পর সেইলোক পৃথিবী নিয়ে ভাবলেন এবং পৃথিবী তার কাছে তুচ্ছ ও নগণ্য মনে হলো। তিনি পরকাল নিয়ে ভাবলেন যা তার কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদার মনে হলো। তাই তিনি সেই জান্নাতের পথে ছুটে এলেন যার বিশালত্ব পৃথিবী ও আকাশসমূহের বিশালত্ব। দেরি না করে তিনি তার ইচ্ছাপত্র লিখে ফেললেন, সবার দেনাপাওনা মিটিয়ে দিলেন, পরিবার পরিজনের কাছে বিদায় নিলেন এবং আল্লাহ্‌র রাস্তায় জিহাদের জন্য ময়দানে গেলেন। সেখানে নিহত হলেন এবং আল্লাহ্‌র রাস্তায় শহীদ হয়ে গেলেন।

ওই লোককে আল্লাহ্‌র রাস্তায় জিহাদ করার জন্য না ডেকে, তাকে যদি তার সালাত হেফাজতের জন্য এবং তার মধ্যে অনুপ্রেরণা সৃষ্টির জন্য কুরআন-হাদীসের দলীল পেশ করতেন, এমন কোনো গল্প বলতেন যা তার মনে ভয় সৃষ্টি করত এবং তার মনকে প্রভাবিত করত, তাহলে সে ক্ষেত্রে কী ঘটত বলে আপনার মনে হয়?

হয়তো তাতে কাজ হতো; তিনি হয়তো সালাতের প্রতি তার অবহেলার কারণে অনুতপ্ত হতেন এবং তাওবা করতেন। হয়তো নিজের সালাত হেফাজতের ব্যপারে এবং সঠিক সময়ে সালাত আদায়ের ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প করতেন। হয়তো কিছুদিনের জন্য সেই সংকল্পের বাস্তবায়ন করতেন। কিন্তু তারপর আবার শয়তান আসবে এবং তাকে কুমন্ত্রণা দেবে; আবার তার ব্যবসা-বাণিজ্য ও লেনদেনের ব্যস্ততা বাড়বে; সভা-সমাবেশ, মানুষের সাথে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা ইত্যাদির চাপ সমান তালে বাড়তে থাকবে। ফলে শয়তান যা চায়, আবারও তা-ই ঘটবে। আবার তার সালাতে বিচ্যুতি আসবে। শয়তান থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য আবার তিনি নিজের আত্মার বিরুদ্ধে জিহাদ করবেন। আবার শয়তান দ্বারা প্ররোচিত হবেন এবং পূর্বের ন্যায় শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদে লিপ্ত হবেন; প্রতিদিন পাঁচবার করে এই জিহাদ অনুষ্ঠিত হবে। এভাবে জীবনের প্রতিটি দিন… আর জীবন তো কেবল কয়েকটি দিনের সমষ্টি ছাড়া আর কিছু নয়।

এই দৃষ্টান্তটি নাফ্‌সের (কুপ্রবৃত্তির) বিরুদ্ধে জিহাদ। আবার পূর্বের দৃষ্টান্তটিও নাফ্‌সের বিরুদ্ধে জিহাদ। তবে প্রথমটির সাথে দ্বিতীয়টির অবস্থানগত পার্থক্য রয়েছে। দ্বিতয়টি হচ্ছে তিল তিল করে জীবনের শেষদিন অবধি জিহাদ করে যাওয়া; আর প্রথমটি হয়তো কয়েকঘণ্টা, কয়েকদিন বা কয়েকমাস কিংবা কয়েক বছরের জন্য। তবে দুটির যেটিই হোক, আমার মতে উভটিতেই কল্যাণ রয়েছে।

আল্লাহ্‌র কাছে দো‘আ করি তিনি যেন আমাকে সালাত ও এর খুশূ‘ (বিনম্রতা) হেফাজতকারীদের অন্তর্ভুক্ত করেন, পাশাপাশি তাঁর প্রতিটি নির্দেশ পালনে সক্ষম করেন এবং আমাকে শহীদদের অন্তর্ভুক্ত করেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাবান।

মিস‘আব ইবনু সা‘আদ বলেন : আমি আমার বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম : ও বাবা! “যারা তাদের সালাতের ব্যাপারে উদাসীন।” (১০৭ : ৫) — এই আয়াত সম্পর্কে আপনার ব্যাখ্যা কী? আমাদের মধ্যে কারা উদাসীন? আমাদের মধ্যে কে (সালাতের মধ্যে) তার আত্মার সাথে কথা বলে না? তিনি বললেন : এর দ্বারা তেমনটি বোঝানো হয়নি। এর দ্বারা সালাতের (নির্ধারিত) সময়কে বোঝানো হয়েছে। মানুষ অযথা সময় নষ্ট করে যতক্ষণ না সালাতের সময় অতিক্রান্ত হয়ে যায়। [আবূ ইয়া‘লা থেকে হাসান সূত্রে বর্ণিত। আরও দেখনু : সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হাদীস : ৫৭৫]

মূসা ইবনু ইসমা‘ঈল বলেন : আনাস থেকে গাইলান থেকে মাহ্‌দি বর্ণনা করেন যে : “একবার আনাস (রা) অনুপাত এবং আক্ষেপ করে বললেন, নবীর (সা) সময়ে যে সমস্ত (‘আমল) দেখেছিলাম এখন তার একটিও দেখতে পাই না। এক ব্যক্তি বললেন, সালাত এখন বাকি আছে। আনাস (রা) বললেন, দেখো না! কীভাবে সালাতকে বিনষ্ট করেছ?” [আল-বুখারী, খণ্ড : ১, অধ্যায় : ৭ “ওয়াক্ত মতো সালাত আদায় না করা সালাতকে বিনষ্ট করা”, হাদীস : ৩২৫]

এখানে তিনি মূলত সালাতের নির্ধারিত সময় পার করে দিয়ে অসময়ে সালাত আদায়ের বিষয়ে কথা বলছেন।

আব্দুল ‘আযীযের ভাই, উসমান ইবনু আবি রাউওয়াদ বলেন : আমি যুহরীকে বলতে শুনেছি : একবার দামেস্কে আনাস ইবনু মালিকের কাছে গিয়ে দেখলাম তিনি কাঁদছেন। তাই জিজ্ঞাসা করলাম : আপনি কাঁদছেন কেন? তিনি কিছুক্ষন থেমে বললেন : হায়! যা কিছু দেখেছিলাম এখন তার কিছুই দেখছি না। এমনকি এই সালাতকেও নষ্ট করা হচ্ছে। [আল-বুখারী, খণ্ড : ১, অধ্যায় : ৭ “ওয়াক্তমতো সালাত আদায় না করা সালাতকে বিনষ্ট করা”, হাদীস : ৩২৬]

‘ফাতহুল বারী -তে ইবনু হাজার (রহ.) বলেছেন : আল-মুহাল্লিব বলেছেন : ‘নষ্ট করা হচ্ছে’ এর অর্থ হলো উত্তম এবং নির্দেশিত সময় থেকে বিলম্ব করা। এর অর্থ এই নয় যে, তারা ওয়াক্ত শেষ হওয়ার পর সালাত আদায় করতেন।’ ইবনু হাজার এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন এবং বলেছেন, এর অর্থ হলো মূলত ওয়াক্ত শেষ হয়ে যাওয়ার পর সালাত আদায় করা।

আমার মতে, কবি সত্য কথায় বলেছেন :

“আমি বলি দুটোই তিতা, দুটোর মধ্যে যেটা সামান্য মিষ্টি সেটাও মূলত তিতাই।”

আনাস (রা) এই ব্যাপারে কান্নাকাটি করতেন আর আমরা কী করছি? আমাদের ক্ষেত্রে কী করা বাঞ্ছনীয়? সালাতের প্রতি অবহেলার জন্য এবং আল্লাহ্‌র অন্যান্য বিধিবিধানের বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য আমাদের কি চোখের জলে নদী হয়ে যাওয়া উচিত নয়?

উবাদাহ ইনবু সামিত (রা) বলেন : আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমি আল্লাহ্‌র রাসূলকে (সা) বলতে শুনেছি : “আল্লাহ্‌ (আয্‌যা ওয়া জাল্লা) পাঁচ ওয়াক্ত সালাতকে বাধ্যতামূলক করেছেন। যে ব্যাক্তি তার অযুকে সুন্দর করে, নির্ধারিত সময়ে সালাত আদায় করে এবং খুশূ‘ সহকারে রুকূ‘ ও সেজ্‌দা সম্পন্ন করে, তার সাথে আল্লাহ্‌র অঙ্গীকার হলো তিনি তাকে ক্ষমা করে দেবেন। আর যে ব্যাক্তি তা করলো না, আল্লাহ্‌র সাথে তার তেমন কোনো অঙ্গীকার নেই। আল্লাহ্‌ চাইলে তাকে ক্ষমাও করতে পারেন, আবার চাইলে তিনি তাকে শাস্তিও দিতে পারেন। [মালিক, আবূ দাঊদ এবং আন নাসা‘ঈ কর্তৃক সংকলিত। ইবনু হিব্বান এটিকে সহীহ বলে মত দিয়েছেন। সহীহুত তারগীব ওয়াত-তাহ্‌রীব (হাদীস : ৩৯৬) গ্রন্থেও রয়েছে]

কা‘ব ইবনু উজ্‌রা (রা) বলেন : আল্লাহ্‌র রাসূল (সা) আমাদের কাছে এলেন এবং আমরা ছিলাম ৭ জনের একটি দল। আমাদের চারজন ছিল মুক্তিপ্রাপ্ত গোলাম আর বাকিরা আগে কখনো গোলাম ছিল না। আমরা মসজিদের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে ছিলাম এবং তিনি (সা) বললেন : “তোমরা বসে আছো কেন?” আমরা বললাম : আমরা সালাতের জন্য অপেক্ষা করছি। তিনি (কা‘ব) বললেন : তখন তিনি (সা) কিছুক্ষন চুপ করে থাকলেন এবং আমাদের দিকে ফিরে বললেন : “তোমাদের রব কী বলেছেন তা কি তোমরা জানো?” আমরা বললাম : “না।” তিনি (সা) বললেন : “নিশ্চয়ই তোমাদের রব বলেছেন : যে সঠিক সময়ে সালাত আদায় করে, ধারাবাহিকভাবে সালাতের হেফাজত করে এবং এর সত্যিকার গুরুত্বকে নগণ্য ভেবে একে বিনষ্ট না করে, তার সাথে আমার অঙ্গীকার হলো আমি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবো। আর যে ব্যক্তি সঠিক সময়ে সালাত আদায় করে না, ধারাবাহিকভাবে সালাতের হেফাজত করে না এবং এর সত্যিকার গুরুত্বকে নগণ্য ভেবে একে বিনষ্ট করে, তার সাথে আমার কোনো অঙ্গীকার নেই। আমি চাইলে তাকে ক্ষমা করে দেবো আর চাইলে তাকে শাস্তি দিবো।” [আত-তাবারানী কর্তৃক আল-কাবীর গ্রন্থে এবং আহ্‌মাদ কর্তৃক আল-আওসাত গ্রন্থে বর্ণিত। সহীহুত তারগীব ওয়াত-তাহ্‌রীব (হাদীস : ৩৯৭) গ্রন্থেও রয়েছে।]

আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রা) বলেন : একদিন নবী (সা) তাঁর সাহাবীদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বললেন : “তোমরা কি জানো, তোমাদের রব (সুবহানাহু ওয়া ত‘আলা), কী বলেছেন?” আমরা বললাম : আল্লাহ্‌ এবং তাঁর রাসূল (সা) ভালো জানেন। আল্লাহ্‌র রাসূল (সা) একথা তিনবার বলেন। অতঃপর বললেন : “আমার ক্ষমতা ও মহত্ত্বের কসম! যথা সময়ে সালাত আদায়কারী প্রত্যেককে আমি জান্নাতে প্রবেশ করাবো। আর যে নির্ধারিত সময়ের বাইরে অন্য কোনো সময় সালাত আদায় করবে, আমি তার প্রতি দয়াও করতে পারি আবার তাকে শাস্তিও দিতে পারি।” [আত-তাবারানী কর্তৃক আল-কাবীর গ্রন্থে বর্ণিত। সহীহুত তারগীব ওয়াত-তাহ্‌রীব (হাদীস : ৩৯৮) গ্রন্থেও রয়েছে।]

দারিদ্র্য নির্মূলে সাফল্য আর উদ্ভূত চ্যালেঞ্জসমূহ

অতি সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে কর্মরত সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড. শামসুল আলমের এ-সংক্রান্ত একটি লেখা দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়েছে। এতে তিনি দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের সাফল্যগুলো সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন যা প্রশংসনীয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, টেকসই সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাধ্যমে গ্রামীণ জনপদে সর্ব ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ যার ফলশ্রুতিতে উল্লেখযোগ্য হারে দারিদ্র্যের হার কমে বর্তমান দাঁড়িয়েছে ২২.৩ শতাংশ আর চরম দারিদ্র্য নেমে এসেছে ১৩ শতাংশে। প্রবন্ধকার আরও উল্লেখ করেছেন যে রূপকল্প ২০২১ এবং জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এস.ডি.জি) অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে।

এই সব অর্জনের পরও দেখা যায় যে নৈতিক অর্থনীতির বিষয়টি এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে অর্থাত্ নৈতিকতার ভিত্তিতে পরিচালিত অর্থনীতির সূচকগুলো অনেকাংশে ফলদায়ক হচ্ছে না— যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ধনী-গরিবের বৈষম্যের মাধ্যমে। এর প্রমাণ পাওয়া যাবে সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখান ব্যুরো (বিবিএস) এর খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০১৬ এর ফলাফলে। ফলাফলটি এ রকম যে জনগোষ্ঠীর নিচের পাঁচ শতাংশের আয় ক্রমাগত কমছে, স্ফীত হচ্ছে মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্ত। যার ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুবিধা পাচ্ছে না দরিদ্র শ্রেণি।

প্রবন্ধকার আরও বলেছেন যে এই অবস্থার উন্নতিকল্পে যা করা প্রয়োজন তার মধ্যে রয়েছে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধি, সামাজিক সুরক্ষার পরিধি বাড়ানো, সর্বক্ষেত্রে সুশাসন তথা জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা, কর আদায়ের প্রসার, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের মাধ্যমে তরুণদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সেবা পেতে ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ করা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো ইত্যাদি। কিন্তু কীভাবে এই সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা হবে তার কোনো রোডম্যাপ তিনি দেননি।

এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার সফলতার সঙ্গে টেকসই দারিদ্র্য বিমোচন কিংবা নিরসনের বিষয়টি সম্পর্কযুক্ত। কারণ পরিসংখ্যান বলছে, দেশে গড়ে দারিদ্র্য কমছে ১.৪ শতাংশ হারে, অপরদিকে জনসংখা বাড়ছে গড়ে ১.৬ শতাংশ হারে— যার সঙ্গে দারিদ্র্য বাড়া/কমার একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তা ছাড়াও সাম্প্রতিককালে চাল, লবণ, পেঁয়াজ, ডালসহ ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির ফলে দেশের পাঁচ লাখ পরিবারের দারিদ্র্য বেড়েছে। পাশাপাশি গত বছরের মার্চ মাসে হাওর অঞ্চলের ৭টি জেলার বোরো ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হওয়ায়— বিশেষত সব ধরনের পরিবারে খাদ্য নিরাপত্তা, জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে যার সঙ্গে দারিদ্র্যের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। আবার দেশের পূর্বাঞ্চলে গত জুন-জুলাই মাসে উজান থেকে পানি প্রবাহ বিশেষত তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনার অববাহিকায় পানিপ্রবাহ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় উত্তরাঞ্চলের ৬টি জেলার কৃষি অর্থনীতি বিশেষত আমন ফসল, গবাদিপশু, মত্স্য সম্পদসহ বনসম্পদ নষ্ট হয়েছে যার বড় ভুক্তভোগী প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যা দারিদ্র্য বৃদ্ধির প্রবণতাকে উত্সাহ জোগায়।

এখন আবার জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শীতের তীব্রতা বেড়েছে অনেকাংশে যা দেশের এক-পঞ্চমাংশ বিশেষত সাড়ে তিন কোটি মানুষের স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করছে। কাজেই সরকারি তথ্য ছাড়াও নিরপেক্ষ গবেষণা বলছে, দারিদ্র্য কমার বিষয়টি কোনো টেকসই ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে তা দাবি করা যায় না। আবার কেউ বলছেন মানবীয় দারিদ্র্য (Human Poverty) অনেকাংশে আয় দারিদ্র্যকে (Income Poverty) ছাড়িয়ে গেছে যার যথাযথ সমাধান জরুরি। বিশেষত নৈতিক অর্থনীতির (Elthical economics) দিক থেকে। প্রবন্ধকার নিজেও বলেছেন বা স্বীকার করেছেন ধনী-গরিবের বৈষম্য বেড়েছে, উচ্চ প্রবৃদ্ধি হলেও তার সুফল দরিদ্র শ্রেণি পাচ্ছে না, ন্যায্য বণ্টন হচ্ছে না। এই অবস্থায় বৈষম্য কমাতে দরিদ্র শ্রেণির আয় বাড়াতে হবে কীভাবে? সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে Trickle down effect এর প্রভাব এখনও রয়েছে।

বাংলাদেশে বর্তমানে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের আওতায় রয়েছে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৬ শতাংশ যার সিংহভাগ হলো যুবক— যাদের বয়স ১৮-৪০ বছর। তাদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিতের সংখ্যা (বিবিএ, এম.বি.এ ডিগ্রিধারী) অনেক—যারা কর্মসংস্থানের অপেক্ষায় দিন গুনছে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকারি কিংবা বেসরকারি খাতে চাকুরির বাজার খুবই প্রতিযোগিতাপূর্ণ, আবার সুযোগ সংকীর্ণ। ফলে স্বনিয়োজিত কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রটি খোলা আছে তাদের জন্য যারা উদ্যোগকে পেশা হিসাবে বেছে নিতে চায়। কিন্তু পরিবেশ সহায়ক কি? যদি না থাকে তবে তৈরি করতে হবে। এর জন্য সরকারের নির্দেশনায় সরকারি/বেসরকারি অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সহজ শর্তে তহবিল জোগানোর ব্যবস্থা করবে। কমাতে হবে প্রশাসনিক জটিলতা। পাশাপাশি বাড়াতে হবে উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ—বিশেষত উত্পাদনভিত্তিক কর্মসূচিতে। সুশাসন উন্নয়নের পূর্বশর্ত এবং এই উন্নয়নের ফসল জনগণের ঘরে উঠবে যদি ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ হয়। কিন্তু প্রশ্নটা হলো কীভাবে?

এখানেই আসে নৈতিকতার প্রশ্ন। কারণ স্বশাসন, গুরুর শাসন, পিতা-মাতার শাসন সবগুলোই শাসনের বিভিন্ন পর্যায় কিন্তু প্রশাসনের শাসন যার মধ্যে নির্বাহী বিভাগের শাসন ও আইনের শাসন আমাদের কর্মজীবনে বেশি প্রভাব ফেলছে। বিশেষত সেবা খাতে সেটা শিক্ষা, স্বাস্থ্য কিংবা যোগাযোগ যাই হোক না কেন। এই খাতগুলো সব সময় আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে থাকছে। কিন্তু কোনো সহজ সমাধান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। উন্নয়নের সুফল সরকার কিংবা জনগণ কারো কাছে যাচ্ছে না বরং চলে যাচ্ছে দুর্নীতি খাতে যা খুবই শক্তিশালী একটি বলয়।

২০১৭ সালের হিসাবে দেখা গেছে, জুলাই ডিসেম্বর পর্যন্ত কর প্রদানের সময় বদ্ধি, দেশ জুড়ে কর মেলার আয়োজন ইত্যাদির ফলে টিনধারী গ্রাহকের সংখ্যা গত ১৯১৬ সালের তুলনায় কিছু বেড়ে দাঁড়িয়েছে সরকারি হিসাবমতে ৩৩ লক্ষ কিন্তু আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছে তার অর্ধেক এবং সরকার এন.বি.আর. আইনে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। ফলে সরকার প্রতিবছরই তার আয়করের টার্গেট অর্জন করতে অপারগ হচ্ছে হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় যা দিয়ে সরকার ব্যয়ের খাতে আরও ভূমিকা পালন করতে পারত। এছাড়াও আর্থিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি খাতের অব্যবস্থা নিরসনে এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকার যদি কার্যকর পদক্ষেপ না নেয় তাহলে দেশের একটি বড় অংশ ক্রমাগতভাবে তাদের নিজের অবস্থান থেকে সরে নিম্নমুখে ধাবিত হবে।

এরজন্য প্রথম প্রয়োজন আইনের সফল প্রয়োগ। এর বাস্তবায়ন হলে মানুষ আইনের পথে চলবে আর আইন অমান্যকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া গেলে সমাজ এর থেকে অনেক শিক্ষা গ্রহণ করবে; ২) নৈতিক শিক্ষার প্রসার বা নৈতিক আচরণের দীক্ষা কেবল সরকারপ্রধানকে মানলেই চলবে না তার অনুসারীদেরও এতে আকৃষ্ট হওয়ার জাদু সৃষ্টি করতে হবে; ৩) দেশে কাজের কৃষ্টি সৃষ্টি করতে হবে অর্থনৈতিকভাবে যা হবে উত্পাদনমুখী, কর্মসৃজনমুখী, পরিবেশবান্ধব, আদর্শিক ও রপ্তানিমুখী। এখানে জাতি, ধর্ম, রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে সবার সমান প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে উন্নয়নের স্বার্থে; ৪) গণতন্ত্র উন্নয়নের পূর্ব শর্ত এবং উন্নয়ন টেকসই করতে হলে গণতন্ত্র চর্চা অর্থাত্ মূল্যবোধ চর্চা অবশ্যই শক্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে; ৫) মুক্তিযুদ্ধ আমাদেরকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দিয়েছে চারটি মূলনীতির ভিত্তিতে যেমন গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও জাতীয়তাবাদ।

বর্তমান সরকার এই চেতনায় বিশ্বাসী কিন্তু সমাজের সকল স্তরে এইগুলো প্রতিষ্ঠা করা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব বলে প্রতীয়মান। কিন্তু এ জায়গাটিতে দেশের সাফল্য ম্লান হয় বার বার। দেশে-বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। এতে দরিদ্র শ্রেণির লোকজন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় রাজনীতিতে নৈতিক বোধের চর্চা আরো বাড়ানো প্রয়োজন; ৬) ২০২১ সালের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীতকরণ এবং দারিদ্র্যের হার ১৩.৫ শতাংশ নামিয়ে আনার লক্ষ্য অর্জন করতে হলে আলোচিত চ্যালেঞ্জগুলো সাফল্যের সঙ্গে মোকাবেলা করতে হবে। তাহলেই অর্জিত সাফল্য অর্থবহ হবে। আবার এস.ডি.জি মতে ২০৩০ সালের মধ্যে অতি দারিদ্র্যের হার ৩ শতাংশে নামানোরও কথা রয়েছে এবং জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি ৮.৫ শতাংশ অর্জন করতে হবে। সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে যদি নৈতিকতার সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি কাঠামোতে কর্ম সম্পাদন হয় তবে অবশ্যই এ অর্জন সম্ভব।