উপমহাদেশের প্রথম রাজনৈতিক দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস আত্মপ্রকাশ করে ১৮৮৫ সালে। কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পরবর্তী একশ’ বছরে আরও অন্তত ২৫টি বড় রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। তার অনেকগুলোই এককভাবে অথবা কোয়ালিশন করে সরকার গঠন করেছে। অনেক দলই সরকার পরিচালনায় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার গত একশ’ বছরের ইতিহাসে মাত্র তিনটি দলের ভূমিকা ঐতিহাসিক; সেই তিন দল হলো কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও আওয়ামী লীগ। কংগ্রেসের নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জন করে ভারত, মুসলিম লীগের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তান এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার এবার ৭০ বছর পূর্তি।
বাঙালি নেতারাই যদিও পাকিস্তান আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রেখেছেন; নতুন রাষ্ট্রের শীর্ষনেতা হিসেবে জিন্নাহই পূর্ব বাংলার মানুষের মধ্যে অসন্তোষের জন্ম দেন। পূর্ব বাংলার জনসংখ্যা সমগ্র পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ। রয়েছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য। পাকিস্তানে যদি একটিমাত্র ভাষাকে সরকারি ভাষা বা রাষ্ট্রভাষা করা হয় তা হলে সেটা হবে বাংলা ভাষা। কিন্তু দ্বিখণ্ডিত পাকিস্তানে বাংলার মানুষ নিজস্ব বিবেচনা থেকে বাংলাকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেনি। তাদের প্রত্যাশা বাংলা হবে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। পনের শতাংশের কম মানুষের মুখের ভাষা উর্দুকে যদি পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে চান বাঙালির তাতে আপত্তি ছিল না। কিন্তু বাংলার মানুষের সঙ্গে কোনোরকম আলোচনা না করে কেন্দ্রীয় সরকার উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র করে। প্রাদেশিক সচিবালয়ে তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের পক্ষ থেকে শুরু হয় প্রথম প্রতিবাদ। এর মধ্যে জিন্নাহ স্বয়ং যখন ঘোষণা করেন ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালের শুরু থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু হয়ে যায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘আমাদের ভাষা আন্দোলনের সময় মওলানা সাহেব [ভাসানী] সমর্থন করেছিলেন। টাঙ্গাইলে যুবলীগ কর্মীদের এক সভা ডাকা হলো, কী করা যায় ভবিষ্যতে। আলোচনা হওয়ার পরে ঠিক হলো, আরেকটা সভা করা হবে নারায়ণগঞ্জে। সেখানে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হবে। মওলানা ভাসানী, আবদুস সালাম খান, আতাউর রহমান খান, শামসুল হক সাহেব আরও অনেক মুসলিম লীগ কর্মী ও নেতা যোগদান করবেন বলে ঠিক হলো।… সভার পূর্বে ১৪৪ ধারা জারি করা হলো। আমরা পাইকপাড়া ক্লাবে সভা করলাম। বিভিন্ন জেলার অনেক নেতাকর্মী উপস্থিত হয়েছিলেন।’ [পৃ. ১০১]
১৯৪৬ সালের নির্বাচনের আগে পাকিস্তানের সমর্থনে লীগের প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারণা চালানোর জন্য ঢাকার ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে একটি অফিস করা হয়েছিল। তার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’, দলীয় কর্মীরা সেখানে থাকতেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও লীগের কর্মীরা সেখানে থাকতেন। টাঙ্গাইলের যুবনেতা শামসুল হক সেখানে অনেকটা স্থায়ীভাবেই থাকতেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন জেলা থেকে আরও অনেক ছাত্র-যুবনেতা সেখানে আসেন। মওলানা ভাসানী ছিলেন আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি এবং আসাম প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য। টাঙ্গাইলের একটি শূন্য আসনে তিনি পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৮-এর ফেব্রুয়ারিতে তিনি পরিষদের বাজেট অধিবেশনে যোগ দেন। টাঙ্গাইল চারাবাড়ি ঘাট থেকে নৌকায় তিনি ঢাকা আসেন এবং সোয়ারীঘাটে নৌকাতেই তিনি রাতে থাকতেন। সারাদিন মোগলটুলী ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের অফিসে ছাত্র-যুবনেতাদের সঙ্গে কাটাতেন। নতুন রাষ্ট্রের সরকারের নেতাদের আচরণ নিয়ে তিনি তাদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। শামসুল হকের সঙ্গে তার আগেই ঘনিষ্ঠতা ছিল। ঢাকায় এসে নতুন ঘনিষ্ঠতা হয় আরেকজন ছাত্রনেতার সঙ্গে, তিনি শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি সাহসী ও তেজস্বী। তাকে মওলানার ভালো লাগে। শামসুল হক ও শেখ মুজিবকে তিনি অবিলম্বে আপন করে নেন। দেশের অবস্থা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা অব্যাহত আলোচনা করতেন।
মুখ্যমন্ত্রী স্যার খাজা নাজিমুদ্দিনের সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের তাঁবেদারে পরিণত হয়। বাজেট অধিবেশনের বক্তৃতায় ভাসানী বলেন, ‘আমরা কি সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের গোলাম? ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের গোলামি করি নাই। ন্যায়সঙ্গত অধিকারের জন্য চিরকাল লড়াই করেছি, আজও করব।’ দলের নেতা হয়ে তার এই জাতীয় বক্তৃতায় সরকার ক্ষুব্ধ হয়। নির্বাচনে তিনি অনিয়ম করেছেন, যথাসময়ে নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব দাখিল করেননি, এই অভিযোগে তার সদস্য পদ বাতিল করা হয়। ১৯৫০ পর্যন্ত তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না এই মর্মে নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার। এই আদেশ ছিল স্বৈরাচারী। পাকিস্তান আন্দোলনে লীগের নেতাকর্মী যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন, তারা সরকারের সামান্য সমালোচনা করলেও তাদের ওপর নেমে আসত নির্যাতন-নিপীড়ন, জেল-জুলুম।
শেখ মুজিব, শামসুল হককে নিয়ে ভাসানী বিভিন্ন জেলা সফর করেন। সরকারের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে তারা জনগণকে সচেতন করেন। এই সময় বিশেষভাবে ভাসানী ও শেখ মুজিব জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের জন্য ব্যাপক প্রচার চালান। তারা জনগণের আস্থা অর্জন করেন। তাদের সেই দিনগুলো ছিল অত্যন্ত কষ্টের। ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণির টিকিট কেনার টাকা ছিল না বলে ২৫-৩০ মাইল পথ তারা হেঁটে গেছেন জনসভা করতে।
১৯৪৯-এর মে মাস নাগাদ সরকার টের পায় যে লীগের বিদ্রোহী পক্ষ নতুন দল গঠন করতে পারে। এদিকে বিদ্রোহীরাও ভাসানী গ্রেফতার হতে পারেন এমন আভাস পেয়ে জুন মাসের মাঝামাঝি রোগী সাজিয়ে মওলানার গায়ে কাঁথা-কম্বল জড়িয়ে ১৫০ মোগলটুলী থেকে হাটখোলা ‘রোজ গার্ডেন’ নামক এক বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে তিন সপ্তাহ ঘরের ভেতরে থাকেন। ২৩ জুন সেখানে এক কর্মী সম্মেলনে আত্মপ্রকাশ করে একটি নতুন দল :’পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’।
কর্মী সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন আতাউর রহমান খান। মওলানা তখন পাশের ঘরে শুয়ে ছিলেন। সর্বসম্মতিক্রমে তাকে দলের সভাপতি করা হয় এবং তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় নতুন দলের পূর্ণাঙ্গ কার্যনির্বাহী কমিটির নাম ঘোষণার।
আতাউর রহমান খান এক সাক্ষাৎকারে জানান, ভাসানী ঘণ্টাখানেক পরে পাশের ঘর থেকে এসে পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যদের নাম ঘোষণা করেন। সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান, সহসভাপতি আতাউর রহমান খান, আবদুস সালাম খান, আলী আমজাদ খানসহ পাঁচজন এবং কোষাধ্যক্ষ ইয়ার মোহাম্মদ খান। যুগ্ম সম্পাদকের পদটির প্রত্যাশা ছিল খোন্দকার মোশতাক আহমদের, কিন্তু মওলানা তাকে এবং একে রফিকুল হোসেনকে করেন সহ-সম্পাদক, যে পদের বিশেষ গুরুত্ব নেই, মওলানার ওপর মোশতাক ক্ষুব্ধ হন।
শেখ মুজিব তখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি। তার অনুপস্থিতিতে তাকে যুগ্ম-সম্পাদক করায় অনেকেই অনেকটা অবাক হন। সপ্তাহখানেক পরে শেখ মুজিব মুক্তির আদেশ পান। যেদিন তিনি মুক্তি পাবেন সেদিন ভাসানী ইয়ার মোহাম্মদ খানের বাড়িতে ছিলেন। তিনি সকালবেলা কয়েকজন কর্মীকে বলেন, একটা ব্যান্ডপার্টির জোগাড় করতে। তারা জানতে চান ব্যান্ডপার্টি কেন? তিনি বলেন, ‘দরকার আছে।’
ব্যান্ডপার্টি নিয়ে ২০-৩০ জন কর্মীসহ মওলানা জেলখানার গেটে যান ঘোড়ার গাড়িতে। সেদিনের স্মৃতি বঙ্গবন্ধু তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন :
“আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন হওয়ার কয়েক দিন পরই আমার ও বাহাউদ্দিনের মুক্তির আদেশ এলো। জেলগেটে গিয়ে দেখি বিরাট জনতা আমাদের অভ্যর্থনা করার জন্য এসেছে মওলানা ভাসানী সাহেবের নেতৃত্বে।… জেলগেট থেকে বের হয়ে দেখি, আমার আব্বাও উপস্থিত। তিনি আমাকে দেখবার জন্য বাড়ি থেকে এসেছেন। আমি আব্বাকে সালাম করে ভাসানী সাহেবের দিকে এগিয়ে গিয়ে তাকেও সালাম করলাম।… জেলগেটে এই প্রথম ‘আওয়ামী লীগ জিন্দাবাদ’ হলো।” [অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১২১]
জেলগেট থেকে ব্যান্ডপার্টি নিয়ে ভাসানী ঘোড়ার গাড়িতে বসিয়ে শেখ মুজিবকে ঢাকার রাস্তা ঘোরান। আতাউর রহমান খান বলেন, সেদিন শেখ মুজিবের অভিষেক হয়ে গিয়েছিল।
চুয়ান্নর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রমাণ করে এটিই দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল। পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে এই দল আপসহীন। একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ স্বীকৃতি পায়। এক পর্যায়ে এই দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি উঠিয়ে দেওয়া হয়।
সত্তর বছরে আওয়ামী লীগের সুসময় এবং দুঃসময় দুই-ই ছিল অনেকবার। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে তো ছিলই, সরকারেও ছিল কয়েকবার। পঞ্চাশের দশকে বিরোধী দলে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে, ক্ষমতায়ও ছিল- কোয়ালিশনে এবং এককভাবে। দলের সভাপতি মওলানা ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব বারবার কারা নির্যাতন ভোগ করেছেন, যা অন্য কোনো দলের নেতাদের করতে হয়নি।
১৯৫৭-৫৮ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের রিপাবলিকান পার্টির সঙ্গে কোয়ালিশন করে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রে ক্ষমতায় যায়। আওয়ামী লীগ নেতা সোহরাওয়ার্দী হন প্রধানমন্ত্রী। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে আতাউর রহমান খানের মুখ্যমন্ত্রিত্বে। ওই সময় বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটে। অনেক প্রগতিশীল কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে।
সোহরাওয়ার্দী ছিলেন পশ্চিমী পুঁজিবাদের সমর্থক; কিন্তু তার সময়ই চীনের সমাজতান্ত্রিক সরকারের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। ভাসানী ছিলেন সাম্রাজ্যবাদের অবিচল সমালোচক এবং পশ্চিমা সামরিক জোটের ঘোর বিরোধী। দলের একটি প্রগতিশীল অংশও ছিল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। পঞ্চাশের দশকে ভাসানী ও বাম ঘরানার আওয়ামী লীগ নেতারা ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিয়েছেন। তাতে একটি মধ্যপন্থি প্রগতিশীল দল হিসেবে আওয়ামী লীগ দেশে ও বিদেশে প্রশংসিত হয়। কিন্তু কেন্দ্রের কায়েমি স্বার্থবাদীদের চক্রান্তে এবং পাকিস্তানের সামরিক-অসামরিক আমলাদের কারণে সামরিক শাসন জারি হয় ১৯৫৮ সালে জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খানের নেতৃত্বে। আওয়ামী লীগ সরকার তার মেয়াদ পূরণের আগেই ক্ষমতা হারায়। আবুল মনসুর আহমদ, শেখ মুজিবসহ বহু কেন্দ্রীয় নেতা কারারুদ্ধ হন।
১৯৬২-তে রাজনৈতিক কার্যক্রম নতুন করে শুরু হওয়ার পর আওয়ামী লীগের অবস্থান বিশেষ ভালো ছিল না। ১৯৬৩-তে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু আওয়ামী লীগের জন্য ছিল এক বড় আঘাত। শেখ মুজিব দলকে সাবলীলভাবে ধরে রাখেন। তার ওপর নেমে আসে নানারকম নির্যাতন-নিপীড়ন। একের পর এক নির্যাতনমূলক মামলা দায়ের করা হয় তার বিরুদ্ধে। ভয়ে অনেক প্রবীণ নেতা দল ছেড়ে যান। তারা হয় নিষ্ফ্ক্রিয় থাকেন অথবা নতুন দল গঠন করেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত আওয়ামী লীগের অবস্থা ছিল বিপন্ন। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের কাণ্ডারি হন। তার অতুলনীয় সাংগঠনিক ক্ষমতার ফলে দল সুসংবদ্ধ থাকে।
বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলার ‘মুক্তির সনদ’ ছয় দফা ঘোষণার পর তার ওপর আঘাতের পর আঘাত আসতে থাকে। আগরতলা মামলায় তাকে করা হয় প্রধান অভিযুক্ত। বাংলার মানুষ আইয়ুব-মোনায়েমের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। বঙ্গবন্ধু জনগণনন্দিত নায়কে পরিণত হন। তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দলে পরিণত হয়।
আওয়ামী লীগের প্রধান গুণ যে কোনো পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দলটি খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে। চারটি সামরিক শাসনের সময় আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিয়েছে এবং প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছে। ষাটের দশকে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছে এবং রাজপথে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনও করেছে।
ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনের মধ্যে ১৯৭০-এ নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ ইতিহাস সৃষ্টি করে। তখনই দলের ওপর এসেছে সবচেয়ে বড় আঘাত। আওয়ামী লীগও প্রত্যাঘাত করেছে। আওয়ামী লীগের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে সফল নেতৃত্ব দান। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের অজ্ঞাত কারাগারে নিয়ে বন্দি করা হয়। তাকেই রাষ্ট্রপতি করে গঠিত হয় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে প্রবাসী সরকার। স্বাধীনতার পর অল্প সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর সরকার একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করে।
সত্তর বছর বয়সী আওয়ামী লীগের তিনটি পর্যায়। প্রথম আট বছর নেতৃত্ব দেন মওলানা ভাসানী, তার প্রধান সহকর্মী ছিলেন শেখ মুজিব। সেটি ছিল আওয়ামী লীগের উত্থানপর্ব। দ্বিতীয় পর্বে ষাটের দশক থেকে আমৃত্যু নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। আশির দশকে তৃতীয় পর্বের শুরু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। সত্তরের সামরিক শাসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। দলে কোনো বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ছিল না। আওয়ামী লীগের অনেক প্রধান নেতা ছিলেন কারাগারে, শেখ হাসিনা দেশে ফিরে দলের সব উপদলকে একত্রিত করেন। আশির দশকে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত হয় যে জোট তা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। তিনিসহ বহু নেতা জেলজুলুম ভোগ করেন।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। ১৯৯১’র নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে না পারলেও তার দল সবচেয়ে বেশি ভোট পায়। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে দিয়ে তিনি সংবিধান সংশোধন করিয়ে সংসদীয় পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তন করতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। ১৯৯৬-তে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেন এবং অনেকগুলো প্রগতিশীল কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন। কিন্তু তার সরকারের শেষের দুই তিন বছর দুর্নীতি ও অনাচারে লিপ্ত হন আওয়ামী লীগের এক শ্রেণির নেতা। তাতে দলের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। ২০০১-এর নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত সরকার গঠন করে। ২০০১-০৬-এর সরকারের সময় দেশে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় উগ্রবাদের উত্থান ঘটে। বিরোধী দলে থেকে তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সোচ্চার হয়। শেখ হাসিনার অক্লান্ত পরিশ্রমে আওয়ামী লীগ আবার দেশে সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত হয়।
২০০৮-এর নির্বাচনে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার দেশকে আওয়ামী লীগের নীতি অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল ধারায় ফিরিয়ে আনে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায় কার্যকর করে। মুক্তিযুদ্ধে যে সব ঘাতক-দালাল পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করেছিল এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিল তাদের বিচার করে সাজা কার্যকর করে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং অবকাঠামো উন্নয়নে বিপুল কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করছে আওয়ামী লীগ সরকার।
যে কোনো বড় দলে উপদলীয় কোন্দল থাকেই। শেখ হাসিনার দৃঢ়তার কারণে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তা নেই, কিন্তু নিচের দিকে এবং অঙ্গ-সংগঠনগুলোতে কোন্দল খুব বেশি। হানাহানি ও রক্তপাত পর্যন্ত ঘটছে প্রতিদিন। বিরোধ নীতি-আদর্শগত নয়, ব্যক্তিগত স্বার্থসংক্রান্ত।
টানা অনেকদিন ক্ষমতায় থাকলেই কোনো দল শক্তিশালী হবে তার নিশ্চয়তা নেই, বরং একটি সুবিধাবাদী শ্রেণি গড়ে ওঠায় দল দুর্বলই হয়। সংগঠনের শক্তির পরিচয় যখন দল বিরোধী দলে থাকে, ১৯৮১ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী। তারপর ২০০৯-এ আওয়ামী লীগ যতটা শক্তিশালী ছিল ২০১৮-১৯-এ তা নেই। পেশিশক্তি কোনো গণতান্ত্রিক দলের প্রধান গুণ বা শক্তি নয়। দল সুসংগঠিত থাকলে, জনগণের আস্থা অর্জন করলে ২০১৪ বা ২০১৯-এর নির্বাচনে সরকারকে অনিয়মের আশ্রয় নেওয়ার অপবাদ পেতে হতো না। আওয়ামী লীগে এখন ‘হাইব্রিড’দের আধিপত্য এবং দলটি ক্যাডারসর্বস্ব। দীর্ঘদিনের নিবেদিত নেতাদের মূল্য কম। তাদের অবস্থান প্রান্তিক। শক্তিশালী ও কার্যকর বিরোধী দল না থাকায় দলের শক্তি ও জনপ্রিয়তা প্রমাণের সুযোগ নেই। একটি মধ্যপন্থি গণতান্ত্রিক দলের জন্য তা ভালো নয়।
একটি গণতান্ত্রিক দলের কাজ যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় যাওয়া নয় এবং যে কোনো পন্থায় ক্ষমতায় টিকে থাকা নয়। দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশে তাকে ভূমিকা রাখতে হয়। ভিন্নমতকে গুরুত্ব দিতে হয়। অন্য দলের গণতান্ত্রিক কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি যাতে না হয় সে ব্যাপারেও ভূমিকা রাখতে হয়। আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে, নির্যাতন ভোগ করেছে, তার দ্বারা দেশের গণতন্ত্রের ক্ষতি যেন না হয় মানুষের সেটাই দাবি। শেখ হাসিনার সহকর্মী হিসেবে এখনও আওয়ামী লীগে অনেক প্রবীণ ও ত্যাগী নেতা রয়েছেন। সাত দশকের দলের সাফল্য ও দুর্বলতা পর্যালোচনা করে, সামগ্রিক কর্মকাণ্ড বিচার-বিশ্নেষণ করে, আত্মসমালোচনা করে অগ্রসর হলে দলও শক্তিশালী হবে, দেশেরও কল্যাণ হবে। সমন্বিত সংস্কৃতির দেশ বাংলাদেশে একটি মধ্যপন্থি উদার অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠনের বিকল্প নেই। সে দায়িত্ব পালনের সক্ষমতা আওয়ামী লীগের রয়েছে।
বিশিষ্ট লেখক, গবেষক ও বুদ্ধিজীবী